STORYMIRROR

Nityananda Banerjee

Classics Inspirational

4  

Nityananda Banerjee

Classics Inspirational

সংশপ্তক ( অষ্টবিংশতি অধ্যায়)

সংশপ্তক ( অষ্টবিংশতি অধ্যায়)

5 mins
250

অষ্টবিংশতি অধ্যায়

সর্বেশ্বরের শ্যেন দৃষ্টি এড়িয়ে বাউল যে কোথায় গেল নীলেশরঞ্জন এবং সর্বেশ্বর উভয়েই বেশ চিন্তান্বিত হয়ে পড়লেন । নীলেশ বললেন - তাহলে আমার আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত হল।

সর্বেশ্বর - তাই তো দেখছি। এবার থেকে বাউলদের উপর নজর রাখতে হবে। ভিক্ষার জন্য গ্রামে গেলে ---

নীলেশ মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন - ওদের ভিক্ষের দরকার হয় না । সবই এই গৌরীকুঞ্জ নামের আশ্রম থেকে বন্দোবস্ত করে দেওয়া হয়। প্রণামী বাক্সতে রোজ যথেষ্ট অর্থাগম হয়। 

এমন সময় বাউলদের ভেতর থেকে হট্টগোল উঠল - রাধাকৃষ্ণ মন্দিরের প্রণামী বাক্সটা পাওয়া যাচ্ছে না।

নীলেশ বললেন - ওই শোন । সর্ষের মধ্যেই ভুত। কি আর করবি! চল এবার বাড়ি যাই। নইলে সবাই চিন্তা করবে। 

ওরা দুজন নদীর পাড় ধরে হাঁটা দিল । সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হয়েছে। কৃষ্ণপক্ষের আকাশে অসংখ্য তারাদের ঔজ্বল্য কালিমা ভেদ করে নিজ নিজ অস্তিত্ব প্রমাণে উঠে পড়ে লেগেছে। একটা শেয়াল মানুষের পায়ের শব্দ শুনে লুকিয়ে পড়ল । মোবাইলের আলোতে পথটুকু শুধু দেখা যায় । দু'টি প্রাণী সচকিত চরণে এগিয়ে চলল।

গ্রামে ঢুকে কিছুটা গিয়েই সর্বেশ্বরের কাঁচা -পাকা বাড়ি। আর তার ঠিক উল্টোদিকে নীলেশদের দোতলা পাকা বাড়ি। খুব বড় নয়; তবে উপরে নীচে রান্নাঘর বাদে পাঁচ ছ'খানা রুম আর লম্বা বারান্দা । বারান্দাতেই বাড়িতে ঢোকার প্রবেশপথ । পিছনদিকে আর একটা দরজা আছে বটে ; তবে তা খুললে খামারবাড়ি এবং বাগান ছাড়া অন্য কিছু নেই। নীলেশ বাড়িতে প্রবেশ করলেন। বৌঠান তখন চা পান করছেন । দীপু কেমো ওষুধ খেয়ে মেরুদণ্ড সোজা রেখে একটা চেয়ারে বসে সকালের কাগজে চোখ বুলোচ্ছিল । রূপু হয়তো রান্নার তোড়জোড় করতে ব্যস্ত ।

নীলেশ দীপুকে বললেন - জানিস দীপু ! আজ একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। আমি আর সর্বেশ্বর মথুরাচণ্ডী---

নীলেশবাবু সব বৃত্তান্ত বললেন । শুনে দীপু বলল - মনে হয় এই প্রথম এরূপ ঘটনা ঘটল ।

বৌঠান বললেন - তোমরা কেন গিয়েছিলে ঠাকুরপো ? ওখানে অনেক কিছুই ঘটে। 

- কিন্তু বৌঠান ! আজকের ঘটনাটা একটু ভিন্ন রকম ।

- যেমনই হোক, ওদিকে দিনের আলো থাকতেই যেও। সন্ধ্যে থেকে রাতভর ওখানে অনেক কিছুই ঘটে।

নীলেশবাবু আর তর্কে গেলেন না। এক কাপ চা নিয়ে দীপুর পাশের চেয়ারে ভসে পড়লেন ।

পরের দিন সকালে আবার একটা নতুন খবর পেলেন। জনৈক জ্যোতিষী মহারাজ এসেছেন গ্রামে। তিনি নাকি অতীত, বর্তমান এমনকি ভবিষ্যত সম্পর্কেও সব কিছু গণনা করে বলে দিচ্ছেন ।

বৌঠান রূপুকে বললেন - যাও তো বৌমা সদর দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এস।

রূপু তাই করল। এখন আর বিমলা মাসী আসে না। ছেলে শঙ্করের সঙ্গে শহরে চলে গিয়েছে। তাই কারোর এখন আসার সম্ভাবনা নেই। শুধু গোরু চরানো রাখাল আসে - সে তো বিকেলে। 

নীলেশবাবু উপরে গেলেন। একবার পোস্ট অফিসে যেতে হবে। পেনশন এসেছে। 

তিনি দশটার পর বেরিয়ে গেলেন পোস্ট অফিসের উদ্দেশ্যে। হয়তো কেউ খেয়াল করেনি দরজাটা খোলাই ছিল । সেই ফাঁকে তিলক কাটা জ্যোতিষী ঢুকলেন বাড়িতে।

ঐন্দ্রিলা দেবী প্রশ্ন করলেন - এখানে কেন মহারাজ ? আমরা জ্যোতিষ- টোতিষে বিশ্বাস করি না। আপনি আসতে পারেন ।

জ্যোতিষী বললেন - কিন্তু মা ?

- কোন কিন্তু পরন্তু নেই। বাড়িতে পুরুষ মানুষ নেই; আপনি আসুন ।

- মা চলে তো যাবই; কিন্তু তোমাদের যে ভারী বিপদ ঘনিয়ে আসছে মা ?

চমকে উঠে রূপসা বলে - আবার কিসের বিপদ ? আমাদের তো বিপদ চিরসঙ্গী।

- না মা, এ অন্য ধরণের বিপদ । আইনঘটিত।

- কি রকম ? নিতান্ত ঔৎসুক্য নিয়ে এবার প্রশ্ন করেন ঐন্দ্রিলাদেবী।

জ্যোতিষী মনে মনে ' আ গই না লাইন পে ' বলে ঐন্দ্রিলাদেবীকে বললেন - আমাকে একটু বসতে দিন মা। আমি গণে পড়ে সব বিস্তারিত বলে দিচ্ছি।

কারও অনুমতির অপেক্ষায় না থেকে জ্যোতিষী বারান্দার মেঝেতে চক দিয়ে লাইন কাটতে কাটতে বললেন - এখানে এই বাড়িতে কিছুদিন আগে একটা খুন হয়েছে। 

চমকে উঠলেন ঐন্দ্রিলাদেবী এবং রূপসাও। তাহলে কি ইনি কোন গোয়েন্দা নয় তো !

জ্যোতিষী বললেন - আমার কথা যদি ঠিক হয়; তবে জানবেন অতি শীঘ্র আসামীকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। আর তখনই আর একটা বিপদ আসবে। আসামী মান বাঁচাতে দোতলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করবে। তাকে বাঁচাতে গিয়ে আরেকজন ----

চুপ করে গেলেন জ্যোতিষী । এ ছাড়াও এই বাড়িতে নিশ্চয় কেউ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে এবং তার মরণ প্রায় সুনিশ্চিত যদি না ....

ঐন্দ্রিলার পাংশুবর্ণ মুখ দেখে গোঁফের কোণায় হাসি ফুটল । এবার বললেন - মা ! আমি কি সত্যি বললাম না মিথ্যে ?

চুপ করে গেলেন ঐন্দ্রিলাদেবী এবং রূপসাও । দীপু এতক্ষণ জ্যোতিষীর কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিল । সেই রাতের ঘটনা তার চোখের সামনে ভেসে উঠল ।জ্যোতিষী ঠিক কথাই তো বলছেন ! কাকাবাবু চেয়ার তুলে অম্বরীশের মাথায় আঘাত করতেই ....

দীপু বলল - যত্তোসব আজগুবি।

জ্যোতিষী বললেন - মোটেও না। এ কথা তোমরা সবাইই ভালো করে জানো । গাঁয়ের মোড়লের জন্য তখনকার মত তোমরা বেঁচে গেলেও এখন দেখছি পাশা উল্টেছে।

ঐন্দ্রিলা দেবী বললেন - আপনার কাছে এর প্রতিকারের কোন উপায় আছে ?

জ্যোতিষী ভীষণ খুশি হলেন । তাহলে ঠিক জায়গাতেই ঘা দেওয়া গেছে। 

- আছে বৈ কি মা ! অবশ্যই আছে। বাগানবাড়ির বেলগাছের তলায় একটা গর্ত খুঁড়ে সেখানে আমি যে কবচটা দিয়ে যাব সেটা পুঁতে দিতে হবে এবং রোজ এক বালতি করে গোবর জলের ছড়া দিয়ে বাগানটা শুদ্ধ করতে হবে । এরপর...

দরজা খোলার আওয়াজ এল । নীলেশরঞ্জন ফিরেছেন। বাড়িতে অপরিচিত জ্যোতিষীকে দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন । ঐন্দ্রিলাদেবীর মুখ লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল । রূপসা ভেতরে ঢুকে গেল। শুধু দীপূ বলল - কাকাবাবু! এসেছ ? খুব ভালো হল। তখন থেকে এই লোকটা কি সব যা তা কথা বলে যাচ্ছে। বলছে এখানে খুন হয়েছে। আবারও একটা খুন হবে । জ্যোতিষী ধরা পড়ার আগে সেখান থেকে পালিয়ে গেল ।নীলেশবাবু পিছু ধাওয়া করলেন । 

জ্যোতিষী দৌড়চ্ছেন প্রাণপণ । সেই পরিচিত রাস্তা ধরে যেখান দিয়ে গতকালই নীলেশরঞ্জন এবং সর্বেশ্বর মথুরাচণ্ডী থেকে ফিরছিলেন। 

দামোদরের তীরবর্তী এই স্থানটি ছোট নাগপুর মালভুমির অন্তর্গত হওয়ায় স্থানে স্থানে টিলার মত ছোট বড় অনেক জমিতে পাথরের চাঁই রয়েছে। দৌড়তে দৌড়তে নীলেশবাবু হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন । আর তখনই সেই জ্যোতিষী চোখের আড়ালে চলে গেলেন। নেংচে নেংচে নীলেশ বাবু আর কতদূর যেতে পারেন ? তাঁকে ফিরতেই হল। পায়ে বেশ ব্যথা করছে। তবে জ্যোতিষী যে ওই গৌরীকুঞ্জের দিকেই চলে গেছে নীলেশবাবুর তা' বুঝতে একটুও সময় লাগল না। তিনি বাড়ি ফিরে সর্বেশ্বরকে ডেকে পাঠালেন। ঐন্দ্রিলাদেবী তাঁর এই দুর্দশার জন্য নিজেকে দায়ী করলেন। ইস ! যদি ওকে প্রথমেই তাড়িয়ে দেওয়া যেত ! সর্বেশ্বর এসে নীলেশকে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গেলেন। প্রাথমিক চিকিৎসার পর এবং ব্যথা কমানোর ওষুধ দিয়ে ডাক্তারবাবু বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন । 

নীলেশ বললেন - লোকটার গতিবিধি সন্দেহজনক। 

সর্বেশ্বর বললেন - ওকে বাড়িতে আটক করে রাখলে এসব ঘটত না। যাই হোক। যা হবার তা হয়ে গেছে। এবার আমাদের কাজ হল ওকে পাকড়াও করা। এজন্য আমাদের ছদ্মবেশ নিয়ে ওই আখড়ায় বাউল সেজে যেতে হবে। ভেতরে থাকতে না পারলে ওকে ধরা চাট্টিখানি কথা নয় ।

নীলেশ বললেন - আইডিয়াটা বেশ ভালো। কিন্তু আমি পায়ের ব্যথা নিয়ে যাই কি করে ?

- সে ভাবনা আমার । আমিও খোঁড়া সেজে তোর মতই হাঁটা চলা করব। উপরন্তু আমি অন্ধের ভূমিকায় থেকে আর তুই পথ দেখানোর ভূমিকায় অভিনয় করে ওখানের সকলের মন আকৃষ্ট করব । আমি বাউল গান গাইতে জানি। তুই শুধু একতারাটায় টুং টুং শব্দ করে যাবি। আর এটা আজ দুপুরেই করতে হবে । 

কৃতজ্ঞতা জানিয়ে নীলেশ বললেন - কি দারুন আইডিয়া !


( ক্রমশ )



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics