সংশপ্তক ( চতুর্দশ অধ্যায়)
সংশপ্তক ( চতুর্দশ অধ্যায়)
চতুর্দশ অধ্যায়।
সপ্তর্ষির মনে আছে AMRI Annexe Building Fire Incident. সেদিন ও ভর্তি ছিল ডাক্তারের নির্দেশে। রাত আটটায় রিলিজ হয়ে বাড়ি যায়। আর সেই রাতেই ঘটেছিল ভয়াবহতম অগ্নিকাণ্ড।
ঈশ্বরের অপার করুণা হয়তো পড়েছিল তার কপালে। নইলে রাতে ছুটি না পেলে ওইদিনই জন্মের মত ছুটি হয়ে যেত তার।
এরপর তো অ্যানেক্সটাই বন্ধ হয়ে গেল । ডক্টর ভট্টাচারিয়া চলে এলেন ফর্টিস হসপিটাল আনন্দপুরে।
সপ্তর্ষি এরপর ফর্টিসেই ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নিয়ে চলল । মুশকিল হল এখানে খরচ অপেক্ষাকৃত বেশি। ইন্টারন্যাশনাল হসপিটাল বলে সব কিছুর চার্জ আমরি থেকে অনেক অনেক বেশি ।
নীলেশবাবু তাঁর অসহায়তার কথা জি এস কে বলেছিলেন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন - এ ব্যাপারে তো আমার কিছু করবার বা বলবার নেই। এটা হসপিটালের আভ্যন্তরীণ বিষয়।
নীলেশবাবু বললেন - স্যার, যদি অনুমতি করেন তো একটা কথা বলি !
ডাক্তারবাবু ওনার মুখের দিকে চাইলেন। নীলেশবাবু বললেন - এই যে রেগুলার রকমারি টেস্ট রয়েছে এগুলো কি বাইরে থেকে করানো যাবে ?
- একদমই না । বাইরের রিপোর্ট গ্রাহ্য করা হয় না। কারণ আমাদের সব রেকর্ড রাখতে হয়।
- ও । তাহলে তো কিছু বলার নেই ।
*************************************************************
ফর্টিস হসপিটালের সব কিছু ভালো ; তবে খরচের বাপান্ত । দৈনন্দিন বেড চার্জ আমরিতে যা ছিল ৭৫০ টাকা এখানে ১৬০০ টাকা। ব্লাড টেস্টের চার্জও প্রায় দেড় গুণ।
খরচ বেড়েছে দেখে দীপু বলল - কাকাবাবু ! একবার সেকেণ্ড ওপিনিয়ন নিলে হোতো না ?
- তার মানে, ডাক্তার চেঞ্জ করতে বলছিস ?
- ঠিক তাই। ডক্টর ভট্টাচারিয়া নি:সন্দেহে ভেরি গুড ডক্টর। কিন্তু বড় একগুঁয়ে। নিজে যা বলেন তার একটু হেরফের হলে কত কথা শোনান।
- বড় বড় ডাক্তারদের মেজাজগুলো অমনই হয় । এত গায়ে মাখলে চলে না । ফ্যাসাদে পড়েছি যখন একটু সহ্য তো করতেই হবে !
এ ভাবে দিন যায়, মাস গড়িয়ে বছর আসে। খরচের তোয়াক্কা না করে দীপুর চিকিৎসা চলে । হিসেবের কড়ি একসময় গোলমেলে হয়ে যায়।
এ এম আর আইতে ডাক্তারবাবুর ও পি ডিতে ভিজিট ছিল চারশো এবং এডমিশন নিলে ভিজিট ছিল এক হাজার টাকা। ফর্টিসে গিয়ে দাঁড়াল যথাক্রমে এক হাজার এবং এক হাজার ছ'শো টাকা। এছাড়াও ডাক্তারবাবু হসপিটালের মেডিসিন শপে যে ওষুধপত্র পাওয়া যেত সেগুলোই প্রেসক্রাইব করত । আর ভেণ্ডার শপ ' এপেলো ফার্মেসি ' বেশ চড়া দামে ওষুধ বিক্রি করত। ফলে বাইরে কোন দোকানে কেনা সম্ভব হত না কারণ প্রেসক্রাইবড ওষুধগুলো সেখানে পাওয়া যায় না।
তথাপি নীলেশবাবু চিকিৎসার কোন ত্রুটি রাখেননি। ই সি এল থেকে প্রাপ্ত অর্থ পুরোটাই চিকিৎসার জন্য বরাদ্দ করে দিয়েছেন।
এবার ডাক্তারবাবু শুরু করলেন অভিনব চিকিৎসা। প্রতি পনের দিন অন্তর অর্থাৎ মাসে দু'বার এজন্য হসপিটালে ভর্তি হবার দরকার ছিল ।
আসলে কারণটা ছিল একটু ভিন্ন। হসপিটালে নতুন নতুন কেস এনে দিতে না পারলে চিকিৎসা পদ্ধতির পরিবর্তন করে যাতে ঘনঘন রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তেমনই নির্দেশ থাকে। নতুবা সেই ডাক্তারের প্র্যাক্টিস সেখানে শেষ হয়ে যেত।
অতএব ডাক্তারবাবু নতুন পথ ধরে চিকিৎসা শুরু করলেন । রোগীকে ভর্তি করিয়ে হার্ট, চোখ, লিভার, থাইরয়েড, প্যারা-থাইরয়েড এবং কিডনীর ডাক্তারদের সঙ্গে কনসাল্ট করতে বলতেন । আজ রেফার্ড টু নেফ্রোলজিস্ট, কাল গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট, পরশু এণ্ডোক্রিণোলজিস্ট - এভাবে চলতে থাকল । সুতরাং খরচ চতুর্গুণ বৃদ্ধি পেল । মূল চিকিৎসাও পরিবর্ধিত সূচীতে চলতে লাগল ।
ওরাল কেমোথেরাপির সঙ্গে শুরু হল Zoledronate Therapy.
ডাক্তারবাবুর মতে যাতে শরীরের হাড়ে কোন সংক্রমণ না হয়; সামান্য আঘাতে যাতে হাড়ে চিড় না ধরে বা না ভেঙে যায় - সেইজন্য এই থেরাপি ব্যবহার করলেন ।
নীলেশবাবু তো এমনিতেই দীপু অন্ত:প্রাণ । দীপুর যাতে কোনরূপ ক্ষতি না হয় - তিনি ভয়ে হোক বা দুপুর প্রতি স্নেহবশতই হোক - কোনকিছুতেই পিছপা হলেন না।
জলের মত অর্থ খসতে থাকল ।
দীপু বলল - কাকাবাবু, একবার অন্তত ডাক্তার পরিবর্তন করে একটা এডভাইস নিই !
- নাহ্ রে বাবু ! রিস্ক নিতে পারব না। আর নেওয়া উচিতও নয় ।
- এই ডাক্তারবাবুকে ছেড়ে দিতে বলছি না কাকাবাবু। জাস্ট একটা এডভাইস ; চিকিৎসা ঠিকমত চলছে কি না।
- বাপু অত ঝামেলায় কাজ কি ? আমাদের তো কোন অসুবিধা হচ্ছে না। বরং তুই বেশ সুস্থ হয়ে উঠছিস। মাঝপথে অন্য ডাক্তার দেখিয়ে মনকে চঞ্চল করা কেন ?
দীপু আর কিছু বলতে পারে না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে ।
Zoledronate Therapy সেদিনের মত নির্বিঘ্নেই সম্পন্ন হল । আসলে এটাও কেমো যা শরীরে সেলাইন চাপিয়ে পুশ করা হয় । এর অসুবিধা হল থেরাপি চলাকালীন মাথা ঘোরানো, বমি করা, বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। দীপুর ক্ষেত্রে কোনটাই হয়নি। ডাক্তারবাবু বললেন - গুড ! দারুন রেসপন্স পাচ্ছি। এবার বাড়ি যেতে পারেন।
প্রায় হাজার ত্রিশেক টাকা বিল মিটিয়ে ওঁরা বাড়ি ফিরলেন।
রাত একটা নাগাদ বাড়ি ফিরলেন ওরা। গ্রাম থেকে রেলওয়ে স্টেশন দু'কিলোমিটার দূরে। মাঝখানে বয়ে গেছে দামোদর নদ । তার চর পেরিয়ে ওদের গ্রাম । পথে জানোয়ারের ভয় নেই; কিন্তু চোর ডাকাতের উপদ্রব যথেষ্ট । এত রাতে স্টেশনেই থেকে যাবেন ভেবেছিলেন
নীলেশবাবু। দীপুকে বলেও ছিলেন। দীপু বলল - এইটুকু তো পথ । চল হেঁটে হেঁটে পেরিয়ে যাব।
নীলেশবাবু বললেন - কিন্তু নদী পেরোনো যে ভয়ানক হতে পারে ।
গরমকাল । দামোদরে খুব বেশি জল থাকে না। বিশেষত নদীর যেখানটা দিয়ে ওরা শর্টকার্ট রুটে যায় ।
নীলেশবাবু বললেন - তাহলে চল রোড বরাবর যাই। ওভারব্রীজের ওপর আলো আছে। অসুবিধা হবে না।
- কিন্তু আরও দু'মাইল বেশি হাঁটবে কাকাবাবু ?
- কি আর করা যায় ! এত রাতে তো গাড়িঘোড়া কিছু পাব না । হাঁটা ছাড়া উপায়ই কি ?
দীপু খানিক ভাবল । তারপর বলল - চল আমরা বাজার দিয়ে যাই। যদি কোন ট্রাক বা কিছু পেয়ে যাই।
বাজার তো বন্ধ। শুধু সারি দিয়ে ট্রাকগুলো ছুটে চলেছে গর্জন করে । দীপু হাত দেখাতে লাগল । কিন্তু ছিনতাইয়ের ভয়ে কোন ট্রাক দাঁড়াল না । এভাবে মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে থেকে বিফল মনোরথ হয়ে ওরা যখন ওভারব্রীজের দিকে যেতে শুরু করেছে; একটা পুলিশ ভ্যান এসে ওদের পথ আটকাল ।
- কোথায় যাবেন ?
- শালডিহা।
- কোত্থেকে আসছেন ?
- কলকাতা থেকে ।
- এত রাতে কেন এলেন ? কলকাতায় কি কাজে গেছলেন ?
তখন নীলেশবাবু পুলিশকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন।
- দেখুন , এই ছেলেটি আমার ভাইপো। ওর চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলাম । এই দেখুন হসপিটালের ডিসচার্জ লেটার ।
বলে ফাইলটা অফিসারের হাতে দিলেন । অফিসার ফাইল দেখে বললেন - ওও।
তারপর ফাইল ফেরৎ দিয়ে বললেন - কি মুশকিলে ফেললেন বলুন তো ! নিন, উঠুন গাড়িতে।
- কেন স্যার ! দীপু প্রশ্ন করল।
- বাড়ি যাবেন না ? উঠে পড়ুন। একটা সিরিয়াস পেশেন্টকে হেল্প করাটা পুলিশের কর্তব্য । উঠে পড়ুন।
নীলেশবাবু হাতে চাঁদ পেলেন ; কিন্তু গাড়ি গ্রামের দিকে না গিয়ে থানায় যাচ্ছে কেন ?
দীপু বলল - স্যার আমরা তো কোন অপরাধ করিনি ?
- আমি কি তাই বলেছি ? থানায় রিপোর্টিং করেই আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আসব।
তারপর বাড়ির দরজায় নামিয়ে দিয়ে পুলেশের গাড়ি চলে গেল। দীপুরা বাড়িতে ঢুকল ।
হাতমুখ ধুয়ে খেতে যাবে ; দোতলা থেকে অম্বরীশ নেমে এল।
দীপু বলল - অম্বরীশ তুই !
- হ্যাঁ আমি, আমি এসেছিলাম পিসাবাবুর সঙ্গে কথা বলতে। দেখলাম তোমরা কলকাতায় গেছ। তাই থেকে গেলাম । তোমাদের সঙ্গে দেখা করব বলে। তোমরা এসে গেছ। খেয়েদেয়ে নাও। তারপর সকাল বেলায় কথা হবে ।
- তোমার সাথে আমাদের কোন কথা নেই। তুমি অযথা জলঘোলা করতে এসেছ কেন ?
- জলঘোলা তো আপনিই করলেন পিসাবাবু। যাক যা হবার হয়ে গেছে। এখন রাতটা কেটে যাক । সকাল হলে না হয় তর্ক করা যাবে ।
নীলেশবাবু বুঝে নিলেন অম্বরীশ এমনি পালিয়ে যাবার ছেলে নয়। রাতে আর কোন কথা বললেন না। ঐন্দ্রিলাদেবী বললেন - ওকে পইপই করে বললাম। কথাই শুনল না। থেকে গেল ।
দীপু বলল - রূপু কোথায় ? ওকে তো দেখছি না ।
অম্বরীশ বলল - এত রাতে কেউ জেগে থাকে ? ক'টা বাজে দেখেছ ?
দীপু দৌড়ে দোতলার ঘরে যেতে পায়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল । সিঁড়ি বেয়ে গড়গড় করে নীচে গড়িয়ে এল । বেশ রক্তপাত হল । বাড়িশুদ্ধ সকলে মিলে চিৎকার করে উঠল। মাথায় বা কোথাও তেমন আঘাত লাগেনি। শুধু রক্ত পড়ছে ঠোঁট দিয়ে। সকলে ভয়ে এবং ভাবনায় অস্থির হয়ে পড়ল । নীলেশ বাবু একতলার ঘরে টেবিলের ড্রয়ার থেকে হোমিওপ্যাথি ওষুধ Hamamellis খাওয়ালেন। কিছুটা ঠোঁটে লাগিয়ে ক্ষতস্থান চেপে রাখলেন ।
রূপসা, ঐন্দ্রিলাদেবী কাঁদতে লাগলেন ।
দীপু বলল - তেমন কিছু হয়নি আমার । এই দেখো আমি ঠিক আছি।
তারপর রূপসার দিকে চেয়ে বলল - তোমরা ঠিক আছো তো ?
সবাই ঠিক ছিল । শুধু অম্বরীশের আগমন হেতু বেশ বিরক্ত হয়েছে বোঝা গেল।
নীলেশবাবু বললেন - তুমি এই মুহূর্তে বেরিয়ে যাও। নইলে গলাধাক্কা দিয়ে বাড়ির বাইরে বের করে দেব ।
অম্বরীশ বলল - আর তো কিছুক্ষন ! সকাল হয়ে এল বলে । ও হ্যাঁ, একটা চিঠি আছে। এখন দেব নাকি সকালে দেব ?
সকলে চুপ আছে দেখে চিঠিটা পকেট থেকে বের করে বলল - না থাক। সকালেই দেব। এখন শুধু শুধু বাটি রাতটুকু নষ্ট হয় কেন ?
নীলেশ দীপু দুজনেই গর্জে উঠল । চিঠি নিয়ে তুই ধুয়ে খা গে যা। তোর অনেক চিঠি দেখেছি। এত রাতে যদি গোলমাল বাধাস; গাঁয়ের লোক জড়ো করে পিটুনি খাওয়াবো ! ভালো চাস তো বেরো -
বলেই অম্বরীশকে টানতে টানতে নিয়ে পথে বের করে দিল ।
অম্বরীশ ' দেখে নেব' বলে চলে গেল।
মজা হল অম্বরীশ তো চলে গেল বাইরে ওর গাড়ি দাঁড় করানো ছিল তাতে চেপে। কিন্তু রাজ্যের চিন্তা সকলের মনে এমন প্রভাব ফেলল যে বাটি রাতটুকু বিনিদ্র থাকতে হল ।
-
