STORYMIRROR

Anupam Rajak

Abstract Fantasy Others

3  

Anupam Rajak

Abstract Fantasy Others

রাজ নর্তকী - ১

রাজ নর্তকী - ১

9 mins
167


আসিল কালা পাহাড়,

ভাঙ্গিল সিঙ্ঘদ্বার,

পান করিল মহানদীর পানি,

ভক্ষণ করিল স্বর্ণ পাত্রে গোমাংস যা দিয়ে ছিলেন মুকুন্দ দেবের রানী

যে চৌদ্বারকে এখন আমরা দেখতে পাই, কটক থেকে ১৫ কিমি: দূরে, সম্বলপুর যাওয়ার রাস্তায়, মহানদী আর তার প্রশাখা নদী ,বিরুপা পার হওয়ার পর, লোকোক্তির পর্যায় তার দুর্ভেদ্য প্রাচীর সম্বন্ধে উপরের কথাটি বলা হয়ে থাকে । প্রবাদ আছে যে মহাভারতের সময়কার রাজা জন্মেজয়, তার বাবা পরিক্ষিতের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে যে সর্প যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন তা চৌদ্বারের অনতিদূরে আগ্রাহাটের অঙ্গারজোড়িতে অবস্থিত। আরও শুনা যায়, যে, পাণ্ডবেরা দ্রৌপদিকে সঙ্গে করে যে শৈব রাজা বিরাটের প্রাসাদে অজ্ঞাত বাস যাপন করেন, তা এই চৌদ্বারেই অবস্থিত। “বিরাট গাদি” নামে একটা উঁচু টিলা, যেখানে চারটে স্তম্ভ আজও দণ্ডায়মান, সেটাকে স্থানীয় বাসিন্দারা বিরাট রাজার সিঙ্ঘাসন বলে মনে করে। এখানে অবস্থিত মহাদেবের অষ্ট শম্ভু (৮ টি শিব মন্দির) নাকি বিরাট রাজার দ্বারা স্থাপিত। তার মধ্যে, “উত্তরেশ্বর” মন্দিরটি তাঁর কন্যা, উত্তরার নামে পরিচিত। বিরাট গাদির কাছেই অবস্থিত “বধী” নামের পুষ্করিণী কীচক বধের স্মৃতি বহন করে। অষ্ট শম্ভু মন্দির বাদে সবগুলোই এখন পুরাতত্ত্ব বিভাগের কবলে, কারণ ক’ বছর আগেও বিরাট গাদির আসে পাশে সোনার গুঁড়ো কুড়িয়ে পাওয়া যেত। প্রবাদ অনুসারে রাজা জন্মেজয়য়ের সর্প যজ্ঞে, মহর্ষি আস্তিকের নিবেদনে যখন তক্ষক এবং ইন্দ্র নিষ্কৃতি পান, তখন দেবরাজ ইন্দ্র এখানে স্বর্ণ বৃষ্টি করেন, যার ফলস্বরূপ এখানে সুবর্ণ কণিকা আজও বিদ্যমান। 

এ তো ছিল মহাভারতের সাথে চৌদ্বারের সমসাময়িকতা। এবার একটু ইতিহাসে আসা যাক। ভৌম করদের সময় থেকে চৌদ্বারের নাম না পেলেও ঐতিহাসিকেরা মনে করেন যে তা তাদের শাসনাধীন ছিল। এর পর আসে সোমবংশি রাজারা। তারা কলিঙ্গ, উৎকল, কঙ্গোদ আর কোসল রাজ্য গুলিকে এক ছত্রের অধীনে আনতে সক্ষম হয়। যত দূর সম্ভব, চৌদ্বারকে তখন যাযনগর চৌদ্বার বলা হত। এর পর আসে গঙ্গ রাজারা। গঙ্গ কুলের প্রখ্যাত রাজা চোডগঙ্গদেব, যে পুরী স্থিত জগন্নাথ মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা, তাঁর রাজধানী ছিল চৌদ্বারে। এই গঙ্গ রাজারাই পরে তাদের রাজধানী চৌদ্বার থেকে কটকে নিয়ে যায়। এর পর গজপতি রাজা কপিলেন্দ্র দেব ১৪৩৫ খৃষ্টাব্দে উড়িষ্যা অধিকার করেন । মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য দেব পুরী থেকে গৌড়ীয় ক্ষেত্রে ফেরার সময় গজপতি প্রতাপ রুদ্র দেবের আতিথ্য স্বীকার করে কিছু দিন কটকে কাটিয়ে যান। তিনি কটকে মহানদীর গড়গড়িয়া ঘাটে সঙ্কীর্তন করেন, যেটা বালিযাত্রা রূপে আজও পালিত হয়। কটক থেকে বেরিয়ে শ্রী চৈতন্য দেব এক দিন চৌদ্বারে অবস্থান করে সেখানেও সঙ্কীর্তন করেন, যা আজও কুমার পূর্ণিমা উৎসব হিসাবে খ্যাত। এই ঘটনার উক্তি কৃষ্ণ দাস কবিরাজ কৃত চৈতন্য চরিতামৃতের মধ্যলিলায় বর্ণিত। প্রবাদ অনুসারে ১৫৬৮ খৃষ্টাব্দে, কালাপাহাড় ( যে প্রথমে হিন্দু ছিল, বঙ্গ সুলতান সুলেইমান কররানির কন্যাকে বিবাহ করার জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে আর পরে পুরীতে এসে পুনরায় হিন্দুত্ব গ্রহণ করতে চায়। সে অভিলাষ প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় ক্রোধের বশে সারা ভারতের বহু হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে) উড়িষ্যা আক্রমণ করে। চৌদ্বার দুর্গের প্রাচীর ভেঙ্গে সে বারবাটি দুর্গ আক্রমণ করে রাজা মুকুন্দদেবকে পরাস্ত করে। এর পর যে বীভৎস ধ্বংসলীলা চলে তাতে কটক ও চৌদ্বারের বহু প্রসিদ্ধ মন্দির আর স্থাপত্য ভেঙ্গে চুরমার হয়ে মাটিতে মিশে যায়। এটা ঠিক, যে, কালা পাহাড় কোন ঐতিহাসিক চরিত্র নয়। তবে বাকি চরিত্রগুল সবই ঐতিহাসিক। 

পাঠক পাঠিকার মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক, যে, একটা ভূতের গল্প লিখতে এত বড় পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক পটভূমিকার কি প্রয়োজন থাকতে পারে। প্রয়োজন অবশ্যই আছে, কারণ বেশীরভাগ পাঠক পাঠিকা হয়ত চৌদ্বার নামের সঙ্গেই পরিচিত নন। আর আমার আজকের এই গল্পটি সেই চৌদ্বারের উপরই আধারিত, যার সঙ্গে তার ইতিহাস ও পুরাণ এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গের ন্যায় জড়িত।

এই হেন বিরাট গাদির থেকে আমার নিজস্ব বাড়ি বড় জোর এক দেড় কিমি: দূরে হবে। আমার বাড়িটা ৫৫ নম্বর জাতিয় রাজপথের কাছেই স্থিত। ঘর থেকে বেরিয়ে সেই রাজপথ ধরে ২০০ মিটার পশ্চিম দিকে এগোলে একটা ছক পড়ে, যাকে কলিঙ্গ ছক বলা হয়। সেখান থেকে এই রাস্তাটা সোজা পশ্চিম দিকে এগিয়ে গিয়ে সম্বলপুর পৌছয়। আর দ্বিতীয় রাস্তাটা (সেটাও পাকা রাস্তা) উত্তর দিকে চলে গেছে চারবাটিয়া ষ্টেশনের দিকে। সেই রাস্তা ধরে প্রায় দু কিমি: মতন এগিয়ে পর একটা কাঁচা রাস্তা ডান দিকে চলে গেছে, যেটা চৌদ্বার সার্কেল জেলের কাছে হয়ে বিরাট গাদি বা বধী পার্কে গিয়ে পৌঁছয়। এ ছাড়া, ঘর থেকে বেরিয়ে জাতীয় রাজপথ ধরে পূর্ব দিকে গেলে, প্রায় এক কিমি: দূরে ও টী এম(ওড়িশা টেক্সটাইল মিলস) পড়ে। সেখান থেকে বাঁ দিকে গিয়ে, ও টি এম কলোনির ভিতর হয়ে একটা কাঁচা রাস্তা চারবাটিয়া ষ্টেশনের দিকে চলে গেছে। এই রাস্তাটাও বিরাট গাদি বা বধী পার্কে গিয়ে পূর্বে বর্ণিত কাঁচা রাস্তার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই লেখার শেষে একটা মানচিত্র দেওয়া আছে, যার নীল রঙ্গের রাস্তাটা পাকা আর অন্যটা কাঁচা। আমি যে ঘটনার উল্লেখ করতে যাচ্ছি, তার সঙ্গে এই বর্ণনা আর মানচিত্রের যোগাযোগ আছে বলেই আমি এত বিষদ ভাবে এই রাস্তার বিবরণ দিচ্ছি।

