Sangita Duary

Classics

4  

Sangita Duary

Classics

তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা

তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা

15 mins
470



ওই ওই ঐতো বাড়িটা। এত ঝাপসা লাগছে কেন? চোখ খারাপ হলো নাকি তাপসীর? না! সে তো দিব্যি এখনো সূঁচে সুতো পরাতে পারে, রেশনে পাওয়া চাল থেকে দিব্যি কাঁকড় বাছতে পারে! তাহলে? তাপসী দৌড়ে সামনে যেতে চায় বাড়িটার। উঃ! গলাটা বড্ড শুকিয়ে গেছে, মুখের ভিতরটা বড্ড আঁঠালো...!


ছেঁড়া ঘুমটা ভেঙে গেল। 

বেডসাইড টেবিল থেকে প্লাস্টিক মগ তুলে ঢকঢক জল খেল তাপসী।

মশারী ঠিকঠাক পাতিয়ে শুয়ে পড়লো আবার। চোখ বুজলো। আজকাল প্রায়ই এই স্বপ্নটা আসে। কেন যে আসে?

আর ঘুম আসবেনা। আর সেই ঝাপসা স্বপ্নটাও ফেরত আসবে না!

কটা বাজে এখন? মোবাইলে তো ছটার আলার্ম দেওয়া থাকে। এখনও বাজেনি নিশ্চয়ই। আর একটু চোখ বুজে শুয়ে থাকলো তাপসী। মশারীর ভিতর কয়েকটা মশা ঢুকেছে, ভনভন আওয়াজটা বড্ড কানে লাগে। শব্দ খানিক থামলো, নিশ্চয়ই কোথাও বসেছে, চোঁ চোঁ করে রক্ত টানছে! পায়ের নীচটা লাগছে, মারবে কি করে? উঠলেই তো পালিয়ে যাবে!

অর্ধেক খোলা জানালা দিয়ে বাইরের মৃদু আলো দেখা যাচ্ছে, অন্ধকার বুজে ভোর হচ্ছে। ধুর! আর আলার্মের আশায় শুয়ে থেকে কাজ নেই, উঠে পড়ে তাপসী।

পূব আকাশে ঊষা এখনও পা রাখেনি। অন্ধকার পাতলা হতে শুরু করেছে। ছেঁড়া ছেঁড়া অন্ধকার এদিক ওদিক পাতলা কাপড়ের মত জড়িয়ে ধরে রেখেছে আকাশটাকে।

পাতলা একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে তাপসী ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায়।

পাশের ঘরগুলোর এখনো ঘুম ভাঙেনি।

ভিতরটা চিড়বিড়িয়ে ওঠে। 

আরকি! খাওয়ার চিন্তা নেই, মাথার ওপর ছাদের চিন্তা নেই, ঘুমো সবাই, জন্মের ঘুম ঘুমো।

ফালি উঠোন ভরে রয়েছে শেষ বসন্তের ঝরা পাতায়।

একটা কাঠির ঝাঁটা উঠিয়ে নিয়েও ফেলে দেয়, নাহ! আগে পাড়ার রাস্তাটা একবার চক্কর দিয়ে আসতে হবে, এইসময় সবাই মর্নিং ওয়াক করে, নিজের ওয়ার্ডের প্রতি উদ্বেগটা এখনই তো দেখানোর সময়। তাছাড়া সুইপারগুলোকেও খানিক বকাঝকা করা যাবে।

কোলাপসিবল গেট খুলে তাপসী বেরিয়ে পড়ে। মাথার ওপর আলগা হাত বুলিয়ে চুল ঠিক করে নেয়। ভ্রুর মাঝখানটা স্বভাব বশতঃ কুঁচকে নেয়। চেহারায় ভারিক্কি ভাব আনার জন্য চোখে মুখে বিরক্তি খুব দরকার।

আস্তে আস্তে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে হাঁটতে থাকে।

গুপ্তদের বাড়ির সামনেটায় মজা একটা ডোবা। পাড়ার লোকেরা রাজ্যের নোংরা প্লাস্টিকে বেঁধে ছুঁড়ে দেয়, তাছাড়া অনুষ্ঠানবাড়ির এঁটো কাগজের বাসন, উচ্ছিষ্ট সব ফেলা হয় ঐখানেই। পচা গন্ধ বেরোয়। বরুণ গুপ্তর প্রায় হাফডোজন দরখাস্ত করপোরেশনের টেবিলে জমা হয়ে রয়েছে। তাপসী আজ পর্যন্ত হাত দেয়নি তাতে।

ডোবার কাছে এসে নাকে চাপা দেয় তাপসী। এগিয়ে চলে। কয়েকজন মাঝবয়স্ক পুরুষ ছুটছেন। তাপসী ভ্রুর ভাঁজ আরও ঘন করে। একজন পুরুষ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল বোধহয়, পাশেরজন হাত টেনে ধরলো।

তাপসীর নাকের পাটা ফুলে উঠলো। এগিয়ে গেল। শুনতে পেল তাপসীর পিছনে ওরা বলছে,"ওকে বলে কিস্যু লাভ নেই, বরাত জোরে কাউন্সিলর হয়ে গেছে, আরে এসসি কোটা তো! নাহলে যোগ্যতা আছে নাকি?"

অন্য আরেকটা চাপা হাসি,"সইটাও বোধহয় ঠিকঠাক...!"

তাপসী গতি বাড়ায়।

মোড় পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসে। দুটো সুইপার লম্বা ঝাঁটা দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করছে, তাপসীকে দেখে কাজ থামায়। নিশ্চয় 'গুড মর্নিং' বলে ঢং দেখাবে। ওদের গুড মর্নিং শুনে তাপসীর কী লাভ?

সেই তো পিছনে সবাই "এসসি কোটা'' বলে খোঁটা দেবে!

দ্রুত পায়ে তাপসী বাড়ির গেট খোলে। হাঁফিয়ে উঠেছে বেশ। মাথার ভিতর অসহ্য একটা টিপটিপ ভাব।

আকাশ ক্রমশঃ পরিষ্কার হচ্ছে। চিলতে রোদ পড়েছে উঠোনে।

ফেলে রাখা ঝাঁটা উঠিয়ে নিয়ে শুকনো পাতা ঝাঁট দিতে দিতে গেটের সামনে চলে আসে। তখনই ভৌমিকদের বড় ছেলেটা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তিরিক্কি মেজাজে তাপসী ঝাঁটা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,"কী চাই?"

সাইকেলটা স্ট্যান্ড করে ছেলেটা এগিয়ে আসে,"বলছি এখানে একটা কাজের লোক খুঁজে দিতে পারেন?"

ইচ্ছে করছে ঠাঁটিয়ে একটা চড় কষিয়ে দিতে। কী মনে হয় তাপসীকে দেখে, কাজের লোক খোঁজা সেন্টারের সেক্রেটারি? আরে ছাব্বিশ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সে। কাউন্সিলরের মান পাবে না?

ঝাঁটা ফেলে হুংকার ছাড়ে তাপসী,"এটা কি কাজের লোক খোঁজার জায়গা? বেরোও!"


---------------------------------------------------------------------

সকাল দশটা। বাড়ির সামনে কাত্তিকের কাঠের দোকানের সামনে বেঞ্চি ফেলে একটা চেয়ার নিয়ে বসেছে কালু। বেঞ্চের ওপর রাখা ফর্মের তাড়া।

দিদির সব কাজই তো সে সামলে দেয়। নামেই কাউন্সিলর কিন্তু ওই সপ্তাহে ক'টা হাতে গোনা দিন পৌরসভায় হাজিরা দেওয়া ছাড়া নতুন কিই বা করে আর?

এইতো মেয়াদ শেষ হতে গেল, কোন ভালো কাজটা করেছে দিদি? আখেরটাও তো ঠিকঠাক গোছাতে পারেনি। এমনকি এমন একটা ইমেজ বানিয়ে রাখে সর্বক্ষণ, যেন কত জানে! ফুঁ! থোড়াই জানে, ঐতো ক্লাস এইট। আরে আর কিছু না পারিস গুডউইলটা তো জিইয়ে রাখ!

এই যে, আমফনের পর ত্রিপল দেওয়া হলো, একবারও এসে দাঁড়িয়েছে?

দত্তদের বুড়িটা রোজ বিধবা ভাতার জন্য হেদিয়ে থাকে। তার দিকে খিটখিট করা ছাড়া কিছু করেছে?

কালু কত বোঝায়, এমন চললে ফেলিসিটেশনটাও তো ঠিকঠাক পাবিনা!

অলক এসে একটা বান্ডিল এগিয়ে দেয়,"ডিজিটাল কার্ডের জন্য দরখাস্ত। দিদিকে দেখে রাখতে বলো, আর কাল যেন অবশ্যই একবার অফিসে যায়।"

ঈষৎ ঘাড় নেড়ে কালু বান্ডিল নিয়ে ঘরের দিকে এগোয়।

পিছনে অলক,"কালু শোন, রাস্তাটার ব্যাপারে একটু ভাব, বর্ষা এলে তো জল আর ঠেকানো যাবেনা।"

তারপর কালুর কানের কাছে মুখ এগিয়ে নিয়ে আসে," মোটামুটি দাঁড় করিয়ে দিলেই হলো, নেক্সট ভোটের আগে পর্যন্ত চললেই ব্যাস, আরে কত আর লাগবে, মোটা প্যাকেট কিন্তু ঘরে ঢোকার এই মোক্ষম সুযোগ, দিদিকে বোঝা!"

অলক চলে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ স্থানুবত অলকের চলে যাওয়া দেখলো কালু। এই তো একবছর হলো পৌরসভার কেরানী হয়ে ঢুকলো ছেলেটা। এর মধ্যেই নিজের মধ্যে কেমন একটা দোমড়া চোমড়া ভাব। লোকে ডেকে ডেকে অলককে অসুবিধের কথা বলে। বলবে নাই বা কেন?

এর মধ্যেই আবাস যোজনায় শ্বশুরের ঘরটি কেমন তুলে দিলো, সামনের খোলা জায়গায় ঢালাই ড্রেন করে দিলো!

একেই বলে তড়িৎকর্মা ছেলে। নিজের ঘরের ড্রেনে ব্লিচিং ছড়াচ্ছে তাও করপোরেশনের মজুরিতে, ছাদের শ্যাওলা, পরগাছা পরিষ্কার করছে করপোরেশন ভায়া।

সবাই, সবাই চালাক। এক তার দিদি ছাড়া।

নাহলে...

ঘরে ঢুকেই থমকেছে কালু। জামাইবাবু এসেছে। তারমানে আজও দিদির মুড টঙে!

-------------------------------------------------------------------


বাবার হাত থেকে বিদেশী ঘড়িটা দেখেই দুই চোখ আনন্দে চিকচিক করে উঠলো বুবাইএর,"ওয়াও! কি করে বুঝলে এটা আমি পছন্দ করবো?"

ছেলের হাতে বাক্সটা ধরিয়ে দিলো বিভাস,"দেখলাম তোর ঘড়ির বেল্টটা ছিঁড়ে এসেছে, তাই...! পছন্দ হয়েছে তো?"

আনন্দ চেপে বুবাই বাবাকে জড়িয়ে ধরে,"খুব হয়েছে। আজ থাকবে তো বাবা?"

এই প্রশ্নটার জন্য আদতেও তৈরি ছিলোনা বিভাস। মুখে বললো,"কতদিন তো তুই ওবাড়ি যাসনি, মলিও বলছিল...!"

থেমে গেছে বিভাস। সামনে তাপসী এসে দাঁড়িয়েছে।

বুবাইএর থেকে ঘড়িটা আড়াল করলো।


অবাক লাগলেও মাকে দেখে বুবাই বুঝলো কারণটা। এই কারণটা তো সে ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে!

ঘরের মধ্যে রমলা এলেন,"আরে বাবাজীবন, কখন এলে? ভালো আছো তো?"

কথাটা বলেই থমকেছেন মহিলা। 

"তুমি বসো, চা খাবে তো?" বলেই একপ্রকার দৌড়েই বেরিয়ে গেলেন রমলা।


আগ বাড়িয়ে কথা বলা তাপসীর ধাতে নেই। তাই দাঁড়িয়েই রইলো। বিভাস ইতস্তত করে বললো,"অনেকদিন বুবাইটাকে দেখিনা, তাই...! কেমন আছো তপু?"

বুকের ভিতর ছলাৎ স্রোতটা যেন আবার চলকে উঠলো। কতদিন পর বিভাসের মুখ থেকে এই নামটা শুনলো তাপসী!

কিন্তু তার যে নরম হওয়ার জো নেই, সে নরম হলেই তো...!

"বসো, আমি মাকে দিয়ে তোমার চা'টা পাঠিয়ে দিচ্ছি!", বলেই বেরিয়ে গেল তাপসী।

---------------------------------------------------

শ্মশানের পাশে যে ঘুপচিটা রয়েছে ওখানেই বিধবা মা আর দুধের ভাইটাকে নিয়ে মাথা গুঁজে পড়ে থাকতো তাপসী।

আগে থাকতো পুরুলিয়ায়। জমিও ছিল নিজেদের। সেবছর প্রচন্ড গুমোট পড়লো যখন, সরাই কাকা বাপকে বললে,"কলকেতায় মিসতিরিদের খুব চাহিদা। চল, কারোর সাথে জোগারে লেগে যাবি, দেখে দেখে কাজ শিখে নিবি'খন।"

গ্রামের জমি যা ছিল, মোড়লের কাছে বন্ধক দিয়ে সব্বাইকে নিয়ে বাপ চলে এলো কলকাতায়। জোগারে কাজ করতে করতে একদিন উঁচু মাচা থেকে পড়ে যায়, মরে যায়।

সরাই কাকা মা'কে একটা ঝিয়ের কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল, বদলে রোজ সন্ধ্যেবেলা মা ফিরলে মাকে নিয়ে ঘরে ঢুকে খিল দিত।

তাপসী সারাদিন ঘরে থেকে ভাইকে আগলাতো। ছোট জাত তারওপর বহিরাগত,তাই সব জায়গায় যেতেও পারতো না।

দিনেরবেলা করাতকলের কাঠকুটো ঘরে আনতো, তাই জ্বালিয়ে রান্না করতো, মা তো সেই কোন সকালে বেরিয়ে যেত, ফিরেও তো রেহাই পেতো না!

কতবার মা'কে বলেছে তাপসী,"সরাই কাকাকে ঘরে ঢুকতে দেবে নে একদম!"

মা ত্রস্ত তার মুখে হাত চাপা দিয়ে থামিয়ে দিত ,"খবরদার অমন বলিস নে, সেদিন ও যদি না ভাতের জোগাড় করে দিত, কী গিলতিস?"


তখন তাপসীর সদ্য যৌবন। ভরন্ত শরীর থাকলেও মুখের শ্রী টুকু ছিলোনা। কাঠকুটো আনতে গিয়েই হঠাৎ একদিন দেখলো সামুইদের বাড়িতে সরাই কাকার সঙ্গে একটা কমবয়সী ছেলে, কাজ শিখছে।

তাপসীকে দেখে সরাই কাকা এগিয়ে আসে। জুলুজুলু চোখে তার শরীর চাখে,"কিরে এখেনে?"

তাপসী চোখ নামিয়ে নেয়,"কাঠ কুড়োতে এয়েছিলুম!"

সরাই কাকা কিছু একটা ভাবলো, বললো,"যা, ভাত চড়া, আমি যাচ্চি, দুপুরে ভাত খাবো তোদের ঘরে!"

সেই শুরু, তারপর থেকে সরাইকাকা রোজ তাপসীকে ভোগ করতো। মা জানতো না। তাপসীরও বলা বারণ ছিল, নাহলে সরাইকাকা হয়তো তার বাপের মতো বাকি সকলকেই খুন করে দিতো!

মাও একদিন জানলো, কিন্তু কিছুই করলো না। করেও যে লাভ হতো না এটা খুব ভালো করে জানা ছিল সকলের।

অসময়ে ভাত জোগানোর মাশুল যে এভাবেও দিতে হয়!

কিন্তু তাপসীর সব কষ্টের একমাত্র ওষুধ ছিল বিভাস। ওকে দেখলেই তাপসীর মনে হতো, পৃথিবীতে ও'ই একজন যে হয়তো ভোগের পরেও ভালোবাসতে জানে!


সেদিনও এক দুপুরবেলা, সরাইকাকা তাপসীর চুলের মুঠি টেনে ধরলো,"খুব পীড়িত! কতদিনের পীড়িত চলছে র‍্যা?"

তারপর কী ভাবে ছেড়েও দিলো তাপসীকে, বললো,"সেই ভালো, অন্য কেউ বে করলে তো অন্য কোথাও চলে যেতি। খ্যাঁক খ্যাঁক! আজই তোর মা'র সাথে কথা কইবো, সামনের বোশেখেই তোদের বে টা দিয়ে দেব।"

বিভাস আজও জানেনা, বুবাই আসলে সরাই কাকারই...!

দূরের দূরের কাজ নিতো বিভাস।

কটা দিনই বা থাকতো তার কাছে? আর কাছে এলেও সরাই কাকার মতো দেহে আগুন ধরাতে পারতো না। মানুষটা বরাবরই দুর্বল, চরিত্রেও, পৌরুষত্বেও।


পার্টির হয়ে কাজ করতো সরাইকাকা। ভোটে জিতেওছিলো। এখন তো সে হোমড়াচোমড়া এক নেতা।

সরাইকাকাই এস সি কোটায় দাঁড় করিয়েছিল তাপসীকে। তখনও তাপসী অতো বোঝেনি। কলের পুতুলের মতো সরাই কাকা যা বলেছে, শুনেছে।

কোথা থেকে যেন জিতেও গেল। বিজয় মিছিল বেরোলো যেদিন, সরাইকাকা কাঁধে হাত রেখে ঘুরিয়েছিলো। পার্টির লোকেরা বাঁকা চোখে তাকিয়েছিল, মনে আছে তাপসীর। তাইতো আজও কারোর সাথে মিশতে সংকোচ হয়, কেবলই মনে হয়, সরাইকাকা আর তার সম্পর্কটা সবাই জেনে ফেলেছে, এবার ছিঃ ছিঃ করবে, বিভাস জানবে, বুবাই জানবে। তখন, কী হবে তাপসীর?

ছোট জাত, তাই বলে লোকজনের কাছে ছোট মুখ করে ঘুরে বেড়াবে তাপসী?

আর তো ক'টা মাস, তারপরেই তার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। তখন তো আর অনিচ্ছা সত্বেও করপোরেশনে গিয়ে হাজিরা দিয়ে আসতে হবেনা! নকল হাসি ফুটিয়ে লোকের সাথে কথা বলতে হবে না!

কিন্তু তারপরেও কি নিস্তার মিলবে তার?

সরাইকাকা ছেড়ে দেবে তাকে?

শোনা যায় আজকাল ওই জেলেপাড়ার ফুলির ঘরে সরাইকাকার খুব যাতায়াত!

হয়তো, সামনের ভোটে ফুলিকেও দাঁড় করিয়ে দেবে! দিক! তাপসীর এরকম খোলোকের মধ্যে মুড়ে থাকতে আর ভালো লাগে না।

এইযে বিভাস এতদিন পর, জিজ্ঞেস করলো সে কেমন আছে, একটা কথাও তো বলতে পারলোনা তাপসী। শুধু কি তাই? এখন বিভাসের দারুণ রমরমা। প্রায় খান কুড়ি মিস্ত্রি তার আন্ডারে কাজ করে, ওই সরাইকাকাই কন্ট্রাক্টে প্রমোটার ধরিয়ে দেয়, বিভাসের কাজ ভালো, শহরে দশটা ফ্ল্যাট উঠলে আটটার কন্ট্রাক্ট সে পায়।

গাবতলায় সলিড একটা জমি কিনে ফেললো গেল বছর, তিনতলা তুলে ফেললো। পাথর বসিয়ে অট্টালিকা বানালো। এ সব দেখেও কি তাপসীর ইচ্ছে করেনা বরের কাছে দুদন্ড বসতে?

করে, খুব করে। আবার ভয়ও করে যদি বিভাস সব জেনে ফেলে? যদি সরাই কাকাই সব বলে দেয়?

তাপসী কি পারেনা, মা বোন ভাইকে এবাড়িতে রেখে বিভাসের আর বুবাই এর হাত ধরে নতুন বাড়িতে গিয়ে উঠতে?

পারে তো! কিন্তু ওই, ভয়, সরাইকাকা যদি রেগে যায়! যদি সবার ক্ষতি করে? 

আরও একটা চিনচিনে ভয় বুকের ভিতর, বিভাস যদি ঘেন্না করে তাপসীকে? একসঙ্গে থাকতে থাকতে যদি ছাপা কাপড়ের মতো সস্তা হয়ে যায় সে বিভাসের কাছে? তখন?


জোর শব্দ করে প্রেসার কুকার হুইসেল ছাড়লো। তাপসীর চিন্তায় ছেদ পড়লো।

বিকেল গড়িয়ে গেল, কই কাজের মাসি তো এখনও এলো না!

পাশের ঘরের পর্দা উঠিয়ে দেখলো তাপসী। বুবাই চিৎ হয়ে শুয়ে মোবাইলে গেম খেলছে। মাথাটা গরম হয়ে গেল তাপসীর। সারাক্ষণ খালি ওই ফোন আর ফোন। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে পড়ানো হচ্ছে, ছেলের সে দিকে হুঁশ আছে?

ছেলেকে শাসন করতে গিয়েও তাপসী নিভে যায়। ছেলে যদি বলে ফেলে,"তুমি পড়াশোনার কী জানো?" তখন? থাক।

বাইরে গ্রিলের দরজা খোলার শব্দ। ওই এলেন মাসি।

আজ বেশ করে রোগড়ে দিতে হবে। বড্ড ফাঁকি দিচ্ছে আজকাল।

উঠোনের এক ধারে বাসনের পাঁজা নিয়ে বসেছে মাসি।

কোমরে হাত রেখে তাপসী সামনে গিয়ে দাঁড়ায়,"বলি ব্যাপারখানা কী অ্যাঁ? আসছো দেরী করে, বাসনে এঁটো লেগে থাকছে, দূর করে দেব একদম! খালি দরকারের সময় মিউ মিউ?"

হাতের বাসন মাজার জালি ছুঁড়ে ফেলে উঠে দাঁড়িয়েছে মাসি,"কী দরকারটা মেটাও তুমি হ্যাঁ? ওই মাইনেটুকুই যা, তাও অন্য বাড়িতে ঘর মোছা বাসন মাজায় হাজার টাকা দেয়, এতগুলো বছর তোমার বাড়ি কাজ করছি, পাঁচশোর এক পয়সা বেশি ঠেকিয়েছো কখনও?"

কোমরে আঁচল গুঁজে তেড়ে আসে তাপসী,"কী বললি? মুখে মুখে খুব তো চোপা করতে শিখেছিস, বলি তোর ছেলেটা যখন জ্বরে পড়লো, কে করপোরেশনের ডাক্তার দেখানোর ঝামেলা পুইয়েছিলো রে?"

- "এক সাফাই আর কতদিন শোনাবে গো? শুধু ডাক্তারের কাছে পৌঁছে দিয়েই এত খোঁটা? খরচ দিলে আরও কী কী শোনাতে?"

- "তোর খরচ আমি বইবো কেন রে মুখপুড়ি? অমন মুখের নুলো জ্বেলে দিতে হয়।"

-" আমার মুখের চিন্তা তোমায় করতে হবে নে, তুমি তোমার মুখ নিয়ে ভাব। সাধে কি আর বর অন্য মেয়েতে মজে?"

কানের ভিতর কেউ গরম কিছু ঢেলে দিল নাকি?

দুমদাম করে তেড়ে আসে তামসী,"কী বললি? ওই কী বললি তুই? প্রমাণ দিতে পারবি?"

- "যা বলেছি ঠিক বলেছি, আর প্রমাণ চাও, নিজের ছেলেকেই জিজ্ঞেস করো, সেও তো নতুন বাড়িতে যায় নাকি!"

আরও অনেক কিছু বলে চলেছে মাসি। তাপসীর কানে ঢুকছে না।

মনে পড়ছে ভোর রাতে দেখা সেই স্বপ্নটা, সেই আবছা হতে থাকা বাড়ি, বাড়ির ভিতর আবছা সাজানো ঝুল গাছের টব! ঝোলা বারান্দা! আচ্ছা সেদিন বিভাস কোন এক 'মলি'র কথা বলছিল বুবাইকে, মলি'ই কি তবে এই মেয়েটি যার সাথে বিভাস নতুন করে সম্পর্কে জড়িয়েছে?

মাথাটা কেমন ঘুরে গেল তাপসীর। অন্ধকার হয়ে আসছে চারিদিক।


---------------------------------------------------------------

সন্ধ্যার দিকেই ফোনটা এলো, বুবাইএর, হাউহাউ করে কাঁদছে,"বাবা, মা অজ্ঞান হয়ে গেছে, বাড়িতে কেউ নেই , মামা দিদাকে নিয়ে শঙ্কর নেত্রালয়ে গেছে। তুমি একবার আসবে?"

সবে বিভাস কাজ থেকে ফিরেছে, পরিষ্কার হয়ে খেতে বসেছে। ওরকম একটা ফোন পেয়ে কি আর শান্তিতে খাওয়া যায়?

মলি চা করতে রান্নাঘরে ঢুকেছিলো। বিভাস না বলে স্ত্রস্ত বেরিয়েই যাচ্ছিল। মলি পিছু ডাকলো,"দাঁড়াও আমি যাবো!"

বিপদের সময় কাঁধে রাখার মতো সত্যিই একটা হাতের বড্ড প্রয়োজন।

ঠিক যেমনটা সেদিন মলির প্রয়োজন মিটিয়েছিলো বিভাস!

গ্রামের পাঠ চুকিয়ে কবেই তো চলে এসেছিল এখানে পেটের তাগিদে। থাকার মধ্যে মা ছিল, সেও তো গ্রামে থাকতে নিউমোনিয়ায় মরে গেল।

শহরে এসে একটা চায়ের দোকানে কাজ পেয়েছিল বিভাস। দুবেলা দুটো পাউরুটি আর চা, এই খেয়ে কি আর পেট জুড়োয়?

সরাইদা রোজ ওখানে চা খেতে যেত। টুকটাক ফরমাস খেটেও দিত বিভাস। সরাই'দাই তো হাতে ধরে কাজ শেখালো। আজ বিভাসের যা কিছু সব তো ওই সরাই দার জন্যই।

তাই সরাইদা যখন তাপসীকে বিয়ে করার কথা বললো, বিভাস 'না' করেনি, এটা জানা সত্বেও যে তাপসী সরাইদার বাঁধা মেয়েমানুষ।

কত মানুষেরই তো বৌদের বাড়তি পুরুষমানুষ থাকে, তারও নাহয় থাকলো।

ইচ্ছে করেই দূরের দূরের কাজ নিতো বিভাস। বাড়ি ফিরতে যখন, বউয়ের কাছে দাঁড়াতো যখন, কেবলই মনে হতো তাপসী শুধুমাত্র সামাজিক স্বীকৃতির জন্য তাকে বিয়ে করেছে, আসল মন তো পড়ে থাকে অন্য কারোর কাছে! নাহলে কেন তাপসী নিজে থেকে কখনো তার কাছে আসেনা?

বিভাস পালিয়ে বেঁচেছে।

আবার বারবার ফিরেও গেছে, কেবল ওই বুবাইএর টানে। 'বাবা' বলে ডাকে যখন ছেলেটা, মনে হয় সব অপ্রাপ্তি যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় ওর ওই এক 'বাবা' ডাকে।

তারপর তাপসী কাউন্সিলর হলো, মুখে যেটুকু মিষ্টতার অবশিষ্ট ছিল সব যেন মিলিয়ে গেল।

''আরে তাপসী সর্দার তো একটা ভূষ মাল। যোগ্যতা আছে নাকি কাউন্সিলর হওয়ার? সই করতে জানে? দেখ কার সাথে শুয়ে পড়েছিল, আবার এস সি কোটা..." এরকম কত কটূক্তি যে বিভাসকে শুনতে হয়!

রাগ হয় খুব।

আবার যখন ভাবে করুণাও হয় তাপসীর ওপর। ওর কী দোষ? সরাই'দা'ই তো সব নষ্টের গোড়া। আগে নাকি তাপসীর মায়ের সাথেও সম্পর্ক ছিল।

পরিস্থিতির চাপে পড়েই তাপসী এমনটা হয়ে গেছে। সত্যিই তো ওর কোনো দোষ নেই।

তাইতো গাবতলায় তিনকাটা জমিটা কিনে বাড়ি শুরু করে দিলো বিভাস। এখানে এসে যদি তাপসী একটু নিজের মত বাঁচতে পারে, গাবতলা ভদ্রপাড়া। সরাই'দা নিশ্চয়ই এখানে এসে জুলুম করতে পারবে না!

কিন্তু তাপসী গেল কই?

বললো, "আমি চলে গেলে আমার মা ভাই কোথায় যাবে? তোমার আশ্রিত হয়ে ওরা থাকুক আমি চাইনা। তোমার যদি এখানে অসুবিধে হয় তুমি নাহয় ওখানে গিয়েই থাকো।"

বিভাস বলতে চেয়েছিল,"ঠিক আছে ওরা নাহয় এখানে থাক, টাকা পয়সা মাসে মাসে আমি পাঠিয়ে দেব!"

তাপসী রাজি হয়নি। তা কি শুধু মা বোন ভাইয়ের জন্য নাকি অন্য কারণে এটা বিভাস জানেনা।

কিন্তু তাপসীর সঙ্গে বিভাস আর থাকেনি।

নতুন বাড়িতে একাই থাকে, একাই রাঁধে, কাজ নিয়ে দূরে চলে যায়, চাবিটা বুবাইকে দিয়ে যায়।


আপাতত তাপসী নার্সিংহোমে। ছোটখাটো একটা স্টোক হয়ে গেছে। ভাগ্যিস বুবাই বুদ্ধি করে ক্লাবে খবর দিয়েছিল, ওরাই এম্বুলেন্স ডেকে নার্সিংহোমে নিয়ে যায়। বিভাস পৌঁছে ফর্মালিটি মিটিয়েছে।

তাপসী ইনটেনসিভ কেয়ারে রয়েছে। স্যালাইন চালু হয়েছে, অক্সিজেন চলছে, পালস বড় দুর্বল। এখনও জ্ঞান ফেরেনি।

ওয়েটিং জোনের এককোণে গুম মেরে বসে আছে বুবাই। খুব ভয় পেয়ে গেছে। মলি এসে দাঁড়িয়েছে ওর পাশে," চল কিছু খেয়ে নিবি। বাবা তো আছেই এখানে।"

হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে বুবাই,"না, আমি মাকে ছেড়ে কোত্থাও যাবো না!"

বিভাসের চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে,"বুবাই, শরীরটা তো ঠিক রাখতে হবে। তুই বড় হচ্ছিস, আমারও যদি হঠাৎ করে তোর মায়ের মতো কিছু একটা হয়ে যায়, তোকেই তো সবটা সামলাতে হবে বাবা, যা, জেদ করিসনা। আমি তো রইলাম এখানে। তুই বরং কাল থাকিস!"

মলি জোর করে টেনে নিয়ে গেল বুবাইকে।

কালুকে ফোনেই খবরটা দিয়েছিল বিভাস। মায়ের চোখের চেকআপ না করিয়ে ফেরত এসেছিল সঙ্গে সঙ্গে। সেও গুম হয়ে বসে রয়েছে।

বিভাস কালুকে ডাকে,"তুইও যা, মায়ের বয়স হয়েছে।"

কালু উঠে দাঁড়ায়,"কিন্তু জামাইবাবু তুমি একা...!"

- "প্রয়োজন পড়লে নাহয় তোকে ফোন করে ডেকে নেব। আর এখন কত রাত যে জাগতে হবে! কাল বরং তুই থাকিস! যা আজ গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নে!"

করিডোর দিয়ে কালু মাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল আর মলি বুবাইকে নিয়ে।

এই মলি'র কাছে দিনদিন ঋণ বাড়ছে বিভাসের।

আগে জেলে পাড়ায় থাকতো। গাবতলায় কয়েকটা বাড়িতে ঠিকে ঝিয়ের কাজ করতো। ওকে দেখলেই বিভাসের কিশোরী তাপসীর কথা মনে পড়তো। এমনি করেই তো কোমর বেঁধে কাঠকুটো বইতে যেত তাপসী। সরাইদার কাজের ঘরের সামনে দাঁড়াতো, সরাইদা লোভী চোখ দিয়ে চাখত তাপসীকে, আর বিভাস নির্লিপ্ত হয়ে দেখতো ঘটনাগুলো।


বিভাস জেলেপাড়ায় একটা কাজে গিয়েছিল একদিন, ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয় হয়। একটা বাড়ির সামনে তুমুল চেঁচামেচি, লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। জানা গেল, মাতাল বাপ মেয়েকে বেধড়ক মারছে কারণ মেয়ে তার কথা মতো বিক্রি হতে রাজি হয়নি।

আবার এক তাপসীর করুণ মুখটা চোখের সামনে ঝলক দিয়ে উঠলো।

মাথায় জেদ চাপলো, ঘরে ঢুকে মলির হাত ধরে বের করে আনলো।

তারপর থেকে মলি বিভাসের আশ্রয়েই আছে।

বিভাসের সংসারটা মাথায় করে রেখেছে। নিজের সংসারের মতোই আগলে রেখেছে।

নিজের কাছে যেন হেরে যাচ্ছিল বিভাস।

একদিন মলির মুখোমুখি হলো,"জানিনা তুমি কী মনে করবে, কিন্তু আমি বিবাহিত। হ্যাঁ আমি আমার বউয়ের সাথে থাকিনা ঠিক, তবে তাকে আমি ভালবাসিনা, এমনটাও নয়।"

মলি ঘাড় নেড়ে উত্তর দিয়েছিল, "আমি জানি সব। এও জানি, তোমার এখানে আছি বলে লোকে অনেক অকথা কুকথা বলে, সে তো বাপ বিক্রি করে দিলেও বলতো। আমার মতো মেয়েদের সংসার থাকতে নেই যে! তবু তুমি একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই দিয়েছো এটাই আমার কাছে অনেক।"

বুকের ভার কিছুটা লাঘব হয় বিভাসের। পরদিন বুবাইকে নিয়ে যায় মলির কাছে, সব খুলে বলে। বুবাইও কোনো আপত্তি করেনি।

ছোট থেকে বাবার বঞ্চিত রূপটা দেখতে দেখতে সেও হয়তো চেয়েছিল বাবার জীবনে এমনই কিছু একটা ঘটুক।

 হয়তো মনে মনে মলিকে নিয়ে স্বপ্নও দেখতে শুরু করেছিল বিভাস!

হঠাৎ করে কী যে সব হয়ে গেল?

আচ্ছা, সরাই'দা জানে তাপসীর এই অবস্থার কথা?

বিভাস জানাবে কি?

জানিয়েই বা লাভ কী?

কোন লাভবান কাজটা আজ পর্যন্ত করেছে মানুষটা শুধুমাত্র নিজের আখের গোছানো ছাড়া?


নার্সিংহোমের লোকজন কমতে থাকে। নার্স এসে একটা প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিয়ে বলে,"এগুলো লাগবে এক্ষুণি"।

বিভাস জিজ্ঞেস করে,"কেমন আছে ও? জ্ঞান ফিরেছে?"

নার্স ঘাড় নেড়ে চলে যায়।

----------------------------------------------------------------


কাল সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি মলি। পাশের ঘরে, যে ঘরে বিভাস থাকে সেখানে বুবাই ঘুমিয়েছে।

নিজের ঘরের বারান্দায় বসে সারারাত জেগে কাটিয়েছে মলি। এক অজানা ভয়ে বুকটা বারবার কেঁপে উঠছে।

কিসের ভয় জানেনা। কেবল মনে হয়েছে তার পায়ের তলার মাটিটা যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে।

ছেলেবেলায় মা মারা গেছে, বলা ভালো মাতাল বাপটাই পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।

গাবতলায় কাজ করে যা ইনকাম করতো, তার বেশিরভাগ বাপ উড়িয়ে দিতো তার ওপর ধারও করতো। মেয়ে হয়েছে যখন শুধতে তো হবেই!

গাবতলার বাড়ির সামনের রাস্তাতেই বিভাসের সঙ্গে প্রথম দেখা, কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতো মলি'কে! সেই দৃষ্টিতে কোনো নোংরা ইঙ্গিত ছিল না।

এতো চোখের মাঝে বিভাসের চাহনি তার মনে অন্যরকম এক ভালোলাগা বয়ে আনতো, মনে মনে হয়তো ভালোও বেসে ফেলেছিল বিভাসকে।

যেদিন জানলো বিভাস বিবাহিত, নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল। গাবতলার কাজ ছেড়ে দিয়েছিল। কে জানে, ওই চাহনি যদি আবার তাকে মায়ায় বেঁধে ফেলে, সর্বনাশের পথে নিয়ে যায়?


বাপের নেশার ঘাটতি হচ্ছিল তাইতো জোর করে বিক্রি করে দিতে চেয়েছিল সেদিন। অথচ ভাগ্যের পরিহাস, সেই বিভাসই গিয়ে বাঁচালো তাকে, আশ্রয় দিলো, হয়তো তো একটা সংসারও দিলো।

একটা অনিশ্চিত সুখী সংসারের স্বপ্ন বুনছিলো মলি মনে মনে। বুবাইও তাকে মেনে নিয়েছিল যে!

তারপর!

তাপসী দি যদি ফিরে আসে আবার?

নিজেকে ধিক্কার দেয় মলি," ছিঃ! নোংরায় থেকে মনটাও নোংরা হয়ে গেছে তোর, ছিঃ!"

আচ্ছা! হার্টফেল করলে তো মানুষ মরেও যায়। তাপসীদিও যদি ...!

মনের মধ্যে কুলকুল যেন একটা বাতাস খেলে যায় চকিতে!

নিজের গালে সপাটে একটা চড় কষায় মলি। শেষে কিনা নিজের স্বার্থে সে অসুস্থ একজনের মৃত্যু চাইছে! ছিঃ!

-----------------------------------------------------------------


সারারাত জেগে ভোরের দিকে একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল। সিস্টার এসে খবর দিলো তাপসীর জ্ঞান ফিরেছে। দৌড়ে যায় বিভাস। বসে তাপসীর বিছানার পাশে, আলতো হাত কপালে রাখে। তাপসী চোখ খুলে তাকায়। সেই কিশোরী চাহনি। এই চাহনিতে রাগ লেগে নেই, লেগে আছে এক ঘোর লাগা প্রশ্রয়।

বিভাসের হাতটা নিজের বুকের কাছে টেনে নেয় তাপসী, জড়ানো গলায় বলে," কতক্ষণ থেকে বসে আছি, এই তোমার আসার সময় হলো?"

কী বলছে তাপসী এসব?

তাপসী বিভাসের জামার কলার নিজের দিকে টেনে ধরে,"আমাকে বিয়ে করবে? শোনো কিন্তু তুমি আর সরাইকাকার কাছে কাজ করবে না। লোকটা একদম ভালো নয়।"

শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা একটা স্রোত খেলে গেল যেন বিভাসের।

উঠে নার্সকে ডাকতে যাচ্ছিলো, তাপসী হাত টেনে ধরে,"কোথায় যাচ্ছো? মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও না! বড্ড ব্যথা। কী হয়েছে গো আমার? এখানে শুয়ে আছি কেন? এটা কোন জায়গা? তাড়াতাড়ি চলো এখান থেকে, কালুটা না খেয়ে আছে, মাও ফিরবে এক্ষুণি, একটু ডালে চালে বসিয়ে দেব, তুমিও খেয়ে যেও কিন্তু!"

স্থানুবত বিভাসের হাত তাপসীর কপালে থমকে যায়।

এসব কী বলে চলেছে তাপসী?

এ সব তো সেই পুরোনো দিনের কথা।

তবে কি তাপসী সব ভুলে গেল? স্মৃতি লোপ পেল?

এখন কী করবে বিভাস?

তাপসী কি তবে কাউকে আর চিনতে পারবে না?


দরজায় সরাই এসে দাঁড়িয়েছে,"কই সক্কাল সক্কাল কী সব শুনলুম হ্যাঁ?" বলেই গটগট করে এগিয়ে গেল তাপসীর বিছানার দিকে,"আরে কাল তো ছিলুম না, সকালে এসেই শুনলুম এই কান্ড। স্পেশাল পারমিশন করে ঢুকেই পড়লুম এখেনে। হ্যারে তপি কী করে পড়ে গেলি রে?"

আতঙ্কে বিভাসের আস্তিন জাপটে ধরে কোলের ভিতর মুখ লুকোচ্ছে তাপসী,"সরাইকাকা! এক্ষুণি আমাকে নিয়ে ...

বাঁচাও আমায়, বড্ড লাগে বড্ড লাগে!"

সরাই রে রে করে ওঠে ,"এ সব কী বলছিস রে? এই ডাক্তার, নার্স... পেশেন্ট কী বলছে এসব?"

তাপসী ভয়ে গুটিয়ে যাচ্ছে আরও।

ভাবলেশহীন চোখে বিভাস দেখছে তার বেরসিক বউকে।

ভিজিটিং আওয়ার বোধহয় শুরু হয়ে গেছে।দরজায় বুবাই দাঁড়িয়ে পাশে আরও একটা বেরঙীন মূর্তি অনড়, অচল... মলি!!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics