রাজ নর্তকী - ৩
রাজ নর্তকী - ৩
এর মধ্যে পাহাড় পর্বত থেকে বের হয়ে অসংখ্য জল রাশি নদীর বক্ষে ভর করে সমুদ্রের বক্ষে গিয়ে সমাহিত হয়েছে। সূর্য চন্দ্র প্রত্যেক দিন উদয় অস্ত হয়েছে। প্রকৃতির ক্রোড়ে বহু মানুষ জন্ম গ্রহণ করেছে আবার বহু মানুষ মৃত্যু বরণও করেছে। জীবন তার অবিরত ধারা বজায় রেখে চলেছে। ধীরে ধীরে আমার জীবনেও পরিবর্তনের পরিমাণ কিছু কম আসে নি। কোন কোন ঘটনার স্মৃতি মুছে গেছে, আবার নতুন কোন ঘটনা তাতে লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে। সময় বড়ই বিচিত্র এক উপাদানে গড়া। সে কারুর জন্য থেমে থাকে না, আবার কারুর গতিবেগ বাড়িয়ে তাকে হটাত করে এগিয়েও নিয়ে আসে না। সে তার নির্দিষ্ট নিয়মানুসারে নির্ধারিত কর্ম নির্ভুল ভাবে করে চলে। মানুষের মধ্যে সব কিছুতেই দোষ খোঁজার একটা প্রবণতা অবশ্যই থেকে থাকে, কিন্তু সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে সে তার ভুল ত্রুটি ঠিকই উপলব্ধি করতে পারে। মৃণ্ময়ীকে হারিয়ে পর আমি অনেক দিন পর্যন্ত নিজেকে জীবনের ধারায় প্রবাহিত করতে পারিনি। দীর্ঘ কাল ধরে তার স্মৃতি আমার মনকে হাল্কা হতে দিতে পারে নি। কিন্তু, আবহমান কাল থেকে চলে আসা সময়ের অবিরত আবর্তনের ফলে, যে, আমি সেই স্বপ্নলোকের শৃঙ্খল থেকে নিজেকে মুক্ত করে স্বাভাবিক জীবন যাপন শুরু করতে পারব তা কি করে জানব!
সেবার মকর সংক্রান্তি রবিবার পড়ে ছিল। আমরা চার বন্ধু; তপন, রবি, শঙ্কর আর আমি, চৌদ্বারের থেকে প্রায় পনেরো কিমি: দূর, ডম ডমণী মন্দিরে গিয়েছি। মন্দিরে পূজা দিতে আমরা যাইনি; জঙ্গলে ঘোরাফেরা করে ভোজ খেয়ে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরব, এই ছিল মূল উদ্দেশ্য। ডম ডমণী একটা বেশ বড় জঙ্গল, যেখানে আগেকার রাজা মহারাজারা শিকার খেলতেন। হরিণ, শূকর, হাতি, সাপ, ছাড়াও ওখানে আগে বাঘও থাকত। বাবার কাছে শুনেছি, ওখানকার জঙ্গল এত ঘন ছিল, যে, দিনের বেলাতেও মাটিতে সূর্যের আলো পড়ত না। বলা হয়, পাণ্ডবেরাও অজ্ঞাতবাসে থাকার সময়ে বিরাট রাজার সঙ্গে এই বনে শিকার করতে আসত। রাস্তায় একটা পুরানো রাজ প্রাসাদ আছে, যা, ব্রিটিশ আমলে, পুরুলিয়ার কাশীপুর রাজা তৈরি করেন।
মা ডম ডমণীর মন্দির সম্বন্ধে একটা সুন্দর প্রবাদ আছে। একবার একটা ছোট্ট মেয়ে জঙ্গলে বাবা মায়ের সঙ্গে এসে হারিয়ে যায়। অন্ধকার হয়ে গেলেও তার বাবা মা তাকে খুঁজে পায় না। ভোরে যখন তারা তাকে খুঁজে পায়, তখন সে একটা পাথরের উপর শুয়ে ছিল। তাকে জিজ্ঞেস করতে, তারা জানতে পারে, যে, এক দেবী তাদের মেয়েকে সারা রাত আগলে রেখে ছিলেন, আর সে ঘুমিয়ে পড়লে, তাকে সারাক্ষণ বাতাস করেছেন। এই কিম্বদন্তীই এইখানে এই মন্দির প্রতিষ্ঠার কারণ।
মকর সংক্রান্তির দিন এখানকার আদিবাসীদের বড় উৎসব। সেই দিন, ডম ডমণীতে ওদের খুব বড় একটা মেলা হয় । সেই মেলা দেখতে আদিবাসী ছাড়াও অনেকে যায় ঐখানে। আমাদেরও ছুটি থাকায় আমরা সেই দিনটার সদ্ব্যবহার করতে লেগে পড়লাম। আদিবাসী মেলা মানেই প্রচুর মদ আর মাংসের ব্যবস্থা। তপন আর রবি তো সুধু মদ খেতেই গিয়ে ছিল।আমরা প্রায় সকাল নয়টার সময় বাইক নিয়ে বেরলাম। সবার বাইকে রান্না করার কিছু না কিছু উপকরণ আছেই। ওখানে যখন আমরা গিয়ে পৌঁছলাম তখন চার দিক লোকে লোকারণ্য। একটু বসার মতন যায়গা নেই। রবি এই দিকটাতে বেশী আসে। ওই জঙ্গল থেকে একটু দূরে একটা সুন্দর বসার যায়গা খুঁজে বার করল। যায়গাটা চার দিক থেকে ঘন গাছে ঘেরা। রান্না করা আর বসে গল্প করার জন্য একেবারে উপযুক্ত পরিবেশ। আমরা তিনজনই রবির খুব তারীফ করলাম । তপন আর রবি সঙ্গে সঙ্গে শতরঞ্জি পেতে বসে পড়ল মদের গ্লাস নিয়ে। আমি আর শঙ্কর সেই রসে অনুপ্রাণিত ছিলাম না। তাই, আমরা ঠিক করলাম, যতক্ষণ ওরা মদের সদ্ব্যবহার করছে, ততক্ষণ আমরা দুজন একটু ঘুরে আসব পাহাড় আর জঙ্গলে। আমরা ফিরে আসার আগে ওরা রান্না বান্না আরম্ভ করে দিবে। আমরা দুজন ফিরলে, সবাই মিলে রান্না বান্না করে খাওয়া দাওয়া করে সন্ধ্যের আগে ঘরে ফিরে যাব। সেই কথা মত আমি আর শঙ্কর জঙ্গলের দিকে পা বাড়ালাম।
জঙ্গলে সাল, সেগুন, আকাশিয়া, আম, মুচকুন্দ ইত্যাদি গাছ ছাড়াও, বাঁশ ঝাড় বহুত দেখা যাচ্ছিল। একটা সরু কাঁচা রাস্তা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এঁকে বেকে এগিয়ে গেছে। এক দুটো গরুর গাড়ি নজরে পড়ল, জঙ্গল থেকে কাঠ কুটো নিয়ে যাচ্ছে। একটা বেশ লম্বা মতন সাপও দেখলাম। শঙ্কর সেটাকে অজগর মনে করে দাঁড়িয়ে পড়ল। কাঠুরিয়ারা কাছেই ছিল। ওরা বলল, “এইটা অজগর নয়, অহীরাজ। এইটা অনেক ছোট, নাহলে, অহীরাজ দশ পনের ফুট লম্বা হয়”। সাপটা চলে যাওয়ার পর আমরা আরও এগিয়ে যেতে থাকলাম। রাস্তাটা ক্রমেই উপর দিকে উঠছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল আমাদের। এক যায়গায় তো রাস্তা এত খাড়া হয়ে উঠেছ, যে, হাতে পায়ে হেঁটে এগোতে হল। প্রায় ঘণ্টা খানেক হাঁটার পর, যখন আমরা চার দিকে তাকালাম, তখন ডম ডমণী মন্দিরটা অনেক তলায় আর অনেক ছোট মত দেখা গেল। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটা ঝর্ণা বয়ে যাচ্ছে। টলটলে জল দেখে আমি হাতে করে নিয়ে একটু খেয়ে দেখলাম। উঃ! কি মিষ্টি জলটা! রাস্তার কাছেই এক এক যায়গায় গোবর দেখা গেল। শঙ্কর বলল, “এইটা নিশ্চয় হাতির গোবর! দেখ, এখনও ধোঁয়া উঠছে। তার মানে, কাছে পিঠেই আছে। আর বেশী দূর এগোন ঠিক নয়। চল ফেরা যাক!” আমি বললাম, “হাতিটা কি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে নাকি, যে, ওর ভয়ে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে!” শঙ্কর বলল, “না রে! তা নয়! কিন্তু, একটু দেখে শুনে যাওয়াই ভাল”। বললাম, “তাহলে চল, ঐ গাছটার তলায় গিয়ে একটু বসা যাক”। শঙ্কর বলল, “আমি বাপু গাছের তলায় বসতে চাই না। বরং চল, গাছের উপরে চড়ে চার দিকটা একটু দেখা যাক”। বললাম, “ঠিক আছে! তাই করা যাক”। আমরা দুজন ঐ গাছটার ডাল বেয়ে উপরে চড়ে গেলাম। বহুত উঁচু গাছ, কিন্তু, ডাল পালা এত, যে, চড়তে কোন অসুবিধাই হল না। উপরে চড়ে বেশ কিছু দূর পর্যন্ত দেখতে পাওয়া গেল। প্রায় আধ ঘণ্টা মত আমরা গাছে বসে চার দিকের প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করলাম। কিছুক্ষণ পর শঙ্কর বলল, “এবার ফেরা যাক। নাহলে ওরা দুজন নেশা করে বসে থাকবে, রান্না করতে অনেক দেরি হয়ে যাবে”। আমরা গাছ থেকে নামতে যাচ্ছি। হটাত, আমার চোখে পড়ল একটা বিরাট বড় হাতির দলের উপর। পাহাড়ের অনেক উপরে জঙ্গলের গাছ পালা ভাঙ্গাভাঙ্গি করছে। শঙ্করকে দেখতে বলায়, ও তাকাল। বলল, “হাতি গুল যদি এখানে চলে আসে, তাহলে, উৎসব মাথায় উঠবে। চল পালাই”। আমরা আবার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সেই কাঁচা রাস্তা ধরে ফিরতে লাগলাম।
আমাদের যায়গায় যখন ফিরলাম, তখন রবি আর তপন রান্নার আয়োজন করছে। আমরাও হাত লাগালাম। রবি ভাল মাংস রান্না করতে পারে। ও মাংস কাটাকাটি করে কড়াইয়ে চাপিয়ে দিল। আমি কাছে পিঠে ঘুরে কাঠ যোগাড় করলাম। শঙ্কর ভাত বসাল। তপন শাল পাতা এনে ছিল, পরিবেশণ করতে, সেগুল সব ধুয়ে রাখল। এইসব করতে করতে দুপুর প্রায় দুটো বেজে গেল। আমরা খাওয়া দাওয়া করতে করতে সাড়ে তিনটা বাজল। এবার বাসন মাজা আর ঘরে ফেরা। চারজন মিলেই বাসন মাজা মাজি করে ধুয়ে বাইকে উঠাতে যাচ্ছিলাম। এমন সময় মন্দিরের দিক থেকে, “হাতি আসছে! পালাও! পালাও!” রব উঠল। অনেককে দেখলাম, ছুটা ছুটি করে জঙ্গলের থেকে বেরিয়ে আসতে। আমরা চারজন বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। কারণ জঙ্গলের হাতির কি রকম ব্যাবহার করতে পারে, তা তো আমাদের জানা নেই! আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, জিনিষপত্র গুটাতে লাগলাম। হটাত, তপন বলল, “দৌড়ো সবাই! ঐ যে হাতি এসে গেল”। আমরা তখন, যে যেদিকে পারলাম ছুট লাগালাম। পেছনে কি হচ্ছে, তা দেখার মত আর অবস্থা নেই। সুধু চিৎকার চ্যাঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। একবার মনে হল যেন একটা হাতির আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি দিক্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়তে লাগলাম। কতদূর দৌড়েছি, খেয়াল নেই। শেষে যখন আর দৌড়তে পারছি না, তখন, একটা বিরাট বড় পাঁচিল টপকে অন্য দিকে গিয়ে পড়লাম। আমার বুকটা তখন হাপরের মত ওঠা নামা করছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর, যখন নিশ্বাস প্রশ্বাস কিছুটা স্বাভাবিক হল, আমি উঠে দাঁড়িয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম, আমি কোথায় আছি। বুঝতে পারলাম, যে, আমি একটা বিস্তীর্ণ বাগানের মধ্যে রয়েছি, যা, চার দিক থেকে অনেক উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। আমি বাগানের গেট খুঁজতে লাগলাম। কারণ আসার সময় তো হাতির তাড়া খেয়ে লাফ দিয়ে এখানে ঢুকে পড়েছি, কিন্তু, এখান থেকে লাফ মেরে বেরোনো সম্ভব নয়, এত উঁচু প্রাচীর! আমি আসতে আসতে হাঁটছি, আর গেটটা কোন দিকে, তাই ঠাহর করার চেষ্টা করছি। হটাতই একটা কর্কশ আওয়াজে আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। “কে ওখানে?” শুনে আমি যখন আওয়াজটা কোন দিক থেকে এসেছে, বুঝার জন্য তাকাচ্ছি, তখনই দেখলাম, দুজন বলিষ্ঠ চেহারার রক্ষী বর্শা উঁচিয়ে আমার দিকে ধেয়ে আসছে। ওদের বেশভূষা দেখে আমার কেমন যেন ঐতিহাসিক সিনেমার রক্ষীদের মত লাগল। প্রথমে তো ওদেরকে দেখে আমার হাঁসি পেল। এইসব বেশভূষা পরে এই জঙ্গলের মধ্যে এরা কি কোন নাটকের মহড়া দিচ্ছে? কিন্তু, ওরা দুজন আমার কাছে এসে যা ব্যাবহার শুরু করল, তাতে আর আমার নাটকের মহড়া বলে মনে হল না।
রক্ষীদের মধ্যে একজন তো বেশ জবরদস্ত ভাবে আমার ঘাড়ের কাছে ধরে ধাক্কা মারতে মারতে নিয়ে যেতে চাইল। অন্য জন বোধয় একটু ভদ্র ছিল। সে ওকে মানা করল ঐ ভাবে আমাকে নিয়ে যেতে। তখন ওরা দুজনে দু দিক থেকে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল।
ক্রমশ:
