যন্ত্র মানব
যন্ত্র মানব
প্রত্যেক দিন গল্প লেখা আর আজকের গল্প লেখাটা অন্যরকম। কি লিখবো খুঁজে পাচ্ছিনা। পাশে বসা বন্ধুকে বললাম, ‘ভাই মাথায় কিছুই কাজ করছে না?’ বন্ধু বলল - 'কি ভাবছিস ?' বললাম- 'ভাই, একটা গল্প লিখবো কিন্তু খুঁজে পাচ্ছি না থিমটা।' বন্ধু বলল - 'তোকে আজ একটা গল্প বলবো, এই গল্পটা আধুনিক প্রযুক্তির, যেটা সত্যই মানবজাতির গর্বের - কিন্ত সাথে সাথে এটাও ঠিক যে আমরা প্রকৃতির স্বাভাবিক কর্মকান্ড থেকে অনেকটাই দূরের হয়ে যাচ্ছি।এটি একটা প্রযুক্তির কল্পিত কাহিনী ধরে নিতে পারিস। ধরে নে ভাই , এই গল্পের পাত্র - পাত্রীর নাম তরুণ আর তন্বী। গল্পের শুরু এভাবে -
তন্বী সময় নিচ্ছে। শোবার ঘরের লাগোয়া বাথরুম থেকে জলের শব্দ আসছে। রাত হল বেশ। জানলার বাইরে টুপটাপ করে আবাসনের আলো নিভছে। তরুণ বিছানার ওপরই ল্যাপ-টপ খুলে বসেছে, অফিসের কাজ নিয়ে। কাজ আর শেষ হয় না। অফিস থেকে ফিরতে দেরি হয়ে যায়, দুজনেরই। তন্বী তথ্য প্রযুক্তির, তরুণ বিত্ত (ফিন্যান্স) বিভাগের। অফিসে দুজনেরই কাজের চাপ। প্রায়শই অতিরিক্ত সময় অফিসে থাকতে হয়। উইকেন্ডও বাদ যায় না। তবে নিয়ম করে ডিনারটা তরুণ আর তন্বী এক সাথে খায়। খেতে খেতে টুকটাক কথা বলে। সারাদিন অফিসে কেমন কাটল, কে কী বলল, প্রজেক্ট কতদূর এগোল, এইসব সাধারণ, হাবিজাবি অদরকারি কথাবার্তা। কখনো তরুণ আলগোছে একটা নতুন শোনা জোকস ছুঁড়ে দেয় - শুনে তন্বী খিলখিল করে হাসে। দিনের শেষে একে অন্যের সঙ্গের উত্তাপ নেয়।
বাথরুমের ছিটকিনি খোলার শব্দ হল। তন্বী বেরোল। মুখ থেকে দিনের প্রসাধন ধুয়ে নিয়েছে। তবু চোখে মুখে একটা আলগা লাবণ্য লেগে আছে। সুন্দর পরিমিত মেদহীন শরীরের ওপর একটা হালকা রাত-পোষাক জড়িয়েছে। তরুণ তন্বীর দিকে তাকায়, ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করে, “কী?” তন্বী চোখ নামিয়ে নেয়। না, এমাসেও নয়। তরুণ মুখ কালো করে ল্যাপ-টপের স্ক্রীনে নজর রাখে।
তিন বছর হল ওদের বিয়ে হয়েছে। সুখী দম্পতি। দুজনের খুব ভাব। তন্বী জানে, তরুণ চায় এবার ওদের একটা বাচ্ছা-টাচ্ছা হোক। তন্বীও কী চায় না? তন্বীর মন ভারি হয়ে যায়। নিজেকে দোষী করে। তরুণের জন্য কষ্ট হয়। ভাবে অনেক দিন আগেই তরুণকে সব কিছু খুলে বলা উচিত ছিল। এভাবে একটা মানুষকে দিনের পর দিন প্রতারণা করা ঠিক নয়।
তন্বী বিছানায় এসে তরুণের হাতে হাত রাখে। তরুণ একটু অবাক হয়ে মুখ তুলে তাকায়। তন্বী বলে, “তরুণ, আমায় মাপ করো। আমাদের কোনদিন ছেলে মেয়ে হবে না।” তরুণ আকাশ থেকে পড়ে, “কেন?”
তন্বীর চোখ ছলছল করছে। সে খানিক চুপ করে থাকে। ভাবে বলবে কিনা। তারপর দোনামনা করে বলেই ফেলে, “তরুণ আমি মানুষ নই, একটা যন্ত্র মানব । আমার আইডেন্টিফিকেশন কোড সি - টু। অন্তরঙ্গ মানবিক ব্যবহার প্যাটার্ন স্টাডি করার জন্য আমার কোম্পানি মেসার্স ইন্টারন্যাশনাল আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স কর্পোরেশন লিমিটেড তোমার জীবনে আমাকে স্থাপন করেছে।”
শুনে তরুণ ম্লান হাসি হেসে, তন্বীকে কাছে টেনে নেয়। তন্বী অবাক হয়। জীবন বলে, “আগে বলো নি কেন? আমাদের কোম্পানী তোমাদের প্রতিযোগী । আমার কোড – জি-টেন।” তন্বী চমকে ওঠে। তারপর তরুণের বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদে। ওদের প্রজন্মের যন্ত্র মানবরা হাসতে পারে, কাঁদতে পারে। কিন্তু সন্তান উৎপাদন করতে পারে না।
তরুণের খারাপ লাগে। জি শ্রেণির যন্ত্র মানবদের আবেগ অনুভূতি সাধারণত নীচু পর্দায় বাঁধা থাকে। তবু তার তন্বীর জন্য মায়া হয়। এই কোম্পানীগুলো কেন যে এমন বোকার মত কাজ করে। নিজেদের মধ্যে ডেটাবেস শেয়ার করলে এইসব ঝামেলা থাকে না। তরুণ তন্বীর চুলে বিলি কেটে দেয়, বলে, “মন খারাপ কোরো না, তন্বী। তোমার যদি খালি খালি লাগে তবে আমরা একটা বাচ্ছা দত্তক করতে পারি।”
চোখে জল, মুখে হাসি নিয়ে তন্বী মুখ তুলে তাকায়, “বেশ হয় তাহলে। আমাদের কোম্পানী দত্তক নিলে চাইল্ড কেয়ার লিভও দেয়, জানো? পুরো ছ-মাসের।” একটা ছোট্ট মানুষ তাদের ঘরে টলোমলো পায়ে ঘুরে বেড়াবে, আধো আধো কথা বলবে, তন্বী তাকে কোলের মধ্যে নিয়ে চটকাই-মটকাই করবে, ভাবতেই তন্বীর গায়ে কাঁটা দেয়।
পরক্ষণেই শিউরে ওঠে। তরুণের দিকে আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে বলে “ওরা যদি আবার একটা যন্ত্র মানব পাঠিয়ে দেয়?” তরুণ জবাব দিতে পারে না। একটা নারী যন্ত্র মানব ও একটা পুরুষ যন্ত্র মানব অসহায় দৃষ্টিতে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। জানলায় আধুনিক পৃথিবীর অন্ধকার ঘন হয়। এখানেই আমার গল্পের শেষ - বাকিটা ভবিষ্যতের হাতে।'
বন্ধুর বলা শেষ হয়ে যাবার পর কিচ্ছুক্ষন আমিও নির্বাক বসে রইলাম - তারপর বিচারের ভার আপনাদের হাতে দিয়ে গেলাম।
