লক্ষ্মীপূজার রূপপরিবর্তন
লক্ষ্মীপূজার রূপপরিবর্তন
লক্ষ্মী কি লৌকিক দেবী ? এই প্রশ্নের উত্তর আপনি প্রথমেই বলবেন না, কারণ পুরানে এর উল্লেখ আছে কিন্তু আপনি আমার আগের লেখাতেই দেখেছেন প্যেঁচা এর বাহন । কিন্তু এর বাহন কিন্তু আগে প্যেঁচা ছিলো না। কখনো ময়ুর কখনো কচ্ছপ কখনো হরিনকে এর বাহন হিসেবে পেয়েছি। সুতরাং লোক বিশ্বাস জন্য এই দেবীর রূপ পরিবর্তন হয়েছে আমরা খুব সহজেই দেখতে পাই।
ইতিহাসের পাতায় গেলে দেখতে পাবেন
কুনিন্দরাজ অমোঘভূতির মুদ্রায় লক্ষ্মীর সামনে হরিণ আছে । কুমারগুপ্তের মুদ্রায় আবার লক্ষ্মীদেবী একটি ময়ূরকে খাদ্য দিচ্ছেন আবার অন্য একটি মুদ্রায় দেবী পদ্মহাতে, ময়ূরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।
প্রথম ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ও কুমারগুপ্তের স্বর্ণমুদ্রায় দেবীর বাহন সিংহ। বৃহৎ স্তোত্ররত্নাকরে মাধব ব্যাস আথর্বণ রহস্য থেকে যে লক্ষ্মীমন্ত্র উদ্ধার করেছেন তাতে লক্ষ্মীকে সিংহবাহিনীরূপে দেখাযায়। নেপালে প্রাপ্ত পটে অংকিত অর্ধ-লক্ষ্মী নারায়ণ মূর্তীতে বিষ্ণুর অর্ধদেহের পদতলে গরুড় ও লক্ষ্মীর অর্ধদেহের পদতলে কচ্ছপ।গুপ্তোত্তর যুগে শশাঙ্কের স্বর্ণমুদ্রায় দণ্ডায়মানা লক্ষ্মীদেবীর প্রসারিত দক্ষিণহস্তে পদ্ম, পিছনে পদ্মলতা ও পায়ে তলায় একটি হাঁস।.
ড. জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাখায় কুনিন্দ মুদ্রায় দেবীর মানবমূর্তী ও পশুমূর্তী অঙ্কিত হয়েছে কারন লক্ষ্মীদেবী চঞ্চলা, হরিণও চঞ্চল । কচ্ছপ বা কূর্মও অঞ্চল বিশেষে দেবীর বাহন হয়েছ। কূর্ম বিষ্ণু দ্বিতীয় অবতারও। সূর্য-বিষ্ণুর শক্তি লক্ষ্মীর বাহন বিষ্ণুরূপী কূর্ম হওয়ার সম্ভবনা আছে। আদিতে লক্ষ্মীর আদি বাহন ছিল হরিণ। পরে সরস্বতীর কাছ থেকে নিলেন সিংহ ও ময়ূর। সরস্বতীর হাঁসটিকে তিনি অধিকার করার চেষ্টা করেছিলেন খ্রীষ্টিয় ষষ্ঠ শতাব্দী পরে । এই বাহনগুলির কোনটিকেই লক্ষ্মী থাকলো না । সরস্বতী হাঁস , দুর্গাদেবী সিংহের হল , ময়ূর গেল কার্তিকের দখলে, কূর্ম বিষ্ণুর অবতার হয়ে রইলো। অগত্যা লক্ষ্মীদেবী আশ্রয় বাহন হলো প্যেঁচা। তাই লোকবিশ্বাস এই দেবী তৈরি হয়েছেন বলে আমার বিশ্বাস।
আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই পূজাতে আলপনা দেওয়া রিতী।কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল আলপনা। এ বাংলায় বিভিন্ন ভাবে লক্ষী পূজা করা হয়। কখনও মাটির পট কখনো কলাগাছ কখনও মাটির চিত্রাঙ্কিত সরা, কখনো ধানের ছড়ায় দেবীকে কল্পনা করে বাঙালীরা পুজো করেন। লক্ষ্মী হিসেবে করে পুজো করা হত, মূর্তির প্রচলন হতেই সেগুলি আলপনার বিষয় বস্তুতে পরিণত হয়েছে। লক্ষ্মী পুজোতে প্যাঁচা, ধানের ছড়া, শঙ্খ, পদ্ম, পদচিহ্ন ইত্যাদি আলপনা আঁকা হয়।
এগুলি সবই সমৃদ্ধি-সম্পদের প্রতীক। ধানের ছড়া, কলা গাছ কৃষিজ সমৃদ্ধির প্রতীক, আজও কোজাগরী পূর্ণিমায় নৌকা পুজো করা হয়, যা বাণিজ্যের প্রতীক। আমরা মঙ্গলকাব্য তে প্রমান পাই জলপথেই বাণিজ্য করতো একসময় বাঙালিরা। পরে আলপনায় ঢুকে গিয়েছে এই সব ছবি গুলো।
আদীপন থেকে আলীপন হয়ে আলপনা শব্দের জন্ম। আসলে আলপনা হল কামনার প্রতিচ্ছবি। ইহজাগতিক বাসনা, সম্পদ সমৃদ্ধি প্রার্থনা, সুস্থ নীরোগ জীবন কামনা, সাংসারিক শ্রীবৃদ্ধির আকাঙ্খা ইত্যাদি আলপনার মধ্যে।
লক্ষ্মীর পদ যুগল একসময়ে লক্ষ্মী রূপেই পূজিত হত। লক্ষ্মী একসময় মনসার মতো লৌকিক দেবীই ছিলেন । আদিমাতা ও পৃথ্বীমাতার রূপে পূজিত দেবী।জৈনসাহিত্যে গন্ধর্ব কিন্নর প্রমুখ ব্যন্তর দেবতা বা মধ্যবর্তী দেবতাদের শ্রেণিতেই লক্ষ্মীকে অন্তর্ভুক্ত করা আছে। খুব ভালো করে দেখলে।দ্বাদশ শতকের আগে কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মী পুজোর চলছিলো না বাংলায় । বাংলার অন্যান্য লৌকিক দেব-দেবী, মনসা ,মসান ঠাকুর,সিনি দেবী , ক্ষেত্রপাল যেমন কোনও না কোনও প্রতীকেরা দ্বারাই পূজিত হন , তেমনই সংকেত বা অন্য কোনও প্রতীকের মধ্যে আরাধনা করা করা হয় আজ লক্ষীকে । এক সমুয় লক্ষ্মীও পূজিত হতেন পদ চিহ্নের মাধ্যমে। লক্ষ্মীর পদ চিহ্ন কিছু বছর আগে পর্যন্ত সংকেত হিসেবেও ব্যবহৃত হতে দেখা যেতো বিয়ের নিমন্ত্রণের চিঠিতে।
তবে পদ চিহ্ন পুজোর রেওয়াজ দীর্ঘদিনের, তা আজও রয়েছে, দক্ষিনেশ্বর- তারাপিঠ- কালীঘাট এর মতো জায়গায় কালী পায়ের অবয়ব বিক্রি হতে দেখা যায় আজো । ভক্তরা তা কিনে নিয়ে গিয়ে পুজো করেন তা বাড়িতে গাড়িতে।নবদ্বীপে নিমাইয়ের পদ চিহ্নেকে পুজো দেওয়া হয়। মৃত মানুষের পায়ের ছাপ রেখে দেওয়াও আমাদের রীতি আছে । আবার পদ চিহ্ন দেখেই জঙ্গলের প্রাণীদের শুমারি করা হয়।অর্থাৎ পদ চিহ্ন হল উপস্থিতি বা অস্তিত্ববাদের ধারক-বাহক।
দেখা যায় লক্ষ্মীর পদ চিহ্নের বদলে পরে দিকে মূর্তি এল অন্যান্য প্রতীকে তাঁর আরাধনা শুরু হল,। মূর্তির আর প্রতীকে পুজোর শুরু হওয়ায় । পদ চিহ্ন আশ্রয় নিলো আলপনায়। আজও যে আসনে লক্ষ্মী মূর্তি স্থাপন করে পুজো করা হয় তার নীচেও পদ চিহ্ন আঁকা হয়। পিঁড়িতেও লক্ষ্মীর পা আঁকা হয়। সংকল্পের ঘটের নীচে অনেকে আঁকেন। এখানেই স্পষ্ট হয় মূর্তি এসে প্রতীকের জায়গা । হেঁটে এসে লক্ষ্মী প্রবেশ করার তত্ত্ব একেবারেই নতুন । কারণ জোড়া পায়ে কেউ হাঁটতে পারে না।
লোকজন বলেন কোজাগরী শব্দের অর্থেও যে জেগে থাকবেন মা তার বাড়ি যাবেন। মানুষ ধারণা জন্ম, ওই পদ চিহ্নের আলপনার অর্থ হল মা ওই পথ ধরেই মা ঘরে আসেন। কিন্তু হেঁটে আসার ভঙ্গিমার সঙ্গে আলপনার আঁকা মেলে না। আজ আবার দ্বিপদ স্টিকারের পা-ই এখন কোজাগরী পূর্ণিমার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ । এক্ষেত্রে পদ যুগল কিন্তু অক্ষত থাকে । তাই মনে এলো এই গল্পটি লক্ষীপূজা আলপনার পা কি সত্যিই লক্ষী ঠাকুরের আগমনের চিহ্ন বহন করে?