Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Sangita Duary

Tragedy Classics

3  

Sangita Duary

Tragedy Classics

মধ্যবর্তী

মধ্যবর্তী

11 mins
249



স্টেশন চত্বরের বড় মেডিসিন স্টোর থেকে ওষুধগুলো গুছিয়ে সানগ্লাস চোখে টানতেই রাতুল দেখলো রাস্তার ওপারে সুজয়ের টু হুইলার। হাত উঠিয়ে গলা তুললো রাতুল, "সুজয়...!"

সুজয় থমকেছে। অনেকদিন পর দুইবন্ধুর দেখা। বাইক স্ট্যান্ড করে সুজয় দৌড়ে রাস্তা পেরোতে যাবে, সামনে চলমান একটা গাড়ি। একটুর জন্য, উঃ!

রাতুলের কড়া ধমক, "উল্লুক, খালি গায়ে গতরে বেড়েছিস, দেখে রাস্তা পার হবি তো।"

সুজয়ের উদাস উত্তর, "ও কিছু হত না। তুই এখানে কি করছিস?"

-" সংসারী মানুষ ভাই, তোমার মত ভাগ্যবান সন্ন্যাসী তো নই, অনেক দায়িত্ব রয়েছে কাঁধে, মার প্রেসারের ওষুধ, বাবার ইনসুলিন, বউএর স্যানিটারি প্যাড আর, বাকিটা আমার!"

-" কেন তোর আবার কি হলো?"

-" বিয়ে হলো!"

-" বিয়ের সঙ্গে ওষুধের কি সম্পর্ক?"

-" বিয়ে না করলে বুঝবে কি করে সোনা, অবশ্য বিয়ে না করেও বোঝানো যায়, দেখবি?"

কালো প্লাস্টিকব্যাগ থেকে রাতুল কন্ডোমের বাক্সটা বের করতেই সুজয় রাতুলের পিঠে চড় কষায়, "ফাজিল কোথাকার, এত বয়স হলো, তুই কি কোনোদিন বদলাবিনা রে?"

- "দাঁড়াও বন্ধুবর, বয়স হলো মানে, কত বয়স আমার, এখনও আর একটা বিয়ে করতে পারি!"

- "আবার একটা বিয়ে! এলেম আছে তোর, দুই বউকে একসাথে...

-" দুই বউকে একসাথে কেন", রাতুল গলা নামায়, " একটাকে তোকে দিয়ে দেব, আরে তোর তো সেকেন্ডহ্যান্ড বিয়ার করার অভ্যেস আছে, মনে নেই, ক্লাস নাইনে পৌলমিকে ল্যাং মারতে, ও যেই তোর কাছে মিউমিউ করলো, তুই কেমন তরলধাতু হয়ে গেলি!"

সুজয় বিরক্ত, "থাম রাতুল, ওগুলো ছোটবয়সের ব্যাপার, তাছাড়া...

- "ক্ষেপে যাচ্ছিস কেন? ইয়ার্কি মারছি তো!"

- "সত্যিই তোর বউ তোকে সহ্য করে কিকরে!"

-" আরে বউ বলেই তো সহ্য করে, সব বউরাই আমার মতই ফাজিল হাজব্যান্ড এক্সপেক্ট করে। বিশ্বাস নাহয়, তুই বিয়ে করে দেখ, আমি বাজি রেখে বলছি, একবছর পর তোর বউ তোর সাথে আমার কম্পেয়ার করবেই করবে।"

সুজয়ের হঠাৎ মনে বিদ্রুপ জাগলো, "তার মানে অহনাও আমার সঙ্গে তোর কম্পেয়ার করে!"

কথাটা গভীর ভাবে নিলনা রাতুল, খেলাচ্ছলে বললো, "ঠিক, এটাতো ভেবে দেখিনি, দাঁড়া, বউকে ফোন করে জিজ্ঞেস করি!"

সুজয় অপ্রস্তুত, "কি পাগলামো করছিস, আমি তো এমনিই কথার কথা বলেছি, তাছাড়া অহনার মত মেয়ে কক্ষনো এরকম ভাবতেই পারেনা।"

রাতুলের ঠোঁটে আত্মতুষ্টি, খানিকটা উদাসও যেন, সুজয়ের পিঠ চাপড়ে বললো, "অহনাকে তুই আমার থেকেও বেশি চিনিস নারে? বাদ দে, অনেকদিন আসিসনি, চল বাড়ি চল, জমিয়ে আড্ডা দেবো"!

-" এই নারে আজ হবেনা..."

রাতুলের ফোনটা বাজছে, স্ক্রিনে অহনা। সুজয়কে দেখিয়ে বলল, "আমার বউ বললে যাবি তো?"

চোখটা পলকে স্থির হলো সুজয়ের। এমন কথা কেন বলছে রাতুল?

কয়েকটা কথা সেরে ফোনটা বাড়িয়ে দিল সুজয়ের দিকে, "কথা বল ,তোর বাইকটা আমি নিয়ে আসছি!"

- কেমন আছেন? অনেকদিন আসেননা!

- হ্যা, সময় পাইনা, রাতুলের সাথেও তো প্রায় মাস চারেক পর দেখা হলো।

- বন্ধুর সঙ্গেই তাহলে আজ আসুননা, রাতে একেবারে খেয়ে ফিরবেন।

- বেশ, রাতুলের সঙ্গেই আসছি তবে, ও আমায় ফোনটা ধরিয়ে রাস্তার ওপারে আমার বাইকটা....

কথাটা শেষ হলোনা, একটা আর্তনাদ।

ফোন ধরে সুজয় তাকালো সামনে, বাইকটা উল্টে আছে মাঝরাস্তায়। রাতুল কোথায়?

লরির নীচে রক্তমাখা কে ও?


****************************


ওটির সামনে লম্বা বেঞ্চিতে বসে আছে সুজয়, পাশে অহনা। আলুথালু বেশ। সুস্থ লোকটা দিব্বি বেরুলো সকালে ডাল ভাত খেয়ে, আজ বৃহস্পতিবার, নিরামিষ, একচামচ আরও আলুপোস্ত চেয়ে নিলো।

বিকেলবেলা ফোন... সুজয়ের সঙ্গে কথাও বলিয়ে দিলো... তারপর কি সব হয়ে গেল!

ওটির দরজা খুলল। ডাক্তার বেরিয়ে এলেন, "কেসটা ক্রিটিক্যাল, আমরা বোধহয়... আপনারা যদি কেউ..."

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই অহনা উদভ্রান্তের মত ভিতরে ঢুকলো, পিছনে সুজয়।

রাতুলের মৃতপ্রায় চোখ ইশারায় কাছে ডাকলো ওদের। নিজের ডান হাতের মুঠোয় ওদের হাত দুটো শক্ত করে ধরে কিছু একটা বলতে চাইলো যেন। তারপর... দৃষ্টি স্থির!

মাথার কাছে মনিটরে হৃদস্পন্দনের আঁকিবুকিটা হঠাৎ সমান্তরাল, লাবডুব শব্দটাও বিপ্..প্..প্..প্..প্...!

সাদা চাদরে ঢেকে গেল রাতুলের মুখ। করিডোরে রাতুলের মা শাপান্তর করছে অহনাকে,"ডাইনি, ও ডাইনি, বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আমার ছেলেটাকে খেলো!"

আঁচল খসে পড়লো অহনার। চৈতন্যহীন মাথাটা এলিয়ে পড়লো সুজয়ের কাঁধে।


*************

রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে রোজ ঠাকুরদালানে কিছুক্ষন বসেন সাধনা। আজও বসেছেন। এইখানটায় বসে বাড়ির ঘরগুলো সারসার দেখা যায়। ওই তো দক্ষিণের ঘরটা, সুজয়ের। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে যখন স্বামীকে হারালেন সাধনা, তখন থেকে তাঁর একমাত্র অবলম্বন তো তার ছেলেই। ছেলেকে ঘিরেই তো তাঁর সবকিছু। সেই ছেলেই যখন ভেতরে দুমড়ে মুচড়ে যায়, মা হয়ে ছেলের কষ্ট কি সওয়া যায়!

ভিন্ন একটা দৃশ্য ভেসে আসে সাধনার চোখে।

সাদা ক্যানভাসে ধূসর রেখায় ফুটছে একটা অবয়ব, সামনে সুজয়, একমনে পেন্সিল চিবচ্ছে, আঁচড় টানছে, আবার পেন্সিল মুখে পুরছে। ধীরে ধীরে রূপ পাচ্ছে একটা মেয়ে, দীঘল চোখ, তীক্ষ্ণ নাক, ঠোঁটে ভুবন ভোলানো হাসি!

মাকে দেখেই ছেলের গাল লাল।

সাধনা জিজ্ঞেস করেন ছেলেকে, "কোথায় পেলি একে?"

ছবিতে মগ্ন সুজয় বলে, "পাইনি তো, শুধু দেখেছি, রোজ সত্তর সি ধরে, ঠিক সকাল দশটায়।"

সাধনা প্রমাদ গোনেন, "নাম কি রে, থাকে কোথায়? জানিস, নাকি মুখটা দেখেই মূক হয়ে যাস?..."

ঠিক সেই সময় রাতুল আসে, "কই দেখি দেখি, আমিও দেখি, শিল্পীর শিল্পটিকে!"

সুজয় বাধা দেয়, "খবরদার, আগে আমার নামে চাল তোলা হোক, তুই আশীর্বাদী গয়না নিয়ে পরে দেখতে আসিস!"

হোহো হেসে ওঠে সবাই। সুজয়ের পিঠ চাপড়ে রাতুল বলে, "বেশ, তাহলে কালই চল আমার চালের ব্যবস্থা করতে!"

-মানে?- সুজয়, সাধনার চোখে জিজ্ঞাসা।

মাথা চুলকে রাতুল বলে, "ইয়ে, কাকীমা, কাল সুজয়কে একটু নিয়ে যাবো, পাত্রী দেখতে! আসলে মা আজকাল এতো ঘ্যানঘ্যান করছে!"

সাধনা ঠোঁট টিপে হাসেন, "হয়েছে, নিজের তীব্র ইচ্ছেটা আর মার ঘাড়ে চাপতে হবেনা!"


রাতুলের পাত্রী দেখে আসার পর, সুজয় কেমন মনমরা হয়ে গেল যেন। দিন নেই, রাত নেই, ছবিটার দিকে নিস্পলক তাকিয়ে থাকে, জিজ্ঞেস করলে কিছু বলেনা।

রাতুলের বিয়ের দুদিন আগে হঠাৎ ব্যবসার কাজে বাইরে চলে গেল।

সাধনা একাই গিয়েছিলেন রাতুলদের বাড়ি। নতুন বউএর মুখ দেখেই চমকে ওঠেন। আর বুঝতে বাকি রইলনা, সুজয়ের শুকিয়ে যাওয়ার কারণ।

বুকটা ধড়াস করে উঠলো সাধনার। অহনাকে তিনি পছন্দ করেছিলেন, সেই সুজয়ের হাতে আঁকা পোট্রেট দেখেই, মনেপ্রাণে চেয়েও ছিলেন, এই মেয়েই তাঁর বাড়ির বউ হয়ে আসুক, রাতুলের সঙ্গে অহনার বিয়ে হওয়ায় ছেলের কষ্টে তাঁর মনটাও উঠালপাতাল হয়েছিল। তবে রাতুলের এরকম পরিণতি সাধনা যে অবচেতনেও চাননি! রাতুল তো তাঁর কাছে তাঁর সুজয়েরই সমান।

আর এক দৃশ্য; রাতুলের দাহকার্য সম্পন্ন হওয়ার পর, বধির অহনার প্রতি অন্দর থেকে রাতুলের মার হুংকার, "রাক্ষুসী, সব ওর ঢং, আমার ছেলেকে খেয়ে মৌনী নিয়েছে, আর কাকে খাবি রে হতচ্ছাড়ি!"

শিউরে ওঠেন সাধনা, বৈধব্যের যন্ত্রনা তাঁর চেয়ে বেশি কে জানে?


******************


"বেরোচ্ছিস নাকি?"- জলখাবারের থালা হাতে সাধনা ছেলের ঘরে ঢুকলেন।

সুজয় শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বললো, "হ্যা মা, ভাবছি একবার অহনাদের বাড়ি যাবো। রাতুলের কাজের পর থেকে তো আর সেভাবে যোগাযোগ হয়ে উঠলোনা!"

রুটির টুকরোয় সবজি ভরে ছেলের মুখের সামনে ধরলেন সাধনা, "ওর বাবামারও তো বয়স হয়েছে! শুধু ফোনে খবর নিলেই যে চলেনা বাবা, সেদিন রাতুলের মা রাতুলের কাজের দিনেও যা ব্যবহারটা করলো মেয়েটার সাথে! বড় ক্ষতি যা হওয়ার, তাতো মেয়েটারই হয়েছে!"

-" শুধু ব্যবহার? দেখোনি, কেমন রাতুলের সমস্ত ইনশরেন্সের কাগজে অহনার সই নিয়ে নিল!"

-" তাইবলে কিচ্ছু দেবেনা ওরা মেয়েটাকে? একটা দুর্ঘটনা, তাতে মেয়েটার কি দোষ?"

পলকের জন্য সুজয় উদাস, "রাতুল আমার জন্যই মরে গেল, না মা?"

সুজয়ের চোখে জল চিকচিক করে উঠলো। সাধনা ছেলের মাথায় হাত রাখলেন, "কষ্ট পাসনা বাবু, ভাগ্যের ওপর আমাদের কোনো জোর নেই, তুই তো নিমিত্ত মাত্র!"

সুজয় উত্তেজিত, "তাহলে সেই ভাগ্যটাকেই না মেনে ওরা অহনাকে অপয়া সাজাচ্ছে কেন? এই আমি, আমার সঙ্গে যদি সেদিন রাতুলের দেখা না হতো, রাতুল বেঁচে থাকতো, অহনাও ওবাড়ির লক্ষ্মীই হয়ে থাকতো আগের মতোই! আমার জন্য...."

সুজয় নিজের চুল খামচে ধরেছে, "অহনার মুখোমুখি হতে ভয় করে আমার মা, ওর চোখের দিকে তাকাতে পারিনা। 

মুখে কিচ্ছু বলেনা মেয়েটা, কোনো দোষারোপও করেনি আমায়, কিন্তু ওর এই মৌনতাই যে আমি সইতে পারিনা। এর বদলে ও যদি আমার গালে দশটা থাপ্পড় মারতো, আমি শান্তি পেতাম, মা।

ওর এই বেশ আমায় কুরে কুরে খায়, ভালো তো বাসতাম ওকে, এখনও বাসি, হয়তো যতদিন বাঁচবো, ততদিনও...

কিন্তু বিশ্বাস করো, রাতুলের এই পরিণতি আমি কোনোদিন চাইনি, অহনার থেকেও আগে রাতুল যে আমার বন্ধু। আমি যে ওদের সুখী দেখতে চেয়েছিলাম মা!"

সাধনা দুই হাতে ছেলেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন, "চুপ কর বাবু, চুপ কর। একবার ভাব তো, এইসময় ওদের পাশে দাঁড়ানোর কে আছে?

দেখ, তাকা আমার দিকে, তুই আমার ছেলে, মিথ্যে আত্মগ্লানিতে ভুগে তুই কাপুরুষের মত লুকিয়ে থাকবি?

সেদিনও তুই লুকিয়েছিলি বাবু, রাতুলের কথা ভেবে আমি তোকে কিচ্ছু বলিনি, আজ বলছি, রাতুলের কথা ভেবেই বলছি, তুই যা অহনার কাছে, এটা তোর মায়ের আদেশ!"


****************


আজকাল ভোররাতে ঘুম ভেঙে যায় অহনার। বিছানায় আলস্য শুয়ে থাকতেও ইচ্ছা হয়না। পাতলা একটা শাল জড়িয়ে বাড়ির সামনে ফাঁকা জায়গাটায় একটু হেঁটে বেড়ায়, দেখে ভোরের শহর, শেষ ঘুমের রেশ মেখে নিশ্চিন্ত। দুএকটা তারা ফুটে থাকে কালো আকাশে। ছোটবেলায় ঠাকুমা বলতেন, মানুষ মরে তারা হয়ে যায়। আজগুবি!

তারা না হলেও রাতুল কি সেই তারার দেশ থেকে দেখতে পায় অহনাকে? অহনার বর্তমান ভবিতব্যকে?

দেখে কি কষ্ট পায় রাতুল? নাকি আত্মতুষ্টি আসে, তার অতীত মেখে অহনা আজ কলঙ্কিত বলে!

রাতুলটা বরাবর বেপরোয়া ছিল, ছুটিছাটায় হুটহাট বেরিয়ে পড়া, সারাদিন মস্তি, খাওয়া দাওয়া, জীবনটা একটাই, সেটাকে কানায় কানায় চুমুক দিয়ে গিলতে হয়!

কোনোদিন অহনার কথা বোঝেনি, তার এই উচ্ছ্বলতায় অহনার মত নাও থাকতে পারে, মাঝরাতে উদ্দাম আদরখেলায় অহনার ইচ্ছে নাও থাকতে পারে! রাতুল ভাবতো, নিজের ভালোথাকা দিয়েই অহনাকে সুখী করবে। পেরেছিল কি?

সেই অহনা, যে কিনা বাসরাস্তার একটা নামহীন ছেলের মূক চাহনীতে আটকে থাকতে পারে, তার কি রাতুলের দুরন্ত প্রেম সহনশীল হয়?

প্রথম যেদিন অহনাকে দেখতে এসেছিল রাতুল, সুজয়কে সঙ্গে নিয়ে, অহনা সুজয়কেই পাত্র ভেবে লজ্জাবনত হয়েছিল, ভুল ভাঙতে আকুতি মাখা চোখে তাকিয়েছিল সুজয়ের দিকে, না সেই মুগ্ধ মূক চাহনির লেশমাত্রও ছিলোনা তখন।

অহনা মানিয়ে নিয়েছিল, নিজেকে, রাতুলের দারুন জীবনের সঙ্গে।

রাতুল কি বুঝেছিল অহনার এই দ্বিচারিতা! নাহলে সুজয়ের কথা উঠলেই সন্দিগ্ধ দৃষ্টে তাকাতো কেন অহনার দিকে? কেন সেদিন হঠাৎ বলে ফেললো, "সুজয় আর তুমি একইরকম আর্ট ফিল্ম, কোনো মশলা নেই, সেন্টিমেন্টের গাদাগাদি! নীরব চাহনি! কামওন বেবি, ড্রিংক লাইফ টু দ্য লিজ"- বলেই চকাস চুমু খেল অহনাকে।

সত্যিই! স্মৃতি বড্ড বেইমান, ভালোর থেকে খারাপটাই সেঁটে রয়ে যায়, নাহলে যে মানুষটা আজ আর বেঁচেই নেই, তার ভালগুলোর থেকেও খারাপগুলো এখনো এতো প্রকট থাকে কি করে!


একটু একটু আলো ফিরছে পৃথিবীতে। অহনা ঘরের দিকে পা বাড়ায়। চেনালোক তাকে দেখে হাহুতাশ করুক, তার ললাটলিখন নিয়ে আহা:উহু: করুক, এ অহনার মোটেই পছন্দ নয়।

পাশের ঘরে বাবামা ঘুমোচ্ছে। অহনা স্নানে যায়, শীত করছে, করুক, তবু মনখারাপ ধুয়ে ফেলতে হবে। 

ধোওয়া কি সম্ভব?

