STORYMIRROR

Nikhil Mitra Thakur

Classics

4  

Nikhil Mitra Thakur

Classics

অগ্নিকন্যা শান্তি ঘোষ

অগ্নিকন্যা শান্তি ঘোষ

4 mins
419

শান্তি ঘোষ ( ১৯১৬- ১৯৮৯) 


১৯১৬ সালের ২২শে নভেম্বর কলকাতায় শান্তি ঘোষের জন্ম হয়। তাঁর পিতার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ ও মাতা ছিলেন সলিলাবালা ঘোষ। দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ ছিলেন কুমিল্লা কলেজের অধ্যাপক। তাই শান্তি ঘোষের ছেলেবেলা কাটে কুমিল্লায়। 

দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ ছিলেন রাজনৈতিক কর্মী ও আদর্শবাদী। তিনি নিজে মেয়েকে দেশাত্মবোধক গান শেখাতেন। তিনি চাইতেন তার মেয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আত্মত্যাগ করতে শিখুক। এইসময় বিপ্লবী সরোজিনী নাইডু একদিন কুমিল্লায় সভা করতে আসেন। সেই সভায় বালিকা শান্তি দেবী গান করে," ভারত আমার, ভারত আমার / যেখানে মানব মেলিল নেত্র।"।সভা থেকে ফিরে আসার পর দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ তাকে বলেন,"আজ তুমি যার সভায় গান গাইলে একদিন যেন তুমি তার মতো হতে পারো।"

১৯২৬ সালে শান্তি দেবীর পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঘোষের অকাল মৃত্যু হয়। শান্তি দেবী ছাত্রী অবস্থায় বাবার দেখানো স্বপ্ন নিয়ে স্বদেশী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ১৯২৮ সালে সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে কুমিল্লায় যে তীব্র বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল সেই বিক্ষোভে তার অন্তর আলোড়িত হয়। ১৯৩০ সালে কুমিল্লায় আইন অমান্য আন্দোলনে জনতার উপর ইংরেজ পুলিশের নির্মম অত্যাচারে তার মন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তিনি ভাবতে থাকেন ইংরেজদের বিতাড়িত করতে না পারলে দেশে শান্তি আসবে না।

শান্তিদেবী তখন কুমিল্লার ফয়জুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। তিনি লাঠি খেলা ও ছোরা খেলা শিখতে শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যেই রিভলবার চালানো শিখতে তিনি যেতেন ময়নামতী পাহাড়ে। পাশাপাশি বিপ্লবাত্মক স্বদেশী পুস্তক পড়তে শুরু করেন। এই সমস্ত বই পড়ে তিনি গার্লিন হত্যা, সিম্পসন হত্যার কথা জানতে পারেন। মনে মনে এইরকম কিছু করার জন্য অধীর হয়ে ওঠেন। ১৯৩১ সালেই তিনি প্রফুল্লনলীনি ব্রহ্ম ও সুনিতা চৌধুরীর সাথে পরিচিত হন এবং তাদের সাথে হাত মিলিয়ে কুমিল্লায় ছাত্রীসংঘ গড়ে তোলেন। এই ছাত্রীসংঘে প্রায় ৬০ জন ছাত্রী যোগদান করে। তিনি ছিলেন ছাত্রী সংঘের সম্পাদিকা।

অবশেষে এসে গেল সেই সুযোগ। বিপ্লবী দলের নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নিলেন শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী কুমিল্লার ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে গুলি করে হত্যা করবে এবং অত্যাচারী ইংরেজ শাসকের দম্ভের ভিত কেঁপে যাবে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যে শান্তিদেবী ও সুনীতি দেবী একটা সুইমিং প্রতিযোগিতার আমন্ত্রণ দেওয়ার অজুহাতে স্টিভেন্সের বাংলোয় গিয়ে তাকে হত্যা করবে।

১৯৩১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর সকালে শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী একটা ঘোড়ার গাড়ি চেপে ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সের বাংলোয় গিয়ে পৌঁছালেন। চাপরাসীর হাতে ইন্টারভিউয়ের একটা কার্ড ধরিয়ে দিলেন। কার্ড পেয়ে স্টিভেন্স বাইরে বেরিয়ে এলেন। সুনীতি চৌধুরী তাকে লক্ষ করে গুলি ছুঁড়লেন। সুনীতিদেবীর গুলি লাগলো স্টিভেন্সের মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে শান্তিদেবীর গুলি স্টিভেন্সের শরীর ঝাঁঝড়া করে দেয়। ফলে ওখানেই তার মৃত্যু হয়। স্টিভেন্সের রক্তাত্ব প্রাণহীন দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।

কিন্তু, তারা পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলেন না। শান্তি দেবী দেখতে পেলেন সুনীতি চৌধুরীকে মাটিতে ফেলে বেশ কয়েকজন চাপরাশি অঝোরে লাথি, চড়, ঘুসি মারছে। আর রিভলবারটা কেড়ে নিতে চাইছে। শান্তি দেবী রিভলবার বের করে গুলি চালাতে গেলে পিছন থেকে একজন বিভলবার সহ তার হাত চেপে ধরে। অন্য কয়েকজন তাকে জাপটে ধরে। চাপরাসীরা তাদের ধরে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও চরম মারধর করতে থাকে। এমন সময় ডি আই বি ইন্সপেক্টর এসে তাদের মারধর থেকে রক্ষা করে দুজনকে আলাদা করে দেন। চলতে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা গুপ্তকথা বের করার জন্য জেরা।

প্রথমে তাদের কুমিল্লা জেলে নিয়ে গিয়ে রাখা হয়। পরের দিনেই প্রফুল্ল ব্রহ্ম ও ইন্দুমতী সিংহকে গ্রেপ্তার করে কুমিল্লা জেলে নিয়ে আসা হয়। কয়েকদিন পরেই শান্তিদেবী ও সুনীতি চৌধুরীকে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে চালান করে দেওয়া হয়। ১৯৩২ সালের ১৮ই জানুয়ারী তাদের বিরুদ্ধে মামলা শুরু হয়। তারা ভীষণ উৎসাহিত ছিলেন যে বিচারে তাদের ফাঁসি হবে। ক্ষুদিরামের মতো হাসতে হাসতে দেশের জন্য জীবন দেবেন, যাতে দেশের মানুষ ভয় ভুলে সমবেতভাবে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু, শান্তি দেবী ও সুনীতি চৌধুরীর বয়স তখন ১৪-১৫ ব্ৎসর। তারা ছিলেন অষ্টম শ্রেণীতে পাঠরতা ও এ দেশের সংঙ্ঘা অনুযায়ী নাবালিকা। তাই চাইলেও অত্যাচারী ইংরেজ শাসক তাদের ফাঁসির আদেশ শোনাতে পারলো না। ১৯৩২ সালের ২৭শে জানুয়ারী তাদের যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আদেশ শোনানো হয়। দুই বিপ্লবী অগ্নিকন্যা তখন রায় শুনে কিছুটা নিরাশ হয়ে পড়ে।

অত্যাচারী ইংরেজ শাসকের বিভেদ নীতি অনুযায়ী শান্তিদেবীকে দ্বিতীয় শ্রেণীর ও সুনীতি চৌধুরীকে তৃতীয় শ্রেণীর বন্দী করে রাখা হয়। তাছাড়াও মাঝে মাঝে একসাথে রাখা হলেও অধিকাংশ সময় আলাদা আলাদা জেলে তাদের স্থানান্তরিত করা হতো। তবে তারা যেখানেই যেতেন নিজেদের সুরেলা গলায় দেশাত্মবোধক গান গেয়ে বন্দীদের মন মাতিয়ে রাখতেন। তাদেরকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রেসিডেন্সি, মেদনীপুর, হিজলী, রাজসাহী প্রভ‌তি জেলে রাখা হতো। তারা একবার মেদনীপুর জেলে জেলার ও মেট্রনের অনাচারের বিরুদ্ধে অনশনে বসে ছিলেন। এর ফলে জেলারকে যেমন অন্য জেলে বদলি করা হয়েছিল তেমনি তাদেরকেও ভিন্ন ভিন্ন জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

দীর্ঘ সাত বছর পর ১৯৩৯ সালে রাজনৈতিক বন্দী হিসাবে জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি ম্যাট্রিক পাস করলেন। আইএ পাস করে শান্তি ঘোষ সাহিত্যচর্চা ও জনহিতকর কাজে মনোযোগ দিলেন। "অরুনবহ্নি" নামক পুস্তকে নিজের জীবন কাহিনি লিখলেন তিনি। বঙ্গীয় প্রাদেশিক বিধান সভার সদস্য হলেন।

১৯৪২ সালে তিনি বিয়ে করলেন চট্টগ্রামের অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন দাসকে। তার বীরত্ব ও সাহসিকতা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এবং বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত মানুষদের যুগে যুগে পথ দেখাবে। ১৯৫২-৬২ ও ১৯৬৭-৭২ সাল পর্যন্ত দুইবার বিধান পরিষদের সদস্যা হয়েছিলেন এবং ১৯৬২-৬৭ সালে প্রাদেশিক বিধান সভার সদস্যা ছিলেন। আজীবন সাহিত্য ও জনকল্যাণে ব্রতী থেকে শান্তি ঘোষ ১৯৮৯ সালের ২৭ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics