Manasi Ganguli

Classics

4.8  

Manasi Ganguli

Classics

আত্মসুখ

আত্মসুখ

5 mins
994


শহরের নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে আজ বিশাল হইচই,চারিদিকে লোকে লোকারণ্য,কেউ জানে,কেউ না জেনেই ভিড় দেখে আরও ভিড় বাড়িয়ে চলেছে,কেউ বা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। গঙ্গার ধারে প্রাতঃভ্রমণে আসা মানুষজন ফিরতি পথে থমকে গেছে ভিড় দেখে। টুকরো টুকরো কথা ভাসছে বাতাসে,তার থেকে অনুমান করা যায় কিছুটা,তবু সত্যিটা জানার অপেক্ষায় সবাই। খানিক পরেই স্কুলে পুলিশ,অ্যাম্বুলেন্স,হই হই কান্ড।

    ক্লাস এইটের সুদীপ্তা ক্লাসরুমের ফ্যানে ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলছে,জিভটা তার বেরিয়ে আছে। ক্লাসে অমনোযোগী হয়ে খাতায় আঁকিবুকি কাটছিল তাইতে মিস বকায় নাকি সম্মানে লেগেছে,তাই। এবার শুরু হলো জল্পনা,কিন্তু কখন করল? কেউ জানতে পারল না? গলায় ওড়না পেঁচিয়েছে ও কি জানত মিস বকবেন,তাই ওড়না নিয়ে স্কুলে এসেছে? আসল রহস্যটা যে কি কেউ জানে না। একজন মিসের নাম বারেবারে শোনা যাচ্ছে,তিনি নাকি খুব মুখরা,ছাত্রীদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেন,আর তাঁর বিরুদ্ধেই রোষ ওগড়াছে জনতা। সবাই তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ফেলেছে যখন একজন তাঁর পক্ষ নিয়ে বলে,"আচ্ছা স্কুলে তো ক্লাস শুরুই হয়নি এখনও তাহলে মিস বকলেন কখন?" অপর একজন বলল, "সেটা বোধহয় কালকের ঘটনা আর তার জেরেই......"।কেউ বলছে,"আহা রে,বাবা-মা কত আশা নিয়ে মেয়েকে এতবড় স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছেন,আর দেখো কি পরিণতি"। লোকমুখে এটাও জানা গেল,সবাই যখন প্রেয়ার লাইনে প্রেয়ার করছে সমস্বরে,ঈশ্বর বন্দনায় যখন স্কুল প্রাঙ্গন গমগম করছে,সুদীপ্তা প্রেয়ারে না গিয়ে এই কান্ডটি করেছে। প্রেয়ার শেষে ক্লাসরুমে ঢুকেই মেয়েরা একসঙ্গে চিৎকার করে উঠলে,সবাই ছুটে আসে সেখানে। অপ্রত্যাশিত এই ঘটনায় সবাই হতভম্ব। নিজেদের সামলে নিয়ে প্রথমেই মেয়েদের সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ক্লাসরুম বন্ধ করে থানায় খবর দেওয়া হয়। পুলিশের গাড়ি আসতে দেরী করে নি। সুদীপ্তাকে নামানো হয় তড়িঘড়ি,ইতিমধ্যে ডাক্তারও পৌঁছে যান,তিনিই ঘোষণা করেন যে সে মৃত। 

    তবু শেষ চেষ্টা,অ্যাম্বুলেন্স এল,কিছু পরে বেরিয়েও গেল বডি নিয়ে হাসপাতাল,পুলিশের গাড়িও বেরল তার বেশ কিছু পর, কিছু পুলিশ রইল স্কুলে নিয়মমাফিক। মেয়েরা কান্নাকাটি করছে,কেউ দুঃখে,কেউ ভয়ে। ক্লাসরুম তালাবন্ধ। স্কুল আজ বন্ধ করে দেওয়া হবে কিন্তু মেয়েরা যে গাড়িতে স্কুলে এসেছে তা তো বেশিরভাগ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে,তাহলে ওই মেয়েরা কিভাবে পৌঁছাবে? সমস্যা অনেক। টিচাররা দায়িত্ব নিয়ে গেটের বাইরে যেসব গাড়ি তখনও ছিল তাদের সাথে কথা বলে যাদের গাড়ি বেরিয়ে গেছে তাদের পাঠাবার ব্যবস্থা করতে থাকেন। যদিও অনেক গাড়িই তখনও ছিল। স্কুলে পৌঁছাবার পর ড্রাইভাররাও অনেকে খানিক সময় আড্ডা মারে স্কুলের বাইরে,আর তারপরেই আজ এমন একটা মুখরোচক খবরে অনেকেই প্রায় থেকে গিয়েছিল।

   সত্যিটা জানা গেল অবশেষে,তবে বেশ কিছুদিন পরে। বাপসোহাগী মেয়ে বাবার ওপর তীব্র অভিমানে এই কাণ্ডটি করেছে। তিন বছর হলো মায়ের এক দূর সম্পর্কের খুড়তুতো বোন মফস্বল থেকে শহরে এসেছে কলেজে পড়াশোনার জন্য,দিদির বাড়ি থেকেই পড়াশোনা চলছিল তার। স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেল,ক্লাস এইটে উঠল সুদীপ্তা। খুবই আনন্দে ছিল সে মাসিকে পেয়ে,কত হইহই করে সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়া,রেস্টুরেন্টে খাওয়া। রাতে মাসির সাথেই শুত ও,ভাই শুত মা-বাবার সাথে। ঘুমের মাঝে রাতে একদিন গরম লাগায় ঘুম হালকা হতে টের পায় বিছানায় আরও কেউ,ফিসফিস করে কথা কানে যায়,ঘুমের ঘোরে বোঝেনা অত তবে মনে হয়েছিল যেন বাবা এসেছিল ঘরে। এমন মাঝে মাঝেই মনে হত কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারত না। একদিন মাকে বলেই ফেলল,"জানো মা,আমি ঘুমিয়ে পড়লে,বাবা আমাদের ঘরে যায়,আমাদের বিছানায় শোয়,আমি ঘুমের মধ্যে বাবার ফিসফিস কথার আওয়াজ পাই"। মা বলেন, "সে কি,তুই উঠে পড়িস না কেন? আর এতদিন আমায় বলিস নি কেন?" সুদীপ্তা বলে,"আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় মা,আমি ভয়ে চোখ খুলতে পারি না,ঘুমের ভান করে পড়ে থাকি,তারপর সারারাত আর ঘুম আসে না,কাঠ হয়ে পড়ে থাকি। একসময় বাবা চলে যায় তাও বুঝতে পারি কিন্তু তখন আর ঘুম আসে না,ভোরের দিকে আবার ঘুম আসে,ঘুমিয়ে পড়ি তখন। সকালে উঠতে খুব কষ্ট হয় গো মা। ভয়ে এতদিন তোমাকেও বলতে পারিনি,কিন্তু আমি আর পারলাম না মা,আজ তাই তোমাকে বলে দিলাম"। মা মেয়েকে বুকের মধ্যে টেনে নেন,মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বস্ত করেন কিন্তু চোখে তার অবিরাম ধারা,বাধ মানে না কিছুতে। সেদিন বাবা বাড়ি ফিরলে এই নিয়ে বাড়িতে খুব অশান্তিও হয় বাবা মায়ের মধ্যে। মা মাসিকে তার বাড়িতে আর রাখতে চান না,পাঠিয়ে দিতে চান,বলেন,"আমি ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দেবো,কাকাকে বলে দেবো তাঁর এই বেহায়া মেয়ের দায়িত্ব আমি আর নিতে পারব না"। বাবার তো মোটেই পছন্দ হয় না,চেঁচিয়ে বলেন,"ওর পড়া শেষ না হলে কোথাও যাবে না,কাকা নিজে আমায় অনুরোধ করেছিলেন,আমার একটা সম্মান আছে"। মা ততোধিক চেঁচিয়ে বলেন," তা কাকা কি রাতে ওর বিছানায় গিয়ে শোয়ার অনুরোধও করেছিলেন তোমায়?”। এভাবে অশান্তি চলতে থাকে,বাড়ির পরিবেশও খারাপ হয় ক্রমে। বড় হচ্ছে সুদীপ্তা,বুঝতে পারে যা ঘটছে তা না ঘটারই ছিল,মায়ের চোখের জল ওকে কষ্ট দিত খুব। বাবাও আর কাছে ডাকত না,আদর করত না,ও ও অভিমানে বাবার কাছে আর যেত না,কিছু আবদারও করত না। অথচ ছোট থেকে বাবার বড় প্রিয়,বড় আদরের ছিল ও। এভাবে চলতে চলতে মাসির পড়া শেষ হলে মা ভাবল এবার বাঁচবে বোনকে পাঠিয়ে,শান্তি ফিরবে সংসারে।

    কিন্তু না,তা হবার নয়,একদিন অফিসিয়াল ট্যুরে যাবার মতন স্ট্রলি ব্যাগ নিয়ে বাবা বেরিয়ে গেলে মাসিও ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে মাকে বলে,"আর তোমায় জ্বালাব না,আমি চলে যাচ্ছি,থাকো এবার শান্তিতে"। মা কোনো উত্তর দেন না,মাসি বেরিয়ে গেলে মা ঠাকুরঘরে গিয়ে প্রণাম করেন অনেকক্ষণ ধরে,ঈশ্বরের কৃপায় সংসারে শান্তি ফিরবে সেই আশায়। কিন্তু কদিন পরেও বাবা না ফিরলে অফিসে ফোন করে মা জানতে পারেন অফিস থেকেই তাদের আমেরিকার অফিসে পাঠানো হয়েছে সোমেশবাবু অর্থাৎ সুদীপ্তার বাবাকে। উনি নিজেই এই পোস্টিং এর জন্য আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। এরপর মা কাকার বাড়ি ফোন করে জানতে পারেন মাসি সেখানে ফেরেনি। পরে ওরা জানতে পারে মাসিকে বিয়ে করে বাবা আমেরিকা নিয়ে চলে গেছে চিরকালের জন্য,আর ফিরবে না। চোখের জলে মা ভাসছিল,চারিদিকে আঁধার,ভাইটা ভালো করে বুঝতেও শেখেনি। বয়ঃসন্ধিক্ষণে যখন নানারকম মানসিক অবস্থায় সুদীপ্তা জর্জরিত সেই সময় ভেতরে ভেতরে গুমরে থাকতে থাকতে আর সহ্য করতে না পেরে এই কাণ্ডটি করেছে সে,আর মিসের বকুনিটা ইন্ধন যুগিয়েছে মাত্র তাতে। তবে সুদীপ্তার বই থেকে পাওয়া চিঠি বাঁচিয়ে দিয়েছে মিসকে যাতে বাবার উপর অভিমান ওগড়ানো ছিল। যার শেষে লেখা ছিল," বাবারা শুনেছি আশ্রয় হয়,বটগাছের মত,আর বাবা তুমি আমাদের এভাবে নিরাশ্রয় করে চলে গেলে কেবল নিজের আত্মসুখের জন্য? তোমার সু-এর জন্য তোমার মনটা একটু কাঁদল না?"


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics