অমানবিকতার দাম
অমানবিকতার দাম
'পুকুরপাড়ে ও কে? বউ, তুই না কি?' বিল্টু সন্দেহের চোখে পানাপুকুরের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে প্রশ্নটা করলো।
নিস্তব্ধ অমাবশ্যার রাত। এমন রাতে এমন পথে কীট-পতঙ্গেরাও বুঝি জেগে উঠতে ভুলে গেছে। জনমুখর লোকালয়ের থেকে একটু দূরে এই এলাকাটি একেবারে নিষ্প্রাণ, নিষ্কম্প। বাঁশবাগানের ভেতর দিয়ে বাড়ি ফেরার এই রাস্তাটা ছোট পড়ে। তবুও, বছর পাঁচেক আগে সেই ঘটনার পর থেকে এই জায়গাটায় আসলেই কেমন গা ছমছম করে সবার। বড়ো রাস্তা ধরে দেড় কিলোমিটার বাড়তি পথ হেঁটে যাতায়াত করতে স্থানীয় লোকজন বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কিন্তু মুদির দোকানি বিল্টুর আজ বড্ড তাড়া। তার অন্তঃসত্বা স্ত্রীয়ের অবস্থা ভালো নয়। দুই ঘর পাশের বিলাল কাজে যাওয়ার পথে এসে তাকে খবর দিয়ে গেছে, সে যেন এক্ষনি সব কাজ ছেড়ে বাড়ি ফিরে যায়। তাইতো সে হুড়োহুড়ি করে দোকানের ঝাঁপি টেনে পড়ি-কি-মরি করে দৌড় লাগিয়েছে।
কিন্তু বিধাতার বোধহয় অন্য কোন পরিকল্পনা ছিল। কিছুদূর যেতেই বিল্টুর সাইকেলের চেন গেল পড়ে। অগত্যা, সাইকেল এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রেখে, পায়ে হেঁটে এগোতে লাগলো সে। কিন্তু তাতেও বিপত্তি। ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যার সাথে এলো অসময়ের ঝড় আর তার সাথে রাশিকৃত কালো মেঘেদের তর্জন গর্জন। ঘন ঘন বাজ পড়ার সাথে শুরু হলো মুশোল ধারে বৃষ্টি। এত বৃষ্টিতে পথ চলা তো দূর, দেখাই দায়। বিল্টুর না দাঁড়িয়ে উপায় রইলো না।
বৃষ্টি যখন থামলো, তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমেছে। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ফাঁক দিয়ে দুই একটা তারা ইতিউতি উঁকি দিচ্ছে। এত রাতে কোথাও কোনো মানুষ নেই। একবার দ্বিধা করলো, কিন্তু পরক্ষনেই মনস্থির করে বিল্টু বাঁশবাগানের রাস্তাটাই ধরলো। বেশ কিছুক্ষন পথ চলার পর, হঠাৎ একটা মেয়েমানুষের কান্না ওকে আকৃষ্ট করলো। আওয়াজটা খুব চেনা। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে বিল্টু হাতের টর্চের আলো ফেলে দেখলো, পানাপুকুরের পাড়ে জলে পা ডুবিয়ে বসে আছে একজন মেয়েমানুষ। পেছন দিক থেকে শরীরের গড়ন, এলোচুলের রাশ, হলুদ শাড়ীর ওপর লাল কল্কে ছাপ, হাতের চুড়ি দেখে বিল্টুর বদ্ধমূল ধারণা হলো, এ তারই বউ রুপমতি। কিন্তু এই বাঁশবাগানে সে এত রাতে কি করছে? তার না প্রসব যন্ত্রণা উঠেছিল?