এবাড়িতে বিশেষ কোনো কাজ নেই অহনার, বলা ভালো কোনো কাজ করতে দেওয়া হয়না অহনাকে।

অথচ বিয়ের আগেই এই কাজ নিয়েই মা কতো বকাঝকা করতো তাকে, "শুধু বই মুখে পড়ে থাকলেই চলবে? যতই বিদ্যেবতী হও, শ্বশুরবাড়িতে খুন্তিটি কিন্তু নাড়তেই হবে, নে নে, আজ মাছের ঝোলটা রাঁধ দেখি!"

মৃদু হাসে অহনা।

অহনা চায়নি, এতো তাড়াতাড়ি বিয়েটা করতে, আরো কিছুটা সময়, সবে তো গ্রাজুয়েশন শেষ হলো। চাকরিবাকরি কিছু একটা... তাছাড়া রোজ বাসস্ট্যান্ডে এক অপরিচিতের মুগ্ধ চাহনি, কিছু বলেনা, পিছুও নেয়না, শুধু চেয়ে থাকে,আর ওই চেয়ে থাকার মাঝেই অনেক কিছু বলা হয়ে যায়!

বাসে উঠে ভিড়ের মাঝে অহনা লুকিয়ে দেখে ছেলেটিকে, ছেলেটি জানতেও পারেনা, পথভোলা নয়নে কেবল বাসটার চলে যাওয়া দেখে।

আরো কিছুটা সময়ের প্রয়োজন ছিল ওদের।

কিন্তু তার মাঝেই যে চলে এলো রাতুল।

অহনাকে মেনে নিতে হয়েছিল, যে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে না, সে ভালোবাসা সঠিক স্বীকৃতিও পায়না, কেবল মনের গহীনে লুকিয়ে থাকে প্ৰথম বৃষ্টিফোঁটার মুগ্ধতা নিয়ে, প্রথম বসন্তের মনকেমন নিয়ে।

সুজয়ের কথা উঠলেই অহনার বুকটা ঢিপঢিপ করতো, তিরতির কাঁপতো চোখের পাতা।

ভিন্ন মানুষের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও যদি ভালোলাগার মানুষটা জড়িয়ে থাকে পরিবারের সঙ্গে, প্রায়শই শুনতে হয় তার নাম, চর্চা, তবে কি তাকে ভোলা সম্ভব?

অহনা জানতো, ওটা অন্যায়, স্বামী থাকতেও পরপুরুষে আকর্ষণ!

অহনা জানে, এটাও অন্যায়, সদ্য স্বামীহারা হয়েই অন্য পুরুষের স্মৃতিচারণ!

বহু দাম্পত্যে ভালোবাসার সূক্ষ্ম অনিভুতির চেয়েও কর্তব্যের শক্ত শিকলের মূল্য অনেক বেশি।

অহনা তো এই নীতিতেই ভালোবসেছিল রাতুলকে, তার স্বামীকে, আজও সেই নীতিতেই ভালোবাসে, ভবিষ্যতেও... ভালোবাসতে... হবে!


********************


কলিং বেলের আওয়াজে দরজা খোলে অহনা। সাধনা দাঁড়িয়ে, অহনাকে দেখেই হাহা করে ওঠেন, "একি চেহারা করেছ নিজের? এভাবে নিজেকে কেউ শাস্তি দেয়!"

বসারঘরে বেতের চেয়ারে বসে অনেক্ষন অহনার দিকে নিস্পলক তাকিয়ে থাকেন সাধনা।

ব্রাউন পেপারের মোড়ক খুলে বের করলেন একটি ছবি, মেলে ধরলেন অহনার সামনে, "চিনতে পারো ছবির মেয়েটাকে? এই মেয়েটিকে আমার ছেলে ভালোবাসতো, এখনও বাসে, এই মেয়েটিকেই। কোনোদিন বলতে পারেনি আগে, নিজের হাতে মেয়েটির ছবি এঁকে আমায় দেখিয়েছিল। তারপর, যখন জানলো, ওর খুব কাছের বন্ধু রাতুল এই মেয়েটিকেই বিয়ে করছে, খুব কষ্ট পেয়েছিল। চোখের জল বুকের ভিতর লুকিয়ে ফেলেছিল, কাওকে বুঝতে দেয়নি। সুখী হয়েছিল ওদের সুখী হতে দেখে।

আমার ছেলেটা আর এই মেয়েটিকে দেখতে পায়না জানো, বদলে নির্জীব লাশ দেখে একটা, ও ভয় পায়, ভাবে মেয়েটির এই অবস্থার জন্য ওই দায়ী। তোমারও কি তাই মনে হয়, অহনা?"

অবাক চোখে অহনা দেখছে আর এক অহনাকে।

সাধনা নিজের হাতের মুঠোয় অহনার হাত নিলেন, "বাবুর মুখে শুনেছি, মারা যাওয়ার আগে রাতুল তোমাদের দুজনের হাতদুটো ধরে কিছু বলতে চেয়েছিল!"

অহনার হাত ছেড়ে যেন স্মৃতিতে ভাসলেন সাধনা, "রাতুলের মা বরাবর একগুঁয়ে, হাজার একটা বিধিনিষেধ, নিয়ম, সংস্কার! রাতুল তাই প্রায়শই আমার কাছে চলে আসতো, বায়না করতো... কাকিমা, মাংসের বড়া বানাও, মাছের চপ বানাও...

সুজয় আর রাতুলের মধ্যে আমি কোনদিন বিভেদ করিনি, রাতুল যে সুজয়ের মতোই আমার আর এক ছেলে! আমার সেই ছেলে আর নেই। আমার অন্য ছেলেটি তার জন্য নিজেকে দায়ী করে!" সাধনা আবার জড়িয়ে ধরেন অহনার হাত, "তুমি পারোনা মা, সুজয়কে তার এই বিবেকদংশন থেকে মুক্তি দিতে?

হয়তো রাতুলও এটাই চেয়েছিলো!"

অহনা অপরাধীর মত বলে, "কিন্তু আমি যে অপয়া, ঐবাড়িতে মা...!"

সাধনা থামিয়ে দেন অহনাকে, "যে যা বলে বলুক, চোখের সামনে আমি আমার ছেলেকে এভাবে বারবার কষ্ট পেতে দেখতে পারবোনা, তাতে সবাই যদি আমায় স্বার্থপর ভাবে, ভাবুক। আমি শুধু তোমার মতামত নিতে এসেছি অহনা, বলো, বলো..."!


********************

আজ অনেকদিন পর আবার অহনা সুজয় মুখোমুখি। না, কোনো বাসস্টপ নেই, নেই বাসে ওঠার তাড়া, নেই ভিড় ঠেলে সামনে চায়ের দোকানে বেঞ্চিতে বসে থাকা ছেলেটাকে চুপিচুপি দেখা, ছেলেটার চোখের মুগ্ধতা শরীরে মেখে গালের টোলে গোলাপি রং আনা।

অহনার ঘরের দক্ষিণদিকের জানলার সামনে দাঁড়িয়ে ওরা দুজন। কেউ কোনো কথা বলছেনা, বাইরে কৃষ্ণচূড়া গাছটা ফুলেফুলে লাল, হয়তো তাকিয়ে আছে সেই দিকে!

কিংবা ওই যে গাছের ডালে একটা মা পাখি সদ্যোজাত ছানাদের ঠোঁটে করে পোকামাকড় খাওয়াচ্ছে পরম মমতায়, হয়তো সেই দিকে!

সুজয়ের মনে একটা ইচ্ছে ডানা ঝাপটায়; ফাল্গুন বিকেলে অহনা বসবে ওই কৃষ্ণচূড়ার নীচে, খোঁপায় থাকবে পলাশ, মুগ্ধ সুজয় পেন্সিল স্কেচে বারবার চেষ্টা করবে অহনার সৌন্দর্য্যকে বাঁধতে, বিফল হবে, ওপর থেকে কৃষ্ণচূড়া পড়বে অহনার আঁচলে টুপটাপ, অহনা আরও আরও আরও সুন্দর হয়ে উঠবে, সুজয়ের সাধ্য কি অহনার রূপকে রেখায় টানবে!

আচ্ছা, রাতুলও কি অহনাকে নিয়ে এমনটাই ভাবতো? কথাটা মনে আসতেই বুকের বাঁপাশটায় চিনচিনে ব্যাথা!

নাহ! আর অতীতে ফিরবেনা সুজয়। নতুন করে বাঁচবে অহনাকে নিয়ে, ভালোবাসায় ভরিয়ে দেবে অহনাকে প্রতিদিন, রাতুলের থেকে অনেক অনেক বেশি!

আশ্চর্য্য! রাতুল আবার ফিরে আসছে সুজয়ের স্বপ্নযাপনে!


আড়চোখে পাশে সুজয়কে একবার দেখে নেয় অহনা, সেই কখন থেকে বাইরে তাকিয়ে আছে। অহনার কি আগে কথা বলা ঠিক হবে! সেই অর্থে অহনা তো ভালোকরে চেনেইনা সুজয়কে। বাসস্টপে দুমিনিটের বাসন্তিক হওয়া আর সারাজীবনের ঝড়ঝাপ্টা কি এক হলো?

বিগত কয়েকমাসে রাতুলকে খানিক চিনেছিল অহনা, সুজয় কি রাতুলেরই মত!

অবশ্য কে কার মত তাতে অহনার সত্যিই কোনো যায় আসে কি? নারী জন্মটাই তো মানিয়ে নেওয়ার, মেনে নেওয়ার।

অহনা মনে মনে হাসে, আগে রাতুলের সাহচর্যে যখন নাভিশ্বাস উঠতো, সুজয়ের মুখটা মনে পড়তো খুব।

ভবিষ্যতে সুজয়ের সাহচর্যও যদি রাতুলের মতোই হয়, কাকে ভাববে অহনা? রাতুলকে?

নিজেকে ধমকায় অহনা, মা তো বলে, যা হয় ভালোর জন্যই হয়, ওদের আগত ভবিষ্যতে সবাই ভীষণ খুশি, নিশ্চয়ই সব ভালোই হবে তাহলে।

সুজয়ের সঙ্গে দিনযাপনে, রাত্রিযাপনে যদি সুজয় আর রাতুলের মধ্যে পার্থক্যটা ধরা দেয় অহনার মননে বারবার, সেটাও কি ভালোরই লক্ষণ?

একইসঙ্গে দুটি সত্ত্বা পোষণ করতে হবে অহনাকে আবার, আগের মতো?


********************


ম্যারেজ রেজিস্টার এসেছেন, আজই তাদের লিখিত বিয়ে হওয়ার দিন। সুজয় নিজের ডান হাত বাড়িয়ে দেয় অহনার দিকে। স্নিগ্ধ হেসে অহনা বামহাতে ধরে সুজয়ের হাত।

এগোতে গিয়ে পাশের টুলে হোঁচট খায় অহনা, টুল নড়ে ওঠে, ওপর রাখা রাতুলের ছবিটা পড়ে যায় মাটিতে। কাঁচ ভেঙে চৌচিড়।

সুজয় অহনার মাঝখানে রাতুলের ভেঙে যাওয়া অস্তিত্ব!

অহনা কাঁচ তুলতে যায়, আঙ্গুল কেটে রক্ত ঝরে। সুজয় সন্ত্রস্ত হাতে চেপে ধরে অহনার আঙ্গুল।


কাঁচহীন ফ্রেমে রাতুলের হাসি মুখটা আরও ঝকঝকে, মেঝের ওপর শোয়ানো, সুজয় অহনার মাঝখানেই!!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy