সংশপ্তক
সংশপ্তক
ত্রয়োর্বিংশতিতম অধ্যায়
দামোদর বরাকর দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। দামোদর তীরবর্তী শালডিহা গ্রামে এখন কোন অশান্তি নেই । হরিপদ মোড়লের স্থলাভিষিক্ত যিনি হয়েছেন তিনি প্রকৃতপক্ষে অপেক্ষাকৃত উদারমনস্ক। উচ্চশিক্ষা না থাকলেও মোটমাট বেশ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি। হরিপদ মোড়লের মত গ্রামের খুঁটিনাটি বিষয়ে নাক গলান না। অবশ্য নিজে চাকুরিজীবী বলে সময়েরও অভাব রয়েছে। তাঁর নাম সর্বেশ্বর রায়। রায় পদবী হলেও হরিপদ রায়দের সঙ্গে তাঁর কোন সম্পর্ক নেই। গ্রাম পঞ্চায়েতে তাঁর প্রভাব ভালোই।
ঐন্দ্রিলাদেবীর পরিবারের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক খুবই ভালো। তিনি নীলেশবাবুর বাল্যবন্ধু। সত্যসাধন বাপুলি অর্থাৎ নীলেশের অগ্রজ যখন গত হলেন ঐন্দ্রিলাদেবীর বয়:ক্রম তখন খুব বেশি হলেও সাতাশ কি আটাশ হবে। তাঁর অকালবৈধব্যে বিচলিত হয়ে সর্বেশ্বরই প্রস্তাব দিয়েছিলেন নীলেশ যাতে ঐন্দ্রিলাকে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ করেন । এটি বিধিসম্মত এবং গ্রামের কেউ তাতে আপত্তি জানাতে পারবে না । তাছাড়াও নীলেশকে যখন বিয়ে করতেই হবে তখন এমন সুপাত্রী তো মন্দ নয়। কিন্তু নীলেশের এই প্রস্তাব পছন্দ হয়নি হয় তো। তাঁর ধারণা ছিল এতে গ্রামের লোকজন বিশেষ করে হরিপদ মোড়ল জল ঘোলা করতে পারে। অহেতুক অপবাদও দিতে পারে।
সত্যসাধনবাবু বলেছিলেন - এমনিতেই ওর যা স্বভাব তাতে দেখ কোনদিন কি আলফাল বলে বসে।
- উম্ এত সোজা। জন্মের মত মোড়লগিরি ঘুচিয়ে দেব না !
- ও সব ফালতু কথা নীলু। দেখ তোর দাদার একটি সদ্যোজাত শিশু রয়েছে। ওকে তো বড় করতে হবে না কি ?
- তো ! তার জন্য আমাকে বিয়ে করতে হবে ?
- সে কথা নয়। বিয়ে তো একদিন করবিই। তখন যদি নতুন বউ এসে বলে সে এমন ঝামেলা নিতে পারবে না। তখন তো বাড়িতে অশান্তি শুরু হয়ে যাবে ! তখন হয় তোকে আলাদা থাকতে হবে ; নয় তো ওই বউই তো বলবে দেবর ভাজে কোন বাজে সম্পর্ক আছে নিশ্চয়। তার চেয়ে বিয়ে যদি করিস বৌঠানকেই কর । কম বয়স; তোর চেয়ে দু'এক বছরের ছোটোই হবে হয়তো। সংসার বেঁচে যাবে !
- আর বিয়েই যদি না করি ?
- তবে তো কলঙ্ক তোর মাথায় আর বৌঠানের অঙ্গে শোভা পাবে রে বুড়বক !
- ধুত্তোর ! ছাড় ও সব চিন্তা । এখন বল দেখি আমি যদি চিরকুমার থাকি এবং অত্যন্ত সংযমী জীবন যাপন করি কেমন হবে ?
- অপবাদ। অপবাদ মাথায় নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে।
- ওই হরিপদ মোড়ল রটাবে তো ?
- নিশ্চয়। এমনভাবে ছড়িয়ে দেবে যে গ্রামের লোকজন ভাববে ' যা রটে তার কিছুও তো বটে '!
- গাঁয়ের কথা ছেড়ে দে। তুই কি ভাববি সেটা বল। নাকি তুইও গাঁয়ের লোকের দলে চলে যাবি।
- দেখ নীলু, আমরা শৈশবের বন্ধু, কৈশোরের সাথী আর এখন এই ভরা যৌবনে দুজন দুজনের সমব্যথী। এই কথা যদি মিথ্যে হয় , তবে জগতটাই মিথ্যে ।
নীলেশবঞ্জন বললেন - তোর মনে যদি বিষ না থাকে, আর সত্যিই যদি তুই আমাকে ভালোবাসিস তবে বলি -
- কি ?
- আমাকে আমার মত থাকতে দে। বিয়ে যখন করব না ভেবেছি ; তখন কোন মেয়ের প্রতি আমার কোন দুর্বলতা নেই - এটুকু জেনে রাখিস। আমার মাথায় এখন কনেক চাস। সদ্য দাদা গত হয়েছেন। বৌঠানের বাপের বাড়ি থেকেও অনুরূপ প্রস্তাব এসেছিল। আমি তৎক্ষণাৎ নাকচ করে দিয়েছি। এমনকি ওদের বলেছিলাম আপনারা যদি বৌঠানের অন্য কোথাও পুনর্বিবাহের আয়োজন করেন; আমি অসম্মতি জানাব না। বরঞ্চ পূর্ণ সহযোগীতা করব।
- তখন ওনারা কি বললেন ?
- বৌঠানের বাবা বলেছিলেন এই মুহূর্তে তোমার চেয়ে কোন সুযোগ্যতর পাত্র আমি দেখি না। আমার হাতে ধরে বলেছিলেন ' বাবা তুমি অমত কর না ; মেয়েটা আমার বেঁচে যাক । কিন্তু আমার দৃপ্ত পৌরুষচিত্ত সসম্মানে তা প্রত্যাখ্যান করেছিল । আমি সবিনয়ে ওনাকে কথা দিয়েছিলাম আমার বৌঠানের কোনদিন কোন অসুবিধে বা কোনরূপ অসম্মান হতে দেব না । আচ্ছা, আমি যে এতগুলো কথা বলছি ; তার মানে কি তোকে ওনারা ঘটকালি করতে বলেছেন ?
এক হাত জিভ বের করে সত্যসাধন বললেন - আমাকে ওরা চেনেন নাকি যে আমাকে ঘটকালি করতে বলবেন! আমার সরল মনে যা এল তোকে বলে দিলাম। কারণ এরকম দু'একটা ঘটনা আমি জানি। আর ওরা এখন সকলেই সুখী গৃহী।
- না রে শোন, আমি ভেবে রেখেছি বৌঠানের বাবাকে দেওয়া কথার কোনরকম নড়চড় হবে না। প্রথম দিন থেকে বৌঠানকে বৌঠান বলে ডেকেছি এবং জীবনের শেষ শ্বাসটুকু পর্য্যন্ত তিনি আমার কাছে বৌঠানই থাকবেন ।
- তুই কি বৌঠানের মনের কথা কোনদিন জানতে চেয়েছিস ?
- মানে ?
- তাঁর সামনে পুরো জীবনটা পড়ে রয়েছে। ততদিন কি তিনি এই বৈধব্য যাতনা নিয়ে থাকতে পারবেন বলে মনে করিস ? দেখ তুই আমার ইন্টিমেট ফ্রেণ্ড এণ্ড ফিলোজফার । সেই অধিকারটুকু নিয়ে অনধিকার চর্চা করছি মাত্র ।
- না রে সতু । আমি তো তা জানি না বা জানার চেষ্টাও করিনি। আর তোর কথায় আমি কিছুই মনে করছি না। তুই প্রস এণ্ড কন্স বিচার করে বলছিস - তাও বুঝি। ঠিক আছে, এমন কথা বললি যখন আমি আজই বৌঠানের সঙ্গে কথা বলব।
- আমাদের এই আলোচনা কিন্তু উহ্য রাখিস। নইলে আমার খুব খারাপ লাগবে। বৌঠানের নিকট মুখ দেখাতে পারব না।
- মাভৈ: তুই নিশ্চিন্তে থাক। আমি এমন কিছু বলব না বা করব না যাতে আমাদের বন্ধুত্বে কোনরকম আঘাত লাগে।
- ধন্যবাদ বন্ধূ।
এরপর নীলেশ বাড়ি আসেন। দেখেন শিশুটিকে পরম যত্নে মাতৃকর্তব্য সমাধা করছেন। বিমলাদি রান্না করছে। নীলেশ তেল সাবান গামছা নিয়ে পুকুরে চলে গেলেন স্নান করতে।
বৌঠান বললেন - বিমলা ! ঠাকুরপো এসে গেছে। খাবার সার্ভ করে দে। আমি একটু পর খাচ্ছি।
নীলেশ বললেন - বিমলাদি তুমি বাড়ি চলে যাও। আমিও একটু পরে খাব।
বৌঠান বললেন - কি ব্যাপার ঠাকুরপো ? অন্যদিন তো স্নান করে দুমিনিটও দাঁড়াও না। আজ আবার কি হল ? শরীর ঠিক আছে তো ?
- হাঁ বৌঠান ! শরীরে কিছু হয়নি । তবে মনটা বড় চঞ্চল।
- সে কি ? কেন ?
- বলছি।
তারপর কানের কাছে মুখ রেখে বলল - বিমলা আসুক, তারপর বলছি।
ঐন্দ্রিলা একটু অস্বস্তিতে পড়লেন। ঠাকুরপো তো কোনদিন এমন ব্যবহার করেন না।!
যাই হোক বিমলা যেতেই ঐন্দ্রিলা ভাত বেড়ে দিলেন। নীলেশ বললেন - আপনিও বসে পড়ুন। খেতে খেতে কথা হবে। দীপু তো এখন ঘুমুচ্ছে। একসাথে খেয়ে নিই।
খাবার টেবিলে বসে নীলেশ ওদের সম্পর্কের সম্ভাব্য টানাপোড়েনগুলো সবিস্তারে বললেন । এমনকি বৌঠানের বাবাও যে একই প্রস্তাব দিয়েথেন তাও বললেন।
ঐন্দ্রিলা তখন বললেন - দেখ ঠাকুরপো। এই সম্পর্কের মধ্যে একটা বন্ধু বন্ধু গন্ধ রয়েছে। তুমি কি তা ডিঙিয়ে কর্তৃত্ব ফলাতে চাও। আর তুমি যদি বৈবাহিক সম্পর্কের কথা বল তো আমি বলব তুমি বিয়ে কর। আমি পাত্রী ঠিক করে দেব ।
- প্রশ্ন সেটা নয় বৌঠান । আমাকে তো আপনি এতদিন ধরে দেখছেন ; আমার মধ্যে তেমন কোন অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া কিছু লক্ষ্য করেথেন কি ?
- তা নয় , কথাটা যখন তুললে তখন বলি আমি যা পেয়েছি তাতেই খুব সন্তুষ্ট। এরপর আবারও একটা নতুন জীবন নিতে আমি অপারগ। তোমার দাদাকে মন প্রাণ দেহ সমর্পণ করেছি। তারই জন্য আজ দীপু আমার কোল আলো করে এসেছে।
নীলেশবাবু অত্যন্ত লজ্জিত বোধ করলেন ।
- আমাকে ক্ষমা করবেন বৌঠান - কথা উঠছে বলে আপনার মত জানতে চেয়েছি। এখন জেনে গেছি। আর আমার মধ্যে কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। আমিও এই আপনার পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি দীপুকে আপনাকে আমি নিজের জীবন দিয়েও দেখভাল করব। আর বিয়ে ? কাউকে কস্মিনকালেও করবার কথা ভাবিনি, ভাবছি না এবং ভবিষ্যতেও তা আর কল্পনায় আনব না।
- এভাবে নিজের জীবনটা ঘুচিয়ে দেবে ঠাকুরপো ?
- কিসের জীবন ? কার জন্য ঘুচিয়ে দিচ্ছি ? আমি যা করছি তা আমার পবিত্র কর্তব্য । আপনার বাবামশাই আমাকে ধরেছিলেন - আমি আপনার কথাগুলোই নিজের কথা বলে তাঁকে নিরুৎসাহ করেছি।
- আমি জানি ঠাকুরপো ! গাঁয়ে ঘরে নানান জনে নানান কথা বলছে। আমার কানেও তা এসেছে। কিন্তু নিজেকে সংযত রেখে বাড়ির মধ্যে লুকিয়ে থেকেছি।
- এরপর থেখে লুকিয়ে থাকবেন না বৌঠান । উঠুন, জাগুন, প্রতিবাদ করুন । আমরা দেখিয়ে দেব সমাজে সব মানুষ একই রকম হয় না। কিছু ব্যতিক্রমও থাকে।
- তুমি ঠিক বলেছ ঠাকুরপো। মাথা উঁচু করে থাকাই জীবন।
