Anupam Rajak

Horror Classics Fantasy

3  

Anupam Rajak

Horror Classics Fantasy

তমসা

তমসা

7 mins
199


সন্ধেবেলায় অফিস থেকে ফিরে, কল্যাণী ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানায় ফেলে দিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে ছিল। নতুন শহরে চাকরির প্রথম দিনেই এত ধকল গেছে ওর উপর, যে, ওর শরীর আর নিতে পারছিল না। রুমের আলো জ্বালিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে ছিল। অনেক রাতে, কোনও কিছুর আওয়াজে ঘুমটা ভেঙ্গে যাওয়ায়, ধড়ফড় করে উঠে পড়ল। অন্ধকার দেখে বুঝল, নিশ্চয় লোড শেডিং হয়েছে। অফিসে থাকা কালীনই বহুবার লোড শেডিং হয়ে ছিল। তাই, ও বুঝে গেছিল, যে, এই শহরে লোড শেডিং এখনও হয়। বিছানার উপরে রাখা ভ্যানিটি বাগটার থেকে মোবাইলটা বের করতে যেতেই একটা অজানা নম্বর থেকে কল এল। কলটা তুলে হ্যালো বলার আগেই অন্য দিক থেকে একটা ক্ষীণ মেয়েলী কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। প্রথমে তো বুঝতেই পারল না, কেউ কিছু বলছে কি না। একটু পরে, খুব মন দিয়ে শুনতে চেষ্টা করলে, বুঝতে পারল, কোণও এক হাসপাতাল থেকে একটা মেয়ে ফোন করেছে।

“হ্যালো! কে বলছেন?”

“মা! আমি বলছি! শুনতে পাচ্ছ?”

“আমি কারুর মা নই। আপনি রঙ নম্বর ডায়াল করেছেন”, বলে, কল্যাণী ফোনটা কেটে দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু, তখনই যা শুনতে পেল, তাতে ও বাধ্য হয়েই কানে চেপে ধরল মোবাইলটাকে। ওর মায়ের অভিনয় করতে বাধ্য হল।

“হ্যাঁ, বল!”

“মা! বাবা আজকে আবার এসেছিল”।

“কি বলল?”

“জিজ্ঞেস করল, তুমি কোথায় আছ। আমি বললাম, আমি কিছু জানি না”।

“কেন?”

“তুমি ভুলে যাচ্ছ মা, বাবা তোমাকে মেরে ফেলবে”।

“কেন? বাবা আমাকে মেরে ফেলবে কেন?”

“ওঃ মা! তুমি এত ভুলো মন নিয়ে কি করে বাঁচবে গো? মনে নেই, তুমি যখন সেলাই স্কুল থেকে তোমার প্রথম বেতন পেয়ে, আমার কলেজের বই খাতা কিনে দিয়ে ছিলে, বাবা সেদিন তোমাকে কি রকম মার ধর করে ছিল! সেদিন, আমি তোমাকে স্টোর রুমে তালা মেরে বন্ধ না করে দিলে, বাবা তো তোমাকে সেই দিনই মেরে ফেলত! মদ খাওয়ার পয়সা না থাকলে, বাবা অন্য কিছুই বুঝত না”।


নিজের শীরা উপশিরায় পুরুষ জাতীর জন্য একটা ঘৃণা এমনিই ছিল, কল্যাণীর। এই ফোন কলটা সেই বিদ্বেষকে আরও ক’এক গুণ বাড়িয়ে দিল। কাটা ঘায়ে যেন নুনের ছিটে পড়ে গেল। কল্যাণী নিজে কম কষ্ট পেয়েছে, মদ্যপ স্বামীর অত্যাচারের জন্য! নাহলে, আজ ও এই নতুন যায়গায় একলা থাকত কেন! তিলে তিলে জ্বলে পুড়ে যখন ছাই পাঁস হয়ে যাওয়ার উপক্রম হল, তখন না ও ডিভোর্স চেয়ে কোর্টে কেস ঠুকে ছিল মিলনের নামে! যাই হোক, শেষমেশ ডিভোর্সটা পেয়ে পর একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল।


ফোনের অপর প্রান্ত থেকে তখন সেই মেয়েটা বলে চলেছে, ”আর যেদিন তোমাকে চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে রাস্তার উপরে আছড়ে ফেলেছিল? সেদিন, পাড়ার শীতল দারোগা না এলে যে কি হত কে জানে! উঃ! কি কষ্ট! আর সহ্য হচ্ছে না, মা! আর থাকতে পারছি না। মাগো!”


“কি হল? কি হল বল!”

ফোনের অপর প্রান্ত থেকে শুধু গোঙানির আওয়াজ ছাড়া অন্য কিছুই আর শোনা গেল না। কল্যাণী অনেক বার “হ্যালো! হ্যালো!” করে চিৎকার করলেও কোনও জবাব পেতে পারল না। শেষে, ফোনটা কেটে দিয়ে আরেকবার নিজে কল করবে ভেবে কেটে দিল। কল হিস্টরিতে গিয়ে কল করতে গেল। কিন্তু, ফোনটা বন্ধ হয়ে গেল। ব্যাটেরি শেষ হয়ে গেছে। অফিস থেকে ফিরে চার্জে বসাতে পারেনি। এখন লোড শেডিঙ্গের ফলে তাও করা সম্ভব হল না। তীব্র উতকণ্ঠা আর উত্তেজনার মধ্যে শুয়ে থাকতে পারছিল না, কল্যাণী। বিছানা ছেড়ে, অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে জলের জগটা খুঁজে তার থেকে এক গ্লাস জল ঢেলে নিয়ে মুখে দিল। কলকল আওয়াজ করে জলটা নামতে থাকল। সন্ধেবেলায় এসে কিছুই খাওয়া হয়নি। ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ে ছিল। ঘুম ভেঙ্গে ঐ মেয়েটার ফোন। ভীষণ অস্থির লাগছিল ওর, কিন্তু, করার কিছুই নেই। ও না মেয়েটার নাম জানে না ঠিকানা! কিন্তু, যতটুকু শুনতে পেল, তাতে বুঝল, মেয়েটা কোনও হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে। বোধহয় ওর চিকিৎসা চলছে। হয়ত, ওর বাবা ওকে মেরেছে, কিম্বা কোনও রোগে ভুগছে মেয়েটা। কে জানে, কি হয়েছে! দপ করে আলো জ্বলে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলটাকে চার্জে বসাল কল্যাণী। মোবাইলের স্ক্রিনটা জীবন্ত হয়ে উঠতেই, ও কল হিস্টরিতে গিয়ে নম্বরটা খুজল। কল হিস্টরিতে কোনও অজানা নম্বর খুঁজে পেল না। আশ্চর্য! অথচ, ও এতক্ষণ ধরে কথা বলল মেয়েটার সঙ্গে! বেশ চিন্তান্বিত হয়েই, হাল ছেড়ে দিল। পেটে ক্ষিদে ভীষণ। রান্না ঘরে ঢুকে, একটা কেক নিয়ে এলো। রাত এখন দেড়টা। আর রান্না করে খাওয়া সম্ভব নয়। কেকটা খেয়েই কাটাতে হবে আজকের রাতটা। এক গ্লাস জল খেয়ে, আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। সকালে উঠে, সেই তো আবার ছুটতে হবে, পেটের দায়ে!


এর পর বেশ কয়েক দিন কেটে গেছে। কল্যাণী সেই রাতের মেয়েটার কথা প্রায় ভুলেই গেছে। মানুষ নিজের যন্ত্রণায়েই কাতর হয়ে থাকে, তো, পরের কষ্ট আর কে বা অত মনে রাখতে পারে! এক দিন ভোরে, কল্যাণীর ঘুম ভেঙ্গে গেল মোবাইলের আওয়াজে। বিরক্ত হয়ে ফোনটা রিসিভ করল কল্যাণী।

“কে বলছেন?” একটু ধমকের সুরেই বলে উঠল কল্যাণী। কলার আইডিতে কারুর নাম দেখতে না পেয়ে, সাত সকালে ঘুম ভাঙ্গানোয় বেশ বিরক্ত হয়ে পড়ে ছিল ও।

“রাগ কোর না, মা! আমি হাসপাতাল থেকেই বলছি”।


অনেক দিন আগে শোনা গলার আওয়াজ চেনা অত সহজ নয়। তবু সেই আওয়াজে ফুটে ওঠা আবেগ ওকে মনে করিয়ে দিল সেই রাত্রের ফোন কলটার কথা। স্বর নামিয়ে বলল, “কি হয়েছে, বল!”

“মা! ডাক্তার বাবু বলেছে, আজ সন্ধে বেলায় আমাকে ছেড়ে দেবে”।

“এখন কেমন আছিস?” সাধারণ ঔতসুক্য নিয়েই জিজ্ঞেস করল কল্যাণী।

মেয়েটা যেন একটা বিদ্রূপের হাসি হেসে উঠল। বলল, “আমার আবার থাকা না থাকার কি আছে মা? শয্যা তো আমার চির সঙ্গী। আমি ওকে ছাড়তে পারব, না ও আমাকে!”

“তুই এখন কোন হাসপাতালে আছিস?”

“কি করবে জেনে? আসবে?”

“হ্যাঁ! যাবই তো!”

মেয়েটা উত্তরে কেবল হেসেই চলল।

“কি হোল? বল, কোথায় আছিস! তবে না, আমি যেতে পারব তোকে আনতে!”

“শুনতে চাও, আমি কোথায় আছি?”

“সেটাই তো জানতে চাইছি! বল এবারে!”

“শুনে সহ্য করতে পারবে?”

“এ আবার কি কথা? সহ্য করতে পারব না মানে!”

“আমি তোমার ঘরেই আছি, ঠিক তোমার খাটের তলায়”।

বলে কি এই মেয়েটা! কল্যাণী বেশ রাগত কণ্ঠেই বলে উঠল, “ইয়ার্কি হচ্ছে?”


“না মা! আমি ইয়ার্কি করছি না মোটেই। তোমার ঠিকানা না দেওয়ায়, বাবা রেগে গিয়ে আমাকে মেরে এই ঘরেরই মেঝেতে পুঁতে দিয়েছিল। উঃ! কি ভীষণ কষ্ট! উঃ! আর পারছি না”।


কল্যাণী একটু অস্থির হয়েই নিজের খাটের তলায় দেখতে চেষ্টা করল। কিছুই নেই। শুধু খাটের তলাটায় মেঝেটা একটু উঁচু করে করা আছে।

মেয়েটা বলে উঠল, “খাটের তলায় ঐরকম করে খুঁজলে কি আর আমাকে পাবে?”


“তবে! তুই যে বললি হাসপাতালে আছিস!”

“এই ঘরটাই তো একটা হাসপাতাল ছিল। আমি বাবার হাতে মার খেয়ে, দোতলার থেকে নিচে পড়ে গিয়ে শিরদাঁড়ায় প্রচণ্ড চোট পাই। তলার শেষ দুটো হাড় বসে গেছিল। ডাক্তার বাবু বলে দিয়ে ছিল, অস্ত্রোপচার করে শিরদাঁড়া সোজা করতে হবে। তবেই আমি বাঁচতে পারব। সেই জন্যই তো তুমি বাবার থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে চলছিলে। আমার অস্ত্রোপচারের খরচের জন্য টাকা পয়সা জোগাড় করতে। বাবা সেটা জেনে গেছিল। তাই তো, সকাল সকাল এসে, বাবা আমাকে তোমার ঠিকানা চাইল। তখন হাসপাতালে কেউ ছিল না। উপরের এই ঘরটায় তখন মেঝের কাজ হচ্ছে। যখন বাবা দেখল, আমি কিছুতেই তোমার ঠিকানা বলব না, তখন, আমাকে হাসপাতালের বিছানা থেকে আমাকে টেনে ফেলে দিল। আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লাম যন্ত্রণার চোটে। আর বাবা আমার শরীরটাকে টেনে হেঁচড়ে এখানে দোতলায় নিয়ে এল। বাবা তো রাজ মিস্ত্রী ছিল। দোতলার মেঝের কাজ তো ওই করছিল। আমাকে মেঝের উপর শুইয়ে দিয়ে, আমার উপরটাকে উঁচু করে পলেস্ত্রা করে দিল। পরে, হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ্য জানতে পারল, যে, বাবা আমার শরীরটাকে হাসপাতাল থেকে সরিয়ে দিয়েছে, কিন্তু কোথায়, তা আর জানা গেল না। বাবা পালানোর চেষ্টা করল। পারল না। ধরা পড়ে গেল। পুলিশের মার খেয়ে বাবাও মরল। কিন্তু, কেউ আমার শরীরের হদিশ পেল না। সবাই শুধু জানতে পারল, যে, বাবা আমায় খুন করে, অন্য কোথাও ফেলে দিয়েছে। বাবা পুলিশের মার খেয়েও কক্ষনও স্বীকার করল না, আমাকে কোথায় ফেলেছে”।

কল্যাণী এই সব কথা শুনে, ব্যাতিব্যস্ত হয়ে পড়ল। বলল, “তুমি যখন সব কিছুই জানো, তাহলে, আমাকে মা বলে ডাকলে কেন?”

“তুমিই তো আমার মা!”

“কি রকম?”

“হাসপাতালে আমাকে খুঁজে না পেয়ে, তুমি ডাক্তার বাবুকে অনেক অনুনয় বিনয় করলে, আমি কোথায়, জানতে। যখন তারা কিছুই বলতে পারল না, তখন, তো তুমিও বাহ্য জ্ঞান শুন্য হয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলে রাস্তার দিকে। আর তখনই একটা ছুটন্ত ট্রাকের তলায় পড়ে গিয়ে তুমি প্রাণ হারালে”।

এবার কল্যাণী মুখ খুলল, “সে না হয় বুঝলাম! কিন্তু, আমি তোমার মা কি করে হলাম?”

“তোমার নাম কল্যাণী। তুমি এর আগের জন্মেও কল্যাণী নামে পরিচিত ছিলে। তোমার পেটের উপর একটা লাল রঙের দাগ আজও আছে। ঠিক কি না?”

কল্যাণী হতভম্ব হয়ে গেল। এই কথা মেয়েটা কি করে জানল? আশ্চর্য!

“মা! তুমি শুধু একটা কাজ করে দিও। আমি মুক্তি পাচ্ছি না। এই খাটের তলায় থাকা উঁচু যায়গাটাকে ভেঙ্গে, ওর ভেতর থেকে আমার শরীরের হাড়্গুলোকে বের করে, সৎকারের ব্যবস্থা করো। তবেই আমি মুক্তি পাব। নিজের পূর্ব জন্মের মেয়ের জন্য এইটুকু করতে পারবে না, মা?”

কলটা অনেক ক্ষণ হল শেষ হয়ে গেছে। তবু, কল্যাণী তখনও মোবাইলটাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কি করবে, বুঝে উঠতে পারছে না। ঘরটা তখনও অন্ধকার হয়ে আছে। সকালের সূর্যের আলো তখনও ফোটেনি। চারিদিক তমসাচ্ছন্ন। ঘরের দরজাটা হঠাত করে খুলে গেল। বাইরে, ভোরের আলো ধীরে ধীরে দরজার ফাঁক দিয়ে চুয়িয়ে পড়ছে। হয়ত বা আজকে কেউ একজন নিজের জীবনের তমসাচ্ছন্ন ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারবে!



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror