তিন মুর্তি
তিন মুর্তি
আমাদের খেলার মাঠটাতেই বাড়ি করে এসেছেন ঘোষ বাবুরা। এখন খেলা ধুলাটা পাশের জমিতেই সারছি। মাঠটা একটু ছোট হয়ে গেছে আরকি।ওদের বাড়ির ছেলেটা যদিও আমাদের সাথে খেলেনা। কিন্তু ওদের বাড়ির কুকুর জুঁই বড়ো বদমাইশ আমাদের লালুকে দেখে চ্যাচায়, দাঁত দেখায়।হমবি তমবি যতো গ্যাটের ভিতর থেকেই।লালু যদিও কিছুটি বলে না। তবে মিমি ভালো পাঁচিল বেয়ে কার্নিশে বেয়ে গিয়ে। ওদের পর্দায়, কখনো বিছানায় পেচ্ছাপ করে দিয়ে আসে। আবার কত বদমাইশ ও কাউকে দেখলেই বলে
" মেউ মেআউ" মানে উনি এমন ভাব খানা , উনি এসছেন যখন, তখন একটুখানি দুধ টুধ দিয়ে যাওয়া হোক, ওনাকে আপায়ান করা হোক।

তবে জুঁই যে দিন শেরুর পালায় পড়বে , সেইদিন ই মজা হবে।গত চার-পাঁচ দিনের মতো আজকেও শেরু বেড়ার ফাঁক গলে এদিকে এসে গোয়ালঘরে ঢুকল।কাজল-জেঠুরা গেল শীতে পৈল্যানহাট থেকে কিনে এনেছে । দাম পড়েছিল একটু বেশিই। দাম এত বেশি কেন জিজ্ঞেস করায় নিজের সাদা গোঁফ তা দিয়ে ব্যাপারী বলেছিল “এ কি যেমন-তেমন জিনিস পেয়েছেন? এ হল একেবারে বাঘের বাচ্চা”।
সেই থেকে এই নাম। যেমন নাম তার তেমনই কাজ। লালকালো পালকে ঢাকা ভারিক্কি চেহারা, মাথায় লাল ঝুঁটি, দেখলেই কেমন ভয় করে। তাকে পোষ মানাতে কম বেগ পেতে হয়নি। সারাক্ষণ যেন রাগে গরগর করছে। অচেনা মানুষ দেখলে ঘাড়ের পালক ফুলিয়ে তেড়ে যায়। মেজাজ গরম থাকলে চেনা মানুষকেও রেয়াত করে না। কুকুর বিড়ালের কথা ছেড়ে দাও। মিনি কাছাকাছি গেলেও , লালু ওর ধারে কাছে ও ঘেঁসে না।
বুড়িদিদির সঙ্গে আমাদের কথা বলা বারণ নয়তো আরো গল্প জানতে পারতাম। এতদিন ওবাড়িতে জ্যাঠাইমার রাগই ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু শেরুর মেজাজ যেন আরও এক কাঠি ওপরে। জ্যাঠাইমাও নাকি শেরুকে খুব একটা ঘাঁটায় না। অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে খাবার দিয়ে খুব নরম করে ডাক দেয়, আয়, আয়, তি-তি-তি-তি-তি-তি।
সেই যেদিন এবাড়ির ছাগল সুন্দরী ও বাড়ির লাউগাছ মুড়িয়ে খেয়ে এল সেই থেকে আমার মায়ের সঙ্গে বুড়িদিদির মায়ের ঝগড়া। কথা বন্ধ, যাওয়াআসা বন্ধ, দু-বাড়ির কেউ কারুর মুখের দিকে তাকায় না। আজ কতদিন হয়ে গেল। দুটো বাড়ির মধ্যিখানে এখন বাঁশকঞ্চির বেড়া। আচ্ছা কথায় বলে ছাগলে কিনা খায়, ওকি অতোশত বোঝে ।বুড়িদিরা ঝগড়া করায়, ওদের ছাদ থেকে ঘুড়ি ওড়ানো বন্ধ হয়ে গেছে দুঃখ হয়।

দুই বাড়ির বাঁশবন গায়ে গা লাগানো। ডালপালা দিয়ে একে অন্যকে জড়িয়ে রেখেছে দুদিকের আমগাছ জামগাছ , জামরুল গাছ। গাছে-গাছে পাখিদের ওড়াউড়ি, কাঠবেড়ালিদের আসাযাওয়া। কিন্তু বাড়িতে পোষা গরুছাগল বা হাঁসমুরগির এদিক থেকে ওদিকে যাওয়ার জো নেই। তাদের ওপর দুই গিন্নির কড়া নজর। এমনকি মিনি ও যায়না ওবাড়িতে। লালু তো ভদ্র ছেলে। তবে ওসব আইনকানুনকে পাত্তা দেয় না শেরু। সে খুশি মতো এদিকে আসে, খড়ের গাদার চারপাশে ঘুরে ঘুরে পোকামাকড় খুঁটে খায়। আমি একবার ‘যা, পালা’ বলে তাড়াতে গিয়েছিল। জবাবে একদিকের ডানা ঝুলিয়ে তেড়ে এসেছিল শেরু দৌড়ে । ঘরের ভেতর লুকিয়ে পড়তে হয়েছিল আমাকে।
মা ভালো জোতিসী হতে পারতো, যা বলেছি ল তাইই। গোয়ালঘরের এককোণে ডাঁই করে রাখা খড়ের ভেতর সাতখানা ডিম পেলাম।
মা নিজের মনে মনে বলল, "এ তো আচ্ছা শয়তান মুরগি। দু-বাড়িতে আবার ঝগড়া লাগানোর তাল করছে।"
তারপর রান্নাঘর থেকে একটা ঝুড়ি এনে তাতে ডিমগুলো তুলে নিয়ে আমাকে বলল, "যা তো বাবা, এগুলো বুড়িমাকে দিয়ে আয়। বলবি, ‘তোমাদের মুরগি আমাদের গোয়ালঘরে ডিম দিয়েছিল’।" জ্যাঠাইমা বকবে নাতো ? ভাবছিলাম। মায়ের কথামতো ডিমের ঝুড়ি নিয়ে ধীর পায়ে ওবাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। একটু একটু ভয়ের সঙ্গে একটু একটু আনন্দও হচ্ছে আমার। কতদিন বাদে যে বুড়িদিদিদের বাড়ি যাচ্ছি।
আমি বাড়ির গ্যেট আগল ঠেলে ঢুকতে দেখে জ্যাঠাইমা বলল, কী রে বাবা, কিছু বলবি?
আমি ভয়ে ভয়ে বলল, "তোমাদের মুরগি আমাদের গোয়ালঘরে ডিম দিয়েছিল। মা পাঠিয়ে দিল।"
জেঠিমা বলল"ও তাই বলি, এত দিন হয়ে গেল শেরু ডিম দেয় না কেন! ও যে এমন বজ্জাত তা বুঝবো কী করে বল। আয় বাবা, আয়, বস। "
বুড়িদিদিও জানালা দিয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
জ্যাঠাইমা বলল, "আমার হাত-জোড়া বাবা, যা, রান্নাঘরে গিয়ে উনুনের পাশে দুটো ডিম রেখে দিয়ে বাকিগুলো তুই নিয়ে যা।"
আমি বললাম, "আমাকে মা বকবে।"
জ্যাঠাইমা বলল," মাকে বলবি আমি দিয়েছি। আর মাকে এও বলবি, তার এত দেমাক কীসের? আমি তার চেয়ে বড়, রাগের মাথায় কবে দুটো কথা শুনিয়েছি বলে এত রাগ! আমার কাছে এসে দুটো কথা বলতে পারে না? আমার সঙ্গে কথা বললে কি তার মান যায়?"
বুড়ি দিদি দৌড়ে এসে আমারর হাতে একটা ডাঁসা পেয়ারা ধরিয়ে দিয়ে গেল।দুবড়ির ঝগড়া এবার ঠিক মিটে যাবে। জ্যাঠিমা বললো " শোন দাদু বার্ষিক কাজ শেষ হয়ে গেছে সোমবার থেকে হরিলুট দেবো সন্ধায় আসবি।"

গত তিন চার দিন ধরে লালু মিনিও যাও শুরু করলো ওদের বাড়িতে । শেরু ওদের তেড়ে আসে না, ওরা বন্ধু হয়ে গেছে। জুঁই কে আজকাল বিকালে সন্ধ্যা করে ঘোষ বাড়ির ছোট্ট মেয়ে তিন্নি ঘুরতে নিয়ে বেড়ায়। জুঁই রোজ ইচ্ছে করে আমাদের বাড়ির সামনে পেচ্ছাপ করে। লালু প্রতিবাদ করেছে বলে তিন্নির হাত ছাড়িয়ে তেড়ে এলো লালুর দিকে। শেরুকি ছেড়ে দেবে। তাড়া করলো ওকে। প্রান ভয়ে জুঁই ঝাঁপ দিলো পুকুরে। আমিই তুলে আনলাম ওকে। ও বাড়ির লোকজন সব শহরের বাবু সাঁতার কাটতে জানেন না। কিন্তু অবাক কান্ড। লালু আর মিনি, জুঁই এর গা চেটে দিতে শুরু করলো। ওদের মতো তিন্নিদের সাথে ও আমাদের বন্ধুত্ব হলো সেইদিন থেকে। মাঝখান থেকে কাজল জেঠুর মাজায় ব্যাথা হলো , এদের দৌড়াদৌড়িতে পড়ে গিয়ে।