 উপরে যে সব কথার উত্থাপন করলাম, ইন্টারনেটে “চৌদ্বার” লিখে সার্চ করলেই এই সকল তথ্য বেরিয়ে আসবে। কিন্তু যেটা বেরবে না তা হল, ঐ বধী পার্ক এবং বিরাট গাদির পাশেই আরও দুটো গুরুত্বপূর্ণ যায়গা আছে যা ওখানকার বাসিন্দা ছাড়া জানা সহজ নয়। ওখানে আছে একটা রক্ষা কালী মন্দির আর একটা শ্মশান । আমি যখনকার কথা বলতে যাচ্ছি, সেই সময় ভারতে মোবাইল ফোনের চল হয়নি আর আমি তখনও কোথাও চাকরি করতে আরম্ভ করি নি। আমি তখন সাইকেলে করে ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়ি গিয়ে পড়াই। সবে কলেজ শেষ করে, হাত খরচের জন্য টিউশন করা। আমার এক স্কুলের বন্ধু, প্রাণ নামে, আমাকে কিছু টিউশন যোগাড় করে দেয় । আমি মাস সারা ওদেরকে পড়াই আর যা পাই, তাতে আমার দিব্যি চলে যায়। আমি একদিন সেই প্রাণের সঙ্গে সন্ধ্যের দিকে দেখা করতে গেছি। সেখানে আরও অনেকে ছিল। গল্প করতে করতে দেরি হয়ে গেল। প্রাণ আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তোর কোন কাজ আছে আর?” আমি বললাম, “না! নেই”। বলল, “তাহলে চল আমার সঙ্গে, একটু চারবাটিয়া যেতে হবে”। বললাম, “চল তবে!” ওর ঘরটা ছিল ও টী এম কলোনির কাছে। কাজেই, আমরা সাইকেলে চড়ে সেই কাঁচা রাস্তা ধরে গেলাম।এই দিকে গেলে বধী হয়ে যেতে হয়, জানতাম। কিন্তু, প্রাণ আমাকে ওদিক দিয়ে কেন নিয়ে গেল, বুঝলাম না। প্রাণ নিজের কাজ টাজ সেরে যখন ফেরার কথা বলল, তখন, রাত প্রায় ন’টা বাজে। প্রাণ ওই বধী হয়েই ফিরতে চাইল, কিন্তু আমি ওদিক দিয়ে ফিরতে চাইলাম না, কারণ আমার ঘর একটু দূরে হয়ে যাবে। সোজা পাকা রাস্তা দিয়ে গেলে আমার ঘর আগে পড়বে। প্রাণকে সে কথা বলায়, বলল, “তাহলে চল, ওদিক দিয়েই যাওয়া যাক”। আমি বললাম, “তুই যেতে চাইলে কাঁচা রাস্তা ধরে চলে যেতে পারিস!” প্রাণ বলল, “না!না! কিছু দরকার নেই। চল তুই, পাকা রাস্তা হয়েই যাব”।

যেহেতু আমি স্কুলের পর, চৌদ্বার ছেড়ে, প্রথমে কটক ও পরে রাউরকেলায় পড়াশুনা করতে যাই, চৌদ্বারের অনেক যায়গার সম্বন্ধেই আমার কোন বাস্তব ধারণা ছিল না। তখন পর্যন্ত আমি বধী বা বিরাট গাদি দেখিইনি আর ওর নেপথ্যে থাকা বিভিন্ন পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক কথাও জানি না। কাজে, প্রাণ যে ওইদিক দিয়ে একা সাইকেল চালিয়ে যেতে ভয় পাচ্ছে তা আমি তখন মটেই বুঝতে পারিনি। বুঝলাম তার পরের দিন। সেদিন আবার গল্প করতে প্রাণের ঘরে গেছি। প্রাণ ঘরে ছিল না, কোথাও গেছিল। তবে ওর ঘরে আগের দিনের মত আড্ডা চলছিল। আমি তাতে যোগ দিয়ে দিলাম। কথাবার্তার মাঝে আমি ওদেরকে গতকালের কথা বললাম। ওদের মধ্যে একজন আমাকে বলল, “তুমি বিরাট গাদির বিষয় বোধয় কিছু জান না”। আমি বললাম, “না! কিছুই জানি না”। বলল, “সেইজন্য তুমি প্রাণকে রাত্রে ঐদিকে একলা যেতে বললে, নাহলে, কখনও বলতে না”। আমি তখনও ওর কথা কিছুই বুঝতে পারছি না, অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। ও আবার বলল, “ঐ দিকে রাত্রে কেউ যায় না, বুঝলে! তোমরা দুজন তো কালকে ঐদিক দিয়ে চলে গেলে, কিন্তু, অন্যরা সহজে ঐ দিকে কেউ যাবে না। তোমাদের ভাগ্য ভাল যে কিছু হয়নি। ঐদিক দিয়ে গেলে অনেককে সাইকেল থেকে ধাক্কা মেরে কেউ ফেলে দেয়। প্রাণকে লক্ষ্য করে দেখবে, ও ঐদিক দিয়ে বেরতে গেলে পায়ে ইট ঘসে লাগিয়ে তবে যায়“। আমি আরও কিছু জানতে চাওয়ায়, সে আমাকে, পৌরাণিক এবং ঐতিহাসিক তথ্য (যা আমি প্রথমেই দিয়েছি) সংকলিত যে সব প্রবাদ ওখানে আছে, তার কথা আমায় বলল।

আমি আসলে ছোট বেলায় বেশ ভিতু গোছের ছিলাম। পরে, ইঞ্জিনিইয়রিং করার সময়, একলা থাকতে শিখলাম। তখন ধীরে ধীরে ভয়কে জয় করতে পারলাম। এই সব কথা শুনে, একদিন আমার বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি আমাকে বললেন, “দেখ! ভয় যখনই করবি, ভূত তখনই ধরবে। ভুতকে তুই যদি ভয় না করিস, তাহলে ভুত তোর কোন ক্ষতি করতে পারবে না”। কথা হতে হতে, সেদিন রাত্রে বাবা আমায় তাঁর ভৌতিক অভিজ্ঞতার কথা বললেন। কিরকম, একবার বিহারে তিনি একটা ঘরে সুয়ে থাকার সময় একটা মোটা মতন হাত জানলা দিয়ে ভেতরে ঢোকে আর সেটা ধরতে গিয়ে তাঁর হাতটা সেই হাতটার ভিতর দিয়ে ঢুকে বেরিয়ে আসে। (“ভৌতিক হাত” গল্পটাতে এর বিবরণ দেওয়া আছে)।

এর পর আমি বিরাট গাদি আর বধী বেশ কয়েকবার দিনের বেলায় গেছি। তখন তা A S I (Archaeological Survey of India)র তত্ত্বাবধানের এক্তিয়ারে ঢোকে নি। এক দিন প্রাণ আমাকে, দিনের বেলায়, বধির উপরে নিয়ে গেল। ও অনেক কিছু জানত ওখানকার বিষয়। আমাকে অনেক কথাই বলল সেই বিষয়ে।আসলে তখন যে বয়স, ২৪ কি ২৫ হবে, এই সব বিষয় খুব আকর্ষণ করে মন কে। প্রাণই আমাকে বলল, “দেখ, ওখানে যে মন্দিরটা দেখছিস, না! ওটা রক্ষা কালির মন্দির। আর ওর সামনে দিয়ে যে রাস্তাটা গেছে, তা শ্মশানের দিকে গেছে। রাত্রিবেলায় এইখানে অনেক অশরীরী ঘটনা ঘটে। প্রায় শোনা যায় একটা মেয়ে কাঁদছে। আবার এই মন্দিরের পাশ দিয়ে দেখা যায় কেউ একজন সাদা কাপড় গায়ে দিয়ে ভেসে ভেসে যাচ্ছে। সন্ধেবেলায় এখানে প্রায়শই এক নর্তকীর নূপুরের স্পষ্ট আওয়াজ শোনা যায়”। আমি এসব শুনে বেশ আপ্লুত। যত শুনছি, মনের মধ্যে ভুত দেখার ইচ্ছে তত বেড়ে চলছে। অবশ্য, এসব দিনের বেলার কথা। রাত্রিবেলায় আমি ঐদিকে একলা কখনও যেতাম না। ঠিক বলতে কি, ঐদিকে যাওয়ার কোন দরকারই ছিল না আমার। রাত্রি বেলায় তো মোটেই না। তখন কি আর জানতাম, যে, এই যায়গাটাই একদিন আমার পক্ষে এমনই একটা আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে যাবে যে তার দুর্নিবার টানে পড়ে আমার নিজের মানবিক সত্তা, ইতিহাস ও পুরাণের টানাপড়েনের মধ্যে পয়োধির বিশাল জলরাশির অবিশ্রান্ত তরঙ্গের ন্যায় বার বার সেই একই লক্ষ্যে উন্মাদের মত ছুটে আসতে থাকবে!

সে দিনটা ছিল চৌদ্বারের কুমার পূর্ণিমা উৎসবের দিন, যা প্রথম দিকে এক দিনের জন্য অনুষ্ঠিত হত, আর পরে, তা দু দিন এবং শেষে তিন দিন পর্যন্ত চলতে থাকে। সেই মেলায় এখন শ্রী চৈতন্য দেবের সঙ্কীর্তনের ধ্বনি আর শোনা যায় না, সত্যি, তবে ঐতিহাসিক এবং পৌরাণিক ঐতিহ্য বজায় রেখে, সেখানে আজও ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এক দুষ্প্রাপ্য সংস্কৃতির উপস্থিতি দৃশ্যমান হয়। এলাকার যত দুর্গা মূর্তি, শৈব মূর্তি, লক্ষ্মী মূর্তি, দুর্গোৎসবের সময় থেকে আরম্ভ করে লক্ষ্মী পূজা পর্যন্ত, স্থানে স্থানে পূজা করা হয়, সবকে সেই দিন এক প্রকাণ্ড মেলা প্রাঙ্গণে একত্রীত করে বিরুপা নদীতে বিসর্জনের জন্য বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এই হেন মেলা দেখতে দূর দূরান্ত থেকে বহু মানুষের সমাগম হয় সেই সময়। তা সেই মেলার সময় ছাত্র ছাত্রীদেরকে টিউশন করা এক রীতিমত মানসিক পীড়াদায়ক কর্ম। কেউই পড়তে চায় না, সবাই মেলা দেখতে যাওয়ার জন্য অস্থির, সবাই ছুটি চায়। কিন্তু, টিউশন মাষ্টারেরও তো একটা পেট আছে! দুটো পয়সা সেই সময় না পেলে, তারই বা চলে কি করে! সুতরাং, আমাকে পড়াতে যেতেই হয়, আর ছাত্র ছাত্রীরা বার বার ঘড়ির দিকে তাকাতে থাকে; কখন ছুটি হবে আর কখন তারা মেলা দেখতে যাবে! তেমনই এক দিনে, আমি চারবাটিয়ায় পড়াতে গেছি। আমারও সেদিন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মেলা দেখতে যাওয়ার কথা। ঠিক করেছিলাম, যে সন্ধ্যে পাঁচটায় টিউশন আরম্ভ করে সাড়ে ছটার মধ্যে সেরে দিয়ে বধির রাস্তা হয়ে প্রাণের ঘরে সাইকেল রেখে ওর সঙ্গে হেঁটে হেঁটে মেলা দেখতে যাব। পাকা রাস্তা দিয়ে গেলে দেরি হবে, কারণ তিন চারটা দুর্গা মূর্তিকে ঐ রাস্তা দিয়ে শোভাযাত্রায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি টিউশন শেষে বেরচ্ছি। ঠিক সেই সময় এক ছাত্রের মা (আমি তখন ওদের ঘরেই পড়াচ্ছিলাম) প্লেট ভর্তি মিষ্টি এনে আমার সামনে রাখলেন। উৎসবের সময় এটা প্রায়েই হয়ে থাকে। নিরুপায় হয়ে আমাকে আরও আধ ঘণ্টা তাদের সঙ্গে অতিবাহিত করতে হল আর তার সঙ্গে অহেতুক কথাবার্তাও করতে হল। প্রাণ হয়ত, ওদিকে আমার দেরি দেখে, অন্য বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মেলায় চলে যাবে। 

যাই হোক, শেষে, সাতটার পর, আমি ওদের ওখান থেকে বেরিয়ে, বধির রাস্তা ধরে ভীষণ জোরে সাইকেল চালাতে লাগলাম। প্রাণ যদি তখনও আমার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে, তাহলে এক সাথে মেলা যাওয়া যাবে। আসলে, সঙ্গী সাথীদের সঙ্গে মেলা ঘুরে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তা কি আর একলা ঘুরলে মেলে! সেদিন তৃতীয়া। চাঁদ উঠে গেছে কিন্তু তার আলো পড়তে তখনও একটু দেরি আছে। নামে কুমার পূর্ণিমা হলেও, লক্ষ্মী পুজার এক দিন পরে মেলা বসে, আর চলে তিন দিন ধরে। মেলার দ্বিতীয় দিনের সন্ধ্যায়, মূর্তি গুলকে শোভাযাত্রায় নিয়ে প্রায় মাঝ রাত্রে মেলা প্রাঙ্গণে পৌঁছানো হয়। আমি খুব জোরে পেডাল করে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছি। হটাত সামনের চাকা কিছু একটা উঁচু জিনিষে ধাক্কা লাগে আর আমি ছিটকে পড়ে যাই।  

ক্রমশঃ

 

 

 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract