ক্যারামবোর্ড
ক্যারামবোর্ড
কলেজ থেকে ফেরার সময় ক্লাবঘর লাগোয়া মাঠের পাশটায় রোজকার মতই দাঁড়ালো শান্তনু। গোধূলির লাল আভায় এখানটা দাঁড়ালে সারাদিনকার ক্লান্তি সারা মাঠে চক্কর খেয়ে সূর্যের সাথেই ডুব মারে পশ্চিম আকাশে। মাঠের ওদিকটায় কিছু বৃদ্ধ মানুষ রংবেরঙের গল্প নিয়ে আড্ডা জমিয়েছেন। দুজন অল্পবয়সী ছেলে সাইকেল চালানো শিখছে। তাদের হাসিতে আনন্দ আর স্বপ্ন যেন প্রতিফলিত হচ্ছে বারংবার। মাঠের একটা ধারে সাত আটজন খুদে ব্যাট বল নিয়ে স্বঘোষিত নিয়মের ক্রিকেট খেলায় মেতেছে। আর মাঠের মাঝখানটায় তাদেরই অগ্রজরা ফুটবলে ব্যস্ত তখন। ক্লাব ঘরটার ভেতরে লাল বাল্বের আলোর তলায় ঠকাস ঠকাস শব্দে ক্যারাম খেলা চলছে। খোলা আকাশের তলায় প্রাণ ভরে শ্বাস নেয় শান্তনু।
- এই যে শোনো!
কে ডাকলো! পেছন ফিরে তাকালো শান্তনু। ক্লাবঘরটা থেকে একজন দাদা বেরিয়ে এল, চশমা পরা, একটা টি শার্ট গায়ে চাপানো। এই দাদাটা তো এই ক্লাবেই থাকে এই সময়টায়। রোজ খেয়াল করে শান্তনু।
- তুমি ঘোষ কাকার ছেলে না?
- হুমম দাদা।
- কলেজ থেকে এই সময় ফের নাকি!
- হুমম।
দাদাটা কেন আলাপচারিতা করছে হঠাৎ তা নিয়ে একটু ইতস্তত বোধ করে শান্তনু। কাঁধে হাত রেখে সুরঞ্জনদা জিজ্ঞেস করে
- দাঁড়িয়ে থাকো কেন এইভাবে একা একা! রোজ-ই দেখি।
শান্তনু হাসে। কথাবার্তা চলতে থাকে, আস্তে আস্তে সুরঞ্জনদারা বন্ধু হয়ে ওঠে শান্তনুর। এরপর থেকে আর ক্লাবঘরের বাইরে নয়, ক্লাবঘরের ভেতরেই পাকাপাকি ভাবে যেন শান্তনুর সান্ধ্যকালীন আস্তানা। কতধরনের গল্প, হাসি, মজা! খুব ভালো লাগে শান্তনুর। সব গল্পে হয়তো অংশগ্রহণ করে না ও। কিন্তু আশেপাশের দাদারা যে হাসছে, গল্প করছে, সেসব দেখতে বেশ লাগে শান্তনুর। সৌম্যদা মাঝে মধ্যে সিঙ্গারা খাওয়ায়। সাড়ে পাঁচটা নাগাদ রিন্টুদা কমল কাকুর দোকান থেকে চা নিয়ে আসে। শান্তনু একটু ইন্ট্রোভার্ট বটে, কিন্তু আজকাল ও অপেক্ষা করে দাদাদের সাথে চায়ের কাপে ধোঁয়া ওড়ানো, গল্পের আসর জমানো এই সন্ধ্যেগুলোর জন্য।
সময় বয়ে চলে। হঠাৎ এই আড্ডায় একদিন অর্ণবদা হাজির হল হাতে দু ব্যাগ ভর্তি খাবার দাবার নিয়ে। মোগলাই পরোটার গন্ধে ক্লাবঘরটা তখন ম ম করছে। সবাই আনন্দিত, উল্লাসিত, বিস্মিতও বটে। কিন্তু হঠাৎ করেই উৎসবের ছন্দে তাল কাটল। অর্ণবদা বলল তার পরের দিনই ভোরের ফ্লাইটে ব্যাঙ্গালোর চলে যাচ্ছে। নতুন চাকরি পেয়েছে। অবশ্য অর্ণবদা প্রতিশ্রুতি দিল যে সবার সাথে যোগাযোগ রাখবে। হাজারো লোকের দেওয়া হাজারো মিথ্যে প্রতিশ্রুতির ভিড়ে এই প্রতিশ্রুতিটাও যে খুব সহজে মিশে ঠুনকো হয়ে যাবে তা আঁচ করতে পারল সবাই। বিদায়বেলায় হাসিমুখে আলিঙ্গনের মাঝেও যেন মনখারাপের সুর।
- এই শান্তনু।
- হুমম গো রিন্টু দা।
- ক্যারাম খেলবি নাকি?
- পারি না তো।
- আমিও থোরি কত পারতাম যেন! এখানে খেলতে খেলতেই তো শিখেছি। দ্যাখ, সুরঞ্জনদা আর সৌম্য পার্টনার হয়, আর এদিকে আমি আর অর্ণবদা হতাম। অর্ণবদা চলে গেল তো। এখন তুই খেললে আমরাও খেলাটা চালাতে পারি।
সবার অনুরোধে রাজি হয়ে গেল শান্তনু। প্রথমদিকে একটু অসুবিধে হত বটে। তারপর আস্তে আস্তে এখন ভালোই পাল্লা দেয় সবার সাথে। সবাইকে চমকে দিয়ে যেভাবে রেড-কভার করলো থার্ড পকেটে, সুরঞ্জনদা ‘সাবাস’ বলতে বাধ্য হল। যদিও ক্যারামবোর্ডটা শুধুই একটা মাধ্যম ওদের আড্ডার, ওদের হাসি ঠাট্টার, তবুও শান্তনু খুব খুশি দাদাদের সাথে সমান তালে পাল্লা দিয়ে খেলতে পারে বলে। এই তো! কিছুদিন আগেও দূরে দাঁড়িয়ে দাদাদের ক্যারাম খেলা দেখত। লাল বাল্বের তলায় অর্জুনকে হার মানানো লক্ষ্যভেদ দেখে মনে হত “বাব্বা! দাদাগুলো কি ভালো খেলে”! আর এখন নিজেই খেলছে। নিজের মনেই সেসব ভেবে হাসে শান্তনু।
ধীরে ধীরে ক্যারামে এতটাই সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠল শান্তনু, যে ওদের কলেজের ক্যারাম টুর্নামেন্টে সবাইকে চমকে দিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল। আরে! যে ছেলেটা আগের বছর অবধি অংশগ্রহণই করেনি! সে কি করে চ্যাম্পিয়ন হয়! চুপচাপ শান্তশিষ্ট ছেলেটা কলেজের বাঘা বাঘা প্লেয়ারদের তখন পরাস্ত করে ট্রফি নিয়ে সোজা ক্লাবঘরে। সুরঞ্জনদা, রিন্টুদাদের ধন্যবাদ জানানোর ভাষা নেই তার। গল্পের ছলে খেলতে খেলতে কখন যে এত ভালো প্লেয়ার হয়ে উঠল ও বুঝতেই পারেনি শান্তনু। বারবার সুরঞ্জনদা বলত “শান্তনু, তোর ভিসুয়াল পার্সেপশনটা সেরা। শুধু একটু বেসের কয়েনগুলো প্র্যাক্টিস কর! দারুণ প্লেয়ার হবি তুই”। সেই মত প্র্যাকটিসও করেছিল শান্তনু। আর আজ ট্রফিটা যেন সেই অধ্যাবসায়ের-ই প্রতিফলন।
সময় বড্ড নিষ্ঠুর। এই হাসি খুশি দিন গুলো বেশিদিন স্থায়ী হল না। অর্ণবদার মত রিন্টুদা আর সৌম্যদাও একদিন চাকরি পেয়ে বাইরে চলে গেল। বড় হচ্ছে সবাই। হাজারো দায়িত্ব এসে চেপে বসছে কাঁধে। আর আড্ডা মারার ফুরসত কোথায়! রবিবার দিনটা সুরঞ্জনদা আর শান্তনু ক্লাবঘরে আসে বটে, কিন্তু সেই নিখাদ আড্ডা আর কোথায় হয়! জীবনের এদিক সেদিক টানাপোড়েনের সমস্যার কথার মাঝে সেই নিখাদ হাসি ঠাট্টাগুলো হারিয়ে যায়। আর ইচ্ছে করে না ক্যারাম খেলতেও। কি হবে! ধুলোর আস্তরণ জমা হয় ক্যারামবোর্ডের উপর। ঘরের এককোণে ক্যারাম-গুটি আর পাউডার পরে থাকে নিঃশব্দে। কত আদরের জিনিস! কত যত্নের জিনিস! আজ কত অবহেলায়, অযত্নে দিন গুজরান করছে। ক্লাবঘরের পাশটা দিয়ে যাবার সময় সেসব দেখে মন ভার হয় শান্তনুর। চোখে জল আসে।
নিজের বাবার কাছ থেকে আস্তে আস্তে পারিবারিক ব্যবসার দায়িত্ব শান্তনু বুঝে নিয়েছে। ব্যবসা, ব্যস্ততা, দায়িত্ব সবকিছু নিয়ে দিব্যি রয়েছে এখন সে। দূর্গা পূজা বা কোনো অনুষ্ঠানে মাঝে মধ্যে দেখা হয় সুরঞ্জনদাদের সাথে। হয়তো কথাবার্তার মাঝে মাঝেমধ্যে স্মৃতির দল বিচরণ করে। কিন্তু ওইটুকুই। আবার যে যার কাজে ব্যস্ত। একদিন শান্তনু খবর পেল ক্লাবঘরের মাঠের অর্ধেকটা নাকি একজন প্রমোটার কিনে নিয়েছেন। খুব খারাপ লাগলো। সুরঞ্জনদাকে ফোন করে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনাও করল। কিন্তু সুরঞ্জনদার আপত্তি নেই। সুরঞ্জনদার যুক্তি অনুযায়ী ভালোই হচ্ছে। আজকাল নাকি মাঠে সেরম বাচ্ছারা খেলতেও আসেনা। মাঠটা বেকার পরে আছে। তার থেকে একটা সাইডে ফ্ল্যাট হওয়া বেটার। তাছাড়া প্রমোটার নাকি বলেছে মাঠের বাকি অংশটা পার্কের মতো সাজিয়ে গুছিয়ে দেবেন। তাতে তো ভালোই হবে। রাত্রেবেলা তো অন্ধকারে ডুবে থাকত মাঠটা, ক্লাবঘরটা। তার থেকে এখন পার্কফার্ক হলে আলো হবে। খারাপ কি! হুমম! যা হচ্ছে হোক। বেকার নস্টালজিক হয়ে মায়া বাড়িয়ে কি দরকার! কাজে বাজে প্রভাব পরতে পারে। তাতে বরং ক্ষতিই হবে।
সেদিন রবিবার। দুপুরবেলা খেয়েদেয়ে উঠে টিভি চালিয়ে বসেছে শান্তনু। কেমন একটা ভ্যাপসা গরম পড়েছে। দুপুরের ভাতঘুম আসবে না এই গরমে। শান্তনুর ভাইপো অভি শান্তনুর পাশে এসে বসল। অভির উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা এই শেষ হলো কদিন আগে। এখন ছুটিই ছুটি।
- কিরে অভি! এখন তো পড়াশুনা নেই! হেব্বি মজা বল!
- হ্যাঁ গো কাকা! তবে বোরও হচ্ছি বুঝলে। সারাদিন বাড়িতে। কাজকর্মও নেই।
- কি করিস তবে সারাদিন।
- আরে বলোনা কাকা, আমাদের পাশের গলিতে একটা মাঠ ছিল। ওটাকে এখন পার্ক বানিয়ে দিয়েছে। ওখানে যাই বিকেলবেলাটা। কিছু বন্ধুবান্ধবও হয়েছে। বেশ কাটে সময়টা।
কোন এক দমকা হওয়ায় বছর পনেরোর আগের স্মৃতি হুড়মুড়িয়ে এসে হানা দেয় শান্তনুর কাছে। সেই সবুজ মাঠ, ক্লাবঘর, ক্যারামবোর্ড যেন চোখের পলকে হাজির হয় শান্তনুর মনের দোরগোড়ায়।
- যাবে কাকা আজ আমার সাথে? আজ তোমারও তো ফাঁকা।
মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো শান্তনু।
বিকেল পাঁচটা নাগাদ ওরা পার্কে গেল। শান্তনুর চেনা মাঠটা অনেকটা বদলে গেছে। ক্রিকেট ফুটবল নিয়ে কেউ দাপাদাপি করছে না। কিছু ছোট্ট ছেলেমেয়ে স্লিপ, দোলনায় চড়ছে তার বদলে। কিন্তু এক রয়ে গেছে সেই খুদেদের সূর্যমুখী ফুলের মত হাসি-মুখগুলো। কিছু বৃদ্ধ আড্ডাও জমিয়েছেন সেই আগের মতন। টুকরো টুকরো অনুভূতিগুলোর কোলাজ শান্তনুর মনে রংমশাল জ্বালিয়েছে তখন।
- কাকা এদিকটা এস। আমার বন্ধুদের সাথে দেখা করাই।
ক্লাবঘরে শান্তনুকে নিয়ে এল অভি। ইটের পাঁজরে পাঁজরে কত স্মৃতি ফুটে উঠছে। ক্যারামবোর্ডটার সামনে অভিরা চার বন্ধু দাঁড়িয়ে বোর্ডে পাউডার দিচ্ছে। লাল বাল্বের তলায় পাউডার থেকে নস্টালজিয়ার গন্ধ ভেসে আসছে। প্রাণ ভরে শ্বাস নিল শান্তনু।