আত্মদর্পণে--- সাতে সমুদ্র
আত্মদর্পণে--- সাতে সমুদ্র


ঘটনাটা সপ্তাহখানেক আগের। বি.এড কলেজে ক্লাস চলতে চলতে আচমকা স্যার আমাদের একজন সহপাঠিনীকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, "তুমি ভালো না খারাপ?"
মেয়েটি মুখ নামিয়ে নিলো, তারপর মিনমিন করে বলল, "আমি খারাপ।"
স্যার ব্যাখ্যা করে বললেন, "ও মুখ নামিয়ে নিলো কেননা মনে মনে ও জানে যে ও ভালো, কিন্তু ছোটবেলার থেকে আমরা শিখে এসেছি যে নিজের ভালোটা কখনও বলতে নেই তাই মুখে বলল আমি খারাপ।"
কথাটা সত্যি, নিজের ভালো আমরা মুখ ফুটে বলতে লজ্জা পাই। আবার উল্টোটাও সত্যি, নিজের মন্দ দিকটাও আমরা লোকের কাছে প্রকাশ করতে চাইনা চট করে। আসলে আমার মনে হয় আমরা প্রত্যেকেই যখনই কোনো কাজ করি সেটা সবসময় ভালো ভাবেই করতে যাই, কিন্তু ভালো মন্দের ব্যাপারটা যেহেতু আপেক্ষিক তাই অনেক সময় টেরই পাইনা আমার ভালোটাই কিভাবে যেন মন্দ হয়ে ধরা পড়ে অন্যদের সামনে।
যাইহোক, আজ আমি এখানে নিজের মনের আয়নায় তাতাইয়ের তথা আমার নিজের কিছু দোষ ত্রুটি তুলে ধরার চেষ্টা করছি যেগুলো আমি পরিবর্তন করতে চাই। হ্যাঁ, "যেগুলো" বললাম, "যে টা" নয়, কারণ আমার মধ্যে এতো বদ অভ্যাস আছে যে কোনটা ছেড়ে কোনটা বলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা। তাই ঠিক করলাম সব কটাই একটু একটু করে তুলে ধরব।
*****
ভরা ক্লাস রুম, শিক্ষিকা তখনও ঢোকেননি ক্লাসে, কাজেই ছাত্রীদের মধ্যে চলছে তুমুল হুল্লোড়। তারই মধ্যে একটি মেয়ে লাফ দিয়ে ডায়াসে উঠে পড়ল, আর সঙ্গে সঙ্গে হাততালিতে ফেটে পড়ল বাকি ক্লাস। তনু ডায়াসে উঠেছে মানে ভীষণ মজাদার কিছু ঘটতে চলেছে এবার। হলোও তাই, তনু নামের মেয়েটি শুরু করল মিমিক্রি। দিদিমণিদের দিয়ে শুরু হয়ে তার মিমিক্রির পরিধি বিস্তারিত হয়ে চলে গেল সহপাঠিনীদের বেশ অবধি। আচমকা তনু বলে বসল, "এবার আমি অমুকের মিমিক্রি করব।" ক্লাসের সেকেন্ড বেঞ্চে বসে থাকা মেয়েটা বেশ নড়েচড়ে বসল, আমার মিমিক্রি!
শুরু করল তনু। চেয়ারে বসে থুতনিতে হাত দিয়ে চোখ দুটো ওপরে তুলে কি যেন আকাশ পাতাল ভাবছে সে… অভিনয় শেষ হতে তনুর মন্তব্য, "অমুকের মধ্যে সবসময় দার্শনিক দার্শনিক ভাব, বেশি কথা বলে সময় নষ্ট না করে সে তার দার্শনিক ভাবনা চিন্তা নিয়ে ব্যস্ত থাকে সবসময়।"
সহপাঠিনীর মন্তব্যে নড়েচড়ে উঠল অমুক মেয়েটি, আমি এরকম!!!
এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝে গিয়েছেন অমুক মেয়েটির পরিচয়। হ্যাঁ, সত্যিই তাতাই এরকম। তাতাইয়ের প্রথম মন্দ অভ্যাস, সে বেশি কথা বলা পছন্দ করেনা। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলতে কেন জানিনা তার বাধো বাধো থেকে। প্রয়োজনেও কারুর সাথে খেজুরে আলাপ জমিয়ে প্রয়োজনের কথাটা বলে উঠতে পারেনা। এটা তার মস্ত দোষ। অনেকেই আড়ালে তাকে এর জন্য অহংকারী বলে। সত্যি কথা বলতে অহংকার করার মত কিছু নেই তাতাইয়ের মধ্যে, তাই কথা বলেনা এটা তার অহংকার নয়, তার মধ্যকার একটা ত্রুটি।
*****
"একটা গান শোনা দেখি।"
"আমি গান গাইতে পারিনা।"
"আহা বাথরুম সিঙ্গার তো সবাই হয়, একটা গেয়ে শোনা না।"
"নট ইন দ্য মুড অফ জোক।"
"কিরে ভাই, কখন তোর ইয়ার্কির মুড হবে বল তো! সকাল, বিকেল তোর এই একই কথা।"
"হুমম।"
"কি হুমম?"
"তোর যে কখন মুড ভালো থাকে আর কখন মন্দ থাকে বুঝতে বুঝতে আমার কালঘাম ছুটে যায়।"
"তো কষ্ট করে বুঝতে আসিস কেন? যখন দেখো তখন গান কর, এই কর সেই কর। তোর আর কাজ কর্ম নেই নাকি?"
"চিৎকার করছিস কেন?"
"কই চিৎকার করলাম?"
"এই তো…"
"উফফ...আমার ভালো লাগছেনা কিছু। যা এখন। পড়াশুনার নাম নেই সারাদিন গান নাচ! আমি পারবো না তোর মত হতে।"
"এরকম করে বলছিস?"
"বলছি, ভুল কিছু বললাম কি?"
"ভালো… খুব ভালো।"
এই আলাপের দ্বিতীয় ব্যক্তিটি যে তাতাই সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই, আর প্রথম ব্যক্তিটি শান। হ্যাঁ, এটাই তাতাইয়ের দ্বিতীয় দোষ, সে ভীষণ ভীষণ ভীষণ রগচটা। অল্পতেই এতো উত্তেজিত হয়ে পড়ে যে তখন অপর প্রান্তে থাকা মানুষটাকে কি বলছে তার হুঁশ থাকে না। তার এই বদভ্যাসের জন্য সে তাই প্রিয় মানুষগুলোকেও কষ্ট দিয়ে ফেলে আর নিজেও কষ্ট পায়। মজার ব্যাপার তো হলো এই যে যাদের সে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে কথায় কথায় মেজাজ হারিয়ে দুর্ব্যবহারটাও করে তাদেরই সাথে।
*****
"এই শোন না বলছি পুজোতে আমাদের আড্ডায় যদি গণেশও আসে তাহলে কেমন হয়?"
"খুব একটা ভালো হবে বলে মনে হয়না।"
"কেন?"
"দেখ গণেশের সাথে আমার তাও আলাপ আছে কিন্তু বাকি মেয়েরা তো ওর নামটুকু বোধহয় জানে মাত্র। এক্ষেত্রে ও এলে সবাই অস্বস্তি বোধ করবে না?"
"ওহ।"
বাবা বলেন, "ভেবে কাজ করো, করে ভেবো না।" কিন্তু তাতাই প্রায়শই এর উল্টো কাজটা করে বসে। এটাই তার তৃতীয় দোষ। সে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে। পরে মনে হয় ওই জায়গায় নিজের আবেগটা না দেখালেই চলতো কিন্তু দেখিয়ে ফেলে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, প্রত্যেক বছর পুজোয় তারা বন্ধুরা মিলে আড্ডা দেয়। তো একবার এক বন্ধু ওদেরই এক প্রাক্তন সহপাঠীর নাম বলে বলল জানতে চাইল সে এলে আমাদের আপত্তি আছে কিনা। তাতাইয়ের সাথে ওই প্রাক্তন সহপাঠীর সম্পর্ক মোটামুটি, কিন্তু বাকি বান্ধবীদের সাথে তার সম্পর্ক ছিল নৈব নৈব চ। তাতাই ভাবল---- সে এলে আমার বান্ধবীরা অস্বস্তি বোধ করতে পারে, তাই তাতাই সবার আগে প্রস্তাব নাকচ করে দিল। অথচ বান্ধবীরা কেউ সেই বন্ধুর চোখে খারাপ হতে রাজি ছিলো না তাই তারা বলল ওই সহপাঠী এলে তাদের কোনো আপত্তি নেই। অতএব, দিনের শেষে খারাপ হল তাতাই। এক্ষেত্রে তার আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা উচিৎ ছিল।
*****
"উফফ আজ কোমরটা যন্ত্রনায় ছিঁড়ে যাচ্ছে।"
"হুমম।"
"আজ কি করে রান্না করবো জানিনা!"
…..
"দাঁড়াতে পারছিনা যন্ত্রনায়…"
…..
"বলছি কোমরটা একটু ম্যাসাজ করে দিবি ভলিনি দিয়ে?"
"আচ্ছা।"
তাতাইয়ের আগের বদ অভ্যাসটার ঠিক উল্টোপিঠ তার এই চতুর্থ বদ অভ্যাস। প্রয়োজনের সময় আবেগ দেখাতে পারেনা সে। ভেতরটা হয়তো তোলপাড় হয় কিন্তু তার মুখ থাকে অভিব্যক্তিহীন। কারুর হয়তো সহানুভূতির প্রয়োজন, সেই কেউটা তার মা, বাবা, দাদু, ঠাকুমা বা কোনো বন্ধু হতে পারে; সে শুধু পাথরের মূর্তির মত তাদের কষ্টের কথা শুনে যায়। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেনা।
*****
"ওই ছেলেটা কে?"
"কোন ছেলেটা?"
"টিউশন থেকে বেরিয়ে যার সাথে ফোনে কথা বললি?"
"ওহ ও তো আমার বন্ধু, কলেজে পড়ে।"
"শুধুই বন্ধু? তাহলে এতো হেসে হেসে কথা বলছিলি কেন?"
"কি বলতে চাইছিস কি?"
"ছেলেটার সাথে আমাকে দেখা করা।"(গম্ভীর গলায়)
"মানে?"
"দেখতে চাই কেমন বন্ধু তোর।"
"এই এই কি বলছিসটা কি?"
"আমি ছেলেটার সাথে দেখা করতে চাই, ওকে আসতে বল। আমি জানতে চাই কেমন বন্ধু তোরা।"(চিৎকার)
"এই ডোন্ট ক্রশ ইয়োর লিমিট। তোর হুঁশ আছে কি বলছিস? কেমন বন্ধু দেখার তুই কে? আর আমার সাথে এরকম উঁচু গলায় কথা বলছিস কোন সাহসে?"
"সাহসে চলে গেলি? আর জানতে চাইছিস আমি কে?"(চিৎকার)
"হ্যাঁ। আমার সাথে ফারদার এভাবে কথা বলবি না।"
"আই লাইক ইউ।"
"কি বলতে চাইছিস কি?"
"যা তুই বুঝছিস।"
"হই এসব কি বলছিস! এমন উদ্ভট চিন্তা তোর মাথাতে এলো কেন?"
"উদ্ভট চিন্তা? ডোন্ট ইউ ফিল এনি থিং এবাউট মি?" (চিৎকার করে)
"তুই আমার ভালো বন্ধু, এর অতিরিক্ত কিছু তুই ভেবে থাকলে আমার কিছু করার নেই।"
"তাই? তাহলে আমাকে নোটস দিতিস কেন? পড়া বুঝিয়ে দিতিস কেন?"
"সে তো সবাইকেই দিই, আর তুই সেটা জানিসও। তো এর পরেও এসব বলছিস কেন?"
"আমি ভেবেছিলাম আমি স্পেশাল।"
"আমার সব বন্ধু স্পেশাল, সে ছেলে হোক কি মেয়ে হোক। আমি তাদের প্রয়োজনে যথাসাধ্য সাহায্য করার চেষ্টা করি।"
এই ঘটনাটার কথা এখনও ভুলতে পারেনা তাতাই। এরকম চরম অস্বস্তিতে আর কখনও পড়েছে বলে মনে হয়না। তাই তার পঞ্চম দোষ, সে অন্তর্মুখী হলেও যদি তার সাথে কারুর মোটামুটি ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায় তাহলে সেক্ষেত্রে সে ছেলে না মেয়ে বিচার না করেই তার সাথে মিশতে শুরু করে। তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করে। মাথায় থাকে না যে ছেলে হলে তাদের মনে অন্যরকম অনুভূতি কাজ করতে পারে। ফলস্বরূপ কয়েকবার খুব অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। মানে "ভুল সংকেত" চলে গিয়েছিল তার দুই ছেলে বন্ধুর কাছে। এবং তাদের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। আর বিগত দুই বছরে আতঙ্কে নতুন কারুর সাথে বন্ধুত্ব করতে এগিয়ে যেতে পারেনি।
*****
"দিদি তুই ওই ছোফাতায় (সোফাটায়) বস না।"
"না।"
"উম্ম পিলিজ পিলিজ।"
"না।"
"আমি এই ছোফাটায় ছুব।"
"না। আমি এখানে বসে আছি।"
"পিলিজ ওঠ না।"
"না বললাম তো।"
"উফফ তুই না বড্ড জেদী তাতাই। ছোটো ভাই বলছে যখন তখন অন্য সোফাটায় উঠে গেল তোর কি সমস্যা হয়ে যাবে?"
হ্যাঁ। তাতাইয়ের ষষ্ঠ দোষ, সে ভীষণ জেদি। এটা তার কথা নয়, তার মা বাবা বন্ধু, স্যারেরা সবাই বলেন। তাতাই এর কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারবেনা ঠিক করে কেননা নিজের মনের আয়নায় এই দোষখানি সে ধরতে পারেনি এখন অবধি। তবে তার মনে হয় সে কোনো ব্যাপারে সহজে হার স্বীকার করতে চায়না, সেটা তর্ক বিতর্ক হোক বা অন্য কিছু। তাই হয়তো…
******
"আচ্ছা অমুকটা এতো টাকার, সেইটা তত টাকার, এইটার দাম এতো টাকা তাহলে মোট কত হচ্ছে রে?"
"হুঁ?"
"কত হচ্ছে হিসেব কর তো। পার্সে আমার টাকা কম পড়ছে কেন! কি হল ব্যাপারটা..!
"কি?"
"কিসের কি"
"কি বললে?"
"উফফ বলছি যে অমুকটা এতো টাকার, সেইটা তত টাকার, এইটার দাম এতো টাকা তাহলে মোট কত হচ্ছে?"
"টাকা! কে জানে…!"
"আশ্চর্য! সবসময় তোর মন কোনদিকে থাকে? একটা সাধারণ হিসেবেও করতে পারিসনা। এই দুনিয়ায় টিকে থাকবি কি করে…..!!!!!"
ইয়েস, তাতাই একটি গাধা। সবসময় নিজের কল্পনার জগতে বিচরণ করতে করতে এমন হয়েছে বাস্তব জগতে, বাস্তব জগতের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সে গাধার মত কাজ কারবার করে থাকে। কখনও হিসেব ভুলে যায় তো কখনও সামনের জন কি বলছে তা একেবারে মাথার ওপর দিয়ে যায়।
******
তা যাইহোক, এই হল তাতাই তথা এই অধমের পৃথিবী থুড়ি জীবন, যেখানে সাত সাতটা সমুদ্রের ন্যায় বদভ্যাস বর্তমান। তবে চুপি চুপি বলি, খুঁজলে আরও অনেক পাওয়া যাবে নিশ্চয়। সেগুলোর কথা পরে কখনও লিখবো আবার।