রমলা কি হেসেছিলো !
রমলা কি হেসেছিলো !
বসন্তের আবির্ভাব কতটা আনন্দের
কোকিলের মতো কেউ ব্যক্ত করতে পারে না ।
উচ্ছসিত কোকিলের কুহু কুহু ডাক
বার্তা বহন করে আনে বসন্ত এসে গেছে ।
বসন্ত এসেছে নব যৌবনের উন্মাদনা নিয়ে ;
সেই উন্মাদনার ঢেউ আছড়ে পড়ে
বাগানবাড়িতে বসবাসরত রাজার অন্তরে।
সুরেলী কোকিলের কুহু কুহু ডাকে
রাজামশায়ের তন্দ্রা ভঙ্গ হয় ।
স্বপ্নচারিনী কামিনীর অদৃশ্য আহ্বান
রাজামশায়ের পিপাসার্থ মনকে ব্যাকুল করে তোলে ।
এহেন সুরেলী কোকিলকে অন্তত একবার হলেও
কাছে পাওয়ার বাসনা রাজার অন্তরকে লালায়িত করে ।
একে একে পাইক, বরকন্দাজ, মন্ত্রী, উজির, সেনাপতি
সবাইকে ডেকে আদেশ দেন,
“যেভাবেই হোক কোকিলকে ধরে আনা চাই,
কোকিল আমার চাই ।”
রাজার আদেশ ফেলবার উপায় নাই ।
মন্ত্রী, সেনাপতি, আমলা, নকর-চাকর, কর্মচারী
সবাই ত্রস্ত-ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করে দিবারাতি;
পায়না কেউ টিকের নাগাল কোকিলের ।
সবার চাকুরী যাবে
যদি না পড়ে ধরা কোকিল কাল প্রত্যুষে !
বনে-জঙ্গলে, গাছের ডালে, পাহাড়ে
চলে অনুসন্ধান সর্বত্র কোকিলের ।
এক জলাশয়ের তীরে পুরানো বটবৃক্ষের ডালে
একটি কাকের বাসায় ছিল দুটি ডিম্ কোকিলের,
বোধ হয় একটি নষ্ট হয়ে গেছে অজ্ঞাত কারণে ।
কিছুদিন আগে অপরটি থেকে বাচ্চা বের হয়ে
কোনরকমে চিঁ চিঁ করে ডাকতে শিখেছে ;
মাঝে মধ্যে হাঁ করে ছোট ছোট চোখে তাকায়
মা কোকিল ভেবে কাকের মুখ থেকে
খাবার খায় কাকুতি-মিনতি করে ।
সবে একটু-আধটু পালক গজিয়েছে,
উড়তে শেখেনি ভালোভাবে ।
শরীরে যৌবনের ছোঁয়া না লাগায়
বসন্তের কোকিল হয়ে ডাকতে পারেনা ।
রাজামশায়ের শাগরেদরা চারিদিক দাপিয়ে
তন্ন তন্ন করে খোঁজবার পর
হঠাৎ দেখতে পেলো মা কোকিল
গাছের অন্য ডালে বসে আপনমনে ।
সাজ সাজ রব চারিদিকে,
যেভাবেই হোক কোকিলকে বন্দি করা চাই;
নতুবা আমাদের চাকরি যায় । ।
অনেক কসরত করবার পর ঠিক যখন
কোকিলটা হাতের নাগালে এসে গেছে
তখনই গেলো উড়ে প্রাণভয়ে সংশয়ে অনেক দূরে
ঘন জঙ্গলের কোনও এক প্রান্তে ।
হতোদ্যম হয়ে সবাই ভাবে মাথায় হাত দিয়ে
সেনাপতি দিলেন বিধান,
“উপায় বাঁচার একটাই
যেভাবেই হোক কোকিলকে ধরা চাই ।”
হেনকালে কাকের বাসায় বাচ্চা কোকিল দেখে
সেনাপতি ফেলেন ধরে হাতের মুঠোয়।
বাদ সাধলো অন্যান্য সবাই হাহুতাশ করে ,
এতটুকু বাচ্চা ডাকতে জানে না যে;
রাজামশাই রোজ গান শুনবে কিভাবে !
সেনাপতি গর্জে উঠে বলে,
“আজ নয় কাল গাইবে ও জরুর ;
চলো একে নিয়ে যাই রাজার কাছে ।”
বাচ্চাটা অনেক চেষ্টা করেছিল উড়ে গিয়ে
ওদের হাত থেকে বাঁচতে
কিন্তু ও তো কৈশোর অবস্থা পেরিয়ে
যৌবনে পদার্পন করেনি,
উড়ে পালাবার শক্তি কোথায় !
তাই নির্বাসিত হোল রাজার অন্দরমহলে
এক পিঞ্জরের মধ্যে ।
রাজার হুকুমে চলতে থাকলো শাগরেদদের
চব্বিশ ঘন্টা নজরদারি ।
সবাই প্রতীক্ষারত এই বুঝি কোকিলের মুখ থেকে
বের হবে কুহু কুহু ডাক ।
সময়ের আগে যেমন গাছে ফুল ফোটে না
গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, হেমন্ত, বসন্ত, শরৎ ঋতুরও
আবির্ভাব হয় না ;
ঠিক তেমনি কোকিল শাবকও
বসন্তের গান গাইতে পারেনা ।
একসময়ে রাজার ধৌর্যচ্যুতি হলে
সেনাপতি মহাশয় রাজাকে খুশি করবার তরে
গর্জে ওঠে বলে, "গাইবে না মানে ! আলবাত গাইবে।
আমি তৈরি করেছি বিশাল সেনাবাহিনী,
তারা সবাই শৃঙ্খলা পরায়ণ ।
আমার আদেশ পালন করে অক্ষরে অক্ষরে,
আর এ তো একটা সামান্য কচি মেয়েমানুষ ।
ওর বুলি আওড়াতে আর কতদিনই বা লাগবে !
আমার শিক্ষা-দীক্ষায় সবাই রপ্ত করে রণকৌশল,
আমিও ওকে শেখাবো কঠোর শাসন করে
কিভাবে রাজামশাইকে খুশি করতে হয় ।
আমার শাসনে ও শিখবে, জরুর শিখবে ।”
আঘাতে নির্যাতনে জর্জরিত হয়ে
প্রাণভয়ে চিৎকার করতে চাইলো রমলা !
বসন্ত তখনও রমলার জীবনে প্রবেশ করেনি ।
নারী আসক্ত পুরুষের মুখোশধারী কাপুরুষেরা
লালসাপূর্ণ নেত্রে তাকায় রমলার পানে ।
আঘাত ও যন্ত্রনায় কাতর রমলার দুচোখ বেয়ে
বিগলিত জাহ্নবীর অশ্রুধারা
গড়িয়ে পড়তে লাগলো অনবরত।
কিছু বলতে চাইলো হাঁ করে ।
ওরা অট্টহাস্য করে বলে, “ওই তো, ওই তো
কোকিল হাঁ করেছে,ও হাসছে
এবার মধুর সুরে গাইবে কুহু কুহু ।
ওর দাঁত চেপে কষ্ট সহ্য করাই
নরপিশাচদের কাছে হাসি ।
রমলা কি হেসেছিলো !