STORYMIRROR

Nityananda Banerjee

Crime Others

4  

Nityananda Banerjee

Crime Others

আকাশের রঙ ফ্যাকাশে

আকাশের রঙ ফ্যাকাশে

5 mins
339

ষট্চত্বারিংশতি অধ্যায়

তেজপাল সিং, বাব্বন সিং আর বড়দা রাত তিনটে নাগাদ মল্লিকপুর ছেড়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন । এমনিতে প্রায় সারা রাত জেগে কাটিয়েছি । 

অবশ্য গোপাও ঘুমোতে পারেনি । বাকি সকলে আরামে নিদ্রা গেছে । গোপা আমার সন্নিকটে এসে বিছানার পাশে বসল ।

আমার গা ছমছম করছে । ওকে কি বলব ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না । গোপার হয়তো অনেক কিছু বলার আছে - সেও সাহস করে বলতে পারছে না । আমি বিছানার ধার বরাবর পায়চারি করছি । 

গ্রামের রাত । একেবারে নিস্তব্ধ , নিঝুম । একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার বিশ্রী চিৎকার কানে আসছে । নিকটবর্তী গোয়াল থেকে গোরুগুলো মাঝে মাঝে জোরে শ্বাস নিচ্ছে । 

গোপাকে সরে আসতে দেখে আমিই প্রথম মৌনতা ভাঙলাম ।

- কোন অসুবিধা হয়নি তো ? 

কি ভাবে কথা বলতে হবে ভেবে পেলাম না । আপনি না তুমি সম্বোধন করব খুঁজে পাচ্ছি না । সেজন্য ভাববাচ্যে কথা বলাই শ্রেয় মনে করে বললাম - গ্রাম তো ! ভোল্টেজও বড়ই কম । পাখাটা তো আর জোরে ঘুরবে না । একটা হাতপাখা আছে দেব ?

গোপা বলল - লাগবে না । যে কষ্ট বুকে নিয়ে দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছর কাটিয়েছি তার সামনে এগুলো কোন ম্যাটার করে না । তুমি এমন অস্থির হয়ে পায়চারি করছ কেন ? এখানে বস - কথা আছে ।

গোপার ভাষায় নিজে অনেকটাই আশ্বসিত হলাম । ও যখন তুমি বলছে ; আমারও তুমি বলতে কোন বাধা নেই। 

কিন্তু জিভের আড়ষ্টতা প্রমাণ করে দিল যত উঁচু পদেই কাজ করে থাকি না কেন ; ঠিক এই মূহুর্তে সম্বোধনী ভাষা নীচে নামতে পারল না । তুমি বলতে যেয়েও আটকে গেলাম । মাত্র একটি রাতের দেখা তাও আবার ক্ষুণ্ণ মনে । ভুলে যেতে চেয়েছিলাম ; ভুলে গেছলামও, কিন্তু বুকুনের চিঠিগুলো আমাকে বারবার মনে পড়িয়ে দিচ্ছিল সেই রাতের কথা, সেই মেয়েটির কথা , যে নিজেকে তার বাবার যোগ্য উত্তরসূরী ভেবে আত্মতুষ্টিতে ভুগছিল ।

সে না হয় নিজ কৃতকর্মের ফল ভোগ করেছে কিন্তু আমি ? আমাকে এখন কেমন যেন অপরাধী মনে হচ্ছে । গোপার দৃঢ়চিত্ততার নিকট এটা এক বড় পরাজয় বলে মনে হল ।

আমার ভাগ্যে হয়তো ঘর- সংসার পাতা লেখা ছিল না । এখন এই বয়সে নিজেকে সংসারী রূপে দেখতে প্রস্তুত ছিলাম না। ভেবেছিলাম বড়দার পদাঙ্ক অনুসরণ করে জীবনটা ঠিকই কাটিয়ে দেব । তা যে আর সম্ভব নয় - যথেষ্ট বোধোদয় হল ।

বুকুনের চিঠিগুলো আমাকে কৌতূহলী এবং অনুসন্ধিৎসু করেছে বলাই বাহুল্য । ওই চিঠিই আমার ভবিষ্যৎ জীবনকে নির্ধারিত করে দিয়েছিল। ফলস্বরূপ শখের গোয়েন্দাগিরি করতে ইচ্ছে হয়েছিল । সে কাজেও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করল বড়দার ক্রিমিনোলজি। কি ভাবে যে নির্বিকার চিত্তে কাজ হাসিল করে দিলেন ; সেও এক বিস্ময় ।

যাই হোক গোপার এই 'তুমি' কথাটাও আমাকে উদ্বুদ্ধ করল । যদিও বললাম - আপনি না মানে তুমি বলছিলে না কথা আছে ! কি কথা ?

গোপা তেমনি নির্লজ্জের মত বলতে শুরু করল - আমি কি আবার কোন ভুল করে ফেললাম ?

- ভুল ? কেমনতর ভুল ?

- এই যে গায়ে পড়ে নিজের অধিকার আদায় করে নিলাম!

- অধিকার ! 

ভয় পেয়ে গেলাম এমন কথায় । তবে কি এরা যুক্তি করে আমাকে চুক্তিবদ্ধ করতে চাইছে ! তা তো নয় । হতেও পারে না । কারণ এর পিছনে যে বড়দার হাত রয়েছে। যে বড়দা কেবলমাত্র আমার স্বপ্ন সাকার করতে নিজের স্বপ্নগুলো বিসর্জন দিয়েছেন । 

তিনি তো ইচ্ছা করলেই চাকুরী করতে পারতেন, আর দশ জনের মত ঘর সংসার বাঁধতে পারতেন । তা তো তিনি করেননি । তাহলে গোপা কি বড়দার ভরসায় নিজের অধিকার নিতে এসেছে ? ভালোই করেছে । আর কিছু হোক বা না হোক, এই বাড়ীতে অন্তত প্রাণচঞ্চল কোলাহল তো শুরু হল !

বললাম - হয়তো ভুলই করেছিলে তুমি । বিশেষ করে গায়ের জোর দেখিয়ে সবচেয়ে বড় ভুল করেছিলে। আচ্ছা, সেই একবারের দেখায় তোমার মধ্যে প্রেমের সঞ্চার কি করে হল ? আমার কেন হল না ?

গোপা বলল - তোমার সব প্রশ্নের যথাসঙ্গত উত্তর দেবার জন্যাই তো আমাদের এখানে আসা । নাহলে তুমিই বল; একটা মেয়ের জীবনের পরম প্রাপ্তি তো আমার হয়েই গেছে বুকুন পেয়ে । তথাপি মন মানেনি । আমি তোমাকে বাড়ীতে ডেকে এনেছিলাম তোমার রূপ দেখে নয় ; আমার এই দুই চঞ্চল চোখের দৃষ্টিতে তোমার একাগ্রতা আমাকে মুগ্ধ করেছিল । কারও দিকে না দেখে তুমি যে ভাবে পরীক্ষা দিচ্ছিলে , আমাকে লেখায় মন দেবার পরামর্শ দিয়েছিলে , আমি তখনই তোমার চারিত্রিক গুণাবলী দেখতে পেয়েছিলাম । কিন্তু আমার দাম্ভিক বাবা যে এমন কাজ করে বসবেন - আমি মোটেই বুঝতে পারিনি।

আমি মন দিয়ে গোপার কথাগুলো শুনছিলাম । মাঝে মাঝে বড়দার কলকাতা গমন নিয়েও চিন্তিত হয়ে পড়ছিলাম। 

গোপা বলল - আমার মা ছিলেন জিমে যাওয়া মেয়ে ; তবু তিনি নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি বাবার খপ্পরে পড়ে তাঁর ফোলানো বেলুন ফুটো হয়ে গেছল । তিনি নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়েছিলেন; অবশ্য আমিও তেমনি ...

গোপার দু'চোখ জলে ভর্তি হয়ে গেল । আমার হৃদয় আবার বড়ই কোমল । কারও চোখে জল দেখলে বুকে ব্যথা হয় । গোপা যাতে আর না কাঁদে বললাম - বুঝতে পারলাম তুমি ভুল করনি । নাটের গুরু তোমার বাবা লঙ্কেশ্বর ।

- লঙ্কেশ্বর !

দারুন কষ্টের মধ্যেও গোপা হাসল ।

- হ্যাঁ, লঙ্কেশ্বরই বটে । এই দেখ না কাউকে কিছু না জানিয়ে তিনি রাতেই হাওয়া হয়ে গেলেন । তবে কেউ জানুন বা না জানুন, আমি কিন্তু জানি, তিনি অকারণে চলে যাননি । এর পিছনে অবশ্যই কোন কারণ আছে ।

আমি তখন বললাম - তা'হলে বড়দাকে জানিয়ে দি ফিরে আসুন ।

- আমি তো অলরেডি বলেছি , তিনি কথা শুনলেন না। দাদা যখন গেছেন একটা কিছু বিহিত না করে ছাড়বেন না।

- আমিও তাই ভাবছি। সে না হয় হল , এখন তোমার কথা বল । 

- আমার কথা তো অনেক বলেছি । এবার তুমি বল কেন

বিয়ে করনি!

আমি একরকম হকচকিয়ে গেলাম। এর কি উত্তর দেব ভেবে পেলাম না। বললাম 

- যদি বলি ইচ্ছে করেনি ?

- বিশ্বাস হয় না ।

- যদি বলি মেয়েদের প্রতি একটা অনীহা কাজ করেছে ?

- তা'ও বিশ্বাসযোগ্য নয় । আমার মনে হয় একটিমাত্র মেয়েকে দেখে সকল মেয়ের প্রতি কারও আগ্রহ হারিয়ে যায় না । আমার ওপর বিতৃষ্ণা জন্মাতেই পারে; তার অর্থ এই নয় যে হব মেয়েদের উপর তোমার চাপা রাগ বা অভিমান ছিল। তাহলে সুনেত্রাকে বুকুন ভেবে এত উতলা হতে পারতে না ।

আমি বললাম - ইউ আর সামহোয়াট রাইট । সুনেত্রাকে আমি বুকুন ভেবেছিলাম । তারপর হিসেব করে দেখলাম ওর যা বয়স তাতে সে আমাদের সেই রাতের ফসল হতে পারে না । তাই বাধ্য হয়ে বড়দার শরণ নিলাম । তার ফলাফল তো হাতেনাতে পেয়ে গেছি ।

- যাক এবার আমি নিশ্চিন্ত হলাম , আমার দ্বিতীয়বার ভুল হয়নি।

জীবনে এই দ্বিতীয়বার আমি কোন মেয়ের উষ্ণতা অনুভব করলাম । যে উষ্ণতায় তাপ আছে কিন্তু উত্তপ্ত নয় । যে উষ্ণতা শরীর পোড়ায় না বরঞ্চ নাতিশীতোষ্ণ স্পর্শ বুলিয়ে দেয় ।

( চলবে )1


 -




--


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Crime