মাপকাঠি
মাপকাঠি
এলাকার সবকটি বিদ্যালয়ের পরিদর্শন শেষ করে সবশেষে আদর্শ বিদ্যামন্দির বিদ্যালয়ে পৌঁছালাম।
বিদ্যালয়ের ভেতরে ঢুকতে গিয়েই পায়ে একটা হোঁচট খেলাম। সময়ের কি নিষ্ঠুর খেলা! ভবিতব্য-ই হয়ত মানুষকে পুনরায় আগের স্হানে ফিরিয়ে দেয়।
সেদিনও এভাবেই নবম শ্রেণীকক্ষে ভূগোল পড়া ভুল করে সবার সামনে শাস্তিগ্রহণ করতে যাওয়ার সময় হোঁচট খেয়েছিলাম। নিশীথ মাস্টারের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ছিল অন্যান্যদের থেকে বেশ আলাদা।
ভূগোলের নিশীথ মাস্টার ডানহাতটা সামনে নিয়ে তর্জনী আর মধ্যমার মধ্যে পেন রেখে চাপ দিয়ে বলেছিলেন, "তোর দ্বারা কিচ্ছু হবে না অনিন্দ্য! তোর অভিভাবকরা বেকার ভস্মে ঘি ঢালছেন।"
অপমানে মুখচোখ লাল হয়ে গিয়েছিল। ব্যথার থেকেও যে অপমানের জ্বালা বেশি, সেদিন বুঝেছিলাম।
তারপরের বিদ্যালয়ের দিনগুলো আমার কাছে সাদা-কালো ছায়াছবির মতো ছিল। আমার হাজিরা কমতে লাগল বিদ্যালয়ে; বিশেষ করে যেদিন নিশীথ মাস্টারের ক্লাস নেওয়ার থাকত, সেদিন আমার অঘোষিত ছুটি থাকত। এর জন্য অভিবাবকদের ডাকাও হয়েছিল বিদ্যালয়ে আর আমার কপালে জুটেছিল আরো একচোট অবমাননা। অবশ্য বাড়িতে তখন বাবার বেতের মলম ছিল অনেক রাতে লুকিয়ে মায়ের আঁচলে বসে কান্না।
তবুও আমার সংকল্প থেকে একচুলও সরাতে পারেনি কেউ, একলব্যের মতো নিশীথ মাস্টারকেই গুরু মেনে নিভৃতে ভূগোলের সাধনা করে গেছি। মাধ্যমিকে ভূগোলো সর্বাধিক নাম্বার আমারই ছিল আর উচ্চ মাধ্যমিকের পর ভূগোল নিয়েই আমি গ্রাজুয়েশন আর মাস্টার্স ডিগ্রী হাসিল করি। সত্যি বলতে কী, ভূগোলের প্রতি বিতৃষ্ণাকে ভালোবাসায় পরিণত করার জন্য নিশীথ মাস্টারের অবদান ছিল অনস্বীকার্য!
তবে বি.এড আর এম.এডের পর বিদ্যালয় পরিদর্শকের চাকুরি পাওয়াটা মোটেও সহজ ছিলনা। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, শুধু মেধার জোরে সরকারী চাকুরি জোগাড় করাটা কতটাই কঠিন। শুধু প্রতিজ্ঞা করেছিলাম বলেই এই পথের শেষ দেখাটাও জরুরী ছিল।
বারো বছর পর আবার সেই পুরানো বিদ্যালয়ে পরিদর্শকের কর্মসূত্রে এসে এবার প্রধান শিক্ষকের কক্ষে প্রবেশ করলাম। উনি তাড়াতাড়ি করে উঠে দাঁড়িয়ে আমায় অভিবাদন করে বললেন, “স্যার আমায় ডেকে নিলেই তো পারতেন। এতোটা পথ কষ্ট করে আসলেন।” আসলে, কাউকে কোনো বার্তা না দিয়ে আসাটা আমার স্বভাব; কাজটাকে আমি ভালোবেসে নিজের মতো করে করতেই বেশী পছন্দ করি।
আমি নিশীথ মাস্টারকে প্রণাম করে বললাম, “আমায় চিনতে পারলেন না স্যার? আমি তো আপনারই হাতে-গড়া ছাত্র অনিন্দ্য চৌধুরী।”
