আশাবরী
আশাবরী
পাঁচ বন্ধু ,ছোটবেলায় এক স্কুলে পড়েছে ।পাঁচজনের এক এক জন কিন্তু একেক রকম। কেউ বা পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল ,কেউ ভালো ছবি আঁকত , কেউ ছিল দুরন্ত বাউন্ডুলে আবার কেউ বা কবিতা লিখত লুকিয়ে ।প্রত্যেকের এক একটা আলাদা জগৎ ছিল। তবু বয়সের ভারে ক্লান্ত হয়ে পড়ার মুখে এই পাঁচজন হঠাৎ একত্রিত হয়ে পড়ল।বহুদিন ছাড়াছাড়ি। সকলেই অনেক বদলেছে,কিন্তু কেউ কারো অতীত ভুলে যায়নি।কবিতা লিখত যে, সেই দীপক এখন আর অবসরই পায়না।পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল,অথচ সে এখন সামান্য একটা চাকরি করে,এত ছুটতে আর ঘুরতে হয়, কবি মনটাই বোধহয় মরে গেছে। দুরন্ত যে ছেলেটা সবাইকে ছোটবেলায় দাবিয়ে রাখত ,সেই শঙ্করের মাথায় এখন চকচকে টাক,বয়সের ছাপ ওর মধ্যেই যেন সবচেয়ে বেশি। অথচ ললিত কোনদিনই পড়াশোনায় ভাল ছিল না।সামান্য একটা ব্যাবসায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল জ্যাঠা।আজ সেই ব্যাবসা বেড়ে তিনটে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আজ সে কোটিপতি।
সপ্তমীর দিন বিকেলে ওদের আড্ডা চলছে ,আড্ডাটা ললিতের বাড়িতেই হচ্ছে।কিন্তু সালতামামির হিসেব আর ছোটবেলার স্মৃতিচারণ ছাড়াও আরো কিছু ছিল ওদের আড্ডায়-পুরোনো আফশোষ,পুরোনো রেষারেষি, এমনকি পুরোনো অভিমান-যন্ত্রণাও।হেডস্যারের ঘরে ঢিল মারার গল্পটা সকলেই অল্পবিস্তর মনে করতে পারল, কাজটা শঙ্করেরই, কিন্তু মার খেয়েছিল ক্লাসশুদ্ধু ছেলেরা। কেউ ভয়ে শঙ্করের নাম বলতে চায়নি, কারণ তারপর শঙ্করের হাতে রাম ঠ্যাঙানি খেতে হত্।শেষ পর্যন্ত সকলকেই মার খেতে হয়েছিল।সকলেই হাসছে, শঙ্কর নিজে কিন্তু গম্ভীর।"কি হল রে ?বুড়ো বয়সে এসব দুষ্টমির কথা শুনতে লজ্জা করছে নাকি?" বিভাস ফুট কাটল। সকলেই হো হো করে হেসে উঠল।দীপক ছিলো একটু অন্যরকম, পড়াশোনায় খুব ভাল ছিল কিন্তু কারো সঙ্গে সেভাবে মিশত না ।ও ছিল কবি।বসন্ত বলল,"কিরে দীপক,এখনো কবিতা-টবিতা লিখিস নাকি ? ""আরে না ,না" দীপক লজ্জা পেল।কবি পরিচয়ে ওর কোনদিনই খুব গৌরব ছিলনা অবশ্য।
একমাত্র বসন্তের চেহারাটাই এখনো ভালো আছে। চুল-টুল ওঠেনি।বলল, "আরে শরীরটাকে রাখতে হলে নিয়মিত সাধনা করতে হয়। এই দেখ না এই বয়সেও আমি নিয়মিত ব্যায়াম করি। "দীপক বসন্তের হাতটা টিপে দেখে বলল "তা বটে"।শুধু প্রাণচঞ্চল শঙ্কর কি ছিল, আর এখন কেমন যেন মনমরা হয়ে গেছে।ওকে অনেক কষ্টেও সক্রিয় করে তোলা যাচ্ছিল না।শঙ্কর পাল্টে গেছে।
আজকের আলোচনাও সংসার, বেড়ানো,পুজো,ওষুধপত্র এসব নিয়েই চলছিল, কিন্তু শঙ্কর যখন দেওয়ালে ঝোলানো বেহালাটার দিকে এগিয়ে গিয় হাতে তুলে নিল ওদের গল্প একটু থমকে গেল।বেহালায় এক একটা করে সুরের সৃষ্টি হয় আর ঘরের সকলে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে।বিভাসের কাগজ কখন হাত থেকে পড়ে গেছে, কাপে চা সবার ঠাণ্ডা ।ললিত যে বালিশে হেলান দিয়ে ছিল , এখন সেটা কোলে নিয়ে সোজা হয়ে বসেছে।সুর নয়,যেন শব্দ ভেসে আসে ।জানলার ধারে ছোট টুলটায় বসে শঙ্কর বেহালার তারে টান দিয়ে চলে।বেহালার মৃদুরাগ আশাবরীতে হারিয়ে যাচ্ছিল ললিতের মন। এই ঘর, এই দেওয়াল,শঙ্কর আর সব বন্ধুরা, সকলকে ভুলে যাচ্ছিলেন তিনি ।শুধু বেহালার তার চারখানা আর ছড়িটা।সুরের নিজস্ব ভাষা যেন কান্নার বর্ণমালা।ভুলে গেলেন একাদশীর দিন কোলোন পৌঁছেই একগাদা মিটিং করতে হবে, তার কথা।তার চোখে ভেসে উঠল খুব ছোটবেলার একটা দৃশ্য ।বাবার হাত ধরে সে চলেছে স্কুলে।কত গল্প ,কত কথা বলতেন। প্রতিদিন স্কুলে হেটে যাবার অতোটা পথ কখন যে শেষ হয়ে যেত !সেই বাবা একদিন অফিস থেকে বিধ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফিরলেন । কোন এক টাকা চুরির কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছেন। বাবা কখনো এ কাজ করতে পারে ভাবতেই পারত না ললিত।যে বাবা পকেটে দু’টাকা থাকলেও ভিখিরিকে একটাকা দিয়ে সাহায্য করতে দ্বিধা করত না, বাড়ি ফিরে চুপচাপ মায়ের বকুনি সহ্য করত?সেই বাবা করবে চুরি?বিশ্বাস করেনি ও,দেখেছে লুকিয়ে বাবার কান্না।বাবার চাকরি গেল ,বাড়ি থেকেও বের হত না বিশেষ। শেষ কালে এই ঘটনার তিন মাসের মধ্যে বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়।'বাবা ,এত ঝাপসা কেন তোমার মুখটা?'।ললিতের চোখ ভিজে এল ,গলা বুক দিয়ে যেন নেমে আসতে চাইছিল সুরটা।ললিত যে বেহালা বাজাতে জানে না।
প্রতিবাদী কন্ঠ বসন্ত ফিরে গেল তার রক্তঝরা অতীতে। সেদিন ওর বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল।কিন্তু পারল না।এই শঙ্কর অনেক দূরের অন্য শঙ্কর ,ও জানে, কিন্তু,ওর হাতের বেহালায় কি অপরিসীম মায়া আর আবেগ,আগে জানত না বসন্ত।শঙ্করের বড় ছেলে বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে, ছোট ছেলের পরিণতির কথা ভাবলেও বুকটা কেঁপে ওঠে।বাড়িতে ঢুকে কিছু আশ্রিত গুন্ডা ছেলেটাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। শঙ্করের মাথায় আঘাত করে অজ্ঞান করে দেওয়া হয়েছিল। গুরুতর আহত হয় শঙ্করের স্ত্রীও। এক সপ্তাহ পরে খালধার থেকে ছেলেটার লাশ পাওয়া যায়। বসন্ত নিজে সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করেছে কিন্তু এই পরিণতির কথা কোনদিনও ভাবেনি ।আপনিই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ওর।ভেতরে ভেতরে এই ভেবে বসন্ত লজ্জা পাচ্ছিল,যে এখনো অল্পস্বল্প রাজনীতি ও করে। যখন সক্রিয়ভাবে পার্টি করত, রেষারেষি চলত তার সঙ্গে পাড়ার এক গণ্যমান্য ব্যক্তির, যার নাকি পোষা গুন্ডার সংখ্যা কম নয়। ওদের দল দু'ভাগ হয়ে গিয়েছিল। বসন্তের দলের ছেলেরা নিরাপদ ছিল না,তবু ওরা আলাদা একটা দল গড়ল। ভোটের সময় এক সংঘর্ষে ওদের কজন মারাও যায় ,এর মধ্যে বসন্তের হবু জামাইও ছিল।বসন্ত ছিল শক্ত লোক,সে ছেড়ে দেয়নি।লড়াই করে আজ একটা সম্মানীয় জায়গায় সে পৌঁছেছে, কিন্তু যুবক বয়সের সেই আকর্ষণটা এখনো যায়নি। রাজনীতি তার রক্তে, তবু ও বীতশ্রদ্ধ।
দীপক চিরকালই এমন আমুদে ছিল না,চাপা স্বভাবের ছিল। সে স্বভাব এখন বদলেছে।তবু যুবক বয়সের সেই অভ্যাসটা যায়নি।লেখালেখিতে বন্ধুবান্ধব উৎসাহ দিত ,তাই লুকিয়ে চুরিয়ে লিখে ফেলত খাতার পেছনে, গড়ে উঠত তার ব্যক্তিগত অনুভূতির জগত।হাওয়ার কানাকানি আর মৃদু স্পর্শের রোমাঞ্চ নিয়েই মেতে ছিল যৌবনটা ।সেই স্পর্শের উত্তেজনা কেটে গেলে ও দেখল, যেখানে ছিল সেখানেই পড়ে আছে।তবু ও বলত,ও হল জীবনের কবি,মৃত্যুর নয়।আনন্দ ও ভালবাসার কবি,বিরহের নয়।বেহালার সুরে ওর সঙ্গীতপ্রিয় মনটা নেচে উঠছিল। ভালোবাসার অনুভূতির কথা গুলো মনে পড়ে যেতে লাগল।সেই সব আনন্দ, যার কোন কারণ নেই,নাম নেই।ও ভেসে চলছিল সুরের মূর্চ্ছনায়।ভারি ভাল লাগছিল আজকের বিকেলটাকে।দীপক ভাবল, বাড়ি ফিরেই আবার কবিতা লেখা শুরু করবে।সেই ক্ষমতা এখনও ওর আছে।জীবনের সুখ দুঃখের সরু মধ্যরেখাটার গুরুত্ব ও ভালভাবেই জানে, নতুন করে সব শুরু তো করাই যায়। মনে হল ছোট ছেলেটাকে ক্রিকেট কোচিংয়ে দিতে হবে।গিন্নিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে এ সপ্তাহেই ।আচ্ছা কোলেস্টরেল ফ্রি মাখনটা খেয়ে দেখলে কেমন হয়?
সন্ধ্যা হল ,যেন অনন্তকালের বেহালা বেজে চলেছে। সময় নিরপেক্ষ হয়ে বেজে চলেছে।সুরটা যেন দেওয়ালের ওপার থেকে ভেসে আসছে, কি এক আশ্রয়হীনতার অভিমান নিয়ে।বাইরে মাইকে হিন্দি গান চালু হল। কেউ জানল না এই দোতলার ঘরে কি আলোড়ন ঘটে গেল, এই পাঁচ বুড়ো কি জাদুতে, কি আবহে, এক আবেগময় অস্তিত্ত্বের জগতে চলে যেতে পেরেছিল।কিভাবে নিজেদের স্বরূপ নতুনভাবে আবিষ্কার করতে পেরেছিল।শুধু বিভাস হয়ত কোন অজ্ঞাত কারণে নিজের অতীত জীবনের কথা মনে করার বিলাসিতায় গা ভাসাতে চাইছিল না ।বেহালার সুর শুনতে শুনতে চোখ বুজে এক অন্য রাজ্যে চলে গেছিল , ভাবনা নেই , আবেগ নেই, আশা নেই ,আশা ভঙ্গ নেই, কৈশোরের চপলতা নেই, যৌবনের মত্ততা নেই, জীবনের গড়ে তোলার বা ভেঙে দেওয়ার সহজ পদ্ধতির গল্প নেই। শুধু শঙ্করের পিতৃহৃদয় এক ব্যথায় দুমড়ে মুচড়ে উঠছিল।সে কোন ছন্দই হারায়নি ,কোন কিছুই তাকে অভিমানী করে তোলে না ।এক অশেষ উন্মুক্ততা তার চারপাশের পৃথিবীতে ।সেই আনন্দেই হয়তো তার চোখ ফেটে এক ফোঁটা জল বেরিয়ে আসে ।কেউ দেখতে পায় না।