হঠাৎ রুপমতি উঠে দাঁড়ালো। তার শাড়ী বেয়ে ভেসে যাচ্ছে অবারিত রক্তের স্রোত। কালচে লাল হয়ে গায়ে লেপ্টে যাচ্ছে তার বসন।
'আহ, বড্ড কষ্ট হচ্ছে গো, আমায় একটু রেহাই দাও, শান্তি দাও...' কাতরাতে কাতরাতে সে পানাপুকুরের জলে নেমে এগোতে লাগলো হাত পা আছড়ে।
'যেও না রুপু, যেও না ও জলে...' চিৎকার করে এগিয়ে যায় বিল্টু। তার এহেন আচমকা শব্দে চারদিকের নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে যায়, কিন্তু সামনের রমণীটি এগিয়ে চলে বিনা বাক্যব্যয়ে। বিল্টুর মনে পড়লো একদিন এই জলেই যন্ত্রণাকাতর আরেক অবলা মা নেমেছিল নিজেকে আর নিজের সন্তানকে বাঁচাতে। সেদিনের সেই কাতর চোখদুটো ভেসে উঠতেই শিউরে ওঠে বিল্টু। বউ করছে কি? উন্মাদ হয়ে গেল না কি? টর্চ ফেলে দৌড়ে গিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়লো পুকুরের জলে। পরক্ষনেই বিল্টুর খেয়াল হলো, এই পানাপুকুর তো সে কিছুক্ষন আগেই পেরিয়ে এসেছে। আবারও সোজা পথে এই জলাশয় এলো কি করে? কোনো এক গাছের ডাল থেকে একটা প্যাঁচা ডেকে উঠলো। বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো বিল্টুর। সাঁতরে পেছতে গেল সে, কিন্তু ঠান্ডা কালো জলে তার হাত পা ক্রমশ অবশ হয়ে আসতে লাগলো। জলের ভেতর থেকে কার যেন করুন আর্তনাদ তাকে বিহ্বল করে দিল।
নিশ্চন্দ্র রাত্রে রুপমতিকে তখনও পরিষ্কার দেখা যায়না। হঠাৎ একটানা কান্না থামিয়ে সে ফিসফিস করে বলতে লাগলো,
'মনে পড়ে, এই পুকুরেই একদিন সে এসেছিল?'
'কে? কে এসেছিল?'
'বিন্তি'
শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায় বিল্টুর। পাঁচ বছর আগের সেই কালান্তিক দিনটার কথা আবারও মনে পড়ে যায়, যেদিন বিন্তি ভুলবশত এসেছিল মধুপুরের লোকালয়ে। অন্তঃসত্ত্বা হস্তিনীটি সম্ভবত দলছুট হয়ে পড়েছিল, তারপর কিভাবে যেন আঁখের ক্ষেতে ঢুকে পড়েছিল। দালালির কাজে নিযুক্ত হতে চাওয়া বিল্টু তার এলাকার নেতার সাগরেদদের সাথে সেখানে কথা বলতে গিয়েছিল সেদিন। ক্ষেত তছনছ হয়ে যাওয়ার ভয়ে, তারা বিন্তিকে অন্যত্র তাড়িয়ে দেওয়ার অভিপ্রায়ে পটকা ফাটাতে লাগলো ক্রমাগত। ক্ষেপে গিয়ে যত্রতত্র দৌড়াদৌড়ি করে লন্ডভন্ড অবস্থা বাধানোর উপক্রম করলো হস্তিনী। সেই সময় মাধব নামক একজন এক কাণ্ড বাধাল। বুনো শুকর তাড়ানোর জন্য পটকা ভরা তরমুজ এনে হাজির করলো বিন্তির সামনে। চমকে উঠেছিল বিল্টু।
হাজার হোক, এই সেই হস্তিনী, যাকে শাবক অবস্থায় রুপমতি ঘরে এনেছিল। বিন্তিকে তো রুপমতিই খানিক বড়ো করে জঙ্গলে ছেড়ে এসেছিল। তার ডানদিকের চোখের নিচের স্পষ্ট সাদা দাগ দেখে বিল্টুর চিনতে অসুবিধে হয়নি বিন্তিকে। সেই বিন্তির এত বড় আসন্ন সর্বনাশে সে বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। পরক্ষনেই মাথা ঠিক রাখতে না পেরে চেপে ধরেছিল মাধবকে।
বিশ্রী হেসে লোকটা বলেছিল,
'দালালির কাজ ভুলে যা তবে। আমার ওপর কথা কওয়ার সাহস তোর? যা এখন থেকে, আজই গ্রামে একঘর করে দেব তোকে'
বিল্টু সহসা চুপসে গিয়েছিল ভয়ে। এক বোনের বিয়ে বাকি। বয়স্কা মা বিনা চিকিৎসায় দিনের পর দিন বড় কষ্টে আছেন। রুপমতি সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী। এই কাজটার তার বিশেষ প্রয়োজন। তাই তরমুজ হাতে নিয়েও ফের ঘাসের ওপর রেখে দিয়েছিল বিল্টু। আর সেটাই হলো সার!
বিন্তি কপ করে সেই তরমুজ তুলে মুখে পুরে নিয়েছিল শুঁড় দিয়ে। তারপর উঠেছিল হৃদয় বিদারক যন্ত্রণার ডাক। বিন্তির কান ফাটানো আর্তনাদ আর হন্তদন্ত দৌড় এসে থেমেছিল এই পানাপুকুরে, যেখানে দাঁড়িয়েও সে একবিন্দু স্বস্তি অনুভব করতে পারেনি। যতক্ষণে বন দপ্তরের লোকজন এসে বিন্তিকে উদ্ধার করে নিয়ে গেল, ততক্ষনে সব শেষ। অনেক তল্লাশি চালিয়েও অপরাধীদের ধরতে পারেনি পুলিশ। কাজটাও জোটেনি বিল্টুর। বেশি উচ্চবাচ্চ করলেই ওকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি আসত। সংসারের সুখ কি আর ওই হস্তিনীর বিচারের থেকে বেশি?
এরপর এক বন্ধুর কল্যাণে লোকালয় ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা দূরে নিজের দোকান বসিয়েছে বিল্টু। তবে বোন আইবুড়ো রয়ে গেছে। তার মাও গত হয়েছে অনেকদিন হলো। স্ত্রী দুবার অন্তঃসত্ত্বা হয়েও হারিয়েছে সন্তান। এই সবই তার পাপের ফল, মনে করে বিল্টু। সেই ঘটনার পাপবোধ পাঁচ বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছে সে। অনুশোচনাবোধ তাকে কুড়ে কুড়ে খেলেও, এক সাংঘাতিক ভয় বিল্টুকে সারাক্ষন তাড়া করে বেড়াত। সে জানত, তারও সময় আসবে। ঠিক কি কারণে উপস্থিত বাকি তিনজন লোক ওই পানাপুকুরেই আত্মহত্যা করেছিল, সেটা বিল্টুর জানা নেই। পর পর তিনবছর তিনজনের মৃত্যু। মাঝে দুবছর নির্বিঘ্নে কেটে যাওয়ায়, সামান্য আশঙ্কার মেঘ কেটেছিল তার মন থেকে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে... পানাপুকুরের সামনে ওই মহিলা রুপমতি নয়, অন্য কিছু...
ডাঙায় নিভে পড়ে থাকা টর্চলাইটটা আচমকা আপনা থেকেই জ্বলে উঠলো। সেই আলোতে বিল্টু দেখতে পেল, রুপমতি নয়, জলের মধ্যে দাপাচ্ছে তার সহোদরা-সম বিন্তি। কি ঠান্ডা তার চোখের চাহনি। সেই চোখ দিয়ে ঠিকরে বেরোচ্ছে আগুন, আর সেই আগুনের স্রোতে ঝলসে গিয়ে জলে ডুবে পরিত্রাণ চাইছে বিল্টু, কিন্তু পারছে না, কিছুতেই পারছে না!
পরেরদিন সকালে নাইট ডিউটি থেকে ফিরতি পথে বিলাল বিল্টুর সাইকেল পড়ে থাকতে দেখে অবাক হলো। একটা আদ্যোপান্ত ভালো সাইকেল ছেড়ে সে ওই দুর্যোগের দিনে বাড়ি ফিরল কি করে? মধুপুরে যখন ফিরল, তখন খবর পেল, বিল্টু গত রাত থেকে ঘরে ফেরেনি। রুপমতির কন্যাসন্তান জন্মেছে। চোখের নীচে তার একটা স্পষ্ট সাদা দাগ।
সমাপ্ত।।