Sucharita Das

Tragedy

3  

Sucharita Das

Tragedy

অমূল্য এক চিঠি

অমূল্য এক চিঠি

4 mins
552


আজ প্রেরণার আঠারো বছরের জন্মদিন। বাবা ওকে বলেছে, আর একটু পরেই বাবা ওর হাতে তুলে দেবে এক অমূল্য উপহার। প্রেরণা ভীষণভাবে অপেক্ষা করে আছে বাবার দেওয়া সেই উপহারের জন্য। এখন বাবা মন্দিরে গেছে ওর নামে পুজো দিতে। প্রত্যেক বছর ওর জন্মদিনের দিন সকালে বাবা ওর মঙ্গল কামনায় পুজো দিতে যায় মন্দিরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবা ফিরে আসবে, আর তারপর প্রেরণা পাবে তার বহু প্রতীক্ষিত বস্তুটি। ওই তো বাইরে গাড়ির আওয়াজ, তার মানে বাবা ফিরে এলো। ঘরে ঢুকেই বাবা ওর মাথায় পুজোর ফুল বুলিয়ে দিলো। বাবাকে প্রণাম করলো ও। বাবা প্রেরণাকে বললো, আয় আমার ঘরে। তারপর আলমারির ভেতর থেকে একটা সুন্দর চন্দন কাঠের বাক্স বের করলো বাবা। বাক্সটা প্রেরণার হাতে তুলে দিয়ে বাবা ওকে বললো, "এই নে তোর আঠারো বছরের জন্মদিনের উপহার।" প্রেরণা বাক্সটা হাতে নিলো। কি সুন্দর গন্ধ। ঘরময় চন্দনের সুগন্ধ। তাড়াতাড়ি বাক্সটা হাতে তুলে নিয়ে খুলতে গেল ও। বাবা ওকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বললো,"এখানে না, নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে খুলে দেখিস একা।"প্রেরণা বাক্সটা হাতে নিয়ে নিজের ঘরে গেল তাড়াতাড়ি। কি আছে এই সুন্দর বাক্সতে দেখতে হবে তো। নিজের ঘরে গিয়ে প্রেরণা খুললো বাক্সটা। একটা সুন্দর গোলাপী খামে একটা চিঠি। আস্তে আস্তে চিঠিটা খুলল প্রেরণা, তাতে লেখা-------


আমার প্রেরণা,

          জানিনা তুমি আমার ছেলে নাকি মেয়ে। আমি শুধু জানি,ছেলে, মেয়ে যেই হও না কেন তুমি, তুমি আমার সন্তান, আমাদের সন্তান। তুমি আমার আর তোমার বাবার বেঁচে থাকার প্রেরণা। তুমি যখন এই চিঠিটা পড়বে, হয়তো আমি তোমার কাছে থাকবো না। অনেক অনেক দূর থেকে আমি তোমাকে দেখবো সেদিন। আজ তোমার আঠারো বছরের জন্মদিন। এই দিনে তোমাকে ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য মা হিসাবে আমার হলো না। কিন্তু আমার স্নেহ, মমতার স্পর্শে চিরকাল আমি তোমাকে আগলে রাখবো।জানো তো প্রেরণা, যেদিন আমি আসন্ন মাতৃত্বের সুখানুভূতিতে আবিষ্ট হয়ে ছিলাম, সারাদিন তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম জেগে জেগে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে। আমার সারা মনপ্রাণ জুড়ে শুধু ছিলে তুমি। কতো স্বপ্ন দেখতাম তোমার ছোট্ট ছোট্ট হাতের আঙুল দিয়ে তুমি এই পৃথিবীতে আসার পর আমার হাতের আঙুল জড়িয়ে ধরে থাকবে।আর আমি কখনও সেই আঙুল ছাড়বো না। তোমার পাশে সবসময় তোমার ছায়ার মতো থাকবো। ছোট্ট তুমি নিজের হাসিতে, কান্নাতে ভরিয়ে রাখবে আমার হৃদয়। একটু একটু করে তোমার বড়ো হয়ে ওঠাকে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত উপলব্ধি করব আমি।তোমাকে একটু একটু করে চোখের সামনে বেড়ে উঠতে দেখে মা হিসাবে পরিপূর্ণ হবো আমি।টলোমলো পায়ে যেদিন তুমি চলতে শিখবে প্রথম, সেদিন তোমাকে হাত ধরে এক পা, এক পা করে চলতে শেখাবো আমি। জানো তো প্রেরণা, তুমি যেদিন আমার পেটে ছোট্ট একটা ভ্রূণ ছিলে, সেদিন ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, এই সন্তানকে নষ্ট করে দিন। নইলে আপনাকে বাঁচাতে পারবো না আমরা। মা আর সন্তানের মধ্যে যে কোনো একজনকে বেছে নিতে বলেছিলেন ওনারা তোমার বাবাকে। তোমার বাবার কাছে তো তখন তোমার কোনো অস্তিত্ব সেভাবে ছিল না। তাই তিনি আমাকেই বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু আমি তো তোমার অস্তিত্ব আমার ভেতর প্রতি মুহূর্তে অনুভব করতে পারছিলাম তখন। তাই আমার কাছে তোমার বেঁচে থাকটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল। তোমার বাবাকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছিলাম সেদিন শুধুমাত্র তোমার অস্তিত্বকে এই পৃথিবীতে আনার জন্য। আমি চেয়েছিলাম আমাদের বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা হয়ে এই পৃথিবীর বুকে তোমার জন্ম হোক। একটা প্রাণ যে আমারই অংশ, তাকে অঙ্কুরে আমি বিনষ্ট হতে দেব না কিছুতেই। আমি নাই বা থাকলাম, তুমি থাকবে এই পৃথিবীতে আমার অংশ রূপে।তোমার প্রতিটা সত্তায় বেঁচে থাকবো আমি। তোমার চোখ দিয়ে দেখবো আমি পুরো পৃথিবীকে। তোমার মন দিয়ে উপলব্ধি করবো সব ভালো মন্দকে। প্রেরণা তোমার আঠারো বছরের এই জন্মদিনে তোমার মা তোমাকে অনেক অনেক আশীর্বাদ করছে। তুমি আরও বড়ো হও। মানুষ হিসাবে তুমি সকলের প্রেরণা হয়ে ওঠো এই কামনা করি।এটাই আমার তোকে লেখা প্রথম আর শেষ চিঠি প্রেরণা। তুই যখন আমার পেটের ভেতর একটু একটু করে বেড়ে উঠছিলিস, তখন তোর প্রত্যেক দিনের বেড়ে ওঠায়, আমার জীবনের একটা একটা করে দিন ও শেষ হয়ে যাচ্ছিল, বুঝতে পারছিলাম আমি। তোকে হাত দিয়ে ছুঁতে পারলাম না আমি। কিন্তু এই চিঠির প্রত্যেকটা অক্ষরে আমার ছোঁয়া রেখে গেলাম আমি তোর জন্য, শুধু তোর জন্য। ভালো থাকিস মা বাবাকে নিয়ে।

                            ইতি

                         তোর মা 


চিঠিটা পড়ে প্রেরণার দু চোখে জলের ধারা। চিঠিটার প্রত্যেকটা অক্ষরে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে ও আজ অনুভব করছে ওর মায়ের স্পর্শ। আর ও শুনেছে মায়েদের গায়ের গন্ধ নাকি খুব সুন্দর হয়। ঠিক এই চন্দনের বাক্সটা থেকে যেরকম সুগন্ধ বের হচ্ছে। প্রেরণার গোটা ঘরে চন্দনের সুগন্ধ ম ম করছে। চিঠিটা হাতে নিয়ে প্রেরণা চোখ বন্ধ করে উপলব্ধি করতে পারছে আজ মায়ের গায়ের সুগন্ধ আর মায়ের স্নেহের স্পর্শ। যেটা থেকে আজ এতদিন ও বঞ্চিত ছিল। এর থেকে বড়ো উপহার ওর জন্মদিনে কেউ ওকে কখনও দিতে পারবে না।


             সমাপ্ত

                                      



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy