শুভায়ন বসু

Tragedy

4  

শুভায়ন বসু

Tragedy

সমনামী

সমনামী

8 mins
331



“এই শুভদীপ ,এদিকে আয়”, মেয়েলি কন্ঠে চমকে উঠে, পিছনে ফিরল শুভদীপ। ফিরেই চমক, তাকে ডাকা হয়নি। ‘শুভদীপ’ বলে তরুণ যে ছেলেটি, সুন্দরী মেয়েটির ডাকে সাড়া দিয়ে তার কাছে হেঁটে গেল, সে আলাদা ।নন্দন চত্বরে ‘কলিখাতা’ বলে একটা লিটল ম্যাগাজিনের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান ছিল আজ,তাতে শুভদীপই ছিল প্রধান অতিথি। কবি হিসেবে ওর মোটামুটি ভালই পরিচিতি আছে, লিটিল ম্যাগাজিনগুলো তো বটেই ,নামী পত্র-পত্রিকাগুলোও নিয়মিত ওর লেখা চায়,ছাপে। এদেরই আমন্ত্রণে আজ ও এসেছিল, ভাষণও দিয়েছে। কবিতা নিয়ে কিছু তো বলতেই হয়,ওর যে জীবনটাই কবিতা।  


অনুষ্ঠানের শেষে এবার বাড়ি ফিরে যাবার পালা। ফুডস্টলগুলোর কাছে এসে শুভদীপের মনে হল এক কাপ চা না হলে যেন চলছে না। ঠিক তখনই এই কাণ্ড।চায়ে চুমুক দিতে দিতে, একটু থমকে দাঁড়াল ও। এই তরুণ শুভদীপ কিন্তু বেশ হ্যান্ডসাম, ওরই মতো উচ্চতা, রোগা, ফর্সা, গালে হাল্কা দাড়ি, চোখে সানগ্লাস, আকর্ষণীয় চেহারা। একটু দাঁড়িয়ে,শুভদীপের আরো একটু দেখতে ইচ্ছে হল নিজের সমনামীকে। যদিও ফেসবুক বা গুগল খুলে অনেক ‘শুভদীপ’ ও পেয়েছে, নামটাও খুব একটা বিরল নয়। এই ছেলেটা সেরকমই একজন হবে।ওর নিজের কম বয়সের কথা মনে পড়ে গেল, বেশ লাগছিল।


হঠাৎ ছেলেটা বন্ধু বান্ধবীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সানগ্লাসটা খুলে বুকপকেটে রাখল। তখনই চমকে উঠল শুভদীপ, ছেলেটার সঙ্গে ওর চেহারায় ভীষণরকম মিল, ঠিক যেন কম বয়সের শুভদীপ। নিজেকে যেন আয়নায় দেখছিল ও। চা শেষ করে, একটু সরে এসে ,একটা বেঞ্চিতে বসে, ছেলেটাকে ভাল করে নিরীক্ষণ করতে লাগল। ছেলেটা জিন্সের প্যান্টের ওপর একটা কালো আর কমলা রঙের প্রিন্টেড পাঞ্জাবী পরে আছে,কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, চোখ ফেরাতে পারছিল না শুভদীপ।বসে বসে ,বন্ধু- বান্ধবীদের সঙ্গে ছেলেটার কথা অল্পস্বল্প কানে আসতে লাগল। 

“কিরে বাড়ি যাবি কেন এখনই?” 

“না রে, মার শরীরটা খারাপ। একা আছে।“

“সত্যি,তোর মতো মাতৃভক্ত দেখা যায় না রে।“ 

“কি করব বল, ছোটবেলা থেকেই তো শুধু আমি আর মা। আর কে দেখবে মাকে?” 

“যা বলেছিস, তোর কপালটাই খারাপ”, আরেক বান্ধবী এসে বলে। 

“হ্যাঁরে শুভদীপ, তোর বাবা এখনও তোদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না?” 

“নাঃ, ডিভোর্সের পর থেকে আর কোন খোঁজই নেই।“ 

“কখনও আসে না? ফোনও করে না?” 

“নারে,ছাড় ওনার কথা।কোনদিন তো মাকে দেখেননি। ওনার থাকা না থাকা সমান।“

“আরে,ওকে আর সেন্টু খাওয়াস না তো, বেচারা এমনিতেই চাপে আছে।“ একজন বলে ।

ছেলেটা এবার একটা সিগারেট ধরায় ।ওর বন্ধু বান্ধবীরাও ধরায়।দু’টান দিয়ে আর এক বান্ধবীকে কাউন্টার দেয়, হাসি-ঠাট্টা চলতে থাকে। ছেলেটা একটু যেন উদাস হয়ে যায়,ওর মুখে কি কোন ব্যাথা ফুটে ওঠে? অন্য সবাই চুপ করে যায় ।

তখনই শুভদীপের চোখের সামনে ভেসে উঠল বিশ বছর আগেকার কথা, তখন ওর যৌবন। নন্দিনীর সঙ্গে সম্পর্কটা হঠাৎ আসা দমকা হাওয়ার মত ছিল। শুভদীপ তখন নিত্যনতুন সম্পর্কের নেশায় ছুটে চলেছে এক সম্পর্ক থেকে আর এক সম্পর্কে। ঠিক তখনই এক সময়ের কলেজবন্ধু নন্দিনীর সঙ্গে হঠাৎ দেখা ব্রিটিশ লাইব্রেরীতে। নন্দিনীর মধ্যে শুভদীপ কিছু একটা দামালপানা দেখেছিল, পেয়েছিল সেই সমস্ত, যা ও চায়,যা ওর নিজের অস্থির মনের গোপন কামনা বাসনার সঙ্গে মেলে।শুনেছিল নন্দিনীর অসুখী বিবাহিত জীবনের কথা,ওর স্বামীর অত্যাচারের কথা, শারীরিক মিলনে অনীহার কথা। দেরি করেনি শুভদীপ,তখন ও নিজেও ওর যৌবনের অদম্য চাহিদার জন্য নতুন পুতুল খুঁজছে। নন্দিনীরও সেই দুরন্ত হাতছানিকে এড়ানোর কোন উপায় ছিল না, চাহিদা ছিল দুজনেরই। নন্দিনীদের ফ্ল্যাটেই সুযোগমতো মিলিত হত ওরা,ওর স্বামী যখন অফিসে থাকত। ওর প্রেমে খুব একটা হৃদয় থাকত না, থাকত শুধু শরীর, শুধুই শরীর। নন্দিনী কিন্তু শুভদীপের থেকে আরও বেশি কিছু চাইত,শুধু শরীর নয়,একটা সঙ্গী চাইত,একটা বন্ধু চাইত।বলত,ওর কষ্টের কথা, স্বামীর উপেক্ষার কথা, ভালবাসা চাইত একটু, কাঙালীর মত। 

“শুভদীপ, তুমি আমাকে ভালোবাস? সত্যি বাস?” 

“কেন ভালবাসব না? এরকম কেন জিজ্ঞেস করছ?” 

“কি জানি! তুমি আমার সঙ্গে চিরকাল থাকবে তো ?চলে যাবে না তো, আমাকে আবার একা করে দিয়ে?” 

“ধুর, কি বোকার মতো বলছ?”

“বোকা তো আমি বটেই,ভালবেসেছি যে।কিন্তু আমি জানি, তুমি শুধু তোমার বউকে ভালবাসবে। আমাকে ভুলে যাবে।“

“না গো, জীবনে ভালোবাসা ছাড়া কি শরীর আসে?” 

“কিন্তু আমি যে শুধু শরীর চাইনা শুভ, তোমার মনটাও চাই। তোমাকে পুরোপুরি চাই।“ 

“তা কি করে হবে? তোমার স্বামী আছে না ?”

“আমি যদি ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিই। আর পারছি না।“ 


 শুভদীপের পুরোনো সব কথা আজ মনে পড়তে লাগল,ও আজও একা । তনুশ্রীর সঙ্গে বিয়েটা টেঁকেনি বেশিদিন, ছেলেপুলেও হয়নি ।ও জানে দোষ ওরই।ওর এই বহুগামীতার নেশা, কোন একক নারীতে সন্তুষ্ট না হতে পারা, স্বীকার করতে দেয় না সম্পর্কের চিরস্থায়ী মধুরতাকে। কিন্তু সেসব অস্থির দিনগুলো চলে গেছে, আজ পড়ে আছে শুধু প্রৌঢ়ত্বে দাঁড়ানো শুভদীপ। চুলে পাক ধরেছে, শরীরেও ভাঙন , মনটা তো দুর্বল হয়েছেই। এখন ও একটু থিতু হতে চায়। কিন্তু আজ আর উপায় নেই। যৌবনের নেশায় সম্পর্ক গুলো ভাঙতে ভাঙতে, জোর করে অগভীর ক্ষণস্থায়ী একটা মোড়কে ঢেকে রেখে আর প্রকৃত ভালবাসাকে ইচ্ছে করে অসংখ্যবার ছুঁড়ে ফেলে দিতে দিতে, তারা সব ধুয়ে মুছে আজ সাফ হয়ে গেছে, বড় দেরি হয়ে গেছে।যদি একটা সাথী থাকত, যদি একটা সন্তান থাকত, যদি নতুন ক’রে আবার সব ঠিকঠাক শুরু করতে পারত! আজকাল প্রায়ই আফসোস হয় শুভদীপের।


ততক্ষণে ছেলেটাও রওনা দিয়েছে, বন্ধু-বান্ধবীদের বিদায় দিয়ে। ওকে দেখে আর কথাবার্তা শুনে এক অদম্য আকর্ষণে পিছনে পিছনে চলল শুভদীপও। ছেলেটা কে, দেখতে হবে। আধুনিক ছেলে, হয়তো শুভদীপেরই মত কবিতা লেখে। না হলে এই পত্রিকার অনুষ্ঠানে আসবে কেন ! একটু এগিয়েই ময়দান মেট্রো, শুভদীপকেও বাড়ি ফিরতে হবে মেট্রো করেই। যাবার কথা দমদম, স্মার্টকার্ড তো কাটাই আছে। ছেলেটার পাশের লাইনেই টিকিট কাটতে মিছিমিছি দাঁড়িয়ে শুনল,ছেলেটা যাবে শোভাবাজার। বুকটা ধ্বক্ করে উঠল। তবে কি? তবে কি? নন্দিনীর বাড়ি তো ওখানে নেমেই যেতে হয়। আর মায়ার বাঁধন এড়াতে পারেনা শুভদীপ। ওকে দেখতেই হবে শেষ পর্যন্ত। ছেলেটার পিছনে একটু দূরত্ব রেখে চলতে শুরু করে। প্লাটফর্মে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ওকে লক্ষ্য করে যায়। ছেলেটা কাকে যেন ফোন করে। ওর মাকে নয়তো? ছেলেটা বলতে থাকে “এইতো, এসে গেছি।মেট্রোয় উঠছি। হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি শুয়ে থাকো। ঠিক আছে,রাখছি।“ ফোনের কথাকটা কান খাড়া করে শোনে শুভদীপ। ফোনের ওপারে কি নন্দিনী?কি হয়েছে নন্দিনীর,অসুস্থ বলল। মনটা চঞ্চল হয়ে ওঠে। তবে কি ও যা ভাবছে, তাই? এই নন্দিনীর সেই সন্তান ? এইজন্যই একদম যৌবনের শুভদীপের সঙ্গে এত মিল। এ কি সেই?তাই কি নন্দিনী শুভদীপের নামটাকে জোর করে ধরে রেখেছে ছেলের মধ্যে? শুভদীপের বুকে হাতুড়ির ঘা পড়তে থাকে।ওর আবারও মনে পড়ে যায় পুরোনো সব কথা।


“তুমি আমার হও শুভদীপ, আর কারও না।“ 

“সে তো ঠিক আছে। কিন্তু আমার বাড়িতে জানাতে হবে তো! বাবা-মাকে বোঝাতে হবে। দেখি ,সময় লাগবে ।“

“আমার জন্য এইটুকু করতে পারবে না? আমি কি শুধু তোমার সেক্সপার্টনার ?একটুও ভালবাস না আমাকে ?”

“তোমার কি তাই মনে হয়? একথা বলতে পারলে?” 

“সত্যি! সত্যি ভালোবাস আমাকে?” 

“হ্যাঁ ,সত্যি।“ 

“তাহলে আমি যা চাইব, তা দিতে পারবে তো?” 

“কি চাও, বল। তুমি যা চাইবে,চলো এখনই ।“ 

“না গো ,আমি যা চাই তা কোন বাজারে পাওয়া যায় না।“ 

“মানে?” 

“আমাকে একটা বাচ্চা দেবে,শুভদীপ? আমার একটা বাচ্চা চাই।আমি মা হতে চাই।দেবে শুভ?“ 

কি উত্তর দেবে বুঝতে পারেনি শুভদীপ।শেষে ফেঁসে যাবে না তো ! জানাজানি হলে সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না , ওর পরিবারের একটা সুনাম আছে। চাকরিটা তখন সবে পেয়েছে, বিয়ের কথাবার্তাও চলছে। কিন্তু কামনার আগুনে পুড়তে পুড়তে আগুপিছু কিছুই ভাবে নি ওরা।শুধু দুজনে, দুজনের শরীরের নেশায় ভেসে গিয়েছে। মিথ্যে প্রেমের সম্পর্কটা টিঁকে ছিল আরও কয়েক মাস। হঠাৎ একদিন নন্দিনী বলেছিল, ও মা হতে চলেছে। ততদিনে দুজনেই ছক কষে ফেলেছে এবং ওর স্বামীকে ভুলিয়ে এনে,নন্দিনীর চিত্রনাট্য রচনা করা হয়ে গেছে, যাতে ওর স্বামী কোন সন্দেহ করতে না পারে। ঠিক তখনই শুভদীপ বুঝে গেল, এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার সময় হয়ে গেছে। সুতরাং সম্পর্কের শেষ করতে আর বিন্দুমাত্র দেরি করে নি ও। একটুও কষ্ট হয়নি,আসলে কোন আবেগ ভালবাসা ছিল না তো,তাই নন্দিনীকে ভুলে যেতেও ওর কোন অসুবিধা হয়নি। তারপর থেকে আর ওর কোন খবর, কোনদিনও নেয়নি শুভদীপ।মাঝেমাঝে অবশ্য একান্তে ওর কথা মনে পড়েছে ঠিকই,মনকেমনও হয়ত করেছে,কিন্তু ঐ পর্যন্তই।


হঠাৎ ওর চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল। ট্রেন ঢুকছে। জুনিয়ার শুভদীপের কামরাতেই উঠতে হবে, নজর রাখতে হবে। কামরায় উঠে একটু দূরে থেকে ছেলেটাকে দেখে চলে শুভদীপ ।একটা অপত্য স্নেহ উঠে আসছে যেন অকারণে। হতে পারে,এ কেউ নয়। হতে পারে সেরকম কেউ নেই ।নন্দিনী বা তার কোন সন্তান, কেউ নেই। তবু ভাবতে ভাল লাগে। সেই দিনগুলোর কথা ভাবলে আজ শুভদীপের আর আগের মত রোমাঞ্চ লাগেনা,বরং আফসোস হয়। সে ভুল করেছে, সম্পর্কগুলো নিয়ে, ভালোবাসাবাসি নিয়ে, যৌনতা নিয়ে খেলা করে সে নিজেকেই সস্তা করে তুলেছে,নিজেকেই বঞ্চিত করেছে।সন্তানের মুখ দেখেনি আজও, স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে বছর দশেক হল। কি পেয়েছে জীবনে? একটু থিতু হয়ে বসতে পর্যন্ত পারেনি,খালি দৌড়ে বেড়িয়েছে মিথ্যে মরীচিকার পেছনে।চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে শুভদীপের,চশমাটা খুলে চোখদুটো একটু রগড়ে নেয়। তারপর ভালো করে দেখে জুনিয়র শুভদীপকে।কামরায়, চারপাশে সবাই মোবাইলে গেম খেলতে ব্যস্ত, কিন্তু এই ছেলেটা আর পাঁচজনের মতো নয়। এক কোণে দাঁড়িয়ে আজকের প্রকাশিত পত্রিকাটায় ডুবে আছে। কবিতাই এখন শুভদীপের সবকিছু, ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। সম্পর্কের টানাপোড়েনে শেষ হয়ে যাওয়া একটা ব্যর্থ জীবনের হতাশার মধ্যেই হয়ত ওখানে ও কবিতার খোলা রাস্তায়, একটু মুক্তি খোঁজে। সব ব্যর্থতা,সব কষ্ট থেকে ছুটে বেরিয়ে আসতে চায়। শুভদীপ আজ একা, বড় একা। এই একাকীত্ব থেকে কবিতাই ওকে মুক্তি দেয়, শান্তি দেয়। আর কিছু নেই ওর এ পৃথিবীতে ।মনে হয় সুস্থ জীবনের প্রকৃত স্বাদ ও কোনদিনই পেল না,একটা সুন্দর সংসার ,সুখী জীবন, একটা সন্তান- সব ওর কাছে চিরকাল অধরাই থেকে গেল । আজ যৌবন ফুরিয়েছে, যা ছিল আজ সব নেগেটিভ,আলোর পথে এলনা।


“আর একটু বোসো না শুভ,তুমি চলে গেলে আমি আবার একা হয়ে যাব।“

“না নন্দিনী,আজ যেতেই হবে।কাল সকালেই অফিসের কাজে টাটা যেতে হবে।“

“আবার আসবে তো!তুমি কিরকম যেন পাল্টে গেছ।“

“না,না,তা নয়।“

“আমায় কষ্ট দিও না ,শুভ। আমার জন্য তোমার একবারও খারাপ লাগে না?আমি কোন কিছু নই তোমার কাছে,না?”

“তুমি তো মা হতে চেয়েছিলে,আমিও আমার কথা রেখেছি।আর কি চাও আমার থেকে?”

“আর কিচ্ছু চাই না।তুমি আমাকে অনেক দিয়েছ,আমি সারাজীবনেও তোমার ঋণ শোধ করতে পারব না। শুধু আমাকে একা করে দিয়ে যেও না,আমি কোথায় মুখ লুকোবো বলো! তুমি ছাড়া আমার যে আর কেউ নেই।”

“আমার কিছু করার নেই,নন্দিনী। একটু বোঝার চেষ্টা কর প্লিজ।“

“আমার কি হবে ,শুভ?আমার বন্ধু হয়ে অন্ততঃ থেকে যাও।তোমার কোন ভয় নেই,তোমার কোন ক্ষতি আমি জীবন থাকতে হতে দেব না।“

“জানি,আর আমিও তোমাকে সারাজীবন ভালবাসব।আবার আসব,কথা দিলাম।শুধু আজ আমায় যেতে দাও।“

“সবকিছু শুধু তোমার কথা মত হবে ,তাই না শুভ?আমার জন্য তোমার কোন সময় নেই,কথা বলারও না।শুধু যাবার তাড়া।“

বিশ বছর আগের এক দুপুরের এসব কথা ভেসে ওঠে শুভদীপের মনে। নন্দিনীকে ছেড়ে চলে আসার দিন ।নন্দিনী মনে হয় কিছু বুঝতে পেরেছিল ,ওকে কিছুতেই যেতে দিচ্ছিল না। শুভদীপের তখন ফেঁসে যাবার ভয় বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল, সবে পাওয়া চাকরি ,ওদিকে নন্দিনী প্রেগনেন্ট ।ওর স্বামী ইম্পোটেন্ট, তক্ষুনি বেরিয়ে আসতে হবে এই সর্বনাশা সম্পর্ক থেকে। নন্দিনীকে স্বার্থপরের মত ছেড়ে এসে, কোনরকমে সেদিন শেষবারের মতো বাড়িটা থেকে পালিয়ে, বেরিয়ে এসেছিল শুভদীপ।কারণ, ততক্ষণে ও মনস্থির করে ফেলেছে, আর ফিরে তাকায়নি কোনদিনও।


হঠাৎ ছেলেটা দরজার দিকে এগোতে, চিন্তায় ছেদ পড়ে শুভদীপের। শোভাবাজার এসে গেছে। আর মাত্র একটু সময়, তারপরেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ও অনুসরণ করতে থাকে ছেলেটাকে। স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে গ্রে স্ট্রিট ধরে সবে একটু গেছে, হঠাৎ ছেলেটা দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে শুভদীপের মুখোমুখি হয়, ওর দিকে এগিয়ে এসে ওকে চার্জ করে। “কি ব্যাপার বলুন তো, আপনি কে? কেন আমার পিছনে পিছনে আসছেন?” শুভদীপ বুঝে উঠতে পারে না, কি বলবে। আমতা আমতা করে বলে “না, মানে আমি তো এখানেই থাকি।“ ছেলেটা শুভদীপের চোখের দিকে তাকায়, একটু গভীর দৃষ্টি দিয়ে ওকে খুঁটিয়ে দেখে। তারপর একটু নরম হয়। মৃদু হেসে বলে,”ও”। বলেই আবার হাঁটা দেয়।গলাটা শুকিয়ে আসে শুভদীপের। ছেলেটা কি বুঝতে পেরেছে? শুভদীপ দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দেয়।

শেষে হাঁটতে হাঁটতে ,শুভদীপ তাল রাখতে পারে না, পিছিয়ে পড়ে।ছেলেটা বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে।আর একটু জোরে হাঁটলে,হয়ত এখনও ওকে ধরা যাবে।কিন্তু শুভদীপ সে চেষ্টা করে না,বরং দাঁড়িয়ে পড়ে।সব চলায় যেমন একদিন থামতে হয়,সেরকমই।


সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল,'তুমি কে?কোথা থেকে আসছ?'

আমি বললুম 'আমি অতীত থেকে আসছি,অন্য আলোয় যাকে দেখেছিলুম,তাকেই খুঁজছি।'

সে বলল 'আলো তো নিভে গেছে এখানে,অনেক আগে।'

আমি বললুম 'তাহলে অন্ধকারেই খুঁজি,এই তো! বেশ দেখা যায়।'



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy