আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
অষ্টচত্বারিংশতি অধ্যায়
বীরেশ্বর রক্ষিতকে নিয়ে ওঁরা ফিরে এলেন মল্লিকপুরে। এর মধ্যে গাড়িতে বসে বীরেশ্বরের কথাবার্তায় আসল রহস্যের কারণটা বের করে নিলেন মিঃ রায়চৌধুরী।
বললেন - দেখুন মিঃ রক্ষিত ! একবার অসৎ কর্মে লিপ্ত হয়ে গেলে আর সৎপথে ফিরে আসা ভীষণ কঠিন। কারণ এই অন্ধকার জগত এক একটি কৃষ্ণগহ্বর যেখানে আলোও প্রবেশ করতে পারে না।
বীরেশ্বর বললেন - এই কারণেই আমি নিরুদ্দেশ হতে চেয়েছিলাম।
- এ ভাবে কতদিন থাকতে পারতেন ? একদিন না একদিন ঠিক ধরে ফেলত । তখন এই বয়সে সে ধকল সহ্য করতে পারতেন না । তার চেয়ে বলি কি , আপনি এবার শাসকদলের তোষামোদি ছেড়ে বিরোধী পক্ষে যোগ দিন।
- তা কি ভাবে সম্ভব ? আমার মত একজন কুখ্যাত অপরাধীকে কেই বা বিশ্বাস করবে?
- প্রথম দেখায় কেউই হয়তো বিশ্বাস করবে না । কিন্তু যদি শাসকদলের দুর্বলতাগুলো বলতে থাকেন তবে অচিরেই আপনি দলের মুখপাত্র হয়ে যেতে পারেন । আমাদের দেশে বহুদলীয় রাজনীতি প্রচলিত আছে । এবার আপনি অপরাধমূলক কাজকর্ম ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দিন। আপনার অন্তত প্রাণ সংশয় আর থাকবে না ।
- সেটা কি করে সম্ভব হয় বলুন ! আমি কোন রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ধরলাম আর তিনি আমাকে দলে টেনে নিলেন - এমন তো হয় না ।
- হয় । আপনি তো যথেষ্ট বুদ্ধি ধরেন । অন্তত আপনার কাজকর্ম তো তাই বলছে । অবশ্য শাসকদলের প্রশ্রয় পাওয়া আপনার প্লাস পয়েন্ট ছিল । তবে এখনও উপায় আছে।
বীরেশ্বর বললেন - কি রকম ?
- এখন কেন্দ্রে এবং রাজ্যে পরস্পর বিরোধী শাসক দল প্রতিষ্ঠিত । এতদিন তো রাজ্যের শাসকদলকে আনুগত্য দেখিয়েছেন; এবার উল্টোটা করুন । আর এ বিষয়ে আপনাকে হেল্প করবে আপনার নাতি বুকুন ।
বোধ করি কথাগুলো বীরেশ্বরের মনে ধরল । মুখে কিছু না বললেও বোঝা গেল তিনি বুকুনকে নিয়ে ইতিমধ্যে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন ।
বললেন - বুকুন যেন কি পদে রয়েছে বললেন ?
- ডেপুটি কমিশনার । পশ্চিমবঙ্গে যাদের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বলা হয় ।
- ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ! সে তো বিশাল ব্যাপার !
- বুঝতে পেরেছেন তা' হলে ? ওই বুকুনই পারবে আপনার ভবিষ্যৎ ঠিক করে দিতে । আমি বুকুনকে জানিয়ে দেব আপনার মনোবাসনা । আশা করি সে আমাকে নিরাশ করবে না ।
ট্রাক এসে দাঁড়াল মল্লিকপুরের বাড়ীর দরজায়। বীরদর্পে নামলেন মিঃ উৎসব রায়চৌধুরী । গাড়ি থেকে নেমে বললেন - ধীরে নামুন । পাদানি অনেক উঁচুতে তো ; পড়ে চোট লাগাবেন না যেন ।
তারপর বীরেশ্বরকে নিয়ে প্রবেশ করলেন অন্দরে । তেজপাল ও বাব্বন বলল - অব তো হমে যানে দিজিয়ে সাব । হমে ভি তো ঘর যানা হ্যায় !
মিঃ রায়চৌধুরী বললেন - আপলোগ ভি আইয়ে অন্দর । বাদমে দিখা যায়েগা কব আপলোগ লৌটেঙ্গে ।
আমি তখন বাড়ী ছিলাম না । বুকুনকে নিয়ে গ্রাম পরিদর্শণ করছিলাম । কখন ওঁরা এসেছেন জানি না । সংবাদ পেলাম গোপার ফোনে। তড়িঘড়ি সফর সংক্ষিপ্ত করে বাড়ী ফিরলাম ।
আমাকে দেখে তেজপাল সিং চেঁচিয়ে বলল - ওয়ে পাঁজি! হমারা তো কাম ধান্দা হ্যায় জী । মুঝে কিউ অটককে রাখ দিয়া ?
আমি বললাম - সর্দারজী , এমন একটা ঐতিহাসিক সময়ে আপনারা চলে যেতে চাইছেন কেন ? এখানে কি আপনাদের কোন অসুবিধা হচ্ছে ?
- অসুবিস্তা ? হো হো হো , ক্যায়া বোলতে হ্যায় দেখো। বাত তকলিফ কা নেহি, বাত হ্যায় কামধান্দা কা ।
আমি বললাম - বড়দা যখন ধরে রেখেছেন আমার কিছুই করার বা বলার নেই । তবু বলি আপনাদের যেটুকু ক্ষতি হচ্ছে তা সুদেমূলে পুষিয়ে দেওয়া হবে ।
তেজপাল জীবনে অনেকবার বাংলায় এসেছে। আমার কথা অনুধাবন করে তখনকার মত চুপ করে গেল । আমি এই আবার লঙ্কেশ্বরের সম্মুখে সাহস করে দাঁড়ালাম।
বুকুন বলল - দাদু, পালিয়েছিলে কেন ?
লঙ্কেশ্বর বললেন - ঘি হয়ে আগুনের সামনে থাকি কি করে বল দাদুভাই ! তবে তোমার জেঠুমণি যে খেলা দেখাচ্ছেন তা'তে ফাঁদে পা না দিয়ে উপায় নেই ।
বড়দা বললেন - এই ফাঁদই এখন আপনার রক্ষক ।অন্য কেউ আপনাকে বাঁচাতে পারবে না । যে ফাঁদে আপনি পড়ে আছেন সেখান থেকে উদ্ধার পেতে গেলে এই ফাঁদ আপনাকে গলায় পরতেই হবে । সে যাক ; বুকুন ! তোমাকে একটা কাজ করে দিতেই হবে ।
বুকুন বলল - এ ভাবে কেন বলছেন জেঠুমণি ? আপনার যে কোন কাজ আমি আদেশ মনে করে সাধন করব ।
- পাক্কা ?
- সেন্ট পার্সেন্ট । একবার বলেই দেখুন ।
আমি দেখলাম বড়দার প্রতি বুকুনের আনুগত্য । সে কথা গোপাকে জানাতেই সে তো খুশীতে উচ্ছ্বল হয়ে উঠল ।
বড়দা বুকুনকে বললেন লঙ্কেশ্বর সম্পর্কিত সকল কথা । বুকুন মন দিয়ে শুনল । আমি ভেবেছিলাম বুকুন আনন্দে নাচানাচি করবে । তা তো হলই না ; উল্টে তার চোখমুখ গম্ভীর হয়ে উঠল ।
- জেঠুমণি ! দাদুর বয়স হয়েছে । এখন আর সে চাপ কি নিতে পারবেন ?
লঙ্কেশ্বর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ।
- কি ভাবো আমায় দাদুভাই! আমি এখনও তোমার চেয়েও বেশী এনার্জেটিক ফিল করি ।
বুকুন বলল - তাই ?
- তা' নয় তো কি! একবার বলেই দেখ না করতে পারি কি না ?
বুকুন বলল - লেট মি ডিসকাস দ্য ম্যাটার উইথ কনশার্ণড পার্সন । তারপর জানাচ্ছি ।
বলে চলে গেল উপরে যেখানে ওর মা , মাসী এবং সুনেত্রা শিউলি, লাবণ্যদেবীরা আছেন ।
আমি বুঝে গেলাম গোপার অনুমতি বা পরামর্শ ছাড়া ও কিছু করবে না । বাধা দিলাম না শুধু লঙ্কেশ্বরের প্রতি অনুকম্পায় ।
শমন দমন রাবন রাজা এই লঙ্কেশ্বর। নিজের চোখে দেখেছি। কি প্রতিপত্তি ! হুংকারে ইট পাথরকেও নড়ে যেতে দেখেছি । আর সেই লঙ্কেশ্বরই কি না আজ আমার বড়দা ও ছেলের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। এ জন্যই হয়তো বলে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।
মিনিট কয়েক পর বুকুন নীচে নেমে এল । এসে জানিয়ে দিল জনৈক পলিটিক্যাল পার্সোনালিটির সঙ্গে প্রাইমারি কথা হল । আবারও রাত্রে কথা বলব ।
পুরো ব্যাপারটা আমার কেমন যেন হেঁয়ালি মনে হল । বড়দার সঙ্গে বুকুনের তেমন কথা তো হয়নি যে বুকুনকে কোন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে কথা বলতে হল । ব্যাপারটা বড় ইন্টারেস্টিং লাগল আমার । বুকুনকে বললাম - কি হয়েছে বল তো ?
বড়দা বললেন - পরে শুনবি ভাই । আর মিঃ রক্ষিত এবার তো নিজেকে একটু নর্মাল করুন !
তেজপাল ও বাব্বন দু'জনে পুকুরে গেছে স্নান করতে ।
বুকুন বলল - চলুন বাবা , আমরা পুকুরের দিকে যাই ।
বুঝতে পারছি ছেলে আমাকে বেশীক্ষণ অন্ধকারে রাখতে চায় না । কোন মন্তব্য না করে বুকুনের অনুগামী হলাম।
পুকুর ঘাটে গিয়ে দেখি দুই পাঞ্জাবি মিলে হাত পা ছুঁড়ে সাঁতার কাটছে ।
বুকুন আমাকে পাড়ের কৃষ্ণচূড়া গাছের তলিয় নিয়ে গেল ।
বলল - বুঝেছেন বাবা ! দাদু ভীষণ বিপদে পড়েছেন। পুলিশ ওঁকে গ্রেপ্তার করতে চাইছে। এখানকার সরকার তাঁকে দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাইছে । শাসকদল দৈনিক পাওনাগণ্ডার অংশ চাইছে । আর দাদু, এবার নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাইছেন ।
আমি বললাম - কোথায় গুটিয়ে নিচ্ছেন ? এ তো দেখছি এবার রাজনৈতিক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়বেন ।
- সেটাই তাঁর পক্ষে শুভ হবে । এ ছাড়া আর অন্য কোন উপায় নেই ।
আমি হাঁ করে বুকুনের কাছ থেকে লঙ্কেশ্বরের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা জেনে নিচ্ছি । সেই সঙ্গে আমাদের নিরাপত্তার দিকটাও ভাবছি ।
( চলবে )
