STORYMIRROR

Sangita Duary

Tragedy Classics Others

4  

Sangita Duary

Tragedy Classics Others

স্মৃতির পাঁচালী

স্মৃতির পাঁচালী

6 mins
253

"ভাই চল, রেলগাড়ি দেখবো...", বাধা দেওয়ার অবকাশ না দিয়ে আমার ডানহাত টেনে ক্ষেতের দিকে ছুটলো দিদি। একে শীতকাল, হাফহাতা একটা সোয়েটার কেবল, ঠান্ডায় কাঁপছি আমি, তার ওপর আলের ধারের শিয়ালকাঁটাগুলো এত বিঁধছে পায়ে! দিদির কি ঠান্ডা লাগেনা? খালি গায়ে ওই একটা পাতলা সুতির শাড়ি জড়ানো, কিন্তু দিদি তো ফ্রক পরতো!


"ছাড় দিদি লাগছে, শীত করছে আমার, বাড়ি যাবো ছাড়..."!


কানের পাশ দিয়ে হুশ করে একটা লরি বেরিয়ে যেতেই ঘুম ভাঙল আমার।


আমি, শ্রীযুক্ত অপরাজিত সান্যাল। থাকি কুড়ি বাই তিন বালিগঞ্জ স্ট্রিট।


পরিবার এবং অফিস থেকে একদিনের ছুটি ম্যানেজ করে চলেছি দেশের বাড়ি।


মা-বাবা থাকেন ওখানে। ফোনে খবরাখবর নেওয়া চললেও বছরে একবার কি দুইবার দেশের বাড়ি না যাওয়াটা খুবই অশোভনীয়। নিজের কাছে না হলেও লোকজনের কাছে তো বটেই, বিশেষ করে বিজয়ার প্রণাম কিংবা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে পিসি কিংবা মামা কিংবা মাসিকে ফোন করলেই যখন শুনতে হয়, "হ্যারে অপু বছরে একটা দিনও কি বাপমায়ের জন্য প্রাণ কাঁদে না রে?"


প্রথম প্রথম পুজোর সময় যেতাম।


ধীরে ধীরে তা বন্ধ হলো, গিন্নির জন্যই। কলকাতার থিম ছেড়ে কোন পাগল ধ্যারধ্যারে গাঁয়ের পুজোয় যায়?


শেষে এই শীতকালে। তাতে অবশ্য আমার লাভ বই ক্ষতি হয় না।

মা রীতিমত একটা ট্রলিব্যাগ গুছিয়ে দেয়; নতুন গুড়, নতুন আলু, পেঁয়াজ, টাটকা সবজি, পিঠে, মোয়া!


এবারে আলু, পেঁয়াজটা বেশি করে নিতে হবে, যা দাম!


মাথায় বাবার একটা কথা টোকা দিচ্ছে বারবার।


গত সপ্তাহে বাবা ফোনে বলছিল, বাড়িটার দেয়াল থেকে ড্যাম্প উঠছে, বর্ষায় নাকি দেয়াল ভিজে জল চুঁইয়েও পড়ে! বহুকালের বাড়ি, সেই ঠাকুর্দার আমলের। মেরামত না করলেই নয়!


চুমকি তো শুনেই রে রে করে উঠলো, "খবরদার! ওই ষাটের দশকের বাড়ির মেরামতির কোনো দরকার নেই, এক পয়সা দেবেনা তুমি, করে হবেই বা কি? তুমি থাকবে ওখানে? নাকি তোমার দিদি হায়দ্রাবাদের বাস হটিয়ে ওখানে যাবে?

আজকাল ইট বালি সিমেন্ট মিস্তিরির দর জানো? তার থেকে কোন্ প্রমোটার কিনতে চাচ্ছিলেন না? ওনাকেই ধর!"


একদিকে চুমকি ঠিকই বলেছে, বাড়িটা ছেড়ে দিলে প্রায় পৌনে বিঘে জমি ভালোই দাম উঠবে, বাবার ভাগের ফ্ল্যাট এবং টাকা দুটোই একটা সময় তারই তো হবে! দিদি তো বলেই দিয়েছে, ওসবে ওর কোনো ইন্টারেস্ট নেই, বাবা-মা কে পালা করে ওর ওখানে আর আমার এখানে থাকার প্রস্তাবও দিয়েছে। বাবাই শুধু বেঁকে বসছে। ইগো ইগো! বয়স বাড়লে ইগোও বাড়ে নাকি!


না না বাবার মগজধোলাইটা এবার করতেই হবে! এতক্ষন বাসের ভিতর ছিলাম তাই মালুম হয়নি, বেশ ঠান্ডা এখানে। কলকাতায় এখন আর ঠান্ডা কই!


অবশেষে শীতের পরশ লাগলো হিয়ায়। উহু! শুধু হিয়ায় কেন শরীরেও।


মাঠের পাশ দিয়ে হাঁটছি, সামনে খালি জমির ওপর একটা জটলা, ধোঁয়া, বাচ্চা ছেলেমেয়ে ছুটছে, ঘুড়ি ওড়াচ্ছে, ওটা কী, পেটকাটি!

না, চাঁদিয়াল বোধহয়।

মোমবাতিও হতে পারে!


চড়ুইভাতি হচ্ছে। শীতমাখা আর একটা চড়ুইভাতির গন্ধ পেলাম আমি, আমাদের বাড়ির সামনের পুকুরপাড়ে বসে দিদি মাটি লেপে উনুন গড়ছে, আমি, গোপাল, কানাই, রাজু মাঠ থেকে বেগুন, আলু চুরি করে এনেছি, পাশের বাড়ির লক্ষ্মী দিদি জামার কোচড়ে চাল এনেছে, দিদি টুকুশ করে মাকে ঘাটে দেখে দৌড় রান্নাঘরে। একটু পরে বাটি ভোরে ডাল এনে রেখেছে। আমাদেরও চড়ুইভাতি তখন। এঁতু ঠাকুরের ভাসানের পর সেই মাটির বড়ো গামলা কাঁচা উনুনে বসিয়ে দিদি ভাত চড়াল। মাটির রস পেয়ে উনুন কিছুতেই জ্বলে না, ধোঁয়ায় সবার নাকে চোখে জল, শেষে ইট পেতে কঞ্চি ধরালো লক্ষ্মী দিদি। সেদিন আমাদের বেগুন ভাজা মা'র হাতের বেগুন পোড়ার মত হয়েছিল। 

মাঠের পথ ফেলে সামনে লাল মাটির রাস্তা। রাস্তার দুই ধারে আগে জঙ্গল মত ছিল, এখন প্লট করা হচ্ছে, মা বলছিল, এখানে কাঠা নাকি দুই লাখ করে। বাব্বা!


কয়েক বছর পর এইটুকু ফাঁকাও হারিয়ে যাবে। সামনের খোলা জায়গায় এক মহিলা আয়তকার ট্রের মত বিশাল পাত্রে রস জ্বাল দিচ্ছে। আহ! সেই পুরোনো দারুণগন্ধ!


শিশিরভেজা সকালে দিদির হাত ধরে পুকুরের পাশের খেজুর গাছের নিচে বসে থাকতাম তখন। কখন হাঁড়ির গা বেয়ে খেজুর রস আমাদের গালে পড়বে! নিজের মনে হাঁটছি, সেই সঙ্গে গলার মাফলারটা বার বার ঠিক করে নিচ্ছি, আমি যে বরাবর শীতকাতুরে!


চুমকি তো মজা করে বলে, "রাতে হিসি করতে উঠলেও তোমার ঠান্ডা লাগে!"


ঠোঁটের কোণে হাসিটা এসেও থমকে গেল।


স্বভাব মতোই, হলুদ বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলাম। গতবছরেই দেখেছিলাম, হলুদ রং ফিকে হয়ে শ্যাওলা হয়েছে, আমাদের বাড়ি থেকে গুনে গুনে বারো হাত দূরে। অতসীদের বাড়ি। আমাদের বাড়ির ছাদ থেকে এবাড়ির ছাদ দেখা যায়। কৈশোরের ওই ছাদই তো ছিল আমার আর অতসীর ডিঙি সুতোর নৌকো!


শীতকালে ভরত স্যারের কোচিংয়ে যাওয়ার সময় রোজ অতসী সাইকেল নিয়ে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতো। আমি বাড়ি থেকে বেরোতেই দেখতাম, চারিদিক কুয়াশা, ও নেই নাকি!


একটু একটু এগোতাম, আর একটু একটু করে কুয়াশা কেটে অতসী প্রকট হত।


একবার বন্ধুদের সঙ্গে প্যাকাটির মুখে আগুন ধরিয়ে বিড়ি টানছি, সামনে অতসী হাজির। আমি থতমত খেয়ে গ‍্যোঁত করে ধোঁয়াটা গিলতে যেতেই নাকে মুখে ধোঁয়া ঢুকে খুক খুক ,হ‍্যাঁচ্ছো!


অতসী রাগী চোখে খিলখিল হেসে ফেলেছিল। সেই প্রথম পাড়ার সর্দি ঝরা ফ্রক পরা অতসীর মধ্যে কুছ কুছ হোতা হ্যায় এর টিনাকে খুঁজে পেয়েছিলাম!


পুতুল খেলার বর বউ থেকে টিনএজ প্রেম; শীতের ভোরের শিশিরের মত! মাথাটা ঝাঁকিয়ে আবার এগোলাম, প্রত্যেকবার গ্রামে এলেই কত পুরোনো স্মৃতি ভিড় করে। বাস রাস্তা থেকে নেমে হাঁটা পথ এই তিরিশ মিনিট! গায়েই লাগেনা! 


দুপুরবেলা গাওয়া ঘি সহযোগে গরম গরম একথালা খিচুড়ি সাটিয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে ভাতঘুম দিচ্ছিলাম। মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙল, "কৈ রে নে নে ওঠ! একটা দিনই তো থাকিস, ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিবি?"


ড্যাবড্যাবিয়ে দেখলাম, টেবিলে থালায় সাজানো পাটিসাপটা।


মনটা বড্ড কফি কফি করছে, হোক গে! কফি তো রোজই খাই, বলেই থালাখান কোলে নিয়ে বসলাম, "ইস! দিদিটা সব মিস করে যাচ্ছে!"


মা বোকা হাসে, "তুই তো তবু বছরে একটা দিন আসিস...!"


মুখভরা পাটিসাপটা চিবোতে চিবোতে বললাম, "দেখবে তোমার মেয়েকে?"


ভিডিও কলে নিলাম দিদিকে।


বাবা পাশের ঘরে ছিল। মেয়ের গলা পেয়ে এঘরে এসেছে।


কিছুক্ষন হৈ হৈ এর পর আবার সবাই চুপচাপ।


আমি আসল কথায় এলাম, "বাবা, বাড়ি মেরামতের কথা কী বলছিলে, আমি বলছিলাম, এত পুরোনো বাড়ি মেরামত করেই বা কী হবে, তার চেয়ে প্রমোটারকে দিয়ে দিলেই তো সুবিধে হত, না মানে বলছিলাম, এখানে এসে আমিও থাকবোনা, দিদিও না, বেকার এত টাকা খরচ, তার চেয়ে এখানে ফ্ল্যাট উঠলে থোক টাকার সঙ্গে তুমিও নতুন একটা আস্তানা পেতে!"


বাবা গম্ভীর, "তোমার দিদিরও কি তাই মত?"


-" শুধু দিদি কেন? যেকোনো বুদ্ধিমান লোকই তাই বলবে!"


বাবা বলিষ্ঠ চোখে তাকালো, "এসো আমার সঙ্গে!" মায়ের ঘরের কালো বিশাল পালঙ্কের পাশে একটা মস্ত কাঠের সিন্দুক। ওটাতে ঠাকুমা নাকি বাসন রাখতেন, কাঁসা পিতলের।


সিন্দুক খুলে বেরিয়ে এলো কিছু স্মৃতি, আমাদের ছোট্টবেলাকার। বেশ কিছু ছোটছোট জামা, আমার, দিদির।


আরে এই তো সেই ফাউন্টেন পেনটা যেটার জন্য দিদি আর আমার মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল, আর পরদিন মা বলেছিল ওটা হারিয়ে গেছে!


ছেঁড়া ঘুড়ি একটা। ছাদের এন্টেনায় আঁটকে গিয়েছিল।


সবুজ রঙের নাইলনের দোলনা, আমি আর দিদি দুলতাম।


আমার প্রথম পুরস্কার, কবিগুরুর, "শিশু," "বীরপুরুষ" বলে পেয়েছিলাম।


দিদির বোনা প্রথম আসন, ওয়ার্ক এডুকেশনের জন্য বানানো খুদে মোজা।


আমার ফুটবলের জার্সি!


সিন্দুক ছেড়ে আমার চোখ গেল পাপড়ি ওঠা দেওয়ালে, লম্বা স্কেল আঁকা, আমি আর দিদি নিয়ম করে মাপতাম, কে কতটা লম্বা হয়েছি!


আমার কাঁধে বাবার হাত, "তোর মনে পড়ে বাবু, যেদিন প্রথম সিগারেট খেলি, আমি ধরে ফেলেছিলাম!


তুই আমার লেপের ভিতরেই মুখ লুকিয়েছিলি, এমনই এক শীতকালে!


এখন তোরা ব্যস্ত। হাত বাড়ালেও তোদের পাইনা আর, তাই মুঠোর মধ্যেই তোদের স্মৃতিগুলো ধরে রেখেছি, নিঃসঙ্গ দুই বুড়োবুড়ির এটুকুই তো সম্বল বল! চারিদিক তাকিয়ে দেখ, ঘরের দেওয়ালে কোনায় তোরা, তোদের শৈশব, কৈশোর, তোদের বেড়ে ওঠা সব জড়িয়ে আছে!"


পাঞ্জাবির আস্তিনে চোখের কোন মুচ্ছে বাবা। বড্ড শীত করছে আমার। এই শীত আমার বড্ড চেনা। প্রথম প্রেমের চিঠি লিখতে ঠিক এরকমই কাঁপুনি দেওয়া শীত করেছিল আমার।


মাধ্যমিকের রেজাল্ট, এমনিই কেঁপেছিলাম আমি।


সিগারেট খেয়ে ধরা পড়ে ঠিক এমনই ঠক ঠক দাঁত কেঁপেছিল আমার।


 আবার আমি বাসে। মায়ের গুছিয়ে দেওয়া বস্তাসম ব্যাগটা ড্রাইভারের পাশে রাখা, পরে নামিয়ে নেব। খুব বেশি টাকা সঙ্গে নিয়ে আসিনি। এটিএম থেকেও এখন দুই এর বেশি তুলতে দেয়না একবারে।

নিজের কাছে ক্যাশ তিনের মত ছিল, হাজার পাঁচেক বাবার টেবিলে রেখে এসেছি।


এবছর শীতে আবার একবার আসবো, মায়ের হাতের নলেন গুড়ের পায়েসটা আয়েশ করে খাওয়া হলো না, রসবড়া টাও ট্যারা চোখে তাকিয়েছিল আমার দিকে, মালপোয়াটারও ওঁয়া ওঁয়া কান্না কানে আসছিল যে!


নিজে দাঁড়িয়ে থেকে রিনোভেট করবো বাড়িটা। নতুন রঙের জৌলুসে পুরোনো স্মৃতি চাপা না পড়ে যায়!


রোজকার ব্যস্ততায় শীতকে সেভাবে চেনা আর যায় কই? শহরের উষ্ণতায় শীতের চোখেও গভীর ঘুম।


কিন্তু আমি যে বড্ড শীতকাতুরে, এবং স্মৃতিকাতুরেও।


   





Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy