Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Sourya Chatterjee

Classics Others

4.5  

Sourya Chatterjee

Classics Others

ফড়িংয়ের ড্রাইভার

ফড়িংয়ের ড্রাইভার

6 mins
285


পার্কিং স্পেসে গাড়িটা নিয়ে ঢুকে থামল রাকেশ। প্রতিদিনকার মতোই দম্ভ আর অহংকারের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে গাড়ির দরজাটা সশব্দে বন্ধ করলেন শুভাশিসবাবু। গাড়িটাকে খুব ভালোবাসে রাকেশ, তার আপন বলতে তো এই গাড়িটাই শুধু। যখন দরজাটা সশব্দে বন্ধ হয় , রাকেশের মনে হয় কেউ যেন ঠিক তার বুকের পাঁজরে আঘাত হানছে। কষ্ট হয় রাকেশের। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয় "স্যার, এভাবে দরজাটা বন্ধ করবেন না। কষ্ট হয় গাড়িটার। কষ্ট হয় আমার।"


কিন্ত বলতে আর পারে কই। থাক না, তাও তো চাকরিটা আছে। মাস গেলে পয়সা তো পাচ্ছে। তার থেকে বরং একটু বেশিই যত্ন নেবে গাড়িটার, রোজগারটা তো থাকুক।


রাকেশ কলকাতায় একাই থাকে। একটা ভেন্ডার কোম্পানির কাছ থেকে কন্ট্রাক্টচুয়াল বেসিসে শুভাশিসবাবুকে সোম থেকে শুক্র পিক-আপ আর ড্রপের দায়িত্ব পেয়েছে। তাছাড়া টুকটাক এদিক সেদিক ভাড়া খেটে যতটুকু রোজগার হয় আর কি! এভাবেই দিন কাটে।


স্যার কে অফিস থেকে আনতে সন্ধ্যে ৬টা বাজতেই আবার রওনা হল রাকেশ। রাস্তাঘাটের যা অবস্থা! আজ এখানে জ্যাম তো কাল ওখানে অবরোধ। স্যারের কাছে পৌঁছাতে দেরি হলে স্যার খুব রাগারাগি করেন। তার চেয়ে আধ ঘন্টা আগে গিয়ে ওখানে অপেক্ষা করা অনেক ভালো। আরো বেশ কিছু ড্রাইভার রাকেশের মতোই ওখানে ডিউটি করে বটে, কিন্তু রাকেশের সাথে তেমন বন্ধুত্ব হয় না তাদের। 


বিল্টুর চায়ের দোকানে পাঁচ জন ড্রাইভার বসে তাস খেলতে খেলতে আড্ডা জমিয়েছে। রাকেশ ওরম ধাঁচের নয় ঠিক। দোকান থেকে চা-বিস্কুট খেয়ে আরো কিছু বিস্কুট কিনে তখন সে লালু কালু ভুলুদের সেই বিস্কুট ভাগ করে দিতে ব্যস্ত। রাস্তার কুকুরগুলোও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে রাকেশের জন্য। রাকেশকে দেখলেই লেজ নাড়িয়ে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটায় তারা। স্বার্থপর শহরের ছোট্ট এক প্রান্তে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার আদানপ্রদান চলে তখন।


শুভাশিসবাবুর অফিস থেকে বেরোতে অন্যদিনের থেকে একটু বেশি দেরি হলো আজ। রাত বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে জ্যামটাও বেড়েছে। শুভাশিস বাবু বিরক্ত হচ্ছেন বেশ, আর তার রেশ গিয়ে পড়ছে রাকেশের উপর।

-   ভাই, একটু স্পীডে চালাও রাকেশ। পাশের গাড়িটা পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলো। তুমি এগোতে পারলে না! 


-   চেষ্টা করছি স্যার।

রাকেশ যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি গাড়িটাকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে। বড় রাস্তা ছেড়ে একটা পাড়ার মধ্যে গাড়িটা নিয়ে ঢোকে রাকেশ। একটু শর্টকাট হয়, তাছাড়া জ্যামটাকেও এড়ানো যাবে। রাস্তার আলোগুলো জ্বলছে না, লোডশেডিং সম্ভবত। হঠাৎ একটা বাচ্চা কুকুর কোথা থেকে যেন ছিটকে গাড়ির সামনে চলে এলো। সঙ্গে সঙ্গে জোরে ব্রেক চাপলো রাকেশ। শেষ রক্ষা হল না। ভয়ংকর জোরে মৃত্যুমুখী সারমেয়র চিৎকার আর তারপর-ই মুহূর্তে সব শুনশান। শুভাশিসবাবুর অফিসের সামনের কুকুরগুলোর মুখ মনে পড়ে রাকেশের। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায় ও। রক্তমাখা নিথর দেহটা পড়ে রয়েছে তার চাকার সামনে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে রাকেশের।

কোথা থেকে পাড়ার কিছু ছেলে জড়ো হয়। শুভাশিসবাবুও গাড়ি থেকে নামেন, চোখেমুখে ক্রোধের ছাপ।


-   এই, প্রথম দিন থেকেই এত রাফ গাড়ি চালাও। কিছু বলিনা বলে মাথায় চড়ে বসেছ। নাকি! 

পাড়ার একটা ছেলে রাকেশের কলার চেপে ধরে


-   এই রাস্কেল! লাইসেন্স দে। তাছাড়া গাড়ি ছাড়ব না।


বাদিক থেকে একটা ছেলে এসে সপাটে থাপ্পড় মারে রাকেশকে। ওরা গাড়িতেও পদাঘাত করতে থাকে। অসহায় রাকেশ মার খেতে খেতে সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করে "এটা একটা দুর্ঘটনা।" কেউ শোনে না। উল্টে আরো মার খায় রাকেশ। হাত জোড় করে ক্ষমা চায় রাকেশ। কিন্তু জনগণ তখন গণপিটুনির নেশায় মেতেছে। একজন মধ্যবয়সী লোক অবশেষে থামতে বলে উত্তপ্ত জনতাকে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে রাকেশ। চোখের পাশ থেকে টপটপ করে রক্ত পড়ছে তখন তার।


-   এই শোন্, আজকের পর থেকে আর গাড়ি চালাবি না।


মাথা নিচু করে সম্মতি জানায় রাকেশ। 


-   রাস্তা টা কে পরিষ্কার করবে এখন। তোর বাবা? শোন বে, তোর গাড়িতে তুলে দিচ্ছি মরা কুত্তাটাকে।

হাত জোড় করে রাকেশ অনুরোধ করে


-   আমি স্যারকে ড্রপ করে এসে পরিষ্কার করে যাই! হবে?

-   আমরা ঘাসে মুখ দিয়ে চলি! কি মনে হয় তোর? তুই আবার আসবি?

-   বিশ্বাস করুন। আসব।


শুভাশিসবাবু গলা খাকরিয়ে বলে ওঠেন


-   নাটক করিস না। 

মুহূর্তে 'তুমি' থেকে 'তুই' হয়ে যায় সম্পর্কটা। রাকেশ বুঝতে পারে শুভাশিসবাবুও জনতার দলেই ভিড় জমিয়েছেন। উনি বলে চলেন


-   এখন কুত্তা মারছিস! একটু পর তো আমায় মারবি! কি ভেবেছিস! আমি আর তোর গাড়িতে উঠব! উবের নিয়ে নিচ্ছি। আর তোর ব্যবস্থা হচ্ছে। কলকাতার বুকে কি করে আর গাড়ি নিয়ে বেরোস আমি দেখবো।

ততক্ষণে পাড়ার ছেলেগুলো কুকুরের দেহটাকে গাড়ির পেছনের সিটে তুলে দিয়েছে। নির্বাক দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাকেশ। কখন যে চোখের কোণ থেকে ঝরা রক্তে চোখের জল মিশে গেছে টের পায়নি সে। আস্তে আস্তে ফাঁকা হতে থাকল জায়গাটা। একফালি চাঁদের কিরণ গাড়িটার উপর ঠিকরে পরছে। লজ্জা, দুঃখে, অপমানে মুখ নিচু করে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে রাকেশ।

ভেন্ডার কোম্পানিটা থেকে প্রত্যাশিতভাবেই ফোন এল। কাল থেকে আর চাকরিটা নেই। ঘরে ফিরে আসার রাস্তায় ময়দানের পাশে গাড়িটা নিয়ে একটু থামল রাকেশ। বারবার ঘটনাগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে! এসব কিছুই হত না যদি দুর্ঘটনাটার পর স্পীডে গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে যেত। অন্য ড্রাইভার হলে অবধারিত তাই করত! দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাকেশ।

গাড়ির পেছন থেকে কিসের একটা শব্দ শোনা গেল। ভেতরের আলোটা জ্বালিয়ে রাকেশ দেখল একি! পেছনের সিটের বাচ্ছা কুকুরটা তো বেঁচে আছে এখনো। চারিদিকে রক্ত। কিন্তু নিশ্বাস নিচ্ছে তো। ভালো করে দেখল রাকেশ। এই তো বেঁচে আছে। ওকে বাঁচাতে হবে যে করে হোক, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল সে। দেরী না করে সোজা ভেটেরিনারি হাসপাতালে গাড়ি ছুটিয়ে নিয়ে চলল। লজ্জা, দুঃখ, অপমান নিমেষে মুছে গিয়ে তখন রাকেশের চোখে মুখে আশার আলো।

ডাক্তারবাবু অভয় দিলেন কুকুরটা বেঁচে যাবে। সুস্থ হতে খানিক সময় লাগবে বটে, কিন্তু বেঁচে যাবে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রাকেশ। কিছু বোন ইনজ্যুরি হয়েছে যা কিনা শীঘ্রই সেরে যাবে। নার্ভ ইনজ্যুরিগুলো সারতে আট দশ মাস সময় লাগবে। আপাতত পেছনের পা দুটোতে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে ওরা। কাল আবার ওকে নিয়ে আসতে বলল অপারেশনের জন্য। হাজার তিরিশেক টাকা জমা দিতে হবে, তারপর অপারেশন।

কুকুরটাকে বাড়ি নিয়ে এল রাকেশ। দুধ গরম করে দুধের বাটিটা মুখের সামনে ধরতেই চুকচুক করে সব দুধ খেয়ে নিল কুকুরটা। তারপর কুঁইকুই করে ডেকে রাকেশের প্রতি যেন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে সে। রাকেশ কুড়িয়ে বাড়িয়ে তিরিশ হাজার টাকা জোগাড় করল। কুকুরটাকে কোলের উপর রেখে ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কখন যে ঘুমে দু চোখ বুজে এসেছে তা রাকেশ নিজেও জানে না।

পরদিন সূর্যের মিঠে রোদ গায়ে লাগতেই উঠে বসল রাকেশ। হাসপাতাল যেতে হবে, অনেক কাজ। যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছিল সেখানে গতকালের ঘটনা নিয়ে আলোচনা চলছে। কমলকে বাহবা দিচ্ছে বাকি ছেলেরা। "ভাগ্যিস বুদ্ধি করে গাড়িতে তুলে দিয়েছিলিস, না হলে আজ আবার আমাদেরই লোক ডাকিয়ে পরিষ্কার করতে হত।" একটা 'ডগ ওয়েলফেয়ার সোসাইটি' রাকেশকে গ্রেফতারের আবেদন জানিয়েছে নাকি। শুভাশিসবাবুর অফিসে ড্রাইভারদের মধ্যে কানাঘুষো আলোচনা চলছে " ও রাকেশ ড্রাইভার আছে না! বহুত খতরনক ড্রাইভার আছে ও। কুত্তাকো খানা খাওয়াতো, আর খানায় পয়সন মিশিয়ে দিত। কাল এক কুত্তা মারা ভি গেছে!" পৃথিবীটা বড্ড অদ্ভুত, সত্যি মিথ্যের যাচাই করে না। রাকেশ যখন দাঁতে দাঁত চেপে কুকুরটাকে প্রাণে বাঁচানোর জন্য লড়াই করছে তারই নামে নানান রটনা সারা শহরের আনাচে কানাচে ঘুরে চলেছে। 

হাসপাতালে ডাক্তারবাবু দেখে বললেন 

-   ভালো আছে তো ও।

রাকেশের মুখটা খুশিতে চকচক করে উঠল। ডাক্তারবাবু জিজ্ঞেস করলেন

-   তা আমার পেশেন্টের নাম কি?

এই রে! নাম তো ঠিক করা হয়নি। বাচ্ছা কুকুরটা সামনের পা দুটোতে ভর দিয়ে তখন হরিণের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে একটা ফড়িং কে ধরার চেষ্টা করছে। সাতপাঁচ না ভেবে রাকেশ বলে উঠল

-   ফড়িং

-   খাসা নাম কিন্তু!

ব্যাস! সেই থেকে ওর নাম হয়ে গেল ফড়িং। এক বছর ডেইলি চেক-আপ, কিছু এক্সারসাইজ, কিছু মেডিসিনের দৌলতে ফড়িং এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। আজ ফড়িংকে কলকাতা ঘোরানোর প্ল্যান করেছে রাকেশ। গঙ্গার পাশ দিয়ে যখন গাড়িটা চলছে চোখ বন্ধ করে বাইরের কলকাতাটার স্বাদ নিচ্ছে ফড়িং। রাকেশ আর ফড়িং, ওদের দুজনের ছোট্ট সংসারে এখন সুখের দিন। গাড়ির সাউন্ড সিস্টেমের ভলিউমটা একটু বাড়ালো রাকেশ। তাতে গান বাজছে "মিলন হবে কত দিনে, আমার মনের মানুষের-ই সনে।"

সিগন্যাল হঠাৎ লাল হল। সঙ্গে সঙ্গে জোরে ব্রেক চাপলো রাকেশ। রংবেরঙের গ্যাস বেলুন হাতে নিয়ে একটা বাচ্ছা মেয়ে রাস্তা ক্রস করল। সবুজ সিগন্যাল পেতেই আবার স্টার্ট দিল রাকেশ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics