স্মৃতির স্মরণী
স্মৃতির স্মরণী
"শ্রাবনের ধারার মতন পড়ুক ঝরে ,পড়ুক ঝরে", ভোরের বেলায় রোজের মতন পাশের বাড়ির পরমাদি গান গাইতে বসেছে। টিনের চালের উপর ঝরে পড়া হালকা বৃষ্টির শব্দ আর গানের সাথে রোজকার মতন আমার ঘুম ভাঙলো। গলাটা একটু ব্যাথা করছে কে জানে মনে হয় ঠান্ডা লেগেছে।
চোখ খুলে মনে পড়লো কালকে যেন কি করছিলাম রাত্রে। সামনে দেখলাম ছোটবেলার ফটো অ্যালবাম বের করে রাখা।
ফ্ল্যাটে একা থাকতে থাকতে মন কেমন করছিলো বলে বের করেছিলাম ,কে জানে মনে হয়ে দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছি ।
হালকা হাওয়া এলো জানালাটা দিয়ে ,জানালাতে ঝোলানো উইনচাইম টা আপন মনে টুং টাং শব্দে নেচে উঠলো। সামনে অ্যালবামের একটা পাতা উল্টে গেলো।
লাল একটা জ্যাকেট পড়া ছোটবেলার আমার ছবি,খুব প্রিয় ছিল জ্যাকেট টা ,জ্যাকেট টা একটু ছিড়ে গিয়েছিলো,রাস্তায় পড়ে গিয়ে,তাও এটাই পড়তাম।
কিভাবে যেন ছিড়েছিলো ,ভেসে যেতে লাগলাম সেদিনের ঝাপসা স্মৃতি তে।
"বাবু টাটা করে দাও মা কে ",মা প্রতিদিনের মতন স্কুলে বেরোচ্ছে।
আমি ভাবছি মা বুঝি আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে ,"মায়ের সাথে যাবো।...মা যেও না' ...
মা কে দেখছি কেঁদে ফেলেছে আমাকে দেখে ,আমি রাস্তা দিয়ে দৌড়াতে গেলাম আর পড়ে গেলাম ,চোখ ঝাপসা হয় গেছে কাঁদতে কাঁদতে, বাবা এসে তুলে ধরলো ,মা কে বললো "তুমি যাও আমি দেখছি " .
আমাকে ধরে তুলে বললো "চ ঘুরতে যাবো দুজনে"। হাতটা ধরে তুলে জামা ঝেড়ে চোখ মুছতে মুছতে চললাম বাবার হাত ধরে। সেই শুরু তারপর থেকে রোজ বাবার একই কাজছিলো।
একদিন বাবা দেখি বাইরে থেকে ফিরে এসে বসে ,মা জিগ্গেস করছে কি হলো ?
বাবা ধীরে বললো আমরা দুজন একসাথে কাজ করলে ছেলেকে মানুষ করতে পারবো না ,তাই কারখানা তা বিক্রি করে দিয়ে এলাম।
তখন শুধু খুশি হয়েছিলাম বাবার সাথে বেশিক্ষণ খেলতে পাবো বলে।
পরে বুঝেছিলাম বাবার প্রিয় ছোট কারখানা তা বিক্রি করতে কতটা কষ্ট পেতে হচ্ছিলো। আর সেই সময়ে যদিও ওমেন্স ইকুয়ালিটি এসব শব্দ খুব বেশি প্রচলিত হয়নি তা সত্ত্বেও বাবা মা কে বলেনি চাকরি ছাড়তে ,যুগের থেকে হয়তো খানিকটা এগিয়েই ছিল মনোভাব।
কি খেয়ালে ভেবে যাচ্ছিলাম,নিচের চায়ের দোকানের প্রেসার কুকারের আওয়াজে ঘোর টা কাটলো।
"বাবু খেয়ে না স্কুলে দেরি হয়ে যাবে " ,হ্যান বসছি
"আজকেও একই খাবার? সেই ভাত ডাল মাছ ভাজা ?" অন্য কিছু দিতে পারো না?
মায়ের স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হতো বলে স্কুলের জন্যে প্রস্তুত করার দায়িত্ব বাবার কাঁধেই থাকতো। রাগ করতাম আমি খাবার এর ব্যাপারে ,কিন্তু তখন ধারণা ছিল না বাবা আমার জন্মের আগে কোনোদিন রান্না করেনি, তাই অপটু হাতে রান্নাহলেও চেষ্টার ত্রুটি থাকতো না।
না জেনে কত কিছুই না বলেছি ,একটা দীর্ঘই নিঃস্বাস বেরিয়ে এলো। গলার কাছটায় একটু জ্বালা দিচ্ছে। কে জানে হয়তো জমা হওয়া কান্না জড়িয়ে আটকে আছে।
পরের পাতা তা উল্টে যেতে ছবিটা দেখে মনটা খুশি হয় উঠলো ,মনে হয় অন্যতম সবচেয়ে স্মরণীয় দিন। স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। ক্লাস এ ফার্স্ট হয়েছিলাম ,তার পুরস্কারটা পেয়েছিলাম বাবার হাত থেকেই।হোয়াটস আপের প্রচলন সেসময়ে হলে হয়তো দিয়ে দিতাম এই ছবিটা "#মাইড্যাডমাইহিরো" বলে। ছবিতে বাবার চশমা ঘেরা চোখে খুশি উপচে পড়ছে দেখেই বোঝা যায়। মনে পরে কত পরিশ্রম এর জন্য ছিল বাবার ,আমাকে পড়াতে বসাতো সকাল সন্ধেয় ,নিজে কলেজের পড়া শেষ করতে পারেনি দাদু মারা যান বলে তাই হয়তো বেশি করে চাইতো বাবা আমি ভালো কিছু করি।
ধীরে ধীরে বড়ো হয়েছি ,বাবার সাথে দূরত্বটাও আস্তে আস্তে বেড়েছে কখনো মনের মিল না হতে আবার কখনো অন্য কোনো অজানা কারনে।
বাবার ইচ্ছা ছিল সরকারি চাকরি করি ,কিন্তু অতো গা করিনি ,বন্ধুর মারফত একটা বেসরকারি চাকরি পাই কলকাতায়।
"আমার আর বাড়িতে থাকা সম্ভব হচ্ছে না ,এখন থেকে অফিস অনেক দূরে পারছি না ".
মফস্সলের ছেলে হলেও কলকাতা খুব একটা দূরে না , তাও সদ্য যৌবনে তখন চাই নিয়ম ভাঙা বাঁধ।
বাবা মা দুজনেই কেঁদেছিলো,"তাও মাঝে সাঝে আসিস,শনি রবি বার করে ".
"কেন বুঝতে পারছো না সম্ভব না সারা সপ্তাহ কাজ করে ওই দু দিন শুধু একটু রিলাক্স করার সময়ে "
সুটকেস তা বন্ধ করতে করতে বলেছিলাম যেটা হয়তো না বললেও হতো ,"তোমাদের টাকা পয়সা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না মাসে মাসে পাঠিয়ে দেব"
বাবা শুনে একদম চুপ করে গেছিলো চশমা টা চোখ থেকে খুলে পাঞ্জাবির কোনটা দিয়েমুছতে মুছতে বেরিয়ে গেছিলো।
কলকাতা শহরে রঙিন জীবন ,চারিদিকে এতো এল চোখে ধাঁধা লেগে গেছে। রোজ রোজ রঙিন জলের বন্যা আর ধোয়াঁতে জীবন ভেসে চলা ।
কয়েকমাস টাকা পাঠাতে থাকলাম, পরে বন্ধ করে দিলাম তখন পুরো টাকা জীবনের শৌখিনতা পূর্ণ করতে লেগে যাচ্ছে।
হটাৎ মাস কয়েক আগে থেকে শুরু হয়েছে লক ডাউন,চাকরি টাও গেছে। এখন শুধু ধার দেনা করে চলছে।
মনে পড়লো কালকে রাতে বাবা কে ফোন করেছিলাম , কিছু টাকা চাইতে। কিন্তু আর কথা বলতে পারিনি ,ফোনের ওপর প্রান্তে বুঝতে পারছিলাম বাবা বলছে ,"হ্যান বাবু বল শুনতে আছি না তোর কথা "
মা কে ফোন দিয়ে,"দেখো তো কি বলছে আমি শুনতে পারছি না" ,মা ফোন তা নিতেই কল তা কেটে দিলাম। তারপর আর মনে নেই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছি কাঁদতে কাঁদতে।
ফ্ল্যাটের নিচে একটা ট্যাক্সি এসে থামলো ,জানালা দিয়ে দেখলাম বাবা নামছে,শত দুঃখের মাঝেও মনটা হালকা হয়ে গেলো। দৌড়ে গেলাম ফ্ল্যাটের দরজায় দিকে ,দরজা তা খোলাই ছিল ,গিয়ে পা তা জড়িয়ে ধরলাম বাবা ক্ষমা করে দাও আজ পর্যন্ত যা যা ভুল করেছি ক্ষমা করে দাও ,সব ছেড়ে চলে যাবো তোমাদের কাছে ,আবার নতুন করে পড়াশোনা করবো ,লড়াই করবো,তোমার স্বপ্ন পূরণ করবো।
বাবা নিশ্চুপ উঠে দাঁড়ালাম কি হলো বাবা ,পাথরের মতন দাঁড়িয়ে আছে, "বাবা ও বাবা কিছু বলছো না কেন ?"
বাবার চোখের দৃষ্টি বরাবর চেয়ে দেখলাম ,ফ্যানটা অল্প দুলছে আর ফ্যান থেকে ঝুলছে আমার দেহ। পাশের বাড়ি থেকে হালকা স্বরে গান ভেসে আসছে ,
"জীবন মরণ সুখ দুখ দিয়ে,বক্ষে ধরিব জড়ায়ে,........চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে ,নিয়ো না ,নিয়ো না সরায়ে ........