উদ্বেগ
উদ্বেগ


প্রিয় ডায়েরি,
আমার আজকের বিষয় এই লক ডাউনে একাকী থাকা বয়স্ক মানুষদের নিয়ে, তাদের সমস্যা নিয়ে।
ছোট থেকেই এলার খুব ইচ্ছা ছিল ,ওর যেন দূরে বিয়ে হয়। ছোটবেলায় ও দেখেছে ওর ছোট পিসি ব্যাঙ্গালোরে থাকতো বলে, বছরে একবার ই আসতো বাপের বাড়ি তে দাদুন আর ঠামির কাছে। কত কিছু আনতো পিসি, আর যখন আসতো ছুটিতে, পিসিকে সব আত্মীয় স্বজনরা নিজের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতো। ছোট্ট এলাও পিসির সঙ্গে সব জায়গায় যেত, আনন্দ করতো। কতো জায়গায় ঘুরতে যেত পিসি ওকে নিয়ে। ছোট্ট এলা তখন না জেনেই বলতো সবাইকে, "আমিও ছোট পিসির মতো দূরেই বিয়ে করবো। তারপর সবাই তোমরা আমাকেও নিমন্ত্রণ করবে তোমাদের বাড়িতে।"। তখন সবাই ওর কথায় হেসে বলতো, "তুই কাছে বিয়ে করলেও তোকে আমরা নিমন্ত্রণ করবো।" যাইহোক এসব তো ছোটবেলার কথা। তারপর সেই ছোট্ট এলা বড়ো হয়েছে।তার চাকরি হয়েছে , আর হয়েছে অবশ্যই দূর দেশে পুণে তে। আর চাকরি করতে করতেই ওর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ওরই অফিস কলিগ রজতের । তারপর দুজনে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এলার ছোটবেলার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে হয়তো।বিয়ে, চাকরি সব দূরে। ছোট্ট এলা তো সেটাই চেয়েছিল ছোট থেকে।
কাজকর্মের ব্যস্ততার মধ্যেও এলা দুবার ফোন করে সারাদিনে মা, বাবাকে। কোনো কোনো দিন ভিডিও কলেও সামনা সামনি কথা বলে। মা,বাবা একা থাকে দুজনে। দুজনের ই বয়স হয়েছে। কাজের লোক , রান্নার লোক সব থাকা সত্ত্বেও এলার খুব দুশ্চিন্তা হয় । কারণ ওদের শরীর সবসময় ঠিক থাকে না। কতবার এলা বলেছে ওদের, কোলকাতা থেকে ওখানে চলে যেতে। কিন্তু ওরা রাজী হয়নি কেউই।জন্মস্থানের টান আসলে এই বৃদ্ধ বয়সে।
এলার কোলকাতায় ফেরবার কথা ছিল মা, বাবার কাছে। ফ্লাইটের টিকিটও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু করোনা আতঙ্কে পুরো দুনিয়া স্তব্ধ হয়ে গেল যেন হঠাৎই। জনজীবন স্তব্ধ। পুরো দেশকে লক ডাউনের মতো পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে । এমতাবস্থায় আসা যাওয়ার সমস্ত রাস্তা বন্ধ। নিজেকে ভীষণভাবে অসহায় মনে হচ্ছে আজ এলার। এই প্রথম এলার মনে হচ্ছে যে ,ছোট বেলায় ওর দূর দেশে থাকার ইচ্ছা টা ঠিক ছিল না। বাবা,মা কি করছে, কি খাচ্ছে সবসময় ফোনে জিজ্ঞেস করছে ও। একটা ছেলে বাজার হাট করে দিতো বাবার। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে সে ও আসছে না। মা, বাবার প্রেশারের ওষুধ, সুগারের ওষুধ সবকিছু র ব্যবস্থা ওদের নিজেদের ই করতে হচ্ছে। এলা অনলাইনে
অর্ডার করে দিতো সব ওষুধ মা, বাবার। কিন্তু এই লক ডাউনের পরিস্থিতিতে সেটাও আর পাওয়া যাচ্ছে না। সকালে মা যখন বললো, কোনো গাড়ি ছিলো না,ওরা হেঁটে হেঁটে ওষুধ কিনতে গেছে।এলার বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছিল।এই প্রথম এলার মনে হয়েছিল, ছোটবেলায় ওর দূরদেশে থাকার ইচ্ছাটা ঠিক ছিল না। মা, বাবা আজ কতো অসহায় ওকে ছাড়া এই বৃদ্ধ বয়সে।তাও যখন ই ফোন করে ওরা দুজনে ই বলে ,"তোমরা সাবধানে থেকো, আমাদের জন্য চিন্তা করবে না। আমরা ভালো আছি। ঘরেই থাকি, তোমরাও ঘরেই থেকো সবসময়। বাইরে যাবে না একদম"। হয়তো এটাই মা, বাবার ভালোবাসা। নিজেদের হাজার কষ্ট হলেও বলবে না যে কষ্টে আছে। নিজের সন্তানের ভালো থাকার কথা চিন্তা করে যায়। তাদের মঙ্গল কামনা করে।
দেশের এই বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের অনেকেরই এলার মতো অসহায়তা। দূর থেকে মা, বাবার মঙ্গল কামনা ছাড়া আর কিছুই করবার নেই আমাদের। সন্তান হিসাবে আজ আমরা বড়ই অসহায় পরিস্থিতির সামনে। এর থেকে বড়ো অসহায়তা হয়তো আমাদের জীবনে আগে আসেনি কখনও।যত তাড়াতাড়ি দেশ তথা সমগ্ৰ দুনিয়া এই বিপদ কাটিয়ে উঠতে পারবে, ততই মঙ্গল। এর থেকে বেশী এই মুহূর্তে বলবার ভাষা নেই হয়তো আমাদের কাছে। সকলের মঙ্গল কামনা করি।
ধন্যবাদান্তে
কলম রাখলাম।