Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Sangita Duary

Classics Others

4  

Sangita Duary

Classics Others

পুনরাবৃত্তি

পুনরাবৃত্তি

8 mins
244


ঠাকুর ঘরে বসে মালা জপছেন মৃন্ময়ী।

এর মধ্যেই কি খেয়ালে একবার চোখ খুলেই রে রে, "গেল গেল, সব গেল, কি অনাসৃষ্টি কান্ড বলো,দেকি!"

দশকর্মার ভারী ব্যাগ হাতে থমকে দাঁড়ায় পাঁচু, কাঁচুমাচু হয়ে এবাড়ির দশ বছরের পুরনো কাজের লোক হাত কচলায় "কি হলো মা? আমি কি ভুল করলুম?"

তেড়ে এলেন মৃন্ময়ী, "বলি, কি কান্ডজ্ঞান তোর,অ্যা, অজাত কুজাত কোথাকার, ভরসন্ধ্যেবেলা আমার ঠাকুর ঘর মাড়িয়ে দিলি!"

পাঁচু কেঁদে ফেলার আগের স্টেজে এখন।

-"বউ.. বৌদিমণিই তো এখানে এগুলো রাখতে বললেন!"

মৃন্ময়ী এবার তারস্বরে চিৎকার করেন, "তুই আগে এবাড়িতে এসেছিস, না তোর বৌদিমণি? এবাড়ির নিয়ম তুই জানিস না? একবছর গড়াতে না গড়াতেই কি তিনি ধরা কে সরা জ্ঞান করছেন? এই বলে দিচ্ছি পাঁচু, আমার অনুমতি ছাড়া এবাড়ির কুটোটি নড়বেনা, বুঝেছিস?"

আজ্ঞাবহ দাসের মত পাঁচু ঘাড় এলালো।

*************


কাঁধে ব্যাগটা নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে আস্তে করে স্যান্ডেলটা পায়ে গলিয়ে নেয় শিবাঙ্গি। আজ এন সি সির আউটডোর প্র্যাকটিস আছে কোনোমতেই বাংক করা যাবেনা। ওদিকে বড়মার কড়া নির্দেশ, আজ শিবাঙ্গির কোত্থাও বেরুনো চলবেনা।

বিকেলে মেয়ে দেখার নাম করে কতগুলো উটকো লোক মিষ্টি ধ্বংস করতে আসবে, আর শিবাঙ্গিকে কলের পুতুল সেজে নিজের দর বোঝাতে হবে, তারপর প্রায় দুইদিনের খাবার উদোয়স্ত করে ভ্রু কুঁচকে বলবে,.. মেয়ের রংটা বড্ড চাপা... আমরা বাড়ি ফিরে আলোচনা করি, তারপর নাহয়...

ভালো লাগেনা শিবাঙ্গির। সবার কিসের এত ভয় তাকে নিয়ে? তার রং কালো বলে? লম্বায় পাঁচ ফুট সাত বলে? তার জন্য পাত্র জুটবেনা? তাই শুধুমাত্র ছেলেরবাড়ির একটা 'হ্যা' শোনার জন্য ,শিবাঙ্গির মতামতের কোনো মূল্য না দিয়েই...

শিবাঙ্গি যে পুলিশ হতে চায়, নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়!

কিন্তু বড়মা চায়না। এবাড়িতে মেয়েদের বাড়ির বাইরে কাজ করা নিয়মবিরুদ্ধ।

আর বড়মার নিয়ম অগ্রাহ্য করে এবাড়ির কোন কাজ হয়না।

তবু মনকে তো নিয়মের বাঁধা যায়না!

শিবাঙ্গি চৌকাঠ টপকাতে যাবে পিছনে মৃন্ময়ী, "কোথায় চললে? তোমায় বলেছিলাম, আজ না বেরুতে, ভুলে গেছো? কাকে বলে তুমি বাইরে যাচ্ছো?"

বড়মায়ের বজ্রনিনাদ হুংকারে কেঁপে ওঠে শিবাঙ্গি, "বউ... বৌদিদি...!"

মৃন্ময়ীর স্বর কঠিন, "ভিতরে যাও, যাও বলছি..."


*****************


পেল্লাই সিংহদুয়ার ফেলে বিশাল উঠোন, তার চারিদিকে গোল হয়ে দুতলা সারসার ঘর। বাড়িতে বড় কোনো অনুষ্ঠান, বিয়ে পুজো ইত্যাদি, আরামসে উঠোনে কুলিয়ে যায়। একসময় নাকি এবাড়িতে পুজো পাব্বনে যাত্রার আসর বসতো, ওই উঠোনেই। বাড়ির কর্তাদের জন্য নীচে উঠোনের ওপর দালানে গদি সাজানো হতো, আর বাড়ির মেয়ে বউরা দোতলায় উলুকাঠির পর্দার আড়াল দিয়ে যাত্রা দেখতো।

ঘুম চোখে দোতালার রেলিংয়ে ঝুঁকে কাঞ্চনা দেখছে নিচের উঠোন।

সকালের,বিশেষ করে এই সময়টা, উঠোনটা অদ্ভুত ফাঁকা থাকে।অথচ এই সময়টাই সব চেয়ে ব্যস্ত সময়। বাড়ির ছেলেদের অফিস যাওয়ার তাড়া থাকে, শিবাঙ্গির কলেজ যাওয়ার তাড়া থাকে। ঝি চাকরদের ছুটোছুটি, রান্নার ছ্যাকছোক, তবুও ঠিক এইসময় নিচটা ভীষণ শুনশান। এইসময় নিচের উত্তর কোণায় রাধাগোবিন্দের মন্দিরে মৃন্ময়ী পুজোয় বসেন। টানা একঘন্টা।

এইসময়টায় ওই জায়গায় কোনো মানুষের বিচরণ মৃন্ময়ী পছন্দ করেননা। কে কি অবস্থায় থাকে, ছোঁওয়া ছুঁয়ি হলেই কেলেঙ্কারি।

দোতালার দক্ষিণ কোণের ঘরটা কাঞ্চনার। শিবাশিস খুব সকালে অফিস বেরিয়ে গেছে,জরুরি মিটিং।

দুমাস হলো কাঞ্চনা এইবাড়ির বউ হয়ে এসেছে। এসে থেকে দেখছে, বড়মাকে সবাই ভয় পায়, এমনকি তার ওরকম রাশভারী শ্বশুরমশাই, তিনিও তাঁর বৌদিদির সামনে চোখ তুলে কথা বলেননা। এইবাড়িটাও নাকি বড়মার নামে। সেইজন্যই কি সবাই তাঁকে তেল দিয়ে চলে?

আর উনি, কুসংস্কারের দোহাই দিয়ে বাড়ির মেয়েদের, বউদের বাড়ির বাইরে বেরোতে, স্বনির্ভর হতে বাধা দিয়ে চলেছেন দিনের পর দিন!

শিবাঙ্গির ওতো ভালো হাইট, ওতো ভালো রেজাল্ট, কত স্বপ্ন মেয়েটার, পুলিশ হবে! শুধুমাত্র বড়মার জেদে সব স্বপ্ন ভেঙ্গে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হচ্ছে!

ঘাড় এলিয়ে পাশে শিবাঙ্গির ঘরটা একবার দেখে নেয় কাঞ্চনা। এখনও দরজা বন্ধ। কাল অনেক রাত পর্যন্ত কাঁদছিলো মেয়েটা। হয়তো ঘুমোচ্ছে এখন, ঘুমোক!

কাঞ্চনা গুটিগুটি ছাদে আসে।

এবাড়িতে সকাল সকাল স্নান সেরে নেওয়ায় নিয়ম। 

ভিজে চুল থেকে জল বেয়ে কাঞ্চনার ব্লাউজ ভিজিয়ে দিচ্ছে। বেশ ঠান্ডা একটা আমেজ। কাঞ্চনা নিজের মনেই লজ্জা পেল খানিকটা। অন্যদিন তার এই স্নানে ভেজা রূপে শিবাশিস মাতাল হয়ে থাকে। রাতের গভীর আদর খেলার তলানিটা যেন সে এই সকালেই চুমকে নেয়।

ছাদের এক কোণে চিলেকোঠা। কেউ আসেনা। বাড়ির বাতিল জিনিস এইঘরেই শিকলবন্দি থাকে।

কাঞ্চনা শিকল খুলে ঘরে ঢোকে। বাব্বা! কতদিন মানুষ ঢোকেনি! মোটা মোটা ফাঁদ আর পুরু ধুলোর আস্তরণ।এই ঘরটা বোধহয় কোনো একসময় কারোর আস্তানা ছিল। শিবাশিসকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

দেওয়ালে বাহারী পেইন্টিং, ধুলো জমলেও বোঝা যায় বেশ দেখনবাহার রয়েছে ছবিগুলোয়। কয়েকটা ল্যান্ডস্কেপ, কয়েকটা অবস্ট্রাক্ট।

দক্ষিণদিকে জানালা ঘেঁষে একটা ডিভান, তার ওপর ছোটবড় পিচবোর্ডের বাক্স ঢাই করা।পাশে দেরাজ।একটা কাঠের পরী জাদুদন্ড হাতে একপায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেরাজের একপাশে।

মেঝের ওপর আরও একটা কাঠের টেবিলে ভাঙা ফুলদানি, চিনামাটির ভাঙা বাসন... আচ্ছা, এসব পরিত্যক্ত জিনিস ফেলে না দিয়ে এমন ভাবে জমানো রয়েছে কেন?

দেরাজের গায়ে তিনটে ড্রয়ার। কাঞ্চনা এগিয়ে যায়, টেনে খোলার চেষ্টা করে। বহুদিনের অব্যাবহারের ফলে আঁটকে গেছে। একটিতে পুরোনো কাঁচের শিশি, অনেকগুলো, ওষুধের।

আরেকটিতে ...একটা পুরোনো ডাইরি।

প্রথম পাতায় মুক্তোর মত হস্তাক্ষর, 'মৃন্ময়ী'!

বড়মার ডাইরি!

বড়মাও ডাইরি লিখতেন?

কাঞ্চনা পরের পাতা ওল্টাতে যাবে, এমন সময় নিচ থেকে চিৎকার...মুন্নি রে... এ তুই কি করলি!

মুন্নি? কি করেছে শিবাঙ্গি?

কাঞ্চনা দৌড়ে নীচে এলো। শিবাঙ্গির ঘরের সামনে ছোট কাকু, কাকীমা। খাটের উপর শিবাঙ্গির দেহটা। মা কাঁদছেন। পাশে বড়মা নিথর দাঁড়িয়ে। হাতে একটি চিরকুট। কাঞ্চনা দৌড়ে যায়। চিরকুটে লেখা...

"এ বিয়েটা যেমন আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়, তেমনই দিব্যেন্দুকেও ভুলে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়! যদি তোমরা এই কথাটা বুঝতে...

আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়!!

ইতি, শিবাঙ্গি"



************

স্টমাক থেকে অনেকটা বিষ বের করা গেছে। বিপজ্জনক অবস্থা কাটিয়ে উঠলেও শিবাঙ্গি এখনও অবজার্ভেশনেই রয়েছে। হাসপাতালে আপাতত শিবাশিস, শিবাশিসের বাবা অলকেন্দু, কাকা মুকুন্দ এবং খুড়তুতো ভাই স্নেহাসিস।

বাড়ির পরিবেশ এখন ভীষণ থমথমে। মাধবী কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছেন। কাঞ্চনা এতক্ষন শাশুড়ির কাছে বসে ছিল। এবার উঠে রান্নাঘরে উঁকি দিলো একবার। কাকীমা রুটি সেঁকছেন।

কাঞ্চনা নিজের ঘরে ফিরতে গিয়ে থমকালো খানিক। সকালের পর থেকে বড়মাকে আর দেখেছে কি?

বুকটা ধড়াস করে উঠলো যেন!

দৌড়ে ঠাকুরঘরে আসে কাঞ্চনা। না, এখানে তো নেই!

আশ্চর্য্য! সারাদিনে যে মানুষটার অঙ্গুলিলেহনে বাড়ির সবাই ওঠে বসে, আজ এই ভীষণ দিনে তিনি কোথায় মুখ লুকিয়ে বসে আছেন?

কি মনে করে চিলেকোঠায় দৌড়োলো কাঞ্চনা।

ভারী বুক থেকে হালকা একটা শ্বাস বেরিয়ে গেল যেন!

দেরাজের সামনে মরচে ধরা লোহার চেয়ারে বসে একটা পুরোনো এলবামের পাতা ওল্টাচ্ছেন মৃন্ময়ী।

শান্তস্বরে কাঞ্চনা জিজ্ঞেস করে, "দিব্যেন্দুর কথা আপনি জানতেন বড়মা। শিবাঙ্গির পুলিশ হওয়ার স্বপ্নের কথাও আপনি জানতেন। তাহলে কেন রোজ ওকে পাত্রী দেখার নামে বিপণন বানিয়েছিলেন?

রংটা ফর্সা নয় বলে? ও লম্বা বলে? আপনার কি মনে হয়, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এইসব যুক্তি অকাঠ্য?"

মৃন্ময়ীর কঠিন চোখে তাকান কাঞ্চনার দিকে। তারপর কোলের ওপর রাখা এলবাম বন্ধ করেন। দেরাজ খুলে বার করেন সেই ডাইরিটা। যত্নে হাত বুলিয়ে সরিয়ে দেন পুরু ধুলোর আস্তরণ।

হলুদ পৃষ্ঠা নাকের সামনে ধরেন ,গন্ধ নেন অতীতের।

"পরাধীন দেশে এই বাড়িটার জৌলুশ আরও বেশি ছিল। শ্বশুরমশাই সাহেবদের খাসলোক ছিলেন।দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও জমিদারির প্রকোপে কমতি ছিলোনা। তোমাদের জ্যাঠামশাই তখন কলেজে পাশ করে কাছারিতে বসেছেন, আমি এবাড়ির বউ হয়ে আসি। অলকেন্দু, মুকুন্দ তখন ছোট, আমার আঁচলের খুঁট ধরে ঘুরতো। আর ছিল, শ্যামা। আমার একমাত্র ননদ, সমবয়সী বলেই হয়তো আমার সঙ্গে মনের খুব মিল ছিল তার। এত্ত এত বই পড়তো, লাইব্রেরি যেত। কি সুন্দর সেলাই জানতো, ছবি আঁকত, নাচতো।

ধীরে ধীরে আমি ওর ছাত্রী হয়ে গেলুম। ওর থেকে সেলাই শিখলুম, আঁকা শিখলুম, রান্না শিখলুম, নাচ শিখলুম। একদিন বললুম, "তুমি বিয়ে করবেনা ঠাকুরঝি?"

সে বলতো, "দেশের মত আগে নিজে তো স্বাধীন হই, তারপর নাহয় ..."

তখনও জানতুম না খুব ছোটবেলায় শাশুড়িমার সইয়ের ছেলের সঙ্গে ওর কণ্ঠীবদল হয়ে রয়েছে। ছেলে বিলেত থেকে লেখাপড়া সেরে ফিরলেই চারহাত আবার এক হয়ে যাবে।

যেদিন ঠাকুরজামাই ফিরলেন, বসার ঘরে আমিই ঠাকুরঝিকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে গিয়েছিলুম। সেদিনই দেখেছিলুম, ঠাকুরজামাইএর চোখ ঠাকুরঝির দিকে নয়, আমার দিকে, চকচক করছে। তারপর, প্রায়ই ঠাকুরজামাই বাড়িতে আসতেন। ঠাকুরঝির সাথে দেখা করতেননা। বাবার সাথে, ওনার সাথে কথা বলতেন। জানলুম, ঠাকুরজামাই ব্যবসা করতে চান ওনার সঙ্গে।

বিদেশী খদ্দের জোগাড় করে দেবেন, মুনাফা যা হবে, সমান সমান।

বিদেশি পুঁজির লোভে কেউ আপত্তি করেনি তখন।

বাবা এবং উনি, দুজনেই খুব ভরসা করতেন ওনাকে।

সেদিন পাশের বাড়িতে বাবা মা দুজনেই হরিনাম সংকীর্তনে গিয়েছিলেন। ঠাকুরঝি লাইব্রেরীতে।

ঠাকুরজামাই বিকেল থেকে দাবা খেলছিলেন ওনার সঙ্গে। সন্ধ্যে নামতেই বৃষ্টি। ঠাকুরঝির জন্য চিন্তা হচ্ছে, উনি একটু এগিয়ে গেলেন।

সেই সুযোগে আমার ঘরে ঢুকে ...

আপ্রাণ চেষ্টা করছি বাঁচবার। হঠাৎ বিষম চিৎকার করে মাথা চেপে ধরে ঠাকুরজামাই লুটিয়ে পড়লেন।কার্পেট বিছানো মেঝে ঠাকুরজামাইএর রক্তে ভিজে গেল। পিছনে পিতলের ফুলদানি হাতে ঠাকুরঝি।

সইমা পুত্রশোকে অভিশাপ দিয়েছিলেন।

কয়েকদিন পর ঠাকুরঝি এই চিলেকোঠার ঘরেই গলায় ফাঁস দিয়ে....

মা বললেন, আমি অলক্ষ্মী, অপয়া। মেয়েমানুষের নাকি বেশি রূপগুন থাকতে নেই।

একঘরে হয়েগিয়েছিলুম।আলাদাই থাকতুম, এইখানেই। ঠাকুরঝিকে ডাকতুম, "বলে যাও ঠাকুরঝি, আমার জন্যই কি তুমি...!"

তোমাদের জ্যাঠামশাই মার ওপর কথা বলতে পারতেননা, অন্যায় হচ্ছে জেনেও চুপ থাকতেন। গভীর রাতে আসতেন, তাকিয়ে থাকতেন, কথা বলতেননা, শুধু দুচোখ থেকে অবিরাম অশ্রু গড়িয়ে পড়তো।।

পুরুষ মানুষের চোখে কান্না শোভা পায়না। শোভা পায়না স্ত্রীর প্রতি অন্যায় হচ্ছে জেনেও চুপ থাকা। একদিন উনিও...

সইমার অভিশাপ ফলছে।

একদিন মা ঠাকুরঘরের সিঁড়ি থেকে পড়ে গেলেন। মাও আর ফিরলেননা। এত বড় বাড়িতে বাবা বাকি দুই ছেলেকে নিয়ে একা, আর চিলেকোঠায় একঘরে আমি।"


মৃন্ময়ী অতীতে হারিয়ে গেছেন। তাঁর পলক পড়ছেনা।

"বাবা হয়তো আমার কষ্ট বুঝেছিলেন। কিংবা ভেবেছিলেন, এই অভিশপ্ত বাড়িতে নতুন করে আর কিই বা বিপদ আসবে? তার থেকে যাকে কেন্দ্র করে এই বিপদ, সে নিজেও এর মুখোমুখি হোক।

আমি ছাড়া পাই। অলকেন্দু মুকুন্দর যে তখন মাএর খুব প্রয়োজন।

সব ভুলে মায়ের স্নেহ ওদের বড় করতে থাকি, লেখাপড়া শেখাতে থাকি। নামেই বৌদি, কিন্তু আমিই যে ওদের মা!

গত হওয়ার আগে বাবা বাড়িটা আমার নামে লিখে দিয়ে যান।

আমি আজও বিশ্বাস করি, বাড়িটাতে এখনও আমার কাছের মানুষদের রক্ত লেগে আছে।

অভিশাপ লেগে আছে।

নিজেকে এবং বাড়িটাকে শুদ্ধ রাখতে কোনো ত্রুটি রাখিনি।

তবুও বড়ো অপরাধী লাগতো নিজেকে, কিন্তু যেদিন শিবাঙ্গি জন্মালো, দেখলাম, যেন ঠাকুরঝি ফিরে এসেছে, বুঝলাম, আমার প্রায়শ্চিত্ত সফল হয়েছে।"

মৃন্ময়ী এগিয়ে আসেন, কাতর চোখে তাকান কাঞ্চনার দিকে, " তুমি এবাড়িতে আসার পর লক্ষ্য করলাম, শিবাঙ্গি এবং তোমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠছে। ভয় পেলাম।

কয়েকদিন পর শিবাঙ্গি দিব্যেন্দুর কথা জানালো।কেঁপে উঠলাম, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবেনা তো?

তাড়াতাড়ি ওর জন্য পাত্র দেখা শুরু করি, দরকার নেই ওর স্বনির্ভর হওয়ার, দরকার নেই ওর বেশিদিন এবাড়িতে থাকার।

বহুবছর আগের চাপা পড়ে থাকা আতঙ্ক আমাকে চঞ্চল করে দিচ্ছিল।"

একটু থামেন মৃন্ময়ী। তারপর সরুচোখে তাকান কাঞ্চনার দিকে,"তোমার কি মনে হয়, শিবাঙ্গির এই অবস্থার জন্য আমিই দায়ী?"



***********

শিবাঙ্গি এখন সুস্থ। হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির অবস্থা আগের ছন্দে ফিরলেও কেমন যেন থমথমে।

তবুও সকাল হয়, প্রকৃতির নিয়মে এগিয়ে চলতে হয়।

শিবাঙ্গি ঘুমোচ্ছে। শাশুড়িদের সঙ্গে কাঞ্চনা রান্নাঘরে। শিবাশিস, স্নেহাসিস অফিস বেরোবে, এই কদিন তো ছুটিতেই ছিল দুজন। দুটো থালায় স্বামী, দেওরের জন্য ভাত বাড়ছে কাঞ্চনা, এমন সময় পাঁচুর চিৎকার, "মা চলে গেছেন, কে কোথায় আছেন সবাই, দাদাবাবু, গিন্নিমা ..."



************

সকালে মৃন্ময়ীর ঘর পরিষ্কার করতে এসে পাঁচু দেখে, আলমারিটা খোলা। টেবিলে রাখা অষ্টধাতুর গোপাল, জপের মালা ,জ্যাঠামশাইয়ের ছবি, কিচ্ছু নেই দেখে এবাড়ির বহুবছরের পুরোনো চাকর পাঁচুই প্রথম মৃন্ময়ীর অন্তর্ধান সন্দেহ করে।

তার চিৎকারেই বাড়ির সবাই মৃন্ময়ীর ঘরে দৌড়ে আসে।

টেবিলের ওপর একটা চিঠি, পাশে একটা দলিল। অলকেন্দু, মুকুন্দ, শিবাশিসের পড়া শেষ হতেই কাঞ্চনা প্রায় ছিনিয়ে নেয় চিঠিখানা।


"স্নেহের অলোক,


অনেকদিন আগেই স্থির করেছিলাম, শেষ বয়সটা হরিদ্বারে কাটাবো। যাওয়ার আগে উকিলের সাথে পরামর্শ করে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আশা করি তার মর্যাদা পাবো। বাড়িটা অনাথআশ্রমে দান করলাম। তোমরা, তোমাদের ছেলেরা সদুপার্জয়ী, বাসস্থানের সুবন্দোবস্ত নিশ্চয় তোমরা করে নিতে পারবে। আশ্রমের কমিটির সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, ততদিন তোমরা এবাড়িতেই থাকবে।

শিবাঙ্গি মার স্বপ্ন পূরণ করো।

নতুন বৌমাকে আমার আশিস দিয়ো।

তোমরা সবাই ভালো থেকো।


-----ইতি, মৃন্ময়ী"



কাঞ্চনা দৌড়ে গেল চিলেকোঠায়। ডাইরি,এবং এলবাম নেই। বড়মা অতীতের সাক্ষীগুলো নিজের সঙ্গে নিয়ে গেলেন!

ভাঙা তেপায়া টেবিলের ওপর কয়েকটা পেইন্টিং, সেলাই করা রুমাল আর একজোড়া ঘুঙুর পড়ে রয়েছে। কাঞ্চনা সযত্নে তুলে নেয় জিনিসগুলো। কি লেগে রয়েছে এগুলোতে,অভিশপ্ত ইতিহাস, নাকি সব হারানো, বঞ্চিত এক নারীর চোখের জল!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics