STORYMIRROR

Arindam Ghosh

Fantasy

4  

Arindam Ghosh

Fantasy

সময়ের ফাঁদে বন্দী

সময়ের ফাঁদে বন্দী

10 mins
395

■ গল্পের নাম: সময়ের ফাঁদে বন্দী

■ লেখকের নাম: অরিন্দম ঘোষ

******************************


সাতসকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি যে একটা শালিক পাখি জানালায় বসে আছে। কত করে খুঁজলাম, আরেকটা শালিকের দেখা মিলল না। এক শালিক দেখলে কী যেন হয়? যাক গে! অতশত ভেবে কাজ নাই। চটজলদি তৈরি হয়ে অংক কোচিং সেন্টার-এ ছুটলাম। আজকে আবার জলদি কলেজ যেতে হবে।


    রাস্তায় একটা কুচকুচে কালো বিড়াল পথ কাটল। থমকে দাঁড়াবার সময় হাতে ছিল না। কোচিং সেন্টার-এ ঢোকার মুখেই একজন ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, ক'টা বাজে? আমার সাদা মনে কোনো কাদা নেই। বললাম, সাতটা বাজে।


    কোচিং সেন্টার-এ ঢুকেই দেখি ভবতোষ স্যার পরীক্ষা নিচ্ছেন। এই খবরটা জানা ছিল না। এখন তো পালাবার কোনো উপায় নেই। নাম্বার কম পেলেই 'গার্জেন কল' । তার উপর মধুমিতার সামনে আমার প্রেস্টিজের গ্যামাক্সিন হয়ে যাবে।


     পরের দুই ঘন্টা কাটল ব্যাপক চাপের মধ্যে দিয়ে। জানপ্রাণ লড়িয়ে দিলাম খাতার পাতায়- অংকের সঙ্গে যুদ্ধ করে। আজকের দিনটাই খারাপ। সে'খান থেকে দৌঁড়ালাম কলেজের উদ্দেশ্যে।


     দেখি, মেট্রো অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ। কানাঘুষো শুনলাম, কে যেন লাইনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। যাই হোক, মামুর ট্রেন তো আছে - 'অগতির গতি'। ট্রেনে যাতা রকমের ভীড়। সে যাই হোক, 'নাই মামার চেয়ে কানা মামা তো ভালো'।


     মুস্কিলটা হল, ট্রেনে তো কোনোমতে উঠলাম; কিন্তু নামবার পরপরই আবিষ্কার করলাম পকেট বিলকুল 'গড়ের মাঠ'। 'ঘাটের মড়া' পকেটমার আর কাউকে পেল না, ছিল তো সর্বসাকুল্যে কুড়ি টাকা বারো আনা পয়সা (একটা চার আনা আর একটা আট আনা)। আজ থেকে প্রায় বছর কুড়ি আগের কথা- তখন এই টাকা যথেষ্টই হাতখরচ ছিল কলেজের জন্য আর তখনও উচ্চমাধ্যমিক কলেজে পড়ানো হত।


     যথারীতি শিয়ালদা স্টেশনের গেটে 'চেকার মামু' ধরল। আমিও বুদ্ধি করে চিল্লিয়ে বললাম, এই পরেশ, কাকুকে আমাদের টিকিট দেখা - বলেই পগাড় পার হলাম। বাস ধরে কলেজে গিয়ে দেখলাম, জয়শ্রী ম্যামের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। আমি ঢোকবার পারমিশান চাইতেই ম্যাম বললেন, ক'টা বাজে? আজকের মত অ্যালাও করলাম...লেট করলে আমার ক্লাসে ঢুকবে না।


    গ্যালারীতে গিয়ে বসলাম। জয়শ্রী ম্যাম 'কালার চক' দিয়ে ব্লাকবোর্ডে কি যেন লিখছেন। ববকাট চুল ঠিক করতে যেতেই ও'নার একপাশের ব্লাউজের হাতা মসৃণ ত্বকে পিছলে নেমে গেল নিচে। সামনের ছেলেগুলোর 'চক্ষু ছানাবড়া' হয়ে ভেতরের ট্রান্সপারেন্ট ব্রায়ের স্ট্রাপ দেখেই। তারপর চকটা নিচে পড়ে যেতেই উনি ঝুঁকে তুলতে যেতেই বক্ষ বিভাজিকা বিপদজনকভাবে উন্মুক্ত হল।


     


     সামনের দিকের চার-পাঁচজন ছেলেরা দৌঁড়ে গেল চক কুড়িয়ে দিতে- সেই সুযোগে আমিও ফার্স্ট বেন্চে গিয়ে বসলাম। এই কারণে কোনো গন্ডমূর্খও ফিজিক্স ক্লাস মিস করে না।


     কিন্তু আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না কেন ? ভৈরবকে জিজ্ঞাসা করলাম, কিরে ম্যাম বোর্ডে কী লিখছেন ? ভৈরব বলল, জলদি অপটিক্সের অংকগুলো নামিয়ে ফেল তো গুরু.... আমি তোর থেকে টুকব। এ'দিকে আমি তো খালি পেছন থেকে 'ম্যামের অপ্টিক্স' ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না, বোর্ডের লেখাগুলো সব ঝাপসা লাগছে।


     আমি হাত তুলে দুরুদুরু বুকে দাঁড়িয়ে গেলাম। ম্যামকে বললাম, আমি বোর্ডের লেখা কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আমি কি আপনার পাশে গিয়ে বোর্ড থেকে অপটিক্সের অংক লিখতে পারি?


     ম্যাম দু'মিনিটের জন্য 'সাইলেন্ট মোডে' চলে গেলেন। আমার চোখে কি দেখলেন জানি না। বললেন, ভাস্কর, আমার পাশে চলে এস। হিংসায় তখন সমস্ত ক্লাশ জ্বলছে, দু-একটা বাজে কমেন্টও কানে এল। আমি 'দুগ্গা দুগ্গা' করে ডায়াসে ম্যামের ডেস্কের দিকে এগোলাম।


     জয়শ্রী ম্যাম বললেন, তোমার কি চশমা আছে ? আমি বললাম, না, ম্যাম। উনি বললেন, ঠিক আছে। তুমি অংকগুলো তুলে নাও আর আই চেকআপ করো। কি একটা পারফিউমের গন্ধ আমার চেতনাকে অবশ করছিল .... মনে হচ্ছিল, এর থেকে ভালো দিন আমার জীবনে আর আসেনি।


     ক্লাশের পর ক্যান্টিনে বসে গুলতানি আর দিদিদের সঙ্গে ইয়ার্কি মারতে মারতে আবিষ্কার করলাম, আমার আঙ্গুলের মুক্তোর আংটিটা নিঃখোঁজ। অনেক খুঁজেও পেলাম না। বাড়ি গেলেই উদোম ঝার পড়বে। অনেক সাধ্যসাধনা করে 'মাদার ইন্ডিয়া' এই আংটিটা আমার কুষ্ঠিবিচার করিয়ে গ্রহশান্তির জন্য পড়িয়ে ছিলেন। আবার মুডটা অফ হয়ে গেল।


     যত দোষ এই অপয়া ঘড়িটার- ভেবে দেখলাম, সাতটা বাজে বলবার পর থেকেই একের পর এক খারাপ ঘটনা ঘটে চলেছে আমার সঙ্গে। কি কুক্ষণে যে এই নতুন ঘড়িটা আজকে পড়ে বেড়োলাম? গুনে দেখলাম, চারটে বাজে ঘটনা ইতিমধ্যে আমার সঙ্গে ঘটে গেছে- তবে কি আরো তিনটে বাজে ঘটনা ঘটা বাকী! চীনাপট্টির অনেকটা ভেতরে একটা পুরানো জিনিসের দোকানে খুবই অল্প মূল্যে ঘড়িটি আবিষ্কার করে নিজেকে কলম্বাসের মতো লাগছিল..... কিন্তু..... সব্যসাচীর চিৎকারে চিন্তার জাল ছিন্ন হল।


- কিরে ভাস্কর! ম্যামের ধ্যান করছিস নাকি? ক'টা বাজে বল তো...


- একটাও বাজে না.... স-ব ভা-লো.... স-ব ভা-লো...


                               *************

             ॥ ২ ॥


আমাদের চলার পথে কিছু লোকজন বোধহয় সবসময় থাকে, যাদের একমাত্র কাজ হল অন্যদের হাতে ঘড়ি দেখলেই সময় জানতে চাওয়া। কলেজ শেষে হেঁটে শিয়ালদা যাওয়ার পথে অন্ততঃপক্ষে তিনজন ভদ্রলোক আমায় 'ক'টা বাজে' জানতে লাগল।


     অদ্ভূত ব্যাপারটা হল, আমরা তিনজন বন্ধু মিলে হাঁটলেও, সময়ের প্রশ্নবাণ আমার দিকেই ধেয়ে আসতে লাগল। প্রতিবারই হাবভাব এমন দেখালাম যেন কানে কিছুই শুনতে পাইনি।


     এমনিতেই ব্যাপক চাপে ছিলাম। পকেট 'গড়ের মাঠ'। শিয়ালদা গিয়ে দেখি মামুর ট্রেন অনির্দিষ্ট-কালের জন্য বন্ধ। ধর্মঘটের জন্য পাবলিক রেললাইনে অনশনে বসেছে। আর এ'দিকে পাপীতাপীরা রেলের ডিসপ্লে বোর্ডের দিকে চাতক পাখির মত জলের আশায় চেয়ে রয়েছে।


     আমার কেমন যেন খুশী খুশী ভাব আসছে। আরেকটা বাজে ঘটনা ঘটে গেল বোধহয়। আর মাত্র দু'টো বাজে ঘটনা ঘটা বাকী! এই যা কেলো করেছে.... আমার কাউন্টিং যদি ভুল হয়!


     ঠেলাঠেলি করে বাসেই উঠলাম। আমার সঙ্গে রয়েছে শুধু সুরজিৎ। বাসের টিকিটটা সুরোজিৎ কেটে দিল। গোল বাঁধল শ্যামবাজারে সুরোজিৎ নেমে যাওয়ার পরপরই। অনেকক্ষণ থেকেই ভীড় বাসে চিল্লাচিল্লি চলছিল। আচমকা এক সুন্দরী ভদ্রমহিলা চিলচিৎকার জুড়ে দিলেন, চো-র... চো-র .... আমার সর্বস্ব নিয়ে পালালো।


     যথারীতি আশপাশ থেকে গোটা দশেক যুবক বডিগার্ডের আবির্ভাব হল। এ বলে আমায় দেখ- তো ও বলে আমায় দেখ। আমি নিস্পৃহভাবে ঘটনা থেকে দূরে ছিলাম। ভীমসেনের মত সাড়ে ছয়-ফুটিয়া একজন এগিয়ে গিয়ে বলল, ম্যাম, আপনার কি চুরি হয়েছে? ভদ্রমহিলা বললেন, আমার পার্সের তলা ব্লেড দিয়ে কেটে পকেটমার সব টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।


    তারপর কান্নাভেজা গলায় শাড়ির আঁচলটা ঠিক করতে করতে তিনি বললেন, আমার অনেকক্ষণ থেকেই সন্দেহ হচ্ছিল। আমি তাকিয়ে দেখলাম, মডার্ন শাড়ি ঠিক করার ছুতোয় সুন্দরী ভদ্রমহিলা নিজের শরীরের রহস্যময় নাভি আর পেট আরো খানিকটা উন্মোচিত করলেন। হাতে রুমাল নিয়ে বললেন, আরে ! ঐ ছেলেটাই তো পকেটমার- বলেই আমার দিকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করলেন।


     এরপর আর গায়ক অঞ্জন দত্ত 'রঞ্জনা আমি আর আসব না' বলারও সময় পেত কী না সন্দেহ! ছয়-ফুটিয়া ভীমসেন তার নয়জন অনুচরকে নিয়ে আমার দিকে ভীড় ঠেলে এগোতে লাগল। বিপদ বুঝে ড্রাইভার বাস থামিয়ে দিয়েছে।


     আমি শুনেছিলাম, এইসব পকেটমারেরা দলবল নিয়েই বাটপারি করে। কিন্তু আমার কথা বিশ্বাস করবে কে? গণধোলাই-এর হাত থেকে কে বাঁচাবে আমায়? সুন্দরী ভদ্রমহিলাকে ইমপ্রেস করার জন্য আমায় ভিলেন বানিয়ে কেলানি দেবে পাবলিক - এ'বার এই বাজে ঘটনাকে কাটাব কি করে? তবে কি এই আমার শেষ বাজে ঘটনা? এরপর বাঁচলে তো পরের বাজে ঘটনার সম্মুখিন হব!


                            




              **********

             



              ॥ ৩ ॥


সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে যা করার করতে হত। আমি তিনটে কাজ করলাম- কে জানে কোনটায় কার্যসিদ্ধি হবে- 'আপনি বাঁচলে বাপের নাম'!


      প্রথমতঃ বাসের জানলা দিয়ে পুরানো-মডেলের দমদেওয়া চীনামাল রিস্টওয়াচটি রাস্তায় ছুঁড়ে দিলাম। যদি রিস্টওয়াচটির জন্য এইসব বাজে ঘটনাগুলো ঘটে থাকে; তাহলে এই বাজে ঘটনাটির স্রোতকে থামানো যাবে এই আশায়- অবশ্য রিস্টওয়াচ'টি বন্ধ হয়ে গেলেই বাঁচা যাবে !


      দ্বিতীয়তঃ আমার পাশে দাঁড়ানো গোবেচারা-টাইপ স্কার্ট-ব্লাউজ পরিহিত স্কুলগার্লটিকে টার্গেট করলাম। মনে হল, মেয়েটি ক্লাস এইটের হবে। কিছু বোঝার আগেই, মেয়েটিকে আচমকা কাঁধ দিয়ে 'ফুটবলের পুশ' মারলাম।


      একদম নিঃখুঁত পুশ। কত স্ট্রাইকার এই পুশে পরাস্ত হয়েছে- কোনোদিন ফাউল খাইনি, আজও খেলাম না। মেয়েটি হঠাৎ পড়ে যেতেই নাটকের শুরু হল! মধ্যবয়স্ক কয়েকজন ভদ্রলোক হামলে পড়লেন, মামনি কী হল? শরীর খারাপ লাগছে? দাও দাও..... ব্যাগটা আমাকে দাও..... উফ, এই বয়সে এতো ভারী ব্যাগ ! জল দাও.... জল । মাথা ঘুরে গেছে মনে হয়.... যা গরম পড়েছে.....


      তৃতীয় কাজটি করার মুহূর্ত উপস্হিত। আমি তালেগোলে চিল্লিয়ে উঠলাম, বোম.... বো-ম..... বো-ম....পা-লা-ও......পা-লা-ও ! ব্যাস....মুহূর্তের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে গেল। ভীমসেন আর তার নয়জন সাথীরা যেই এগোতে গেল, তাদের উপর কীল-চড়-ঘুসির সম্মিলিত প্রহার পড়তে লাগল। হঠাৎ করেই ভদ্রমহিলারা স্যান্ডেল-ভেনিটিব্যাগ সহযোগে হামলা হানল। পার পেল না সেই সুন্দরীটিও.... একজন ষন্ডামার্কা ভদ্রমহিলা তার চুলের মুঠি ধরে জানালায় ধমাস করে আছাড় লাগাল।


       মোটের উপর প্রাণভয় যে গুন্ডা-পকেটমারদের মোটেই রেয়াত করে না, তা আবার প্রমাণিত হল। আমি কী করলাম? মনের সুখে কেলাকিলি দেখে 'নয়ন সার্থক' করে হামাগুড়ি দিয়ে সকলের পায়ের তলা দিয়ে দরজা দিয়ে বেড়িয়ে বাসের বাইরে গিয়ে চোঁচা দৌড়।


       পেছনে একবার তাকিয়ে দেখলাম, ট্রাফিক মামু ( পুলিশ ) কেস দিতে এসে গেছে। এ'বার নিশ্চয়ই 'বম্ব স্কোয়াড' আসবে। আমি মানেমানে কেটে পড়লাম। কাছেই শিবব্রত'র বাড়ি- সদর দরজা দেখলাম খোলাই আছে, ঘরে ঢুকে আগে দরজা বন্ধ করলাম। তারপর নিশ্চিন্তে কাকিমাকে ডেকে বললাম, কাকিমা পেটে ছুঁচোয় ডনবৈঠক মারছে। যা দেবে খাবো.... আজকে যা ঘটল.... উফ.... শিবুটা আবার কোথায় গেল?





             *********


            ॥ ৪ ॥


লুচি-আলুরদম'টা বিন্দাস সাটাচ্ছিলাম.... তখনি এন্ট্রি নিল শিবু ওরফে শিবব্রত। আমি কোনোমতে খাবারটা গলায় নামিয়ে বললাম, কিরে কোথায় চরে বেড়াচ্ছিস ? আজকে কলেজ..... আর কিছু বলতে পারলাম না। মুখটা চেপে ধরল শিবু। ইশারায় মুখে আঙ্গুল চেপে চুপ করতে বলল। বলল, এই একটু বুথে ফোন করতে গিয়েছিলাম।


      আমি চোখ বড় বড় করে বললাম, তাই বল.... এবার জানলাম। তা এসটিডি বুথের মেয়েটার নাম কি ? ক'দিন ধরে লাইন মারছিস ? তখনও ব্যাপকহারে মোবাইলের প্রচলন হয়নি, এসটিডি আর লোকাল কলের বুথ সর্বত্রই ছিল।

