STORYMIRROR

Sourya Chatterjee

Tragedy Classics Others

3  

Sourya Chatterjee

Tragedy Classics Others

যন্ত্রমানবী

যন্ত্রমানবী

4 mins
289

অঞ্জলি দেবার সময় পূজামণ্ডপে বড্ড ভিড় হয়। যদিও এত ভিড়ভাট্টা শুভর পছন্দ নয়, তবুও পুজোর গন্ধমাখা এরকম একটা সকাল ভিড় ছাড়া যে অসম্পূর্ণ থেকে যায় সেটা অনুধাবন করতে পারে শুভ। দেবীর পায়ে প্রার্থনা নিবেদন, কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সাথে হরেক রকম বাহারি পোশাক আর নিজস্বীর মেলবন্ধন যেন এক অন্য রূপ দেয় এই সময়টাকে।

শুভদের বাড়িটা পূজামণ্ডপ থেকে খুব বেশি দূরে নয়। পূজামণ্ডপ থেকে সারাদিন মৃদু স্বরে গান আর ঢাকের শব্দ শোনা যায়। বাড়ি বসেই এ এক অদ্ভুতরকম পুজোর আমেজ গায়ে মাখা যেন। সারাদিন মনটা মণ্ডপেই পড়ে থাকে শুভর সেই মৃদু সংগীত আর ঢাকের বাদ্যির ভেলায় ভেসে। 

শুভ মণ্ডপে যাবার জন্য প্রস্তুত হল, অঞ্জলির শেষ পর্ব চলছে। এবার ভিড়টা কমবে মনে হয়। ওই একটু পাড়ার বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা মারবে আর কি! একটা লাল পাঞ্জাবী পরে শুভ চুল আঁচড়াচ্ছে আয়নার সামনে, হঠাৎ করেই ঘরের ফ্যানটা অফ হয়ে গেল। উফফ! রমিতা মাসিকে নিয়ে আর পারা যায় না।

রমিতা মাসি সকালবেলা এসে ঘর ঝাড়পোছ করে রোজই। ঠিক দশটা নাগাদ আসবে, ঝাড়ুটা নেবে, মিনিট পনেরো কুড়ির মধ্যে গোটা বাড়ির ছয়টা ঘর ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে জল দিয়ে মুছে চলে যাবে। যাওয়ার আগে ঘটাং করে গ্রিলের গেটটা বন্ধ করবে আর বাজখাই গলায় চিৎকার করবে “বৌদি এলাম”। দৈনিক এই রুটিনে আদৌ ঘর কতটা পরিষ্কার হল সেটা শুভ টের পায় না বটে, তবে রমিতা মাসি আসে, কাজটুকু করে আবার চলে যায় রুটিনমাফিক। 

এখন তো কত কিছু বের হয়েছে। অটোমেটিক ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, অটোমেটিক হোম ক্লিনার, হ্যানা, ত্যানা। শুভ কিছু পার্থক্য বুঝতে পারে না সেসব যন্ত্রের সাথে রমিতা মাসির। নিঃশ্বাস প্রশ্বাস নেবার ক্ষমতা শুধু ওই ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের থাকে না, বাকি তো সব এক। মিনিট পনেরো কুড়ির মধ্যে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ও ঘর পরিষ্কার করে, রমিতা মাসিও করে। রমিতা মাসিরও ঘর পরিষ্কার হোক আর না হোক, তাতে কিছু যায় আসে না, ভ্যাকুয়াম ক্লিনারেরও তাই।

ভারী অবাক লাগে শুভর। হয়তো কোনো একটা জরুরী কাজ করছে শুভ। বলা নেই, কওয়া নেই, ফ্যানটা অফ করে দিয়ে ঘর ঝাড় দিয়ে চলে যায়। সেই মুহূর্তে খুব বিরক্ত হয় শুভ। হয়তো মাকে গিয়ে বলেও “মা, রমিতা মাসিকে ছড়িয়ে দাও না, কেমন যেন!” মায়ের জবাব আসে “আজকালকার দুনিয়ায় বিশ্বস্ত কাজের মাসি পাওয়া কতটা কঠিন ব্যাপার জানিস তুই! দু মিনিট ফ্যান অফ করেছে বলে থাকতে পারবে না। লাট সাহেবের ব্যাটা তো সব!” ব্যাস! আর কি! এভাবেই চলে। 

“বৌদি এলাম” এই কথাটার বাইরে রমিতা মাসিকে কথা বলতে শোনা যায় এই পুজোর মাসটা এলে। শুভর মা যখন বোনাস দেয় তখন একটু কথা কাটাকাটি হয় আর কি! তারপর দিন থেকে আবার যে কে সেই। 

কোনোরকমে চুল আঁচড়ানোটা শেষ করে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেল শুভ। ভালো লাগে না, আর একটু চুলটা ভালো করে আঁচড়ানো, পারফিউম মাখা কিছুই তো হল না। ধুর ছাই! ভালো লাগে না। 

মন্ডপে এসে শুভর খেয়াল হল তাড়াহুড়োতে মানিব্যাগটা আনতেই ভুলে গেছে। মনে মনে খুব রাগ হচ্ছে রমিতা মাসির উপর। সত্যিই তো, লোককে বললে ভাববে ফ্যানটাই তো দু মিনিটের জন্য শুধু অফ করেছে, তাতে এত রাগ করারই বা কি আছে, এত তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে আসারই বা কি হয়েছে! কিন্তু তারা বুঝবে না, রাগটা শুধু আজকের জন্য নয়। দিনের পর দিন এই যন্ত্রমানবীর আচরণে তার রাগ। বড্ড অদ্ভুত এই রাগটা। কাউকে বোঝানো যাবে না। মাকে বললে মা বলবে “এখন বিশ্বস্ত কাজের মাসি পাওয়া যায় না”, বন্ধুদের বললে বন্ধুরা উল্টে শুভকে নিয়েই খিল্লি করবে। আর রমিতা মাসিকে বললে? ধুর! যন্ত্রমানবীর সাথে কথা বলা যায় নাকি!

না! আবার শুভকে বাড়ি যেতেই হবে সেই। চেয়ার ছেড়ে উঠতেই পেছনে দেখে রমিতা মাসি এদিকেই আসছে। 

-   বৌদি তোমার মানিব্যাগটা পাঠিয়ে দিলেন।

শুভ মানিব্যাগটা হাতে নিয়ে একটু হেসে বলল

-   থ্যাংক ইউ

রমিতা মাসি! না! কোন হাসি বিনিময় না, কিছু না। উল্টোদিকে ফিরে রওনা হল আবার।

শুভ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। ঠিক মানিব্যাগটা দিল আর চলে গেল। দেবীমূর্তির দিকেও তাকালো না একবার। দেবীকে মৃন্ময়ী থেকে চিন্ময়ী রূপ দেবার এত প্রচেষ্টার মাঝে আমাদের খেয়ালই থাকে না কত মানুষজন যন্ত্র হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে নানান ঘাতপ্রতিঘাতে। একটু চেঁচিয়ে শুভ ডাকল

-   মাসি

পেছন ঘুরে তাকালোও না রমিতা মাসি।

-   রমিতা মাসি

এবার পেছন ঘুরল রমিতা মাসি। চোখের দৃষ্টি পাথরের মত। মুখে বিরক্তির ভাব।

-   ঠাকুরটা দ্যাখো।

রমিতা মাসি উত্তর দিল

-   আসি, মিত্তিরদের বাড়িতে সাড়ে দশটায় পৌঁছাতে হবে।

-   একটু প্রণাম করে যাও ঠাকুরকে। দ্যাখো না ভালো লাগবে। 

শুভর কথা রাখতেই যেন কোনরকমে দেবীমূর্তির দিকে তাকিয়ে নমস্কার করে রওনা হল রমিতা মাসি। শুভ তাকিয়ে রইল। এতদিনকার ঘাতপ্রতিঘাতে যে মানবী যন্ত্রমানবী হয়ে গিয়েছে, তাকে এত সহজে আবার হৃদস্পন্দন প্রদান করা যায় নাকি! দেবীকে মৃন্ময়ী থেকে চিন্ময়ী রূপ প্রদান হয়তো অপেক্ষাকৃত সহজতর তার চাইতে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy