সংশপ্তক
সংশপ্তক
দ্বাবিংশতি অধ্যায়
জেল থেকে ছাড়া পেয়ে অম্বরীশ বাড়ি গেল । একমুখ খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাথার চুলে যেন জটা ধরেছে। শরীর আর আগের মত নেই। চোখ কোটরগত। প্রথম দর্শণে তাকে চেনা যায় না। বাড়িতে ফিরে দেখে বাড়ি তালাবন্ধ । পাশের বাড়ির লোকেরা জানাল কালাচাঁদ বাবু বাড়ি বিক্রি করে কোথাও চলে গেছেন । একলা মানুষ ঘরে থাকতে পারছিলেন না; আর অপর্ণা অর্থাৎ অম্বরীশের স্ত্রী বাপের বাড়ি চলে গেছে ।
অম্বরীশ এই প্রথম নিজেকে বড় অসহায় মনে করল। একবার ভাবল অপর্ণাদের বাড়ি যায়। পরক্ষণেই তার মনে পড়ল সে তো ডিভোর্স পেপারে সাইন করিয়ে নিয়েছে। এখনও ডিভোর্স হয়নি ঠিকই তথাপি যদি তাকে ফিরিয়ে দেয় ! অতএব সে ভাবনা ছেড়ে ভবঘুরের মত এখানে সেখানে দিনটা কাটিয়ে রাতে দীপুদের বাড়ির দিকে রওনা দিল ।
বিকেলে , ওখানে গিয়ে একটু মাথা গোঁজার জায়গা পেতে অনুনয় বিনয় করতে লাগল। বড়পিসিমা অর্থাৎ ঐন্দ্রিলাদেবীর কাছে নিজ কর্মের জন্য অনুতাপ করতে লাগল ।
দীপু বলল - রাতটা থেকে যেতে পারিস। মাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নেব। তারপরের দায় কিন্তু আমাদের নয় ।
নীলেশবাবু চুপ করে থাকাই শ্রেয় বিবেচনা করে সেখান থেকে চলে গেলেন । ঐন্দ্রিলাদেবী বললেন - একজন সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীকে কোন মতেই আশ্রয় দেওয়া যাবে না। তবে দীপু যখন বলে দিয়েছে তখন রাতটুকুই সে নীচে বারান্দায় পড়ে থাকতে পরে। আরও ভালো হয় তার এককালের দোসর হরিপদ মোড়ল অথবা বিমলার কাছে চলে যাওয়া।
তিনমাস আগে হলে এই সব কথা অম্বরীশের মত ছেলে মুখ বুঁজে সহ্য করত কি না বলা বাহুল্য; কিন্তু মানুষ যখন নিরুপায় হয়ে পড়ে তখন পরিস্থিতিকে মানিয়ে নিতে বাধ্য হয় ।
অম্বরীশ নিরুপায় হয়ে রাত কাটানোর ব্যবস্থাটিকে স্বাগত জানাল ।
রূপসা চা বিস্কুট দিয়ে গেল । তার ভেতর একটা সুপ্ত চেতনা জেগে উঠল । অম্বরীশ নি:সন্দেহে সুপুরুষ। এখন হয়তো পরিস্থিতির চাপে এমন দশা হয়েছে । সে শাশুড়িমাকে এতটা নির্দয় না হবার পরামর্শ দিল। বলল - মা , উনি তো এখন মণিহারা ফণী। বিষদাঁতও ভেঙে গেছে। এখন আর কিছু করার ক্ষমতা ওনার নেই। তবে এত ভয় করছেন কেন ?
- ও তুমি বুঝবে না। যে রক্ত মাংস দিয়ে গড়া তাতে তাকে আমি পোষা বাঘই মনে করি। আর তুমি জানো নিশ্চয়; বাঘের বাচ্চা বাঘই হয়। অতএব ওর ভেতর যে সুপ্ত চেতনাগুলো রয়েছে তাতে একদিন স্বমূর্তি ধরে সব শেষ করে দিয়ে যাবে। কথায় বলে শত্রুর শেষ রাখতে নেই। সম্পূর্ণ নি:শেষ করাই বিধেয় ।
এরপর রূপসার আর কিছু বলার থাকে না। বললও না। শুধু মনে মনে অম্বরীশের প্রতি একটা অকারণ মমত্ববোধে ক্ষুণ্ণ হল ।
নীলেশবাবু বললেন - বৌঠান , বেচারাকে দেখে আমারও খুব দুঃখ হচ্ছে।
- অযথা দুঃখ করছ ঠাকুরপো। তুমিও কি চাও আমি খাল কেটে বাড়িতে কুমীর ডেকে আনি ?
জিভে কামড় দিয়ে নীলেশবাবু বললেন - কক্ষণো না। আর এ বাড়ির সর্বময় কর্ত্রী হিসাবে আপনার সকল সিদ্ধান্ত শিরোধার্য। এজন্য আমি তখন কোন কথা বলিনি। সুযোগ তো এসেছে কটুকথা শোনাবার । কিন্তু ঈশ্বর যাকে স্বয়ং এই দশা করে দিয়েছেন তখন সামান্য মানুষ হয়ে তার উপকার করার দু:সাহস দেখাব না। শুধু বলি সকাল হলে অম্বরীশ যখন চলে যাবে বিবেকের খাতিরে তাকে কিছু টাকা পয়সা সাহায্য দেবার অনুমতি দিন ।
- ঠাকুরপো তুমি অনুমতি চাইবে কেন ? এই বাড়ির সুখ দু:খ, স্বাচ্ছন্দ্য অস্বাচ্ছ্যন্দ আজ পর্য্যন্ত তুমিই দেখে এসেছো; আমরা কেউ কোনদিন তাতে আপত্তি জানাইনি। আজও কিছু বলব না। তুমি চাইলে দিতেই পারো। তবু বলব এ তোমার ভস্মে ঘি দেওয়া হবে।
- না বৌঠান! আপনি যা বলছেন তা সবই অমোঘ, এবিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। যদি দিতে হয়; আপনি নিজের হাতে দিবেন, অন্যথায় আমরা কিছু করতে পারব না।
ঐন্দ্রিলাদেবী হয়তো খুশি হলেন ঠাকুরপোর এই আনুগত্যে । বললেন - ঠিক আছে, আমার পক্ষ থেকে তুমি ঠাকুরপো ওর হাতে খুব বেশি হলে হাজার পাঁচেক টাকা দিতে পারো । বড়দাকে যেমন দিয়েছিলে।
নীলেশবাবু একটু লজ্জিত হলেন । বললেন - বৌঠান ! আমি তার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি । আপনাকে না জানিয়ে বোধ করি সেই প্রথম একটা কাজ করেছি।
- ভালো করেছ । তার জন্য তো কিছু বলিনি। শুনেছি দাদা বাড়ি বিক্রি করে চলে গেছেন । কোথায় গেছেন জানি না। অম্বরীশও হয়তো জানে না। যাই হোক ওই টাকাটা নিয়ে সে ওদের খুঁজুক। যা খুশি করুক। মোট কথা সকাল হলেই ও যেন চলে যায়। নইলে আমি তুলকালাম করব।
নীলেশবাবু দেখলেন সিচ্যুয়েশন গরম হয়ে যাচ্ছে। সেজন্য কালবিলম্ব না করে নীচে বারান্দায় নেমে এলেন । রূপসা রান্না ঘরে চলে গেল । রাতের রান্না করতে হবে যে !
দীপু এতক্ষণ অম্বরীশের সঙ্গে কথা বলছিল । একা রেখে যেতে মনে সায় দেয়নি। তাছাড়া এমন বিপজ্জনক আত্মীয়কে কুকথা ভাবতে দেওয়ার সময় দেওয়া যায় না। অম্বরীশ দীপুর চাকরি কেমন চলছে জানতে চাইলে দীপু বলল - ইঞ্জিনিয়ারের কাজ তো, ঠিকই চলছে।
- এই যো তোর এমন অসুখ , ঘন ঘন হাসপাতালে ভর্তি ছিলি - ওরা কোন অবজেকশন দেয়নি ?
- তা কেন ? আমার ম্যানেজার তো বলেই দিয়েছেন জাস্ট একটা টেলিফোনিক ইনফরমেশন কেউ দিলেই হবে। কারণ ওনাকে তো ম্যানেজ করতে হয়।
- বাহ্ খুব ভালো । তোদের ওখানে কোন ভ্যাকেন্সি নেই ? আমার কোয়ালিফিকেশন তো তুই জানিস !
- আমাদের তো সবই ইঞ্জিনিয়ারিং জব। তোর স্যুটেবল কোন জব কি পাওয়া যাবে ? খোঁজ নিতে হয়।
- দেখবি তো । খুব উপকার হবে।
দীপু মনে মনে ভাবল তোর মত লোকের উপকার ! কদাপি নেহি।
তবু ভদ্রতা দেখিয়ে বলল - জেনে নেব।
- আমি তবে কবে খবর নেব?
- তোর নং তো জানি। আমি ঠিক খবর দিয়ে দেব।
নীলেশবাবু এসে বললেন - দেখ বাবা অম্বরীশ ! বৌঠানের সঙ্গে ভিভিডলি আলোচনা করলাম। আমাদের এখানে তোমার থাকা যাবে না। কারণ আমরা নতুন করে কোন উপসর্গ নিতে পারব না। আবার তোমার এই হাল দেখে আমরা খুব দু:খ পেয়েছি। যদিও এ' সকলের জন্য তুমি নিজেই দায়ী। তথাপি আত্মীয়তাজ্ঞানে তোমার প্রতি কর্তব্যের খাতিরে এবং যাতে তুমি এখনই কোন অসুবিধায় না পড় ; সেজন্য বৌঠান এই পাঁচ হাজার টাকা তোমাকে দিতে বললেন । তুমি কি তা নেবে ?
- পিসির কি আমার মুখ দেখবেন না ?
- অবান্তর প্রশ্ন করবে না ।
- তাহলে তিনি নিজের হাতে দিলেন না কেন ?
- আমার হাত দিয়ে নিতে কি তোমার আপত্তি আছে ?
অম্বরীশ দেখল এখন তার টাকাপয়সার প্রয়োজন। সেই কথা ভেবে বলল - তা নয়; ভিক্ষের চাল গোটা বা ভাঙা দেখলে চলে না ।আপনি দিন আমি নেব।
হাত পেতে টাকাটা নিয়ে বুক পকেটে রেখে দিল । তারপর বলল - তাহলে চলি ?
হন্তদন্ত হয়ে নীলেশবাবু বললেন - তাই হয় নাকি ? রাতবিরেতে কেউ ইঁদুর বাঁদর তাড়ায় না আর তুমি তো আর যাই হোক আমাদের আত্মীয় । রাতটা কাটিয়ে না হয় সকাল সকাল রওনা দিও।
অম্বরীশের ধড়ে প্রাণ এল । যাহোক রাতটা নির্বিঘ্নে কাটবে। আর সেদিনের মত ক্ষিধেও মিটবে।
- রাতে কিন্তু তোমাকে এই বারান্দাতেই পড়ে থাকতে হবে।
কঠোর ভাবে বললেন নীলেশবাবু ।
- কারণ উপরে তোমার থাকার মত জায়গা নেই। অবশ্য এখানে তুমি আরামেই থাকবে
অম্বরীশ নিজের ভাগ্যকে মেনে নিল ।
( ক্রমশ )