শিবু বলল, আরে না না...তোরা বুঝবি না... তোদের মত সোনার চামচ মুখে করে তো আর জন্মাই নি। এই দ্যাখ দশটা একটাকার কয়েন উদ্ধার করলাম পাবলিক টেলিফোনের থেকে।


      শিবুর এই একটা ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা ছিল - 'মাছের তেলে মাছ ভাজার'। ওর গার্লফ্রেন্ডকে পাবলিক বুথ থেকে একটাকার কয়েনে বিন্দাস ফোন করত, কিন্তু নিজের একটাকাও খরচ করত না। অদ্ভূত কায়দায় একের-পর-এক কয়েন বের করে ফেলত ফোন কাটার হাতলের সাহায্যে। আমি অন্ততঃ জানতাম, সরকারের এই পাবলিক ফোন উঠে যাবে শিবুর মত গোটা দশেক খচ্চর পাবলিক থাকলেই। যাই হোক, আমার কিস্যা শুরু করলাম, জানিস তো আজকে কি হয়েছে.....


            *********


             ॥ ৫ ॥


শিবু 'এক কথায় প্রকাশ'-এ এক্সপার্ট ছিল। খুব সহজেই আমার সমস্যার সমাধান করে দিল। বলল, তোর ঘড়িটা আমায় দিয়ে দে। বুঝলি ভাস্কর, এ'সব তোদের মত ভালো ছেলেদের জন্য নয় - আমাদের মত 'লাথখোর'দের জন্য।


      আমি বলতেই যাচ্ছিলাম, ও আপদ বিদেয় করে দিয়েছি; কিন্তু পিঠের-ব্যাগটা কী যেন কারণে খুলতেই দেখি, সামনেই সেই রিস্টওয়াচ ! রাস্তায় যে অপয়া ঘরিটাকে ফেলে দিলাম - সে'টা এখানে আবার কী জাদুবলে ফিরে এল ? আমার মুখের ভাবসাব দেখে শিবু বলল, ও কিছু না.... চাপ নিস না। তুই যা চাপে আছিস, আমি তোকে বাড়ি পৌঁছে দেব।


     শিবুর সঙ্গে কথা বলে বেশ ফুরফুরে লাগছিল। কিন্তু ওকে ঘড়িটি দিতেও মন চাইছে না। জেনেবুঝে কাউকে বিপদে ফেলতে ইচ্ছা করছিল না। যাই হোক, শিবু কিছুতেই মানল না। জেদাজেদি করে ঘড়িটা ও'র কাছেই রেখে দিল। বলল, আমার একজন তান্ত্রিকবাবার সঙ্গে যোগাযোগ আছে -ক্যাওরাতলার মহাশ্মশানে মাঝেমধ্যে আসেন , ও'নাকে তোর ঘড়িটা দেখাবো।



        শিবু আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিল। সত্যিই আর কোন বাজে ঘটনা ঘটল না। কিন্তু আমার হিসাবে তো আর একটা বাজে ঘটনা ঘটা বাকী ! তবে কি ঘটনাগুলো শুধু আমার সঙ্গেই ঘটবে ? শিবুর সঙ্গে ঘড়িটা থাকায় কি কিছু বাজে ঘটনা ঘটছে না ?



                                    ************


               ॥ ৬ ॥



রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে অবধি কিছুই ঘটল না। অর্থাৎ, সপ্তম বাজে ঘটনাটা ঘটল না। ভাবলাম, শিবুর ভাগ্যের কল্যাণে এ যাত্রায় বাঁচা গেল। খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে একটু এফএম রেডিওটা চালিয়ে দিলাম। ক্যাসেট শুনতে মন করায় আমার ফেবারিট আর.ডি.বর্মণ আর আশা ভোঁসলের ক্যাসেটটা চালিয়ে একটু অংক করব ভাবলাম।


      কিন্তু টেবিলের দিকে তাকাতেই আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল যেন - টিক্ টিক্ করে শব্দটাও যেন শুনতে পেলাম - রিস্ট ওয়াচটা টেবিলের উপর কী করে আসল ?


     তবে কী এই ঘড়ি আমার পিছু ছাড়বে না ? একটা কথা তখুনি মাথায় আসায় আরো ভয় পেয়ে গেলাম - ঘড়িটাকে তো আমি বাসের জানলা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলাম। আপদ বিদায় হয়েছে ভেবে রিল্যাক্স হয়ে গিয়েছিলাম আর ভুলেও গিয়েছিলাম।


     আচ্ছা.... তাই যদি হবে তাহলে শিবু ঘড়িটা যখন চাইল তখন ঘড়িটা আমার ব্যাগের মধ্যে এলো কী করে? দেখেছেন, তালেগোলে আমিও ভুলে গেছি আর আপনারাও আমায় জিজ্ঞেস করেননি, কেন বলুন তো?


     ব্যাপারটা এতোক্ষণে জলের মতো পরিস্কার হয়ে আসছে- এই অভিশপ্ত ঘড়ির হাত থেকে আমার মুক্তি নেই। আরে তাই তো ! একটু আগেই তো দেখলাম, প্রায় বারোটা বাজছে দেওয়াল ঘড়িতে। হিসাব অনুযায়ী এখন রাত বারোটা বেজে যাওয়ার কথা। আর পরের দিন শুরু হয়ে যাওয়ায় আমি বিপদমুক্ত।


     আমি তাড়াহুড়ো করে একছুটে গেলাম দেওয়াল ঘড়িটা দেখতে। তারপর একটা একটা করে ঘরের প্রতিটা ঘড়ি পরীক্ষা করলাম! কি আশ্চর্য! এও কি সম্ভব? প্রতিটা ঘড়ির কাঁটা বারোটা বাজতে ঠিক সাত মিনিট আগে আটকে রয়েছে! আপনারাই বলুন প্রতিটা ঘড়ির একই সময়.... এতো অসম্ভব ব্যাপার! আমার কেমন যেন মনে হতে লাগল, এসব আয়োজন শুধুমাত্র আমারই জন্য.... এই সম্পূর্ণ নাটকের জাল আমার জন্য পাতা হয়েছে।


    ঠিক যা ভেবেছি তাই, ঐ অভিশপ্ত ঘড়িটাতেও একই সময়। আমি পালাবার চেষ্টা করলাম আমার ঘর থেকে। হঠাৎ দরজাটা দমাস্ শব্দে বন্ধ হয়ে গেল। অনেক টানাটানি করেও খুলতে পারলাম না ।


    ঠিক সেই মুহুর্তে টিউব লাইটটা বন্ধ হয়ে গেল। ঠিক সেই মুহুর্তে বাইরে বিশাল ঝড়বৃষ্টি শুরু হল - তীব্র সোঁ সোঁ হাওয়ায় জানলার কপাট খুলে গেল। কিছুতেই বন্ধ করা গেল না।


     ঘরে একমাত্র ঊজ্জ্বল ঐ ঘড়িটির কাঁটাটি রেডিয়ামের মতো জ্বলতে লাগল। কিন্তু এখনো বারো'টা বাজতে সাত মিনিট বাকী? আমি দরদর করে ঘামতে লাগলাম..... ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপতে লাগল.... গলা দিয়ে কোনো স্বর বেড়োচ্ছে না.... বারোটা বাজুক চাই নাই বাজুক, আমার যে বারোটা বেজে গেছে, তা বুঝতে কোন ভুল হল না।


     হঠাৎ কানে তালা-লাগানো পাশবিক চিৎকার শুনতে পেলাম। তার সাথে প্রচন্ড গতিতে আসা ঝড়ের সাইসাই শব্দ। কিছু বোঝার আগেই প্রচন্ড একটা ঘূর্ণিঝড় জানলা দিয়ে আমার ঘরে প্রবেশ করলো; তার মধ্যে সমস্ত নরকঙ্কাল, করোটি আর বীভৎস দেখতে কিছু জীব।


     আমাকে তুলে নিল সেই ভয়ানক ঘূর্ণিঝড়....আমি গোলগোল করে ঘুরতে লাগলাম তার মধ্যে..... সময়ের ফাঁদে বন্দী হলাম আমি.... তবে কী ঘড়িটায় দম দেওয়ায় খুলে গেছে বিশেষ সময়ে বিশেষ অন্য কোনো জগতের অদৃশ্য দরজা? হয়ত আমরা জানি না, আমাদের আশেপাশেই আছে অন্য জগতে যাওয়ার চাবিকাঠি... ভুলবশত সেই দরজা খুলে যেতেই পারে.... কী বলেন আপনারা?


                                                                 (সমাপ্ত)

                               ************


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Fantasy