যোগ্যতা (বিষয় - পাশফেল)
যোগ্যতা (বিষয় - পাশফেল)
বাবাই, মধুযামিনী এবার তো আমাকেও টপকে গেল। হান্ড্রেড পারসেন্ট মার্কস। এখনও তুমি চুপ করে থাকবে? তানিশার কথাগুলোতে রাগ, উদ্বেগ ও বিরক্তি ঝরে পড়ল।
অম্লান ব্যানার্জী খবরের কাগজে মুখ ডুবিয়ে চোখে-মুখে হাসি মেখে মন দিয়ে মনের আঁকা একটা ব্যাঙ্গ-চিত্র দেখছিল। মেয়ের কথায় তার মনের বিরুদ্ধেই মনের ব্যাঙ্গ-চিত্র থেকে তাকে বেরিয়ে আসতে হল।
তোমার রেজাল্ট কেমন হয়েছে, সেটা বল। অপরের রেজাল্টে আমার আগ্রহ নেই।
আমি নাইনটি নাইন পার্সেন্ট। বেঙ্গলি ছাড়া সব সাবজেক্টেই ফুল মার্কস। কিন্তু মধুযামিনী বাংলাতেও ফুল মার্কস।
আবার সেই এক কথা। তুমি তোমার কথা ভাবো। তুমি যথেষ্ট ভালো রেজাল্ট করেছ। সবসময় যে তুমি ক্লাসের টপ হবে এরকম তো কোনও কথা নেই।
তাই বলে মধুযামিনীর কাছে হেরে যাবো? যে মেয়েটা এক বছর আগেও কোনোরকমে পাশ করে ক্লাসে উঠত, যে মেয়েটা গত বছরও হাপ-ইয়ার্লিতে ফেল করেছিল, তার কাছে?
হতে পারে ও ওর খারাপ রেজাল্ট থেকে শিক্ষা নিয়েছে। নিজেকে ভালো ভাবে তৈরি করেছে। তাই এখন ভালো ফল করছে।
হতে পারে না। যে মেয়েটার মেরিট নেই, বংশের কেউ তেমন শিক্ষিত নয়, সে মেয়েটা হঠাৎ করে এরকম একটা রেজাল্ট করে ফেলবে, এটা অসম্ভব। রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে স্বামীর কথার প্রতিবাদ করল শ্রীবন্তী।
শুধু তানিশার বাড়িতেই নয়, ক্লাসের সবার বাড়িতে এখন একটাই আলোচনার বিষয়, মধুযামিনীর নবম শ্রেণীর বার্ষিক ফল। সেই আলোচনা অস্বাভাবিকও নয়। গত বছর অর্ধ-বার্ষিকী পরীক্ষার ফল বের হওয়ার কিছুদিন পর মধুযামিনীর স্কুলে থাকাই সমস্যা হয়ে গিয়েছিল। মধুযামিনীর বাবা প্রশান্ত নস্করের অনুরোধ, ও বিদ্যালয়ের অঙ্কন শিক্ষক প্রচ্ছদ মিত্রের পক্ষপাতিত্বতে একটা সুযোগ পায় মধুযামিনী। ও সেই সুযোগের এরকম সদ্ব্যবহার যে করতে পারবে তা কেউ কল্পনাই করতে পারেনি।
মধুযামিনীর এই সাফল্যের কৃতিত্ব ওর চেয়ে প্রচ্ছদ মিত্রেরই বেশি। উনি স্বেচ্ছায় প্রশান্ত নস্করকে বলে ছ-মাসের জন্য তার মেয়ের দায়িত্ব নেন। আর ছয়মাসেই মধুযামিনীকে সম্পূর্ণ বদলে দেন তিনি। ষাণ্মাসিক পরীক্ষায় যে মেয়েটি অকৃতকার্য হয়েছিল, সেই মেয়েটিই সবাইকে অবাক করে বার্ষিক পরীক্ষায় শতকরা নব্বই নম্বর পেয়ে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়। প্রশান্ত-বাবু, প্রচ্ছদ মিত্রকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা খুঁজে পান না। ওনার তত্ত্বাবধানে মেয়েকে দিয়ে নিশ্চিন্ত হন প্রশান্ত। তারপর মধুযামিনীর সাফল্য লাভ থেমে থাকেনি। নবম শ্রেণির শ্রেণি পরীক্ষা, ষাণ্মাসিক, ও বার্ষিক পরীক্ষায় অসাধারণ ফল করে ধীরে ধীরে ক্লাসের সকল ছাত্র-ছাত্রীকেই ছাপিয়ে যায় মধুযামিনী।
মধুযামিনী যখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী, স্কুল কর্তৃপক্ষ ওকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে তার কারণ মধুযামিনীর পড়াশোনা নয়। ওর আচরণ, ওর এমন একটা কাজ যা ওদের শ্রেণী-শিক্ষিকা দয়মন্তি বসাকের সম্মানহানি করেছিল। শুধু শ্রেণী-শিক্ষিকারই নয়, ওর বাবা-মায়ের মাথাও নত হয়ে গিয়েছিল ওর ঐ কাজে। স্কুল কর্তৃপক্ষ ওর বাবা-মাকে ডেকে আলোচনা সভা বসিয়েছিল। মেয়ের হয়ে ক্ষমা চাওয়া ও মেয়েকে আরেকটি সুযোগ দেওয়ার অনুরোধ করা ছাড়া ওনাদের আর কিছু বলার ছিল না।
লেখাপড়ায় কোনদিনই ভালো ছিল না মধুযামিনী। লেখাপড়া করতে ভালও লাগত না ওর কখনও। স্বাভাবিক ভাবেই কোনও ক্লাসেই ওর মন থাকত না। শিক্ষিকারা যখন ক্লাসে তাদের নির্দিষ্ট বিষয় বোঝাতে ব্যস্ত থাকত, তখন মধুযামিনী আপন মনে নারীপুরুষের নানা রকমের নগ্ন ছবি আঁকত। ঐ দিন যখন দয়মন্তি বসাক ওদের ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের মাথায় বীজ-গণিতের বীজ বপনের চেষ্টা করছিলেন, তখন তার অসাবধানতায় বা তিনি অন্যমনস্ক থাকায় শাড়ির আঁচল সরে গিয়ে তার বক্ষ বিভাজিকা দেখা যাচ্ছিল। মধুযামিনী সেই দৃশ্য পেন্সিলের সাহায্যে ওর খাতায় বন্দী করে। আর সেটা মধুযামিনীর পাশের ছাত্রীর চোখে পড়ে যায়। ও ওর পেছনে বসে থাকা ছেলেটিকে দেখায়। মুহূর্তের মধ্যেই অনেকগুলো কৌতূহলী চোখ মধুযামিনীর খাতার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। স্বাভাবিক ভাবেই সেটা দয়মন্তি ম্যাডামের চোখে পড়ে।
মধুযামিনীর আঁকা ছবিটিতে কারো নাম লেখা ছিল না। তবু ওটা যে দয়মন্তি ম্যাডামকেই আঁকা হয়েছে, তা কারও বুঝতে অসুবিধে হল না। খাতাটি হাতে নিয়ে পাতা ওল্টাতেই নারীপুরুষের নানা রকমের নগ্ন ছবি চোখে পড়ল দয়মন্তির। কোনও কথা না বলে, কাউকে কোনও রকম শাস্তি না দিয়ে খাতাটা নিয়ে প্রধান শিক্ষিকার কাছে জমা দিলেন উনি। সবটা শুনে ও দেখে প্রধান শিক্ষিকা মধুযামিনীর অভিভাবকদের ডেকে একটা আলোচনা সভা বসালেন।
আলোচনায় উপস্থিত সকল শিক্ষক-শিক্ষিকারাই মধুযামিনীর বিরুদ্ধে মত পোষণ করেন। তাদের কথায় এরকম একটি মেয়ে স্কুলে থাকলে অন্য মেয়েরাও ওর প্রভাবে খারাপ হয়ে যাবে। তাই অবিলম্বে ওকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা উচিৎ। তবে অঙ্কন শিক্ষক প্রচ্ছদ মিত্রের বক্তব্য ছিল সকলের মতামতের বিপরীত। তিনি বললেন, চরম শাস্তি দেওয়ার আগে একটা সূযোগ দেওয়া উচিৎ সবাইকেই। মধুযামিনীর বাবা-মায়ের মত থাকলে আমি একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি। কথা দিচ্ছি মধুযামিনীর এই আচরণ দুবার হলে আমি নিজে দায়িত্ব নিয়ে ওকে স্কুল থেকে বার করে দেব।
প্রচ্ছদ মিত্রের অনুরোধে মধুযামিনীকে একটা সুযোগ দিতে রাজি হলেন প্রধান শিক্ষিকা। তবে তিনি সকল শিক্ষক-শিক্ষিকাকে মধুযামিনীর ওপর কড়া নজর রাখতে বললেন। তার ঐ স্বভাবের পুনরাবৃত্তি লক্ষ করা গেলে কোনও রকম আলোচনা ছাড়াই মধুযামিনীকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হবে।
আলোচনা সভা শেষ হলে মধুযামিনীর বাবা মাকে প্রচ্ছদ মিত্র একটু আড়ালে ডেকে বললেন, কাল থেকে মেয়েকে সন্ধ্যে ছয়টা নাগাদ রোজ আমার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যাবেন। আর সাড়ে নটা দশটা নাগাদ একটা ফোন করে নিয়ে যাবেন। ছুটির দিনে আমি আমার সুবিধে মত ওকে ডেকে নেব। ছয় মাস আমাকে বা আপনাদের মেয়েকে কোনও রকম প্রশ্ন করা যাবে না। ছয় মাসের মধ্যে ও যদি একই ভুল দুবার করে, অথবা অ্যানুয়াল এক্সামে যদি রেজাল্টের কোনও রকম ইমপ্রুভমেন্ট না হয় তবে আমি যেকোনো রকম ক্ষতিপূরণ দিতে প্রস্তুত।
প্রশান্ত বাবু বিনীত ভাবে বললেন, আপনি যেচে আমার মেয়ের দায়িত্ব নিতে রাজি হয়েছেন, এ আমাদের পরম ভাগ্য। আপনি আপনার মত করে ওকে পড়াবেন। আমরা দেখতে যাব না। তবে আপনাকে প্রতি মাসে কত দিতে হবে যদি বলেন।
টাকা-পয়সা এখনই কিছু দিতে হবে না। আমি আমার প্রয়োজন মতো চেয়ে নেব। কথাটা বলে প্রচ্ছদ স্যার মধুযামিনীকে ডেকে বললেন, যা হওয়ার হয়ে গেছে। এসব নিয়ে আর ভেবো না। কাল থেকে নতুন করে শুরু করতে হবে। তোমার ওপর ভরসা করে আমি একটা বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিয়েছি। আমাকে ডুবিও না যেন। যে খাতাটাতে তুমি স্কুলে বসে ঐসব শিল্প-কর্ম করতে, সেই খাতাটা আর একটা নতুন খাতা নিয়ে কাল চলে এস। আমার কথা শুনে চললে আশাকরি ছয়মাসের মধ্যে একটা কিছু ফল পাওয়া যাবেই।
পরদিন যথা সময়ে মধুযামিনীকে ওর মা প্রচ্ছদ স্যারের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এলেন। মধুযামিনীর সেই আঁকার খাতাটা হাতে তুলে নিয়ে পাতা ওলটাতে থাকলেন প্রচ্ছদ। একটি পাতায় থেমে গেলেন উনি। সার্ট পরা একটি মেয়ের ছবি। নিচের একটি বোতাম ছাড়া সার্টের সব বোতামই খোলা। সার্টের নিচে কোনও অন্তর্বাস নেই।
এই ছবিটা কি তুমি কোনও ছবি দেখে এঁকেছ ?
না, নিজের মন থেকে এঁকেছি।
ছবিটাতে ভুল আছে।
কি ভুল স্যার?
তুমি তো সার্ট পরেই আছো। নিজেই লক্ষ করে দেখো, কি ভুল আছে।
মধুযামিনী নিজের জামাটা ভালো ভাবে দেখে, ছবিটা দেখল। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারল না।
ঠিক বুঝতে পারছি না স্যার।
মেয়েদের সার্টের বোতাম সার্টের বা দিকে থাকে, আর ছেলেদের ডানদিকে। ছবি আঁকতে গেলে পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ভালো হতে হয়। এখানে তোমার পড়াশোনার সাথে সাথে আঁকার চর্চাও করানো হবে। পড়াশোনা তুমি করবে শুধু ডিগ্রি পাওয়ার জন্য। তাই সেটার জন্য আমরা টেকনিক, কৌশল অবলম্বন করব। তবে তোমার প্রকৃত ট্যালেন্ট আঁকায়। তাই ওটাকে অবলম্বন করেই তোমাকে তোমার ভবিষ্যৎ গড়তে হবে।
আপনি যেমন বলবেন, তেমনটাই হবে। তবে স্যার আমার একটা প্রশ্ন আছে। বলব?
নিঃসঙ্কোচে বল।
সব টিচাররা যখন আমাকে স্কুল থেকে বার করে দিতে চাইছিল, তখন আপনি কেন আমাকে একটা সুযোগ দেবার জন্য অনুরোধ করলেন?
সবাই তোমার আঁকার মধ্যে নগ্নতা, অশ্লীলতা দেখেছিল। কিন্তু আমি ঐ আঁকার মধ্যে তোমার শিল্পী-সত্ত্বা দেখতে পেয়েছিলাম। তুমি তোমার পেন্সিলের টানে কি সুন্দর নিখুঁত ভাবে দয়মন্তি ম্যাডামকে ফুটিয়ে তুলেছিলে, দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে ছিলাম। মনে হয়েছিল একটু অনুশীলন আর সঠিক রাস্তায় তোমাকে চালিত করতে পারলে তোমার মধ্যের সম্ভাবনার চারাগাছটিকে বৃক্ষে পরিনিত করা সম্ভব। সেই জন্যই তোমাকে একটা সুযোগ দেবার জন্য আমি হেড মিস্ট্রেস কে অনুরোধ করি। তুমি শুধু আমার কথা শুনে চল, বাকি দায়িত্ব আমার। তবে একটা কথা, এখানের কোনও কথা কখনও কাউকে শেয়ার করবে না। এমন কি তোমার বাবা-মাকেও নয়।
প্রচ্ছদ মিত্রর সব শর্তে রাজি হয়ে ঐ দিন ওনার বাড়ি থেকে চলে এসেছিল মধুযামিনী। তারপর থেকে শুরু হল তার সংগ্রাম। নানারকম অনুশীলন। প্রশান্ত বাবুর থেকে মাসে মাসে কোনও টাকা না নিলেও এক মাসের মধ্যে এক কালীন একটা মোটা টাকা নিয়ে নেন প্রচ্ছদ। অতগুলো টাকা একবারে দিতে একটু সংকোচ বোধ হলেও কোনও রকম প্রশ্ন না করেই টাকাটা দিয়ে দিয়েছিলেন প্রশান্ত নস্কর। প্রতিটি পরীক্ষার আগে মধুযামিনী, ওর প্রচ্ছদ স্যারের বাড়ি হয়ে যেত। ব্যাপারটা মধুযামিনীর মা বনানীর মোটেই ভালো লাগে না। তবে মেয়ের বার্ষিক পরীক্ষার ফল দেখে মেয়েকে বা প্রচ্ছদ মিত্রকে কিছুই বলতে পারেননি উনি। কিন্তু বনানী নস্করের মনে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়।
মধুযামিনীর এমন রেজাল্ট ওর সহপাঠীরা এবং শিক্ষক-শিক্ষিকারাও অনেকে মেনে নিতে পারেননি। তাই পরীক্ষার সময় মধুযামিনীকে একটু বেশীমাত্রাতেই নজর বন্দী করা হয়। সহপাঠী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নজর অগ্রাহ্য করে পরীক্ষা দিয়ে যায় সে। প্রথম দশ মিনিট নেয় প্রশ্নপত্র পড়ার জন্য। প্রশ্নপত্রের শুরু থেকে, অর্থাৎ স্কুলের নাম, পরীক্ষার বিষয়, প্রভৃতি থেকে শেষ পর্যন্ত সবটাই তর্জনী ছুঁয়ে পড়ে নেয় মধুযামিনী। তারপর শুরু হয় তার লেখা। মাথা না তুলে, কোনও দিকে না তাকিয়ে এক নাগাড়ে লিখে চলে ও। সহপাঠী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কারও কিচ্ছু বলার থাকে না।
তবুও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মনের সন্দেহ যায় না। তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে যে, মধুযামিনী কোনও অসাধু উপায় অবলম্বন করেই পরীক্ষা দিচ্ছে। ওর মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া উচিৎ।
এ কথা শুনে প্রচ্ছদ মিত্র ওনাদের বলেন যে, মৌখিক পরীক্ষা নিলে সবার নিতে হবে। নিয়ম সবার জন্য সমান হওয়া উচিৎ। আর বেশি বাড়াবাড়ি করলে মধুযামিনীকে এই স্কুলে রাখা যাবে না। ও এখন যা রেজাল্ট করছে, তাতে যেকোনো স্কুল ওকে লুফে নেবে। মাধ্যমিকে প্রথম দশজনের মধ্যে ওর স্থান নিশ্চিত। মাঝখান থেকে আমাদের স্কুল সেই সম্মান থেকে বঞ্চিত হবে।
শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আলোচনা প্রধান শিক্ষিকার কানে যেতে উনি সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে, মধুযামিনীকে বিশেষ ভাবে পরিচর্যা করার নির্দেশ দেন। ও যেন সহজেই স্কুলের নাম উজ্জ্বল করতে পারে, সেই দিকে সবাইকে নজর দিতে বলেন। ফল স্বরূপ সকল শিক্ষক-শিক্ষিকারাই মধুযামিনীকে নানাভাবে সুযোগ সুবিধে দিতে বাধ্য হল।
মাধ্যমিকে অষ্টম স্থান অধিকার করে স্কুলের নাম উজ্জ্বল করল মধুযামিনী। সংবাদ ও টেলিভিশন মাধ্যমে ওর নাম ছড়িয়ে পড়ল। নানা জায়গা থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হল মধুযামিনীকে।
এরপর মধুযামিনীর প্রচ্ছদ মিত্রের বাড়ি যাওয়া আরও বেড়ে গেল। প্রচ্ছদ মিত্রের তত্ত্বাবধানেই ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করল। উচ্চমাধ্যমিকে কোনও স্থান গ্রহণ করতে না পারলেও ও যে নম্বর পেল তা দিয়ে একটি নামকরা আর্ট কলেজেই ও ভর্তি হতে পারল। বাড়িতে ও এখন খুবই কম সময় থাকে। আর যেটুকু সময় থাকে, নিজের ঘরেই থাকে। বাবা-মার সাথে বিশেষ কথা-বার্তা হয় না। মেয়ের বর্তমান আচরণ, গতিবিধি মিসেস বনানী আর মেনে নিতে পারছেন না। মেয়ের হাতে এখন বেশ টাকা পয়সাও আসছে। ইদানীং হাত খরচের জন্য বাবার কাছে কোনও টাকা চাইছে না ও। স্যারের সাথে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ানোর খবরও মিসেস নস্করের কাছে আছে। মনে অনেক প্রশ্ন নিয়ে উনি একদিন মেয়ের ঘরে ঢুকলেন। মধুযামিনী তখন খবরের কাগজ ও বিভিন্ন পত্রিকা থেকে মনের আঁকা ব্যাঙ্গ-চিত্র কেটে কেটে খাতা-বন্দি করছিল।
তোর সাথে আমার কিছু কথা ছিল।
পরে কথা বলব মা। এখন একটু ব্যস্ত আছি।
কি এমন রাজ-কার্য করছিস? ভারি তো পেপার কেটে খাতায় আটকাচ্ছিস! কাল রবিবার। কোনও কাজ রাখিস না। তোকে নিয়ে দক্ষিণেশ্বরে পূজো দিতে যাবো। পরীক্ষার রেজাল্টের পর তুই এতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছিস, যে মায়ের পূজা দেওয়ারই সময় পাওয়া যাচ্ছে না।
কাল হবে না মা। কাল সকালে স্যারের বাড়ি যেতে হবে। উনি কাল আমাকে নিয়ে বেরবেন বলেছেন।
কোথায় যাবি?
সেটা স্যারই জানেন।
মায়ের সাথে আর কথা না বাড়িয়ে নিজের কাজে মন দেয় মধুযামিনী। বিরক্ত হয়ে মেয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে বনানী দেবী।
পরদিন সেজে-গুজে সকাল সকাল বেরিয়ে যায় মধুযামিনী। সন্ধ্যে গড়িয়ে যায়, মেয়ের কোনও খবর নেই। ওর মোবাইলে ফোন করেও কোনও হদিশ মেলে না। ফোন সুইচ অফ। মায়ের মনে অনেক দিন ধরেই কু-ডাক ডাকছিল। সে ধারনাই আরও স্পষ্ট হল ওনার। তবে কি মেয়ে সত্যিই মেয়ে কোনও খারাপ কাজে লিপ্ত হল? আর সে কাজ থেকেই মেয়ের হাতে অর্থ সমাগম হচ্ছে? এমন চিন্তার মধ্যেই মোবাইল ফোন বেজে উঠল মিসেস নস্করের। প্রচ্ছদ মিত্রের ফোন থেকে মধুযামিনী ফোন করেছে।
মা টিভি চালাও। “খবর আজকাল” চ্যানেল সাতটা থেকে দেখো। তোমার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।
কথাটা বলেই ফোন কেটে দিল মধুযামিনী। মেয়ের কথায় “খবর আজকাল” চ্যানেলে চোখ রাখলেন মিস্টার ও মিসেস নস্কর। টিভির পর্দায় তখন মনের আঁকা ব্যাঙ্গ-চিত্র দেখাচ্ছে, যা কাল রাতে মধুযামিনী কেটে কেটে খাতা-বন্দি করছিল। এরপরেই ভেসে এলো ওনাদের মেয়ের মুখ। পাশে বসে আছেন প্রচ্ছদ মিত্র। সঞ্চালিকা বলছেন,
- দীর্ঘদিন ধরেই আপনারা খবরের কাগজ ও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় মনের আঁকা ব্যাঙ্গ-চিত্র দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। রাজনৈতিক, সামাজিক বিভিন্ন ঘটনা তার ব্যাঙ্গ-চিত্রে সুন্দর ভাবে ব্যক্ত হয়েছে। আজ সেই মন, অর্থাৎ মধুযামিনী নস্কর আপনাদের সামনে। কিছুদিন আগেই সে মাধ্যমিকে অষ্টম হয়েছে। আমরা মধুযামিনীর কাছে তার সাফল্যের গল্প শুনব আজ।
- ছোটবেলা থেকেই আমার ছবি আঁকাতে ভালো লাগে। ছেলেবেলায় পাড়ায় পাড়ায় বসে-আঁক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে অনেক পুরস্কার ঘরে এনেছি। তবে এই জায়গায় আমি পৌঁছতে পারবো, তা স্বপ্নেও ভাবিনি। সেটা সম্ভব হয়েছে এই প্রচ্ছদ স্যারের জন্য। ওনার চেষ্টা ও পথপ্রদর্শনেই আমি আজ এতদূর আসতে পেরেছি।
- এবারে তাহলে আমরা প্রচ্ছদ বাবুর কাছেই মধুযামিনীর সাফল্যের গল্প শুনব।
- প্রথম দিন মধুযামিনীর আঁকা দেখেই আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। ওকে বুঝিয়েছিলাম যে এই আঁকা দিয়েই ওকে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে হবে। বাংলায় কার্টুনিস্টের বেশ অভাব। সেইকারণে ঐ দিকেই ওকে বেশি উৎসাহিত করলাম। কিন্তু আমাদের সমাজে সে পেশাতেই তুমি যাও না কেন একটা দূর পর্যন্ত তোমাকে পড়াশোনাটা বেশ ভালোভাবেই করতেই হবে। মার্কস কম থাকলে তুমি কোনও কলেজেই চান্স পাবে না। আর্ট কলেজে ভর্তি হতে গেলেও বাবরের জন্ম-মৃত্যুর তারিখ, ডেনমার্কের ক্যাপিটাল, কুকুরের প্রভৃতি তোমাকে জানতেই হবে। সে শিক্ষা তোমার জীবনে কোনও কাজে লাগবে না। তবুও সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য পরীক্ষার হল পর্যন্ত সেই বিদ্যাটা তোমার মস্তিষ্কে থাকা চাই। তারপর ভুলে গেলে ক্ষতি নেই। তাই পড়াশোনাটা ওর যোগ্যতায় নয়, ওকে একটা কৌশল অবলম্বন করে করালাম।
- সেটা কিরকম?
- বিস্তারিত ভাবে আমি কিছু বলব না। বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে একটা কৌশল, যা সাময়ীক ভাবে ওকে ওর প্রয়োজনীয় জ্ঞানটা দেবে। আমাদের বাড়িতে যখন কোনও অনুষ্ঠান হয়, তখন অনেক চেয়ার টেবিল, কড়াই, গামলার প্রয়োজন হয়। সেই সব কি আমারা কিনতে যাই? না আমরা একদিনের জন্য সেসব ভাড়া করে নেই। মধুযামিনীকে আমি সেটাই করিয়েছি। আর এই ব্যাপারে আমাকে আমার এক বিজ্ঞানী বন্ধু, আর এক ছাত্র ভীষণ ভাবে সাহায্য করেছে।
টিভির অনুষ্ঠান শেষ করে বাড়ি ফিরল মধুযামিনী। বাড়ি ফিরিতেই ওর বাবা-মা ওকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, তোকে আমরা কত ভুলই না বুঝেছি। পারলে আমাদের ক্ষমা করিস।
না মা, তোমাদের কোনও দোষ নেই। আমি তো তোমাদের কোনও কথাই বলিনি। তোমাদের তো চিন্তা হবেই। কি করবো বল, প্রচ্ছদ স্যার যে বারণ করেছিলেন।
মধুযামিনীকে ওর বাড়ির কাছে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরেছেন প্রচ্ছদ মিত্র। বাড়ি ফিরে মধুযামিনীর দীর্ঘদিন ধরে ব্যাবহার করা জিনিষগুলো ভালোভাবে গুছিয়ে রাখলেন। এগুলোই আজ সকালে মধুযামিনী ওনাকে ফেরত দিয়ে গেছে।
জিনিষ বলতে বিশেষ যন্ত্র লাগানো দুটো রাবারের কান, তবে একদম আসল কানের মত দেখতে। যেটা মধুযামিনী পরীক্ষা যাবার সময় পড়ে থাকত। আর রয়েছে মোবাইল ফোনের মত একটা যন্ত্র, আর একটা ঘড়ি। মোবাইল ফোনের মত যন্ত্রটা মধুযামিনীর কোমরের নীচে পোশাকের আড়ালে থাকত। ঘড়িটি আসলে একটি ছোটো স্ক্যানিং যন্ত্র। ও প্রশ্নপত্র দেখার সময় যখন প্রশ্নপত্রের ওপর দিয়ে ঘড়িটি চালনা করত, তখন প্রশ্নপত্রটি স্ক্যান হয়ে প্রচ্ছদের এক ছাত্রের কাছে পৌঁছে যেত। সে তখন বিভিন্ন বই দেখে উত্তর গুলো মোবাইল ফোনের সাহায্যে বলতে থাকে। আর সেই উত্তর মধুযামিনীর কোমরের নিচে রাখা মোবাইল ফোনের মত যন্ত্রটির সাহায্যে ওর কানে ভেসে আসে। মধুযামিনী তার কানে ভেসে আসা উত্তর-মালা খাতায় লিপিবদ্ধ করে। বহুদিন ধরে এটা অনুশীলন করে এই শুনে শুনে লেখাটি বেশ ভালো ভাবেই রপ্ত করেছিল মধুযামিনী। এখন সে তার নিজের পছন্দের বিষয় নিয়ে আর্ট কলেজে পরছে। তাই এই পদ্ধতির আর দরকার নেই তার।
প্রচ্ছদ মিত্র জিনিষগুলো যত্ন করে রেখে দিল। ভবিষ্যতে আরেক প্রতিভাকে সঠিক পথে চালিত করবে সে লক্ষ্যে।