যদি
যদি
- দাদা, মিউজিক চলে?
- হুঁ।
- চালান না একটু তবে।
মিউজিক সিস্টেমটা অন করলেন অনলাইন ক্যাবের ড্রাইভার।
- একটু পুরোনো দিনের গান চালান না!
- রেডিও তো। কোন চ্যানেল চালাবো বলুন।
একটা চ্যানেল বললাম বটে, কিন্তু তাতেও সেই জুতসই গানের দেখা না মেলাতে রেডিওটা বন্ধ করে দিতেই অনুরোধ জানালাম।
- ধুর মশাই! বন্ধ করুন তবে!
আসলে মাঝে মাঝে এমন সময় আসে নিজে থেকেই জোর করে নস্টালজিয়ায় ডুব দিতে ইচ্ছে হয়। যেহেতু স্বতঃস্ফূর্ত নয়, তো সেই ডুব দেওয়ার জন্য একটা মাধ্যম তো লাগবে, যা কিনা অনুঘটকের কাজ করবে। এক্ষেত্রে পুরোনো দিনের গানের মাধ্যমে ডুব দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু হল না।
আমি বাড়ি ফিরছি। একটা আস্ত দিন অফিসে কাটানোর পর বাড়ি ফিরছি এখন। একটু তো ক্লান্ত বটেই। দিনটা যে খুব ভালো কেটেছে, সেরকমও নয়। পুজোর ছুটির রেশ কাটিয়ে অফিসে ফেরা তো! তো কলিগদের মধ্যে গল্প, আড্ডা, মিষ্টি খাওয়া এসব চলছিল একটু বেশি পরিমাণেই। তো স্বভাবতই টিমের সবারই কাজটা হয়েছে একটু কম পরিমাণে। না, ইয়ে মানে মিথ্যে বলব না, বেশ পরিমাণেই কম হয়েছে। জানেন তো, ঠিক পুষিয়ে দিতাম আগামীকাল বা আগামীপরশুর মধ্যে, কিন্তু বসের আর তর সইল না। দিনের শেষে চটাং চটাং গালমন্দ করে তবে ছাড়লো আমাদের। স্বাভাবিক কারণেই মনমেজাজ খারাপ। নয় নয় করে বেশ সিনিয়র চাকুরিজীবি হয়েছি এখন। জুনিয়রদের সামনে তীক্ষ্ণ বাক্যবাণে পর্যদুস্ত হতে কার ভালো লাগে বলুন তো! সেসবই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। তাই একটু পছন্দের গান শুনে মনটা যদি একটু ভালো হয় তার চেষ্টা করছিলাম।
ও, আরেকটা কথা! গাড়িতে আমি নেই একা শুধু। আমার এক জুনিয়র ইন্টার্নও রয়েছে। ওর আর আমার বাড়ি পাশাপাশিই, পাশের পাড়ায়। তাই একসাথেই ফিরি আর কি! ওর সামনেই বকাটা খেয়েছি। ও হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। এখন তো ওর দিকে ঠিক করে তাকিয়ে কথাও বলতে পারছি না। সবার সামনে বকে দিল! কোনো মানে হয়! অবশ্য চাকরি করছি যখন, মোটা মাইনে নিচ্ছি যখন অত মানসম্মান নিয়ে ভাবলে চলে না হয়তো।
নস্টালজিয়ায় ডুব দেবার মাধ্যম খুঁজজিলাম না? পেয়ে গেলাম, জানেন তো! ম্যাটাডোরে করে একদল ছেলে ঠাকুর ভাসানে চলেছে। বাড়ির ছোট কোনো পুজো মনে হয়। একচালার ঠাকুর! এরকম যেতাম আমিও! খুব বেশি দিন নয়, বছর দশেক আগের কথা হবে। এরকম ভাবে ঠাকুর ভাসানে যেতাম। আমাদের অবশ্য পাড়ার পুজো ছিল। ম্যাটাডোরে ঠাকুর যেত, আমরা পেছন পেছন যেতাম। উফফ! কত রকমের নাচ নাচতাম। আমরাই ড্যান্সার, আর আমরাই কোরিওগ্রাফার। সেদিনের উদ্দাম দাপাদাপি শেষ হত বিজয়ার কোলাকুলি, প্রণাম আর মিষ্টিমুখ দিয়ে। সেদিনটা শেষ হত বটে, কিন্তু পরদিনের জন্য অপেক্ষায় থাকত আরো আনন্দ।
আমাদের অল্পবয়সী ছেলেদের যে গ্রুপটা ছিল তাদের একটু স্পেশাল বিজয়া সম্মিলনী হত আর কি! দুপুরের লাঞ্চটা বাইরের রেস্টুরেন্টে গিয়ে করতাম! বেশ খানিকক্ষণ সময় একসাথে কাটানো। বয়সের বেড়াজাল পেরিয়ে সে ছিল এক অন্যরকম বন্ধুত্ব। “অল্পবয়সী”দের সম্মিলনীতে পনেরো থেকে পঞ্চান্ন সবাই ভিড় জমাত। চূড়ান্ত পর্যায়ের হাসি ঠাট্টা মজা হত। আর এখন সেসবের কিছুই নেই। রয়েছে হয়তো, আমি খোঁজ পাইনা শুধু। তাই হয়তো সেই আনন্দটুকুর আভা পাওয়ার জন্যই অফিসে একটু গল্পগুজবে মেতেছিলাম।
না, এরম ক্যাবে করে যেতাম না, বরং ট্রেনে, বাসে, লঞ্চে করে ঘুরতে যেতেই তখন বেশ লাগত। অবশ্য কোথায় যেতাম, কিসে চড়ে যেতাম সেগুলো মোটেই মুখ্য ছিল না, যেমন দুগ্গা ঠাকুর দোলায় এল নাকি ঘোড়ায় এল তাতে কিছু যায় আসে না, পুজো, আনন্দ, সেগুলোই আসল। আজ আর নেই সেই আনন্দগুলো। পুজোর মধ্যেও মনে হয় পুজো শেষ হলেই এই কাজ, সেই কাজ! সেইভাবে আনন্দটা আর করা হয়ে ওঠে না।
অবশ্য সবই যে সুখস্মৃতি তা ঠিক নয়, কিছু এমন স্মৃতিও রয়েছে যা না হলেই ভালো হত! কিংবা বলা চলে ওই অল্পবয়সীদের ভিড়ে আমি একটু সিনিয়র হলে করতে দিতাম না। যেমন টিকিট না কেটে ট্রেনে ওঠা! খুব বাজে একটা ব্যাপার! কিন্তু মুখ বুজে মেনে নিতাম! বড়রা বলত “পাঁচটা টিকিট কম কাট, দশটা টিকিট কম কাট!” দলছুট হয়ে যাবার ভয়ে বিনা প্রতিবাদে মেনে নিতাম সব। ওই পাঁচটা টিকিটের দামের অনেক বেশি দাম নিয়ে সিগারেট কিনে খাবে ওরা, কিন্তু ওই পাঁচটা টিকিটের পয়সা বাঁচিয়েই ওদের লাভ! সত্যি কথা বলতে কি এখন মাঝে মধ্যে মনে হয় প্রতিবাদ করাই বরং উচিত ছিল আমার।
আমরা এত আনন্দ করতাম, দল বেঁধে দামী রেস্টুরেন্টে খাবার খেতাম। জানেন তো কোথাও না ওয়েটারদের জন্য মনের ভিতর কষ্টের বুদবুদ দানা পাকাতো। সব দাদাগুলো কেমন করে যেন বলত “কিরে! এত সময় লাগছে কেন! তাড়াতাড়ি সার্ভ কর”, এজাতীয় কত কিছু। তারপর খাবার শেষে সেই ওয়েটাররাও পাঁচ দশ টাকা টিপসের জন্য চেয়ে থাকত, দিতাম না আমরা। সরি, দাদারা দিত না। কিন্তু ওই যে বললাম, বেশ ছোট বলে তেমন কিছু প্রতিবাদ জানাতে পারতাম না।
আমার তো ইচ্ছে করত ট্রেনে বাসে কত ভিক্ষুক ওঠে, তাদের কিছু টাকাপয়সা দেই! কিন্তু হত আর কই! শুধু এই পাড়ার দাদা বলে নয়, যখন বাবা মায়ের সাথে বেরোতাম তখনও তো মনে পড়ে না কেউ কোনো ভিক্ষুককে সাহায্য করেছে বলে। অথচ নানান সময় সবাইই আমাকে শেখাতো যে অসহায়দের সাহায্য করতে হয়। খুব অদ্ভুত লাগত। কিন্তু বড়দের সাথে কথা বলব না মুখে মুখে, এমন মনে করে চুপ করে থাকতাম।
তখন খুব ভাবতাম, যখন বড় হব, তখন সবাইকে খুব সাহায্য করব। কোনো অনৈতিক কাজ করব না। মোদ্দা কথা হল পাড়ার দাদাদের ওই বাজে দিকগুলো যে বাজে সেটা হাতে কলমে প্রমাণ করব। পুজোও থাকবে, বিজয়ার খাওয়া দাওয়াও থাকবে। দেখিয়ে দেব শুধু নিজেরা না, সমাজের অসহায়, অবহেলিত মানুষদের সাথে নিয়েও কিভাবে আনন্দটা করা যায়!
কিন্তু অদৃষ্টের কি বিধান দেখুন! কিছু তো হলোই না, বরং বসের বকা খেয়ে মুখ কাচুমাচু করে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। সব বেকার! ধুর!
- দাদা
পাশের ইন্টার্ন ছেলেটির ডাকে একটা সুখ-দুঃখ স্মৃতি মেশানো নস্টালজিয়া থেকে ফিরতেই হল বাস্তবে।
- বল
- কাল কি তাড়াতাড়ি আসতে হবে?
- কেন? খামোখা তাড়াতাড়ি আসতে যাবি কেন?
- না, একটু কাজ তো বাকি আছে, যদি স্যার আবার বকে!
- এই শোন! স্যার তো তোকে বকেনি। বকেছে আমাকে। তো আমাকেই হ্যান্ডেল করতে দে। সব ব্যাপারে..
থেমে গেলাম। না, খুব সহজে রেগে যাচ্ছি। এমনটা ঠিক নয়। আসলে দিনটা বাজে গেলে এমনই হয়! উফফ! কান্ড দেখেছেন! পাশ থেকে সব গাড়িগুলো হুস হুস করে বেরিয়ে যাচ্ছে, আর আমাদের ড্রাইভারটা যেন গরুর গাড়ি টানছে।
- দাদা, একটু জোরে চালান, গরুর গাড়িও তো এর থেকে স্পিডে চলে।
- স্পিড লিমিট ৮০ আছে স্যার।
- এই শোনো ওরকম অনেক কিছু থাকে। পাকামো মেরো না। জোরে চালাও।
বলতে বলতে সিগন্যালটা খেল। বিরক্তিকর! ব্যাস! আরো নব্বইটা সেকেন্ড অপেক্ষা কর এখন!
হঠাৎ টক টক টোকার শব্দে জানলার দিকে তাকালাম। একজন মহিলা একটা বাচ্চা ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা চাইছে। এটা একটা সময় হল!! কিছু না বলে মাথা নেড়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। কিছুক্ষণ আরো অপেক্ষা করে সেই মহিলা বাচ্চাটাকে নিয়ে হাঁটা লাগালো অন্য গাড়ির দিকে। সত্যি কথা বলতে আমার আর পোষাচ্ছে না এখন একদম। ইন্টার্ন ছেলেটির চোখে চোখ পড়ল। ও একবার আমার দিকে দেখছে, আর একবার ওই চলে যাওয়া ভিক্ষুকটির দিকে দেখছে। মুখ ঘুরিয়ে চোখ বন্ধ করে বসলাম তারপর।
আমাদের ক্যাব ড্রাইভার আরো বেশ কিছুক্ষণ ধীর লয়ে গাড়িটা চালানোর পর আমরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছালাম। জানেন! একে তো এত আস্তে আস্তে চালালো, তার উপর টিপস চাইছে! কি সাহস বলুন তো একবার! মুখের উপর হাজার কথা শুনিয়ে না বলে দিয়েছি।
যাই হোক, গাড়ি থেকে নেমে আমাদের দুজনকেই একটু হাঁটতে হয়। আমাকে আর আমার ইন্টার্নকে। দুজনেই হাঁটছি, কেউ কোনো কথা বলছি না। আমি একটু আধটু কথা বলার উৎসাহ দেখালেও ও দেখাচ্ছে না।
নস্টালজিয়ায় ডুব মেরেছিলাম না কিছুক্ষন আগে গাড়িতে, আবার এক লহমায় সেই নস্টালজিয়ায় ডুব মারলাম আরেকবার। যখন ওই বিজয়া সম্মিলনী উৎসব সেরে ফিরতাম তখন আমিও না দাদাদের সাথে কথা বলতাম না জানেন! ওই সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোর মানে ওই ট্রেনের টিকিট না কাটা, অসহায় মানুষগুলোকে সাহায্য না করতে পারা, ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করতে পারার জ্বালা মনে বয়ে বেরোতাম তো। তাই আর কথা বলতে ইচ্ছে করত না। চুপচাপ ঘরে ঢুকে যেতাম।
যাহ! কান্ড দেখেছেন! আমার ইন্টার্নটা কখন যেন ওর বাড়ি ঢুকে গেছে খেয়ালই করিনি।
