আতঙ্কের আঁধার(তাতাইয়ের গল্প১৩)
আতঙ্কের আঁধার(তাতাইয়ের গল্প১৩)


চারিদিকে নিকষ কালো অন্ধকার। দরদর করে ঘাম দিচ্ছে গোটা গায়ে। তারই মাঝে মনে হচ্ছে যেন কিছু একটা চলে বেড়াচ্ছে শরীরের ওপর, কিছু একটা স্পর্শ করছে শরীরটা… স্পর্শটা তাতাইয়ের মোটেও ভালো লাগছে না। তাতাই চোখ খুলতে চাইছে, কিন্তু চোখ খুলতে পারছেনা। তাতাই চিৎকার করতে চাইছে, কিন্তু পারছেনা চিৎকার করতে, গলা দিয়ে স্বর ফুটছে না ওর। তাতাই ছটফট করছে, উঠে বসতে চাইছে বিছানায় কিন্তু কোনো একটা অদৃশ্য শক্তি যেন ওকে শক্ত করে টিপে ধরে রেখেছে বিছানার ওপর। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তাতাইয়ের, ভীষণ কষ্ট… দম আটকে আসছে…
মা… ওমা… মাগো… গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না কেন! মা… তাতাইয়ের ছটফটানির চোটে বেড সাইড টেবিল থেকে কিছু একটা ছিটকে পড়ল নীচে, আওয়াজ উঠল মেঝেতে।
"তাতাই এই তাতাই কি হল তোর? তাতাই এরকম করছিস কেন?"
"মা…!"
চোখটা খুলেই হাঁফাতে লাগল তাতাই। আওয়াজ শুনে ঘরে এসে মা টিউবটা জ্বালিয়ে দিয়েছেন। এই তো গোটা ঘরটা দেখা যাচ্ছে, কোথাও কোনো অস্বভাবিকত্ব নেই। এই তো সব স্বাভাবিক। নিজের শরীরের দিকে একবার তাকালো তাতাই, আকাশী রঙের নাইট স্যুটটা ঘামে ভিজে গাঢ় নীল মনে হচ্ছে।
"কি হয়েছিল তোর? খারাপ স্বপ্ন দেখছিলি?"
"মা… মা চারিদিক কেমন অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল।"
হাঁসফাঁস করতে করতে বলল তাতাই। মা একবার নাইট ল্যাম্পটার দিকে তাকালেন, জ্বলছেনা সেটা। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো মায়ের ভেতর থেকে, "আর কতদিন এভাবে শাস্তি দেবে ঈশ্বর!"
"মাহ…"
"তুই আমার সঙ্গে চল, আমাদের রুমে ঘুমোবি। তোর বাবা এখানে শুয়ে পড়বে।"
বাধ্য মেয়ের মত ঘাড় নাড়ল তাতাই, তার কাছে যে আর কোনো উপায় নেই।
মায়ের পাশে শোয়ার পর মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, "ঘুমিয়ে পড়।"
পাশ ফিরল তাতাই, সে জানে আজ হয়তো আর ঘুম ধরবে না। নীরবে তার চোখের কোণ দিয়ে দু'ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। তাতাই তো এতো চেষ্টা করে তাও কেন পারেনা স্বাভাবিক হতে!
মা বাবার রুমে একটা লাল রঙের নাইট বাল্ব জ্বলছে। ওটার দিকে তাকাতেই তাতাইয়ের চোখের সামনে ভেসে উঠল আজ থেকে বারো তেরো বছর আগেকার একটা দৃশ্য...
★★★★★
তখন পিচাই কয়েক মাসের মাত্র। তাই রাতে তাতাই ঠাম্মির কাছে শুতো তখন। তাতাইদের পাড়ায় সেসময় চোরের উপদ্রব খুব বেড়েছিল। একজন না একাধিক জন এই কাজ করছিল তাও টের পায়নি কেউ। তবে সেসময় একদিনও রাত্রিরে কারুর বাড়িতে চুরি হয়নি এমনটা হত না। ভয়ে তাই সন্ধ্যার পর থেকে কেউ দরজা জানালা খুলে রাখতে পারত না। কিন্তু সেদিন ছিল প্রচন্ড গরম, ফুল স্পিডে ফ্যান চালালেও দরদর করে ঘাম দিচ্ছিল। রাত্রি বেলায় ঠাম্মি বললেন, "আজ যা হবে হবে জানালা খুলেই শোবো বুঝলি, এই গরমে সব জানালা লাগিয়ে শোওয়াও অস্বাস্থ্যকর।"
ঠাম্মির কথায় সায় দিয়েছিল তাতাই। তখনও তো জানতো না কি অপেক্ষা করে আছে তার জন্য। বায়না করে জানালার ধারে শুয়েছিল সে, ভেবেছিল ফুরফুর করে হাওয়া খাবে। সেদিনও ঠাম্মির ঘরে একটা লাল নাইট বাল্ব জ্বলছিল। ঠাম্মির কাছে গল্প শুনতে শুনতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল তাতাই। তারপর হঠাৎ করে একসময় ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল। চোখটা প্রথমে খোলেনি সে, কেন কে জানে! সে বুঝতে পারছিল মাথার ওপর ফ্যানটা চলছেনা। সেই সাথে তার মনে হচ্ছিল তার বুকের কাছটায় কে যেন হাত বোলাচ্ছে। প্রথমে তাতাই ভেবেছিল ঠাম্মি, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়েছিল ঠাম্মি তো তার বাম দিকে আছে আর এই হাতটা তো ডান দিক থেকে আসছে। আতঙ্কে চোখটা তৎক্ষণাৎ খুলে ফেলেছিল তাতাই। দেখেছিল চারিদিকে নিকষ কালো অন্ধকার, লাল নাইট বাল্বটা বেইমানি করেছে। তাতাই চোখ খুলেছে বুঝতে পেরে আগন্তুক খুব জোরে ওর শরীরের ওপর অংশটাকে যেন পিষে দিয়ে ছুটে পালিয়ে গিয়েছিল। অন্ধকারে তার মুখ দেখতে পায়নি তাতাই। শুধু থরথর করে কেঁপেছিল আতঙ্কে, যন্ত্রনায় কেঁদে উঠেছিল ঝরঝর করে।
সেদিনের পর অন্ধকারকে বড্ড ভয় পায় তাতাই; এই অন্ধকারই তাকে একদিনে যেন অনেকটা বড় করে দিয়েছিল। মা বাবা মানসিক রোগের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, কাউনসেলিং হয়েছিল। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল তাতাই। কিন্তু অন্ধকারটাকে আর কোনোদিনও মেনে নিতে পারেনি সে। অন্ধকার হলেই তার দম বন্ধ হয়ে আসে যেন, মনে হয় সেদিনের সেই বিভীষিকা আবার জেগে উঠেছে। সেদিনের পর থেকে এতো বড় হয়ে গেছে তাতাই তাও আজও মনে হয় সেদিন যদি হাতের সামনে কিছু একটা থাকতো, নিদেন পক্ষে একটা ব্লেড তাহলে তাতাই ক্ষত বিক্ষত করে দিত ওই শয়তানের হাত দুটো। ডাক্তার বলেছেন তাতাইয়ের এই ভয় একমাত্র কাটাতে পারে ও নিজে, আর কেউ নয়। অনেক চেষ্টা করেছে তাতাই কিন্তু পারেনি। অন্ধকার হলেই ওর যে অনুভূতি হয় তা কাউকে বলে বোঝানোর নয়। এই যন্ত্রনা কি সারাজীবনের সঙ্গী হয়ে রয়ে যাবে!!!
★★★★★
কম্পিউটার ক্লাস থেকে ছুটি হতে আজ ভীষণ দেরী হয়ে গেল। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। বাবা তো এখনও নিশ্চয় অফিসে, আর মা পিচাইকে নিয়ে সুইমিং ক্লাসে গেছেন। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করেও আবার ঢুকিয়ে দিল তাতাই। ফোন করে লাভ নেই, কে আনতে আসবে! ঠাম্মি বা দাদুর পক্ষেও সম্ভব নয়। ইনস্টিটিউশন থেকে বেরিয়ে একবার আশপাশটা দেখল তাতাই। রাস্তায় আলো জ্বলছে। কি আর হবে… বেশি পথ তো নয়, তাতাই ঠিক পৌঁছে যাবে নিজে নিজেই। এতো বড় হয়ে গেল তাও সবসময় মা বাবাকে ব্যতিব্যস্ত করতে ভালো লাগে না। কিন্তু কি করবে, দিনের আলোটা পড়ে এলেই একলা রাস্তায় বেরোতে ভীষণ ভয় করে ওর। তবে আজ তো উপায় নেই। বোতল থেকে এক ঢোক জল খেয়ে রাস্তায় নামল তাতাই। যদিও রাস্তায় আলো দেওয়া আছে, তবুও নিজের নীল টর্চটা হাতে বের করে রাখল। বলা তো যায়না কোনো জায়গাটা যদি অন্ধকার হয়!
দ্রুত গতিতে এগোচ্ছিল তাতাই। মা সবসময় বলে নিজের ভয় অন্যের সামনে প্রকাশ করতে নেই। তাই চেষ্টা করছিল নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখতে, কতটা পারছিল কে জানে! বীরেন্দ্র নগরটা পেরোতেই এখান থেকে একটা বস্তি শুরু হচ্ছে। আজকে এই জায়গাটা এতো ফাঁকা কেন কে জানে!!! তাতাই খেয়াল করল একজন মধ্যবয়স্ক লোক ল্যাম্প পোস্টের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাতাইকে দেখে কিছু একটা মন্তব্য করলেন তিনি। তাতাই ঠিক বুঝতে পারল না ওনার কথা। ও ভ্রূক্ষেপ না করে একটু এগোতে না এগোতেই ঝপ করে ল্যাম্প পোস্টটা গেল নিভে। বুকটা কেঁপে উঠল তাতাইয়ের। সঙ্গে সঙ্গে হাতের টর্চটার সুইচ টিপল ও, কিন্তু এ কি টর্চটা জ্বলছে না কেন! বার কতক সুইচটা টিপল তাতাই, নাহ জ্বলছে না। সামনে তাকাল ও, চারিদিক অন্ধকারে ডুবে গেছে। পা দুটো কেঁপে উঠল তাতাইয়ের, দমটা যেন গলার কাছে এসে আটকে গেল… এবার কি করবে তাতাই!
সরসর করে রাস্তার মোরামে একটা জোড়া পায়ের শব্দ উঠল, তারপরেই তাতাই ওর শরীরে একটা বিশ্রী স্পর্শ টের পেল, স্পর্শটা মুহূর্তের মধ্যে চেপে বসে গেল ওর শরীরে, যেন পিষে ফেলবে ওকে। গোটা শরীরটা তিরতির করে কেঁপে উঠল ওর, মাথাটা ঘুরিয়ে গেল, চোখের সামনে আবার ভেসে উঠল আজ থেকে বহু বছর আগে ঘটে যাওয়া কিছু আতঙ্কের মুহূর্ত। দাঁতে দাঁত লেগে গেল; সেদিন তাতাই বুঝতেই পারেনি ওর সাথে কি ঘটছে, তাতাই পারেনি পাল্টা আঘাত করতে; কিন্তু আজ তাতাই জানে, আজ ও সব বোঝে, সব পারে… হাতের টর্চটা শক্ত করে মুঠোয় ধরে আন্দাজে সেটার পেছনটা দিয়ে আঘাত করল তাতাই, মুহূর্তে একটা আর্তনাদ ভেসে উঠল, ওর শরীর জড়িয়ে ধরা বাঁধনটাও আলগা হয়ে গেল খানিক। ঠাম্মি বলতো অন্ধকারে থাকলে নাকি চোখ সয়ে যায়, তাতাই কোনোদিনও টের পায়নি, আজ পেল। ওর স্পষ্ট বুঝতে পারল লোকটার অবস্থান, মুখে চিৎকার করতে করতে লোকটার মুখে চোখে আবার টর্চ দিয়ে আঘাত করল তাতাই। লোকটা বেগতিক বুঝতে পেরে ছুটে পালাতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই তাতাইয়ের চিৎকার শুনে আশেপাশের ঘরগুলো থেকে আলো নিয়ে সব লোক বেরিয়ে এলো। ব্যাপারটা বুঝতে তাদের খুব একটা বেগ পেতে হলো না। লোকটাকে ঘিরে ধরল ওরা। চড় চাপড় পড়তে লাগল তার গায়ে, এরই মাঝে একজন পুলিশকে ফোন লাগল।
তাতাইয়ের সারা শরীর এখনও কাঁপছে। এক কোণে দাঁড়িয়ে সে চুপচাপ দেখছে পুরোটা। গা টা ঘিনঘিন করছে ওর। লোকটা তো ওর বাবার চেয়েও বড় হবে হয়তো!!!
একটা ছেলে এগিয়ে এল তাতাইয়ের দিকে। জিজ্ঞেস করল, "বোন তোমার বাড়ি কোথায়? এগিয়ে দিয়ে আসি তোমায়।"
তাতাই ইতস্তত করছে দেখে আরেকজন মহিলা এগিয়ে এসে বললেন, "আমিও যাবো চলো, ভয় পেয়ো না।"
তাতাই মাথা নেড়ে সায় দিল।
কারেন্ট চলে গেছে, রাস্তাটা এখনও অন্ধকার। ওদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে তাতাই টের পেল এখন অন্ধকারটায় যেন ততটা ভয় আর লাগছে না। ভেতর থেকে অনেক দিনের পুঞ্জীভূত একটা উষ্ণ নিশ্বাস বেরিয়ে এলো বাইরে। নিজের মনেই বিড়বিড় করে উঠল তাতাই, "আমি পারি… আমি পারি…।"