ওলটপালট
ওলটপালট
শেষ হেমন্তের আকাশ পাতলা মেঘের চাদর জড়িয়ে একটু কেমন যেন জবুথবু হয়ে আছে। মেঘের চাদর সরিয়ে মাঝে মাঝে আকাশে উঁকি দিচ্ছে তৃতীয়ার বাঁকা ম্লান চাঁদের ফালি। রুনুর বাহান্ন বছরের ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় আর মনটা ইতিউতি ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অস্থির সব দৃশ্যাবলী মন আর মাথা আচ্ছন্ন করে চিড়ফাঁড় করে দিচ্ছে। রুনু হালকা একটা চাদর গায়ে চাপিয়ে চোখ বুজলো। ওষুধ ছাড়া আজকাল আর ঘুম আসে না।
*********
বড়মা রুনুকে কোলে করে কুমোরপাড়ায় নিয়ে যাচ্ছে ঠাকুর গড়া দেখাতে। পথে যেতে যেতে আঁচলের খুঁট খুলে পয়সা বার করে একটা লজেন্স কিনে দিলো বড়মা। লজেন্স পেয়ে রুনু তো মহা খুশি। ওরা যুগলকিশোর কাকার ঠাকুর গড়ার চালায় পৌঁছে গেছে। বড়মা এবার রুনুকে নামিয়ে দিলো কোল থেকে। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে রুনু একেবারে রঙ তুলি যেখান রাখা আছে তার ঠিক পাশটিতে গিয়ে বসলো।
বড় বড় অবাক দু'টো চোখ মেলে হাঁ করে রুনু দেখছে যুগলকিশোর কাকা কী সুন্দর করে ঠাকুরের চোখ, ভুরু, ঠোঁট, আঙুলের গাঁট নখ সব আঁকছে। একটু একটু করে কেমন তৈরী হচ্ছে ঠাকুরেরা.... দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক , গণেশ সব্বাই।
অনেকক্ষণ হয়েছে রুনুরা এসেছে ঠাকুর গড়া দেখতে। এবারে রুনু একটু উসখুস করে উঠলো। আঁধার ঘনিয়ে সন্ধ্যে হওয়া দেখে রুনু এবার বাড়ী যেতে চাইছে।
বড়মা রুনুর কপালে চুমো খেয়ে বলছে, "তুমি কিন্তু কেঁদোনি রুনুমা, তোমার মা তো আজ একটু কোলকাতায় গেছে, কাল পরশু এসে পড়বে।" ছলছল চোখে কাঁপা কাঁপা কচি গলায় রুনু জানতে চাইছে, "বাবা কখন আসবে?" বড়মার উত্তর, "বাবা একেবারে মাকে নিয়েই ফিরবে।" রুনুর ছোট্ট বুকটা বড্ড টনটন করছে। বড়মা রুনুর মাথাটা নিজের কাঁধে চেপে ধরে বাড়ী ফিরছে। অভিমানী রুনু চুপচাপ, কোনও কথা বলছে না। খানিকটা পরে বড়মার আঁচলটা ভিজে গেছে রুনুর চোখের জলে। কাপড়ের ভেজা অংশ বড়মার কাঁধে একটু জলে ভেজা ঠান্ডা ছ্যাঁকা হয়ে লাগছে যেন। তবুও বড়মা নিশ্চুপ, রুনুকে বুকে আঁকড়ে ধরে পথ হাঁটছে। এবাড়ী ওবাড়ী থেকে ঠিকরে আসা আলো পথের অন্ধকার দূর করতে পারে নি। বড়মা বেরিয়ে আসতে চাওয়া দীর্ঘশ্বাসটাকে কোনোরকমে চেপে রাখলো। আর রুনুকে আরো শক্ত করে চেপে ধরলো বুকে মিশিয়ে।
বড়মা রুনুকে খাইয়ে দাইয়ে শুইয়ে দিয়ে নিজেও রুনুর পাশেই শুয়েছে। রাত ন'টা কি দশটা বেজে গেছে। রুনু বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে, ঘুম আসছে না। বড়মা পিঠে সুড়সুড়ি দিচ্ছে, তাও রুনু ছটফট করছে। রুনু এবারে কচি দু'হাত মেলে বড়মাকে জাপটে ধরেছে। পরমস্নেহে বড়মা রুনুর চুলে বিলি কাটছে। আর রুনু বিরাট এক হাই চাপতে চাইছে, বড়মা যে সবে তখন ক্ষীরের পুতুলের গল্পটা ধরতাই রেখে শেষ করছে। আর পারলো না জেগে থাকতে, রুনু এবার চোখ বুজে ফেলেছে। ঘুমিয়ে কাদা রুনু।
রুনু দেখছে মা-বাবা কতকিছু এনেছে।
বড়মা চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাসটা ছাড়লো এতোক্ষণে।
এতোক্ষণে হয়তো রুনুর মা স্টেজে উঠেছে, রুনুর বাবা হয়তো বাঁশীতে ফুঁ দিয়েছে। অনেককাল পরে ওরা দলে ডাক পেয়েছে। কোলকাতায় গিয়ে ওরা দলের বাসে করেই দূরের কোন এক ছোট শহরে যাবে। আজকাল ওরা আর তেমন কাজ পায় না, বড্ড আকাল। আর ওরা যে কিছুতেই অন্য কাজে মন দিতে পারে না। যাত্রাপালাই ওদের জীবন মরণ। এই যাত্রাপালা গানই তো মিলিয়েছিলো ওদের দু'জনকে। তারপর রুনু হয়েছে, আর দেখো, আজ সংসারের যাঁতাকলে পিষ্ট ওরা, অভাব বড় বালাই।
**********
পরেরদিন খুব ভোরে সদর দরজায় ঠুক ঠুক করে আওয়াজটা রুনুই প্রথম শুনে বড়মাকে ডেকে বলেছিলো, "বড়মা, বাবা-মা এসে গেছে। দরজা খুলে দাও।" ধড়মড়িয়ে উঠে বড়মা দরজা খুলতে ছুটলো আঁচল সামলে। পেছন পেছন রুনুও।
তারপর ডুকরে কেঁদে উঠেছিলো বড়মা, রুনুকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে রেখে। রুনু অবাক, বাবা-মা নয়? তবে কী এমন বললো লোকটা? বড়মা ওরকম করে কাঁদছে কেন? বড়মা তো কখনো কাঁদে না, বরং রুনুকেই কাঁদতে বারণ করে সবসময়। রুনু যত ডাকে, "ও বড়মা," বড়মা তত জোরে কাঁদে। রুনু ভাবতে বসলো, "বাবা-মা যে কখন আসবে? বড়মা বলেছিলো বাবা-মা কতকিছু আনবে। আর এখন বড়মা কোনো সাড়াই দিচ্ছে না।" অধৈর্য্য রুনু এবার বড়মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। আর বড়মা বললো, "ওরে, মুখপুড়ি হতভাগী, কাঁদ রে, যত পারিস কাঁদ।" একথা শুনে রুনু চুপ করে গেলো একদম, বড়মা কী তাকে রাগ করে কাঁদতে বলছে? রুনু ভেবে ভেবে কূলকিনারা পায় না।
*********
রোজ রুনু ভাবে কাল পরশু কবে শেষ হবে?
বড়মা কোথায়? সেই থেকে রুনু আশ্রমে। বড়মাই ওকে নিয়ে চলে এসেছিলো এখানে। তারপর বড়মা একদিন হাসপাতালে যাচ্ছিলো একা একা, চোখে ছানি পড়েছিলো বলে। সেই যে গেলো বড়মা রুনুকে একলা এই আশ্রমটায় ফেলে রেখে, আর ফিরলো না। রুনুর জীবন থেকে তিন তিনটে মানুষ একদম কোথায় যে হারিয়ে গেলো?
**********
রুনুর হাসিটা ভারী মিষ্টি, খুব আস্তে আস্তে কথা বলে, কোনো ঝঞ্ঝাট নেই রুনুর। সবাই রুনুকে খুব ভালোবাসে। নতুন ম্যাডাম রুনুর সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। মেট্রনের হাত থেকে কেস হিস্ট্রি ফাইলটা নিয়ে ওল্টাতে ওল্টাতে থমকালেন........
"রুনুর চারবছর বয়সে ওর যাত্রাশিল্পী বাবা-মা দু'জনেই একসাথে মারা যায়। পালা শো করতে যাবার সময় যাত্রাদলের বাস ব্রেক ফেল করে উল্টে পড়ে রাস্তার ধারের নয়ানজুলিতে। ঘটনাস্থলেই মারা যায় রুনুর বাবা-মা। তারপর থেকে রুনু বড়মার কাছেই ছিলো। এক আশ্রমে। বড়মা রুনুর বাবা-মায়ের আপন সম্পর্কের কেউ না। রুনুর বাবা-মায়ের সাথেই এককালে বড়মাও যাত্রাদলেই অভিনয় করতো। বয়স আর কাজ করবার ক্ষমতা গেলে রুনুর বাবা-মা বড়ো মায়ায় পড়ে সাতকুলে কেউ না থাকা মানুষটাকে একা চলে যেতে দেয় নি। বড়মাই রুনুর মা'কে নিজে হাতে ধরে ধরে কাজ শিখিয়েছে এককালে। এক সম্পর্কবিহীন আত্মীয়তার বন্ধনে তিনটি মানুষ বাঁধা পড়লো।
রুনুর বাবার পরিত্যক্ত পৈতৃক বাড়ীটায় আবার সেজে উঠেছিলো নতুন করে সংসার। রুনুর বাবা-মা আর বড়মার সংসার। তার মাঝে রুনু এলো অনেক আশার আলো নিয়ে। কিন্তু রুনুর জীবন থেকে এক ফুঁয়ে কেউ যেন নির্মমভাবে সব আলো নিভিয়ে দিলো। মুছিয়ে দিলো সব ভালোবাসা রুনুর মাত্র আটবছর বয়সেই। হাসপাতালে চোখ দেখিয়ে ফেরার পথে রুনুর বড়মা বাসের চাকায় পিষে গেছিলো। দেহটা রুনুকে দেখাতে নেওয়াটাই মহা ভুল ছিলো। আট বছরের রুনু বড়মার বিকৃত দেহটা দেখার ধাক্কাটা নিতে পারলো না। স্মৃতি হারিয়ে বসে রইলো। আর অদ্ভুত ভাবে রুনুর চার বছর বয়স থেকে আট বছর বয়স পর্যন্ত বড়মার সঙ্গে থাকার সময়কার পুরো স্মৃতিটা তাজা এখনো। মানসিক ভাবে আটকে আছে ঐ আট বছরেই।
যেখানে ছিলো রুনু, ঐ আশ্রম থেকেই একটা এনজিও রুনুকে এই এসাইলামে এনেছে। সেই থেকে এখানেই রুনু, তবে এই জায়গার পার্থক্যটা ও ধরতে পারে না।"
**********
সত্যিই স্মৃতিরা বড় বেইমান!
------------------------------------------