আনন্দমঠ
আনন্দমঠ


প্রথমেশ হালদার কী একটা মৃতসঞ্জীবনী ট্যাবলেট পেয়েছেন, যা খেলে নাকি মরার পরেও মানুষ বেঁচে ওঠে। কথাটা চাউর হতেই আনন্দমঠে একটা শোরগোল পড়ে গেলো।
এমনিতে এখানে জীবন বেশ পরিপূর্ণ। কলকাতা থেকে অনেকটা দূর, মেদিনীপুর শহরের উপকণ্ঠে গাছপালায় ঘেরা বিস্তীর্ণ একটা জায়গা জুড়ে এই আশ্রম। বয়স্ক মানুষদের থাকবার ঠিকানা। শহরের কোলাহল বা দূষণ কিছুই নেই। কিন্তু সুযোগ-সুবিধা বেশ ভালো এখানে। এটিএম আছে, ছোট্ট একটা পোস্ট অফিস, নিজস্ব ওয়াটার সাপ্লাই, একটা বড়ো চত্বর-আলা মন্দির, কমিউনিটি হল, সব আছে। কম্পাউন্ডের ভিতরেই একটা নার্সিংহোমও আছে। জীবনের শেষপ্রান্তে আসা কিছু মানুষ নিজেদের মতো করে এখানে শান্তিতে সময় কাটান। আদতে এটি একটি বৃদ্ধাশ্রম। কলকাতারই একটা ট্রাস্ট এই বৃদ্ধাশ্রমটা পরিচালনা করে। আশ্রমের নাম আনন্দমঠ।
সমাজের উঁচু তলা, নিচু তলার বিভিন্ন মানুষ থাকেন এখানে। গোবিন্দ মুখুজ্জ্যে যেমন আছেন। হাইকোর্টের জজ ছিলেন। এখন রিটায়ার করেছেন। স্ত্রী গত হয়েছেন পাঁচ বছর আগে। একমাত্র ছেলে আমেরিকাতে থাকে। মুখুজ্জ্যেবাবু আর কী করবেন, আমেরিকায় থাকতে তার মন চায় না। চলে এলেন এই আশ্রমে। পিনাকিলাল ধর যেমন স্কুল মাস্টার ছিলেন। তিনকূলে তার কেউ নেই। শুধু অঙ্ক খুব ভালোবাসেন। রিটায়ারের পর পিএফের জমানো টাকা সবটাই এই ট্রাস্টের হাতে তুলে দিয়ে আজীবনের সদস্য হয়ে গেলেন আনন্দমঠে। আছেন মধুবাবু। খুব একটা অবস্থাপন্ন নয় তার পরিবার। ছেলেমেয়েরা আছে, কিন্তু বোঝাপড়ার অভাব। তিনি স্বেচ্ছায় এই আশ্রমে এসেছেন গত বছর স্ত্রীবিয়োগের পরে। তার খরচাপাতি কিছু তার ছেলেরা দেয়, বাকিটা ট্রাস্ট নিজেই বহন করে। বেশ কিছু দম্পতিও আছেন, যারা বুড়োবুড়িতে একসঙ্গে থাকেন আশ্রমে। ঘোষবাবু যেমন সস্ত্রীক এসেছেন এখানে গত বছর।
সকালে উঠে কেউ মর্নিং ওয়াক করে, কারুর বা সূর্যপ্রণাম। দুপুরে তাসের আড্ডা বসে কোথাও। সন্ধ্যের দিকে মন্দির চত্বরে বেশ একটা উৎসব উৎসব পরিবেশ দেখা যায় রোজ। দুর্গাপুজো আর সরস্বতীপুজো বেশ বড়ো করেই হয় এখানে। মাসে দু'মাসে কালচারাল প্রোগ্রামের আয়োজন করা হয় কমিউনিটিতে। নিজেরাই কবিতা, গান, নাটক ইত্যাদি নিয়ে জমজমাটি অনুষ্ঠান হয় তখন। সব মিলিয়ে ভালোই কাটছিলো দিন। কাল হলো হালদারবাবুর খবরটা। কোথা থেকে তিনি নাকি মৃতসঞ্জীবনী ট্যাবলেট পেয়েছেন, আজব কান্ড।
**************************************************
হালদারবাবুর রুমের সামনে একটা বেশ জটলা দেখা গেলো সেদিন সকালে। এতদিন মৃতসঞ্জীবনী ওষুধের নামই শুধু শুনে এসেছে সবাই। সেরকম যে বাস্তবে সত্যি সত্যি হয়, আর তাও সেটা কিনা এই আনন্দমঠেই পাওয়া গেছে, এরকম খবরে চাঞ্চল্য তো বাড়বেই। সবার মধ্যেই বিশাল কৌতূহল - কই দেখি, কই দেখি!
আজীবন ব্যাচেলার হালদারবাবুর একমাত্র সঙ্গী বলতে সিগারেট। একসময় স্টেট ব্যাংকের কর্মচারী ছিলেন। তামাকের ভীষণ নেশা তার। এই আশ্রমে সবাই-ই প্রায় স্বাস্থ্য নিয়ে খুব সচেতন। সিগারেটখোর সেরকম কেউই নেই। কেউ খেলেও বড়োজোর ওই দু-একটা। একমাত্র ব্যতিক্রম শশধর হালদার। ঘন ঘন সিগারেট না হলে তার চলে না।
সকালের তিন নম্বর সিগারেটটা মনের সুখে ধ্বংস করতে করতে হালদারবাবু বোঝাচ্ছিলেন তখন, "কাল সন্ধ্যেবেলার ঘটনা। বাজারের দিক থেকে ফিরছিলাম, হঠাৎ আধো-অন্ধকারের মধ্যে থেকে কেউ যেন আবির্ভুত হলো, বুঝলেন। পরণে গেরুয়া পোশাক। লম্বা চেহারা। সন্ন্যাসীদের মতো দেখতে কিছুটা। তবে দাড়ি-গোঁফ কিছু নেই। পুরো কামানো গাল। ছ'ফুটের মতো হাইট হবে। তিনিই আমাকে এই ট্যাবলেটের কৌটোটা দিলেন। বললেন, এই ট্যাবলেট একটা খেলেই বেঁচে উঠবে মৃত মানুষ। প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু পরে ভাবলাম, কতদিকে কত পয়সাই তো নষ্ট হয়েছে... একবার নাহয় নিয়েই দেখি, একশোটা তো টাকা, নাহয় জলেই গেলো।"
"তারপর কি লোকটা অদৃশ্য হয়ে গেলো ?" একজন জিজ্ঞাসা করলো ভীড় থেকে।
"হ্যাঁ। মানে কোনদিকে যে চলে গেলো টাকাটা নিয়ে, খেয়াল করিনি। কৌটোটা তুলে নামটা পড়ার চেষ্টা করছিলাম, তারপর মাথা তুলে দেখি তিনি আর নেই।"
"হরি ওম।" দু'হাত জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে বললেন সান্যালবাবু, "সাক্ষাৎ সেই পরমেশ্বরই এসেছিলেন তাহলে, আপনি খুব ভাগ্যবান মশাই।"
"একবার দেখাবেন নাকি কৌটোটা ?" কেউ জিজ্ঞাসা করলো। ঘর থেকে মৃতসঞ্জীবনীর কৌটোটা এনে সেটা উপরে তুলে ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবাইকে দেখালেন হালদারবাবু। কেউ কেউ ভক্তির আতিশয্যে কৌটোটাকেই জোড়হাতে প্রণাম করে ফেললো।
হেডমাস্টার পিনাকিলাল জিজ্ঞাসা করলেন, "কতগুলো ট্যাবলেট আছে মশাই ওই কৌটোতে ?"
"গুনে দেখিনি... তবে খান কুড়ি-পঁচিশ হবে মনে হয়।"
"বাহ্, কুড়িটাও যদি হয়, জীবনের দাম তার মানে মাত্র পাঁচ টাকা। আমার জন্য একটা রাখবেন। বা বলেন তো এখনই একটা কিনে নিই, যদি আপনি দেন তো। আপনার নিজের তো আর একটার বেশি লাগবে না।"
হাতটা ঝটিতে পিছনে সরিয়ে নিলেন হালদারবাবু। বললেন, "থাক না আমার কাছে। আমরা তো সবাই একটা ফ্যামিলিরই মতো। যখন কারুর লাগবে, আমি তো আছি। এই ওষুধ নিয়ে হাজির হয়ে যাবো ঠিক।"
"আচ্ছা, বেশ।" সত্যি, এরপর তো আর কোনো কথা চলে না।
শশধরবাবুর স্ত্রীও ছিলেন সেখানে। বয়স সত্তর ছুঁই-ছুঁই। তিনি শুধু বললেন, "এই কথাটা বাইরে সব জায়গায় রাষ্ট্র করে বেড়াবেন না আবার। যা পেয়েছেন, অমূল্য জিনিষ। সাক্ষাৎ বিধাতার দান। দেখবেন খোয়া না যায়।"
ভীড় একটু কেটে গেলে ব্যারিস্টার গোবিন্দবাবু একান্তে হালদারবাবুকে দুঁদে উকিলের মতো সন্দেহ নিয়ে শুধোলেন, "সবই তো বুঝলাম, কিন্তু মরে যাবার পর কেউ ট্যাবলেট খাবে কীকরে মশাই ? মরা মানুষ কি ওষুধ খেতে পারে ? নাকি তাকে খাওয়ানো যায় ?"
কথাটা মিথ্যে নয়। আমতা আমতা করে হালদারবাবু বললেন, "কী জানি, এটা তো ভাবিনি। হয়তো - ইয়ে, জানি না। কিন্তু ঠিকই বলেছেন।"
**************************************************
আশ্রমের পরিবেশ এর পর থেকে আর স্বাভাবিক রইলো না।
সবসময় একটা যেন উৎকণ্ঠা। কেউ কি মারা গেলো ? কারুর কি শেষ সময় ঘনিয়ে এলো ? তিওয়ারিজি অসুস্থ ছিলেন না ? তার কি কোনো খারাপ খবর পাওয়া গেলো ? এখানে সর্বজ্যেষ্ঠ শশাঙ্কবাবু - তার কোনো খবর ?
উদ্দীপনার অভাব নেই যেন। কারুর একটা খারাপ খবরের আশায় দিন কাটতে লাগলো সবার। কেউ না মরলে মৃতসঞ্জীবনী ট্যাবলেটের কার্যক্ষমতা প্রমান হবে না। ট্যাবলেট কাজ করুক, বা নাই করুক, কিছু একটা মীমাংসা তো হবে। সেটাই সবাইকে যেন উৎকণ্ঠার চরম সীমায় রেখেছে।
মৃত্যুকে জয় করা যাবে। এখন সেই সমাধান প্রায় হাতের মুঠোয়। এর বেশি আর কীই-বা চাইতে পারে জীবন সায়াহ্ণে আসা মানুষ ? আশ্রমে সবার তাই অসীম আগ্রহ। শুধু একবার যাচাই করা।
প্রাণচঞ্চল জীবনের ধারা উধাও হয়ে গেলো যেন আনন্দমঠে। মৃত্যুর প্রতীক্ষায় দিন পার হতে লাগলো। সন্ধ্যেবেলার আড্ডায় এখন একটাই আলোচ্য বিষয়, কে হবে সেই প্রথম জন ? কবে জানা যাবে মৃতসঞ্জীবনীর মাহাত্ম্য ? বাড়তে লাগলো অপেক্ষা আর উদ্বেগ। শশধরবাবুর সিগারেট খাওয়া আরো বেড়ে গেলো। দিনে দু'বার করে ট্যাবলেটের কৌটোটা খুলে ওষুধ গুনে দেখেন তিনি। মাথায় ঘোরে গোবিন্দবাবুর কথাটা। মৃত মানুষ তো আর ট্যাবলেট খেতে পারে না। সত্যিই তো। মৃত মানুষকে ট্যাবলেট খাওয়ানো সম্ভব নয়। কী উপায়, কী উপায় করা যায়।
এইভাবে দু'মাস কেটে গেলো। কিন্তু সবাই সুস্থ ও জীবিত। কী জ্বালা!
**************************************************
রোজকার মতো সেদিনও সকালে নিয়মিত ভোর হয়েছিলো। আনন্দমঠের বাসিন্দারা পার্কের আশেপাশে মর্নিংওয়াকে ব্যস্ত। হালদারবাবু আজ আসেননি। ব্যারিস্টারমশাই একটু বেলার দিকে খোঁজ নিতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন তাঁর মরদেহ। ঘরের দরজা বন্ধ ছিলো। অনেক ডাকাডাকির পর সিকিউরিটিকে ডেকে দরজা ভেঙ্গে ঢুকতে হলো। হালদারবাবু টেবিলের উপর ঝুঁকে বসে ছিলেন। হাতদুটো দুদিকে ঝোলানো। মুখটা বিকৃত হয়ে গেছে। সামনে খোলা মৃতসঞ্জীবনীর কৌটোটা।
ডাক্তার এসে সব দেখে জানালেন যে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে। ওষুধের কৌটোটা দূর করে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হলো পুকুরে। যে ওষুধ খেয়ে মৃত মানুষের বেঁচে ওঠার কথা, বেঁচে থাকাকালীন সেই ওষুধ খেয়ে মৃত্যুই ডেকে আনলেন শশধর হালদার।
কিন্তু এতে একটা উপকার হলো। বোঝা গেলো ওসব বুজরুকি। মরা মানুষ কখনো বেঁচে ওঠে না। মৃতসঞ্জীবনীর ভুয়ো খবরে উদভ্রান্ত না হয়ে আশ্রমের জীবন আবার তার স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে পেলো।
এর কিছুদিন পর সন্ধ্যের সময় পার্কের দিক থেকে ফিরছিলেন গোবিন্দবাবু। হালদারবাবু যে ঘরটাতে থাকতেন, তার পাশ দিয়ে আসার সময় দেখলেন বেশ দারুন একটা ফুলের গাছ হয়েছে। আগে কখনো চোখে পড়েনি তো। লম্বা লম্বা ঘন সবুজ পাতা আর তিন-চারটে ফুল ফুটেছে বাহারি রঙের। বেশ নতুন ধরণের একটা ফুলের গাছ দেখে তিনি কাছে গেলেন। কী ফুল বুঝতে পারলেন না, কিন্তু নাকে তীব্র একটা গন্ধ পেলেন যেন তামাকের। এই গন্ধটা তার ভীষণ চেনা। ওই বাহারি ফুলের কাছে গিয়ে ভালো করে ঘ্রান নেওয়ার চেষ্টা করলেন তিনি। হ্যাঁ, ঠিকই মনে হয়েছিলো। ফুলের গাছটাতে পুরো সিগারেট-সিগারেট গন্ধ।
~ সমাপ্ত