Riya Bhattacharya

Tragedy Inspirational

3  

Riya Bhattacharya

Tragedy Inspirational

সম্পর্কের বুনোট

সম্পর্কের বুনোট

4 mins
357



মকরসংক্রান্তির রাত, হিমেল কুয়াশা জাঁকিয়ে বসেছে আকাশের চাদরে। ছোট্ট মফস্বলের পাড়াটা আচ্ছন্ন গভীর ঘুমে। রাত দুটো বেজে পঁয়ত্রিশ, প্রৌঢ় অমলেন্দু সেন তন্দ্রা ভেঙে দেখলেন স্ত্রী কুসুমলতা নেই পাশে। আজ প্রায় দুই বছর হল কড়া সিডেটিভের সাহায্যে ঘুমপরীদের ডাক পাঠান অমলেন্দু, আজ বোধহয় পাকেচক্রে ওষুধটাই খেতে ভুলেছেন তিনি।

মকরসংক্রান্তি উপলক্ষে সারাদিন বাড়িতে আত্মীয়স্বজনের ভীড়, কুসুমলতার পিঠে বানাবার হাত অতুলনীয়। সকলেই খেয়েদেয়ে বিদায়গ্রহণ করেছেন রাত্রি আটটার মধ্যে। হাতের বাকি কাজ সারতে রান্নাঘরে প্রবেশ করেছিলেন স্ত্রী, সেই সুযোগে শরদিন্দু রচনাসমগ্র নিয়ে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন অমলেন্দু।

বইটা এখন ভাঁজ করা রয়েছে পাশের বেডসাইড টেবিলে, পাশেই খুলে রাখা চশমাখানি। 

টেবিলের ওপরে রাখা জলের গ্লাস থেকে ঢকঢক করে খানিকটা জল খেলেন তিনি, তারপর চশমা চোখে দিয়ে নেমে এলেন বিছানা থেকে।

ড্রইংরুমের পাশের ব্যালকনির দরজাটা হাট করে খোলা, সেখানে পেছন ঘুরে আনমনা দাঁড়িয়ে আছেন কুসুমলতা। হালকা বাতাসে উড়ছে তাঁর কাঁচাপাকা চুল, ইষৎ পৃথুলা গড়ন অন্ধকারে মিশে যেন জড়বৎ হয়ে আছে প্রাচীন বটগাছের মত। পাশে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে ডাক দেন অমলেন্দু,

--- " কুসুম, এখনো ঘুমোও নি? "

মৃদুহেসে পেছন ফেরেন কুসুমলতা।

---" নাহ ঘুম আসছে না এখন। " 

---" কি দেখছ এতরাতে এখানে দাঁড়িয়ে? " 

--" কিছুনা, সময়কে বয়ে যেতে দেখছি। " উদাসীনতা ঝরে পড়ে কুসুমলতার গলায়।

একটু যেন ধাক্কা খান অমলেন্দুবাবু, গলাটা কেমন যেন কেঁপে যায় তার।

---" তুমি কি আমার ওপর কোনো কারণে রেগে আছো কুসুম? " 

---" ষোলো বছর বয়স থেকে আজ পর্যন্ত কি কখনো রাগতে দেখেছো আমায়? তা আচমকা এই মধ্যরাতে উঠে এলে যে! কিছু দরকার? " 

স্ত্রীর এমন কথায় একটু যেন ক্ষুন্ন হলেন অমলেন্দুবাবু, ক্ষুব্ধ গলায় বললেন ---

" তোমায় বিছানায় না পেয়ে উঠে এসেছিলাম। বয়স বাড়ছে, এখন তো একটু দেখেশুনে চলো ; চিন্তা হয়। " 

--" চিন্তা!!!" তীব্র শ্লেষাত্মক শব্দটা যেন জ্বলন্ত শলাকার ন্যায় প্রবেশ করে অমলেন্দুবাবুর কর্ণকুহরে। হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে কুসুমলতার, কোনোক্রমে সামলে নিয়ে গম্ভীর হয়ে বলেন,

---" রাত হল, শোবে চলো। জিনিয়া কাল সকালে ফোন করবে বলেছে তোমায়। এখানে দাঁড়িয়ে থেকো না, ঠান্ডা লেগে যাবে। " কুসুমলতা পা বাড়ান শোবার ঘরের দিকে, স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন অমলেন্দুবাবু। জিনিয়া তাঁদের একমাত্র সন্তান, থাকে ব্যাঙ্গালোরে। সেখানে একটা বড় আইটি কোম্পানির ম্যানেজার সে, স্বামী প্রসূন সরকারি অফিসার। আজকাল মেয়ের যত কথা মায়ের সঙ্গে, বাবার সঙ্গে কালেভদ্রে কথা হয় কিনা সন্দেহ। নাতনি সুরভিরও যত আবদার ঠাম্মার কাছে, দাদু সেখানে ব্রাত্য মাত্র। এই প্রথমবার রাশভারী অ্যাডভোকেট অমলেন্দু সেন একাকীত্ববোধ করলেন, সব থেকেও কিছু নেই এই বোধটা কেমন আচ্ছন্ন করে ফেলল তাঁকে।

পায়ে পায়ে শোবার ঘরে গিয়ে দেখলেন পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছেন কুসুমলতা। চল্লিশ বছরের বিবাহিত জীবনে প্রথমবার স্ত্রীর কপাল চুম্বন করে নিঃশব্দে কেঁদে ফেললেন তিনি।


*     *    *     *


---" কেমন আছো বাবাই? " ফোনের ওপার থেকে যান্ত্রিকভাবে ভেসে এল জিনিয়ার কন্ঠস্বর। 

---" বুড়ো বয়সে আর কেমন থাকব মা? তোদের তো আজকাল এই বুড়ো বাবাটাকে মনে পড়েনা ; যত কথা মায়ের সঙ্গে সেরে ফেলিস। " অভিমান ঝরে পড়ে অমলেন্দুর গলায়।

---" মায়ের কাছে তোমার সব খবর পাই বাবা। মা তোমার সেবায় আজও গাফিলতি করে বলে শুনিনি তো!" ওপাশ থেকে ঠান্ডা শোনায় জিনিয়ার গলা।

---" এমন করে কথা বলছিস কেন মা? কিছু ভুল হয়েছে আমার? বাবাকে খুলে বল প্লিজ!" ব্যাকুল হয়ে বলেন অমলেন্দু।

---" বাবা জানো কেন তোমার সঙ্গে খুব কম কথা বলি? কেন এড়িয়ে চলি তোমায়? তুমিও তো এভাবেই দূরে সরিয়ে রাখতে আমায় মায়ের কাছ থেকে, ছোটবেলায়। "

---" সে তো তোর ভালোর জন্য মা! যতই হোক কুসুমের শিক্ষাদীক্ষা..... "

---" শিক্ষাটাই কি সবকিছু বাবা? ভালোবাসাটা কিচ্ছু নয়? জন্মের পর থেকেই দেখেছি তোমায় মাকে হেয় করতে সর্বসমক্ষে, তাকে নিজের স্ত্রী হিসাবে পরিচয় দিতে লজ্জা পেতে তুমি। তার ছায়া যাতে আমার ওপর না পড়ে তাইজন্য আমায় সরিয়ে দিয়েছিলে বোর্ডিং স্কুলে। ছুটিতে বাড়ি এলে সবসময় উঠতে বসতে মাকে অভিযোগে বিদ্ধ করতে দেখেছি তোমায়। এমনকি আমার বিয়ের সময়েও সব সিদ্ধান্ত একা নিয়েছ, মাকে কিচ্ছু বলতে দাওনি। আজ পর্যন্ত মা কি করবে, কি বলবে, কি পরবে সব সিদ্ধান্ত একা নিয়েছ, কোনোদিন জিজ্ঞেস করেছ সে কি চায়! " আক্রমণ ঝরে পড়ে টেলিফোনের ওপারে।

---" তোর মা তো জানিস অজ গ্রামের মেয়ে, শহুরে স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারত না কোনোদিন। কি বলতে কি বলবে, অসম্মানের একশেষ ; তাইতো তার সবকিছু গুছিয়ে দিতে হত আমায়। " মিনমিন করে বললেন অমলেন্দু।

---" তাই নাকি বাবা! তাহলে মায়ের হাতের রান্না খেয়ে তোমার স্যুট টাই পরা শিক্ষিত ক্লাসি বন্ধুগন এত তারিফ করত কেন? কই তখন তো ভোলোনি প্রশংসার ক্ষীরটুকু স্বামী হিসাবে চেটেপুটে খেয়ে নিতে! তুমি জানো বাবা মা খুব সুন্দর কবিতা লিখত, তোমার ভয়ে বলতে পারেনি কোনোদিন। " তীক্ষ্ণ গলায় বলে জিনিয়া।

--- না মানে, এসব কি বলছিস তুই! তোর মা কবিতা....! মানে যে এই সেদিন পর্যন্ত গ্রাম্য ভাষায় কথা বলত!" বিস্ময়ে কথা আটকে যায় অমলেন্দুর।

---" হ্যাঁ সেই গ্রাম্য, তথাকথিত শহুরে সহবত না জানা মহিলার কবিতাই ছাপতে রাজি হয়েছে বাংলার সবচেয়ে বড় প্রকাশনী, যাকে আজ পর্যন্ত তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দাওনি তুমি। তোমার সঙ্গে তোমার জুনিয়র রাগিনী আন্টির সম্পর্কটাও মা লুকিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল আমার কাছে, যাতে কোনোদিন তোমায় অশ্রদ্ধা না করি। " ক্ষোভ ঝরে পড়ে জিনিয়ার গলায়। 

স্তব্ধ হয়ে যান অমলেন্দু বাবু, মেয়ে যে তাকে আড়ালে এত ঘেন্না করা শুরু করেছে আগে কেন টের পাননি তিনি!

---" জানো বাবা, মা শুধু সকলের জন্য বিশেষ করে তোমার আমার জন্য করে গেছে, বিনিময়ে পায়নি কিছুই। নিজের সামান্য অসুখটুকুও কখনো টের পেতে দেয়নি তোমায়, পাছে বিরক্তবোধ করো! যে মানুষটা তোমার জন্য নিজের সমস্ত জীবনটা শেষ করে দিল তাকে কি বিনিময়ে কিচ্ছু দেওয়ার ছিল না তোমার! " 

অমলেন্দু নিরত্তর, টুপটাপ জল ঝরে পড়ে চোখের কোল বেয়ে।

---" বাবা আমি মেয়েকে কেন তোমার কাছে যেতে দিই না জানো? চাইনা ও তোমার মত হোক, কারন আমি নিজে কখনো আমার বাবার মত হতে চাইনি।" ব্যথা ঝরে পড়ে জিনিয়ার গলায়, টুক করে কেটে যায় ফোন। একরাশ শূন্যতা মেখে স্তব্ধ হয়ে ঝলমলে আকাশটার দিকে চেয়ে থাকেন অমলেন্দু, ঘড়ির কাঁটা শব্দ করে ঘোরে টিক টিক।।


সমাপ্ত


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy