সংশপ্তক ( ঊনত্রিশ অধ্যায়)
সংশপ্তক ( ঊনত্রিশ অধ্যায়)
গৌরীকুঞ্জে নতুন দুই জন বাউল এসেছে। আখড়ায় গুঞ্জন । তরজা জমবে ভালো । নতুন বাউলদ্বয় সবার সঙ্গে পরিচয় করতে লাগলেন ।
- রাধে রাধে।
কেউ বলল রাধে রাধে, কেউ রাধেকৃষ্ণ কেউ জয় গৌর জয় নিতাই , একজন বলল জয় শ্রীকৃষ্ণ।
এরপর শুরু হল আখড়ায় বাউল গান। নতুন বাউলদের গান দিয়ে শুরু হল আখড়া। সর্বেশ্বর বাউল শুরু করলেন লালন ফকিরের গান দিয়ে। ' ধন্য ধন্য বলি তারে ' ।
সকলে বাহবা দিল। কাণা গোঁসাই সর্বেশ্বর আর খোঁড়া গোঁসাই নীলেশ । পাশাপাশি বসে আছেন দুজন। এক শ্বেত বস্ত্র পরিহিত বাউলকে বললেন - গোঁসাই আপনার ডেরাটি কোথা?
- যেথা থাকি সেথা । যেমন এখন হেথা ।
নীলেশ এবং সর্বেশ্বর মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন । প্রথম দিন যে সন্ন্যাসীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল কোথায় বাস সে ও এমনি এক উত্তর দিয়েছিল । জ্যোতিষীও সোজাসুজি উত্তর দেয় নি। এও দিল না । অতএব সন্দেহ তো একটু হয়ই। সাদা পোষাকের গোঁসাই চলে যেতেই ঈশারায় সর্বেশ্বর বললেন - এইই।
অনেক কসরত করার পর তাঁদের দুজনের ডেরা একই রুমে এলট করে দিল বাউল সম্প্রদায়ের প্রধান। নীলেশ এবং সর্বেশ্বর হাত ধরাধরি করে হাঁটার ভাণ করে বারান্দা বরাবর পায়চারি করতে লাগলেন । এখানে কোন রুমে দরজা নেই। সব হাট করে খোলা। শুধু মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুই করে দেওয়া হয়েছে।
এই সুযোগই খুঁজছিলেন ওঁরা। আগে তো এত ভেতরে আসা যায়নি এখন অবাধে ঘোরাফেরা করা যায়। হঠাৎ নীলেশ দেখলেন শ্বেত বস্ত্র পরিহিত বাউলটি একতারা নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন । তখন গোধূলি বেলা। আশ্রমের কেউ কেউ কাছের গ্রামগুলোতে সিদে নিতে যায় ।
লোকটা কাঁধে ঝুলি মাথায় পাগড়ি আর এখন গেরুয়া বসন পরে একতারা হাতে নিয়ে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছে।
ওঁরা দুজনও বাউলের পোষাকে পিছু নিলেন। সর্বেশ্বর বাবু ফোন করলেন দীপুকে ।
অপারেশন ইজ ইন প্রোগ্রেস । বি রেডি । আমরা পিছু পিছু আসছি।
দীপু ব্যাপারখানা জানে। ঐন্দ্রিলাদেবী রূপসাও জানে। ওরা তৈরি হয়ে রইল ।
লোকটা দীপুদের দরজায় এসে দাঁড়াল। মুখে বলল - জয় শ্রীকৃষ্ণ।
দীপু দরজা খুলে আপ্যায়ত করল - জয় শ্রীকৃষ্ণ। ভেতরে আসতে আজ্ঞা হোক।
বাউল ভেতরে এল । আসন পেতে বসল । সর্বেশ্বর সদর দরজা বাইরে থেকে লক করে দিলেন । এরপর পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে বাউলের অলক্ষ্যে রান্না ঘরে এসে দাঁড়ালেন। এখান থেকে বারান্দার সব কিছু নজর করা যায় ।
দীপু দেখল কাকাবাবু নিজের মাথার নকল চুল খুলে ঈশারা করছে বাউলের মাথার চুলে টান দিতে।
দীপু রেডি হয়ে কথা বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালো। বাউল বলল - আমার পাওনাটা দাও।
- কিসের পাওনা !
- না মানে ভিক্ষে । চল ডাল কিছু সব্জী।
দীপু বলল - মা বাউলকাকার জন্য খাবার নিয়ে এস।
ঐন্দ্রিলা দেবী খাবার থালায় ফল মিষ্টি রেখে বাউলকে আপ্যায়ন করলেন। বাউল খুশি হল ।
আরও দুজন বাউল গেয়ে উঠলেন - ধন্য ধন্য বলি তারে।
সাদা বাউলের পিলে চমকে গেল। তড়াক করে উঠে পিছন ফিরতেই ওঁরা দুজন চুল দাড়ি খুলে নিলেন।
সর্বেশ্বর বললেন - বৌঠান, এঁকে চিনতে পারছেন ?
বৌঠান অবাক বিস্ময়ে বললেন - বড়দা ! তুই !
অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন কালাচাঁদ বাবু। বললেন - ইন্দু তোর ভাগ্যটা বড় ভালো রে ! তার এক কণাও যদি পেতাম !
- তোর এত ঢঙ করার কি দরকার ছিল ? আমি তো ঠিক করেই নিয়েছিলাম জেল থেকে ছাড়া পেলে তোর বন্দোবস্ত করে দেব !
- এই ভালো রে ! এই জীবনটাই ভালো। তোকে আমি জন্ম থেকেই পছন্দ করতাম না। একমাত্র মেয়ে বলে বাবা মায়ের বড় আদরের ছিলি। আর ওটাই আমাকে খলনায়ক হতে উৎসাহ দিয়েছিল। তোকে তিলে তিলে মারব বলে ছেলের সঙ্গে জোট বেঁধে সব কাজ করেছি।
দীপু এতক্ষণ চুপ করে ছিল। বলল
- জ্যোতিষী মামা ! খুব তো সেদিন সত্যি কথা বলে মন টানার চেষ্টা করেছিলে।
আবারও হাসলেন কালাচাঁদ বাবু।
- সেদিন তো গেমটা প্রায় পকেটেই পুরে নিয়েছিলাম । হঠাৎ নীলু এসে গেল বলে হাতছাড়া হয়ে গেল । নইলে ঐদিনই..
- আর তারপর বাউল সেজে কেল্লা ফতে করতে চেয়েছিলেন ?
নীলেশবাবু বললেন।
- তোদের সবাইকে একদিন খুন করব । দেখে নিস। জেল হবে তো ? ছাড়া তো একদিন পাবই ।
রূপসা সবকিছুর ভিডিও করছিল। তা দেখে খেপে গিয়ে কালাচাঁদ বাবু বললেন - এই হতচ্ছাড়ি মেয়ে ! আমার অম্বরীশের সঙ্গে তো বেশ জমিয়েছিলি ? হা হা হা। তারপর ? বেশ মজা লুটেছিস না ?
রূপসা কথাগুলো সব শুনল। কিন্তু ভিডিওটা জলজ্যান্ত প্রমাণ হিসেবে রাখার জন্য মুখে কিছু ডলল না। ঐন্দ্রিলাদেবী বললেন - এত নীচে নেমে গেছিস তুই ? বাড়ির বৌকে নিয়ে বলতেও তোর মুখে আটকাচ্ছে না।
ক্রুর হাসি হাসছেন কালাচাঁদ বাবু।
- আমি তোকে বলেছিলাম তুই বিধবা হ। হয়েছিস। এখনও বলছি তুই নির্বংশ হ। তার পথও খুলে গেছে। জোয়ান মদ্দ ছেলে ব্লাড ক্যান্সারে ভুগছে। আর ক'দিন ? এ রোগ সারে কখনও ?
নীলেশের মাথা গরম হয়ে গেল। একটা লাঠি নিয়ে মাথায় আঘাত করতে উদ্যত হলেন। কোথা থেকে সর্বেশ্বর এসে সেই লাঠি ধরে ফেললেন। বললেন - না নীলু। এমন কিছু করবি না যা আইন হাতে নেবার মত হয়।
কালাচাঁদ ওনাকে বললেন - হতভাগা মোড়ল। নিজেকে খুব চালাক ভাবিস না কি ? অম্বরীশকে নীলু খুন করেনি ? কই ও বুকে হাত দিয়ে বলুক তো ? মোড়ল হয়ে ভাবছিস চিরকাল আইনকে কাঁচ কলা দেখিয়ে যাবি ? গণপিটুনির অজুহাত খাড়া করে আপাতত ওকে বাঁচিয়েছিস । এবার দেখি কি করে বাঁচাস !
সর্বেশ্বর বললেন - আপনি বৌঠানের দাদা বলে ধৈর্য্য রেখেছি । নইলে কবে শেষ করে দিতাম ।
কালাচাঁদ বাবু ফুঁসতে লাগলেন। কোমর থেকে কৃপাণ বের করে সর্বেশ্বরের দিকে ছুঁড়তেই সর্বেশ্বর সরে গেলেন। কৃপাণ গিয়ে বিঁধল ঐন্দ্রিলার পেটে। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে তিনি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন। তখন নীলেশ ও সর্বেশ্বর মিলে কালাচাঁদকে ধরে পিছমোড়া করে বেঁধে দিলেন গরাদের সাথে। তারপর পুলিশে ফোন করলেন। রূপসা ভিডিও করা বন্ধ রাখে নি। ইঙ্গিতে দীপুকে বললেন মাকে ধরতে।
পুলিশ এল । কালাচাঁদ ও ভিডিও নিয়ে চলে গেল । সর্বেশ্বর অটো ডেকে ঐন্দ্রিলাকে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে ডাক্তারবাবু তার আশঙ্কাজনক অবস্থা দেখে শহরের হাসপাতালে রেফার করে দিলেন। তখন গাড়ি ভাড়া করে নিকটবর্তী শহরের হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হল । পুলিশকেও যথারীতি জানিয়ে দেওয়া হল । অপারেশন করে ছুরি তো বের করা হল কিন্তু ঐন্দ্রিলাদেবী কোমায় চলে গেলেন ।
দীপু রূপসা এবং নীলেশের সে কি কান্না ! সর্বেশ্বর কাকে ছেড়ে কাকে সান্ত্বনা দেন !
দশদিনের মাথায় ঐন্দ্রিলাদেবীর জ্ঞান ফিরল । কিন্তু কাউকে তখন চিনতে পারছেন না । সবাই মিলে অনেক চেষ্টা করলেন । সবই বিফলে গেল ।
সর্বেশ্বর ডাক্তারবাবুকে বললেন - তাহলে কি বৌঠান এলঝাইমারে আক্রান্ত হয়েছেন ?
ডাক্তারবাবু বললেন - আমরা সে পরীক্ষাও করে নিয়েছি। ব্রেণে কোন এফেক্ট হয়নি । দেখুন, ওনার এখন সময় লাগবে। সবচেয়ে প্রিয়জন বা সর্বাপেক্ষা অপ্রিয়ভাজন যদি কেউ থাকে তাক এনে একবার চেষ্টা করে দেখলে হয় ।
সর্বেশ্বর বললেন - প্রিয়জনেরা তো সবাই ফেল। তবে তাঁর সবচেয়ে অপ্রিয়, ঘৃণ্য মানুষ একজন আছে। তাঁর ই বড়দা। কিন্তু সে তো এখন হাজতে!
- চেষ্টা করুন তাকে যদি আনা যায় ! এমনিতে পেশেন্ট এখন খুব ভালো রয়েছে। প্রয়োজন হলে পুলিশের অনুমতি নিয়ে ওঁকে হাজতে ওঁর বড়দার সামনে নিয়ে গিয়ে দেখুন যদি সাকসেসফুল হন।
সর্বেশ্বর রাজী হলেন । গ্রামপ্রধান হিসেবে এস ডি ও সাহেবের সঙ্গে ভালো পরিচয় আছে। তিনি সাহেবের সঙ্গে কথা বললেন।
