শহীদ
শহীদ
#শহীদ
#শেলী ভট্টাচার্য
আকাশে বাতাসে একটা পূজা পূজা গন্ধ। ঘরে ঘরে নতুন বস্ত্রের আনাগোনা। বাঙালীর শ্রেষ্ঠ উৎসব বলে কথা। মা আসেন সেই বছর ঘুরে, থাকেন চারটি দিন, আবার বিদায়। এই চারটি দিন জুড়ে আপনজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়াপড়শি সবাই একসাথে হয়ে শুধু আনন্দের সাগরে ডুব দেওয়া। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে মাতৃদর্শন; ফুচকা, ভেলপুরি, আইসক্রিম .... আরোও কত কি জমজমাট উৎসবমুখর আয়োজন। যে ঘরের ছেলেরা রাজ্যের বাইরে বিবিধ কর্মে লিপ্ত, তাদেরও ঘরে ফেরার টান ... আপনজনের অপেক্ষায় স্নেহের আত্মসমর্পণ।
এমন দিনে আগমনী সুরে যখন বাংলার ঘরে ঘরে সার্বজনীন উৎসবের মঙ্গলালোক প্রবেশের অপেক্ষা, ঠিক তখনই হঠাৎ টেলিভিশনের পর্দায় ধ্বনিত হয়ে উঠল নিউজটি ...
কাশ্মীর নিয়ে ভারত পাক সীমান্তে হঠাৎ বেসামাল অবস্থা ... গোলাগুলি ... মৃত্যুমিছিল ... কিছু জওয়ান নিহত, কিছু আহত ... পাশাপাশি কয়টি জঙ্গিও নিহত .... এই নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর জরুরী বৈঠক ... স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের গভীর পর্যালোচনা ... বিরোধীপক্ষের ধিক্কার মিছিল।
মিডিয়ার আলোর বাইরে, তৎক্ষণাৎ এ সংবাদ শ্রবণে যেন মূহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল কিছু গৃহের হৃদস্পন্দন। অসময়ের কালবৈশাখিতে যেন নিভে গেল তাদের উৎসবপ্রাঙ্গণের প্রদীপগুলি। বুকের ভেতরে আশার আলোটা হঠাতই যেন আশঙ্কার শিকার হয়ে দপ্দপ্ করতে লাগল কিছু আপনজনের স্নেহের সলতেতে ... ভাগ্যের দুয়ারে আস্ফালিত হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল কিছু সেনা জওয়ানদের প্রেমের চিহ্ন সমূহ। যেসব ঘরের ছেলেরা দিনকাল ক্ষণ মেপে ওই দিনে ওই অবস্থানে থাকার সম্ভাবনার আওতার মধ্যে পড়ে, এই খবর শ্রবণমাত্র শুরু হল তাদের ঘরের আপনজনদের কাঁপা কাঁপা কণ্ঠের টেলিফোনিক যোগাযোগ .... খবরের লেনদেন ... সন্দেহের অবসান ... আশার অন্তিমশয্যা।
অতঃপর সন্ত্রাসময় অঘোষিত চিরকালীন বিবাদের মধ্যস্থতায় সাময়িকভাবে থামলো যুদ্ধ। এ লড়াই দুটি দেশের নাকি দুটি ধর্মের নাকি মানব দানবের যুদ্ধ ... তা জানা নেই কারো। তবে সেই লড়াইয়ে মা দূর্গার আশীর্বাদক সন্তানেরা তার আরাধনার পূর্বেই জয়ী হয়ে ফিরলো কফিনবন্দী হয়ে। যাদের জন্য আমরা কোটি কোটি ভারতবাসী নির্ভয়ে আপনজনদের সাথে বসে উৎসবের প্রদীপ জ্বালাতে পারবো, আনন্দে মেতে উঠতে পারবো, মা বাবার নজরের বাইরের যেকোনো স্থানকে কোনো শিশু ভারতমাতার কোল বলে নিরাপদ ভাবতে পারবে ... সেই অমূল্য আনন্দমুখর সময়গুলো উপহার পেলাম আমরা এই সকল বীর শহীদদের জন্য।
অত:পর অসুরদলনী বীর সন্তানের মায়ের চোখের জল ... স্নেহের নদীসম শূন্য কোলের ত্যাগপূর্বক সাগরে আছড়িয়ে পড়ে চিৎকার করে উঠবে 'মাগো একি করলি? এ পূজায় কারে বক্ষে রাখি বল?' হয়তোবা তখন মৃন্ময়ী মা দূর্গার দুটি আঁখিও নীরবে ছলছল করে উঠবে চিন্ময়ী রূপে।
অতঃপর কফিনগুলি সশ্রদ্ধায় জাতীয় পতাকা বেষ্ঠিত হয়ে কর্মস্থল হতে পৌঁছে যাবে যার যার নাড়িরটানের গন্তব্যে। হয়তো সোশ্যাল মিডিয়াতে তর্ক বিতর্ক হবে ... হয়তো দেশের মাথাদের বৈঠকে নির্ধারিত হবে ওই কফিনবন্দী দেহের কিছু পার্থিব মূল্যায়ন ... হয়তো বিদ্বজ্জনেরা জ্বালাবেন কিছু মোমবাতি ... হয়তোবা কোনো এক কবি তার দেশাত্মবোধের তাড়নায় সেই মুহূর্তে লিখে ফেলবেন একটি রক্তাক্ত কবিতা ....
মনে রেখো আমিও ছিলাম
সবার মাঝখানে,
মা বাবা ভাই বোন আর
প্রিয়ার হৃদস্পন্দনে।
মনে রেখো পূজার ছুটিতে
জমিয়ে কিছু অর্থ,
আনতাম ঘরে উপহার
আমার যা সামর্থ্য।
মনে রেখো আমার দেশের
খাটি মাটির গন্ধে,
আমার শিরায় বইতো রক্ত
হৃদপিন্ডের রন্ধ্রে।
মনে রেখো সীমান্তপাড়ে
গুলির অজানা ভয়ে,
পিছপা হইনি প্রাণের বাজিতে
স্বদেশবাসী হয়ে।
মনে রেখো ভারতবাসী
মন্ত্রীগনের বৈঠক,
আমায় হারিয়ে চোখের জলেতে
মায়ের মেটেনি বহু শখ।
মনে রেখো হিংসা বিবাদ
জয়ী হওনি তুমি,
সন্ত্রাসকে জবাব দিতে
ফিরব এদেশ চুমি।
মনে রেখো জাতীয় পতাকা
আমার কফিন পরে,
এমনি সাহসী শহীদ হবো
জন্ম- জন্মান্তরে।
(সমাপ্ত)