গোলাপের দিন
গোলাপের দিন
আজ সকাল বেলা ঠাকুরের জন্য ফুল কিনতে গিয়েছি | রোজ এই কাজটা আমার শ্বশুর মশাই করেন | কিন্তু আজ উঁনার শরীরটা একটু খারাপ থাকায় আমাকেই যেতে হয়েছে | আমার শাশুড়িমা আবার বিনা ফুলে ভগবানের সেবা করতে পারেন না | অগত্যা, আমাকেই যেতে হোলো | 'অগত্যা' শব্দটা ব্যবহার করলাম, কারণ আমার ফুলে এলার্জি আছে | তাই ওই দোকানটা থেকে আমি একটু তফাৎ দূরত্বে থাকতেই সাচ্ছন্দ বোধ করি | আমার পতিদেব গতকাল ভোরে অফিসের কাজে দিল্লী উড়ে গেছেন, আজ রাত্রে ফিরবেন | ঘুম থেকে উঠে হোয়াটস্যাপের মেসেজে পতিদেবের একটা প্রেম ভরা মেসেজ পেলাম, সাথে একটা গোলাপের ছবি | ছবিটার নিচে বর মশাইয়ের মস্করা , " একরাশ গোলাপের গন্ধে তোমায় ভালোবাসা পাঠালাম | বি. দ্র. ভাগ্গিস, তোমার ফুলে এলার্জি, নাহলে অনেকখানি পকেট খোস্ত আজ আমার | "
বরের মস্করায় হা হা ইমোজি দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই আমার | কারণ, সত্যিই আমি গোলাপের কাঁটার খোঁচা খেতে পারি, কিন্তু গোলাপের স্পর্শ নিতে পারিনা |
বাজারে গিয়ে দেখলাম, ফুলের দোকান গুলি আজ গোলাপে ছেয়ে আছে !! নানা রঙের গোলাপ, তবে লাল রংটাই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে আজ | হৃদয় আহত হলে যে লাল রঙটাই নিঃসৃত হয় শিরা- ধমনী থেকে, তাই বোধহয় লাল গোলাপের এতো ঔদার্য !!
দোকান থেকে ঠাকুরের জন্য ফুল আর মালা কিনে ফিরে আসছি, এমন সময় আমার ওড়নায় একটা টান খেলাম | ফিরে তাকাতেই দেখলাম, একটি বছর আট নয়ের মেয়ে, পরনে একটা ছেঁড়া জামা, হাতে বেশ কিছু গোলাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে | কিন্তু গোলাপ গুলির সব কটাই ঈষৎ ছেঁড়া |
আমি তাকাতেই বাচ্চা মেয়েটি বলল, " আমার কাছ থেকে একটা গোলাপ নাও না গো দিদিমনি| "
পাশ থেকে দোকানদারটা উঠল তেড়ে | " তুই আবার এসেছিস!! কি জ্বালাতনই না করছে মেয়েটা সকাল থেকে!! "
আমি শান্ত স্বরে বললাম মেয়েটাকে, " আমার ফুল লাগবে না রে | আমি নেবো না, তুই অন্য কাউকে জিজ্ঞেস কর | "
"কেউ নিচ্ছে না গো দিদিমনি | আমার ফুল গুলি তো ছেঁড়া , তাই কেউ নিতে চাইছে না |... তুমি নাও না গো দুটো ফুল | "... কথাটা বলে মেয়েটি আমার ওড়না ধরে টানাটানি করতে লাগলো |
এবার আমার সামনের দোকানদারটা লাঠি নিয়ে তেড়ে উঠল মেয়েটিকে | মেয়েটি আমার ওড়না ছেড়ে কিছুটা দূরে পালিয়ে গেল | হয়তো হতাশ হোলো আমার কাছ থেকেও |
আমি দোকানদারটিকে জিজ্ঞেস করলাম, " বাচ্চাটি কে??... ওর বাবা মা নেই ?? "
দোকানদার বিরক্তির সাথে জানালো, " আরে বলবেন না দিদি | মেয়েটা একটা পাগলীর মেয়ে| আরে, ওই যে, রেল গেটের সামনে যে পাগলীটা বসে থাকে না, মেয়েটা ওই পাগলীটারই মেয়ে | আমরা যখন হাওড়া যাই, মেয়েটাও আমাদের পিছন পিছন যায় কখনো সখনো | আজও গিয়েছিলো | আমাদের কারোর কাছ থেকেই বোধহয় শুনেছে, যে, আজ গোলাপ বিক্রি ভালো হবে, তাই গোলাপ কুড়িয়ে এনেছে | এমন মূর্খ, এটাও জানে না, যে, আজ কেউ ছেঁড়া গোলাপ কিনবেই না | "
আমি সব শুনে জিজ্ঞেস করলাম, " ওর মা পাগল হোলো কি করে??..."
"সে টা তো ঠিক জানিনা | তবে হঠাৎ করেই একদিন দেখলাম, পেট ফুলিয়ে বসে আছে | কেউ সুখ মিটিয়ে গেছে বোধহয় কোনো অন্ধকার রাত্রে| "
দোকানদারের কথায় আমি কোনো উত্তর না দিয়ে এগিয়ে গেলাম মেয়েটার কাছে | মেয়েটি আমাকে দেখে বলল, " আমায় মেরো না গো দিদিমনি| আমি তোমাকে ফুল বেচবো না | "
আমি মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলি, " তুই এই গোলাপ গুলি পেলি কোথায়?? "
" বাজারে | শিয়ালদাহ বা হাওড়াতে চলে যাই মাঝে মাঝে| ওখানে অনেক সব্জি তরকারি, ফুল ফল ট্রাক থেকে নামাতে গিয়ে ট্রাকের পাশে রাস্তায় পড়ে, যার কোনো খোঁজ কেউ রাখে না | আমার মতো অনেক ছেলেমেয়ে ওই সব জিনিস কুড়িয়ে বিক্রি করে | আজ শুনছিলাম সবাই বলছিল যে, আজ নাকি গোলাপের দিন, আজ গোলাপ অনেক চড়া দামে বিক্রি হবে, তাই আজ গোলাপ কুড়িয়েছি | কিন্তু গোলাপ গুলির পাঁপড়ি একটু ছেঁড়া হওয়ায় কেউ কিনছে না | "... মেয়েটা কাচুমুচু ভাবে বলল|
"তুই এসব বিক্রি করে কি করিস?? "
"আমি খাই, মাকে খাওয়াই | খেতে তো পয়সা লাগে গো দিদিমনি | পয়সা ছাড়া কেউ কিচ্ছু দেয় না | "
আমি অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম | এই টুকু বয়সেই কি গভীর জীবনবোধ!!
আমি জিজ্ঞেস করলাম, "ইস্কুলে যাস?? "
মেয়েটা হো হো করে হেসে উঠে বলল, " পাগলীর মেয়েকে কখনো ইস্কুলে যেতে দেখেছো নাকি ?? "
আমার মনে হোলো, আমার গালে জোরে দুটো চড় কষালো কেউ | আমাদের সরকার নাকি সমগ্র শিক্ষা মিশন শুরু করেছেন | আদতে সমগ্র শিক্ষা হচ্ছে কি??
আমি বললাম , " তুই কিচ্ছু জানিসনা | তুই ইস্কুলে গেলে রোজ দুপুরে খাবার পাবি, স্কুলের ড্রেস পাবি | ভর্তি হবি স্কুলে?? "
"কে করাবে ভর্তি আমায়?? "
"আমি করাবো ভর্তি তোকে| আমি একটা ইস্কুলের দিদিমনি | তোকে আমি আমার স্কুলে ভর্তি করাব | "
" কিন্তু আজ খাবো কি দিদিমনি??... আমি যে একটা গোলাপও বিক্রি করতে পারিনি | "
আমি ওকে ব্যাগ থেকে একশোটা টাকা বার করে দিয়ে বললাম, " এটা রাখ, কিছু কিনে মা আর তুই খাস| কাল সকাল দশটার সময় এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি | আমি আসবো এখানে | তোকে নিয়ে গিয়ে আমার স্কুলে ভর্তি করে দেবো | "
কথা গুলি বলে চলে আসছিলাম| পিছন থেকে মেয়েটি আবার চিৎকার করতে করতে ছুটে এলো | আমি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, " কিছু বলবি?? "
" এই ফুলগুলি তোমার দিদিমনি | এই গুলি তুমি নাও | গোলাপ গুলি সবই ছেঁড়া, তবুও তুমি নাও দিদিমনি | আমাকে কেউ কোনোদিন এত ভালোবাসেনি গো দিদিমনি | আজ প্রথম তুমি আমায় ভালো বাসলে | তাই, এই গোলাপ গুলি তোমার | "
আমি ওর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলাম | আমি ভুলে গেলাম, যে, আমার ফুলের রূপ - রস - গন্ধ কিছুই সহ্য হয় না| আমি হাত বাড়িয়ে ফুলগুলি নিতে নিতে জিজ্ঞেস করলাম, " তোর নাম কি রে বাবু?? তোর নামটাই তো জিজ্ঞেস করা হয়নি | "
" আমার নাম??... পাগলীর মেয়ে| "
আমার বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল| আজ গোলাপ দিবসে পৃথিবীর সব গোলাপের কাঁটা যেন আমার বুকে এক সাথে বিঁধলো |
আমি বলে উঠলাম, " এবার থেকে কেউ তোর নাম জিজ্ঞেস করলে বলবি, " আমার নাম গোলাপ| "... আজ থেকে তোর দিন শুরু হোলো| জীবনের সকল কাঁটাকে দুমড়ে মুচড়ে তুই তোর সুগন্ধীতে ভরে উঠবি | "
বাড়ি ফিরে আসলে আমার হাতে এক থোকা গোলাপ দেখে আমার শাশুড়িমা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, " তোমার হাতে গোলাপ বৌমা?? "
আমি হেসে উত্তর দিলাম, " হ্যাঁ মা, এক গোলাপের কাছ থেকে পেলাম | "
ছেঁড়া গোলাপের সেই থোকা গুলিকে আমি সযত্নে সাজিয়ে রাখলাম আমার ঘরে | আজকের দিনে যখন বেশিরভাগ ভালোবাসাটাই অভিনয়ে ভরপুর থাকে, সেখানে এই গরীবের ছেঁড়া গোলাপ গুলির মূল্য থাকবে কি করে ?? ... তার চাইতে এই গোলাপগুলি আমার ঘরেই শোভা পাক | এই গোলাপে প্রেম না থাকলেও জীবনের স্পন্দন আছে অনেক খানি |
আজ রাতে আমার জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষটা আমার কাছে ফিরে এলে তাকে এই গোলাপগুলিই উপহার দেবো| পকেট না খসিয়েও যে অনেক দুর্মূল্য গোলাপ আজও জগতে পাওয়া যায়, আজ সেও জানবে |