যথার্থ পরিচয়
যথার্থ পরিচয়


"একটু মানিয়ে নিয়ে চল্ না মা। সব কথা অতো ধরতে নেই। সংসারে হাঁড়ি কলসী একসঙ্গে থাকলে একটু তো ঠোকাঠুকি হবেই। " মানবী যখনই নিলয়ের ব্যাপারে ওর মা'কে কিছু বলতে যায়, তখনই ওর মা ওকে এই কথা বলে। কিন্তু মানবী একটা কথা ওর মা'কে কিছুতেই বোঝাতে পারছে না যে ওরও সহ্যের একটা সীমা আছে। এইভাবে কতদিন চলবে আর। যত মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়া শুধুমাত্র ওর ক্ষেত্রেই কেন হবে। দুই বোনের বড়ো হওয়ার সুবাদে বাবা রিটায়ারমেন্টের আগেই ওর বিয়েটা দিয়ে দিতে চেয়েছিল। কারণ এরপর ছোট বোন, ভাই এদেরও ভবিষ্যত আছে। আর তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও মানবীকে নিজের সমস্ত ইচ্ছা জলাঞ্জলি দিয়ে জোর করেই একপ্রকার বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হয়েছিল। অনেক বার ও মাকে বলেছিল, ও এখনই বিয়েটা করতে চায় না। কিন্তু বাড়ির চাপে শেষ পর্যন্ত ওর কোনো আপত্তি ধোপে টেকে নি। সরকারি চাকরি করা সুপাত্রের হাতে বাবা ,মা নির্ভাবনায় মেয়েকে তুলে দিয়ে মেয়ের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে চেয়েছিল। কিন্তু ওর বাবা,মা এটা বুঝতে পারেনি তখন ,মেয়েকে শুধুমাত্র ভালো চাকরি করা পাত্রের হাতে তুলে দিলেই সব দায়িত্ব পালন করা হয়ে যায়না। মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য তার নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা কতটা জরুরি। বিয়ের পর মানবী ওর স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির সকলের প্রতি নিজের দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করেছিল। কিন্তু বিনিময়ে ও কি পেল? শুধুমাত্র বঞ্চনা আর অপমান প্রতি পদে পদে।
বিয়ের পর প্রথম প্রথম মানবী আর নিলয়ের মধ্যে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও, ধীরে ধীরে কোথাও যেন একটা চুলের মতো ফাটল ধরতে শুরু করেছিল। আর সেই চুলচেরা ফাটল ধীরে ধীরে কবে যে একটা বড়সড় ফাটলের রূপ নিয়েছিল, সেটা মানবী নিজেও বুঝতে পারেনি। নিলয় ওর অফিসের কলিগ প্রেরণার সঙ্গে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা কফিশপ বা রেস্টুরেন্টে সীমাবদ্ধ থাকলেও ধীরে ধীরে সেটা ঘরের চার দেওয়ালের গন্ডিতে প্রবেশ করে গিয়েছিল। কখনও কখনও রাতেও বাড়ি ফিরত না নিলয়। প্রেরণার ওখানেই থেকে যেত। অফিসে নাইট শিফটে কাজ আছে বলে মানবী কে ধোঁকা দেবার চেষ্টা করতো প্রথম প্রথম। কিন্তু এইসব ঘটনা জানাজানি হতে বেশী সময় লাগে না। নিলয়ের এক বন্ধুর বাড়ি প্রেরণাদের পাড়াতেই। পরিচিত হবার সুবাদে সেই বন্ধুর বউ একদিন ফোনে মানবীকে জানায় কথাটা। নিলয়কে জিজ্ঞেস করাতে সরাসরি অস্বীকার করে সে। মানবী এটা বুঝতে পারে না যে, একটা মানুষ এতটা পরিষ্কার ভাবে সাজিয়ে মিথ্যে কি করে বলতে পারে। দিনের পর দিন প্রেরণার সঙ্গে রাত কাটিয়েছে ওর বাড়িতে নিলয়। আর তারপর ঘরে এসে মানবীর সঙ্গে স্বামী হবার দক্ষ অভিনয় করে গেছে। কোথাও এতটুকু সন্দেহের অবকাশ রাখে নি।
মানবী যেদিন প্রথম শুনেছিল, নিলয়ের ব্যাপারে ,ওর শাশুড়ি কে বলতে গিয়েছিল ও। শাশুড়ি ওকে বলেছিলেন আস্তে আস্তে,"আগে পুরো ব্যাপারটা জানো ভালোভাবে, তারপর কিছু সিদ্ধান্ত নিও।অন্যের কথায় বিশ্বাস করে কোনো সিদ্ধান্ত নিওনা।" মানবীর মনও কি বিশ্বাস করতে চেয়েছিল কথাটা? কিন্তু প্রথম যেদিন স্বামীর শরীরে অন্য মেয়ের সোহাগের চিহ্ন দেখতে পেয়েছিল ও, সেদিন কি করে অস্বীকার করতো ও নিজের চোখ দুটোকে। আর কতোটা না বোঝার ভান করে থাকত ও। কানে তো টুকরো টুকরো কথা ভেসে আসছিলো ই। এবার চক্ষু কর্ণের বিবাদ মিটলো সব স্বচক্ষে দেখার পর। সেদিন শোবার ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল ও। সারারাত বাইরের ঘরে কাটিয়েছিল সেদিন। নারী হিসাবে নিজের এতবড় অপমান মেনে নিতে পারেনি মানবী সেদিন। বাবা, মাকে ফোন করে কোনো লাভ নেই, কারণ ওরা আবার সেই মানিয়েই চলতে বলবে মানবীকে। শাশুড়িকে বলে পরদিন ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় মানবী। না শাশুড়ি মা কোনো রকম বাধা দেননি মানবীকে। বরং বলেছিলেন, "যাও নিজের মতো করে নিজের জীবনটাকে তৈরি করে নাও। নিজের যোগ্যতায় সমাজে নিজের একটা অস্তিত্ব তৈরী করো। যাতে সবাই তোমাকে নিলয়ের স্ত্রী হিসাবে না দেখে, তোমার নামেই তোমাকে চেনে। আজ থেকে তোমার নামই হোক তোমার পরিচয়। কারুর স্ত্রী, মেয়ে বা মা হিসাবে না।" মানবী অবাক চোখে শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে, আর ভাবে, এই মানুষটা তাকে এত ভালোবাসেন। যেটা তার নিজের বাবা, মা কখনও ভাবেনি বিয়ের আগে তার জন্য, এই মানুষটা তার নিজের ছেলেকে মানবী ছেড়ে চলে যাবে জেনেও ,তাকে এতটা সমর্থন করছেন। খুব বড়ো মনের মানুষ না হলে এটা করা যায় না , কখনও করা যায়না। মানবী ঘর ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত তো নিয়েছে, কিন্তু যাবে কোথায়? বাপের বাড়িতে গেলেও মা, বাবা কখনও মেনে নেবে না এটা যে সরকারি চাকুরে জামাইকে ছেড়ে , তাদের মেয়ে শুধুমাত্র নিজের আত্মসম্মান বোধের জন্য স্বামীকে ছেড়ে এসেছে। সব শুনলে মা হয়তো এটাও বোঝাবে, " অনেক পুরুষ মানুষেরই ওরকম একটু আধটু দোষ থাকে। তাই বলে কি সবাই স্বামীর ঘর ছেড়ে, সারা জীবনের মতো স্বামীকে ছেড়ে চলে আসে? এরকম বোকামি করিস না মানবী। যা মুখ বুজে সহ্য করতে শেখ। একটু বয়স হলে, ওসব ঠিক হয়ে যাবে।" আর ঠিক এই কারণেই মানবী মরে গেলেও বাপের বাড়ি যাবে না। শাশুড়ি মা বোধহয় মানবীর মনের এই দোলাচল কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। বললেন,"তোমার রাঙা মাসিমা একা থাকেন, ওনারও বয়স হয়েছে, দেখাশোনা করবার কেউ নেই। অতবড় বাড়ি খালিই পড়ে থাকে। তুমি বরং ওখানেই থাকো গিয়ে। তুমি ওখানে থাকলে, সেই সুবাদে আমারও মাঝে মাঝে ওখানে যাওয়া হবে, নিজের দিদির সঙ্গে দু দন্ড বসে মনের কথা বলতে পারব এই বয়সে।" মানবী বিস্ময়ে হতবাক। এই মানুষটা তার জন্য এত কিছু ভেবেছেন। কি করে বুঝলেন, এই মুহূর্তে মানবী কি ভাবছিলো।
পরদিন মানবী নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে রাঙা মাসিমার ওখানে চলে গিয়েছিল। নিলয়কে ও কিছু বলেনি এ ব্যাপারে। যে মানুষটার ওর প্রতি কোনো আগ্ৰহই নেই আর , তাকে ও নিজের জীবনের সিদ্ধান্তের কথা বলতে যাবেই বা কেন। শাশুড়ি মা ই ওকে সঙ্গে করে রাঙা মাসিমার বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন। যাবার আগে শাশুড়ি মা বুঝিয়েছিলেন মানবীকে,"আজ থেকে নতুন করে শুরু করো আবার। আমি তোমার সঙ্গে আছি।"
মানবীর চোখ ছলছল করছিলো, এই মানুষটাকে ছেড়ে থাকতে হবে বলে। কিন্তু নিজের মনকে শক্ত করে ও এই ভেবে যে, যে মানুষটা ওর জন্য এতো করলো, সেই মানুষটার ইচ্ছাকে যথাযোগ্য মর্যাদা ও দেবে না? এরপর নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবার উদ্দেশ্যে ও দু বছরের একটা টিচার ট্রেনিং নিয়েছিল। না তারপর বেশীদিন ওকে অপেক্ষা করতে হয়নি ওর অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য। বছর তিনেকের মধ্যেই ও একটা ভালো সরকারি স্কুলে টিচার হিসাবে জয়েন করেছিল। চাকরিটা পেয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলেছিল মানবী। এর মাঝে নিলয় বহুবার ওর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। কিন্তু মানবী নিলয়ের এই দ্বিচারিতা স্বভাবের সঙ্গে মানিয়ে নিতে চায়নি আর কোনো ভাবেই। ধীরে ধীরে ও নিজের মনকে বোঝাতে শিখে গিয়েছিল। প্রথম প্রথম ওর খুব কষ্ট হতো, কিন্তু তারপর আর হয়নি। কষ্ট সহ্য করতে শিখে গিয়েছিল ও ধীরে ধীরে। ওর প্রেরণাদাত্রী শাশুড়ি মা যেদিন ও চাকরি পাবার পর, ওকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, "দেখলে তো, চেষ্টা করলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয় তাহলে। তোমার কাজই আজ তোমার যথার্থ পরিচয়। আর একটা কথা, এবার তুমি ডিভোর্সের জন্য বলতে পারো নিলয়কে।" শাশুড়ির কথায় অবাক মানবী মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবে, এভাবেও ভাবা যায় তাহলে। এভাবেও সব হারিয়ে নতুন করে শুরু করা যায় তাহলে।
সমাপ্ত