STORYMIRROR

আশালতা Ashalata

Classics Inspirational

4  

আশালতা Ashalata

Classics Inspirational

সখী বহে গেল বেলা

সখী বহে গেল বেলা

16 mins
346

"স্বর্ণলতা কে মণিমা?" ১৯ বছরের নাতনীর মুখে এই নাম শুনে চমকে উঠলেন মৃণালিনী দেবী, ওরফে প্রখ্যাত লেখিকা "ইচ্ছে পূরণ"। 


আজ এতকাল পরে কেউ ওই নামটার কথা তাকে জিজ্ঞেস করল। 


প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে ওই নামটার কথা কেউ তাকে জিজ্ঞেস করছে। 


হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা অপূর্ব সুন্দর মুখ, টানা টানা চোখ , আর সেই চোখ দুটোয়ে একরাশ বেদনা , ঘৃণা, অনেক কিছু না পাওয়ার ক্ষোভ আর কিছু পাওয়ার ক্ষীণ প্রত্যাশা।


চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে ওঠে মৃণালিনী দেবীর।


"ও মণিমা, কি হলো গো, বললে না তো স্বর্ণলতা কে?" নাতনীর ডাকে বর্তমানে ফেরেন মৃণালিনী দেবী। নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, " ওই নামটার তুই কোথায় পেলি রূপ?" 


"তোমার ডায়েরীতে, বারবার ওই নাম এসেছে, তুমিই তো লিখেছো, আমার উপর রাগ করে থাকিস না সন্ন, ফিরে আয় না সই , ইত্যাদি ইত্যাদি। এবার বলতো কে স্বর্ণলতা? সই মানে তো বন্ধু , উনি কি তোমার বন্ধু ছিলেন?"


নাতনীর কথা বলার ঢং শুনে হেসে মৃণালিনী দেবী বললেন," হ্যাঁ রে, আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ, আমার সই। আমাকে ওর চেয়ে ভালো কেউ বুঝত না রে, শুধু আমিই পারলাম না ওকে বুঝতে, আমাদের বন্ধুত্বের মান রাখতে।"


কথাগুলো বলে হঠাৎ করে চোখে চলে আসা অবাধ্য জলটা মুছলেন মৃণালিনী দেবী।


মৃণালিনী দেবীর নাতনী মানে রূপ বলল, "ও মণিমা কেঁদো না গো, আচ্ছা তুমি কেন ওনাকে ভুল বুঝেছিলে? উনি কি এখন আর বেঁচে নেই? কি হয়েছে ওনার? খুব ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে ব্যাপারটা, প্লিজ বল না, প্লিজ ?" 


হেসে ফেলে মৃণালিনী দেবী বললেন,"ওরে থাম , সে যে বিশাল বড় ঘটনা, আর তোর ভালোও লাগবে না ওসব পুরোনো আমলের কথা শুনতে। "


"তুমি কি করে জানলে আমার ভালো লাগবে কি লাগবে না? আর, তাছাড়া আমি এখন যথেষ্ট বড় হয়েছি। সব বুঝতে পারব, বল না গো, আমি এখানে মাত্র দু'দিন আছি, এরপরেই তো গরমের ছুটি শেষ হয়ে যাবে, আর আবার বাবাই এসে বাড়ি নিয়ে যাবে, বল না গো প্লিজ?" 


পুরোনো কথাগুলোকে মনে করতে খুব কষ্ট হয় মৃণালিনী দেবীর, কিন্তু নাতনীর অনুরোধও তিনি ফেলতে পারেন না। তিনি জানেন আজকালকার মেয়েরা অনেক কিছু জানে, তাই রূপ সবটা শুনে বুঝবে।


অনেক ভেবেচিন্তে মৃণালিনী দেবী শুরু করেন অর্ধশতাব্দী আগের ইতিহাস, যা তিনি তাঁর জীবন থেকে মুছে ফেলতে পারলে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন। 


"সালটা ১৯৪৩ বুঝলি তো? দেশ তখনও স্বাধীন হয়নি। আমার বয়স তখন আর কতই বা হবে, ১৫ হয়েছে কি হয়নি , তা তখন কোন মেয়েটাই বা নিজের বয়স নিয়ে ভাবতে বসত। আর এখন এই ৯৫ এর কোঠায় দাঁড়িয়ে অতসব মনেও নেই ঠিক করে । তো যা বলছিলাম, সেই ১৫ বছর বয়সে মা আর জেঠিমা, নতুন শাড়ি আর এক গা গয়না পড়িয়ে বসিয়ে দিল কতগুলো লোকের সামনে। যাওয়ার আগে কত কি শেখালো , এই ভাবে বসবি, সবার আগে প্রণাম করবি , যা যা জিজ্ঞেস করবে শুধু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলবি আরও কত কিছু। এতসব মাথায় রাখতে হবে ভেবে তো আমি ভয়ই কাঁটা। আমাদের বাড়ি ছিল ভয়ঙ্কর গোরা, তাই কাউকে কিছু শুধোতেও পারছিলাম না কি হচ্ছে, কেনই বা হচ্ছে?

শেষে বাড়ির কাজের মেয়েটা যখন ওই লোকগুলোর সামনে নিয়ে এলো তখন বুঝতে পারলাম আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। জানিস তো বিয়ে বস্তুটাকে আমি যমের মতো ভয় পেতাম, খালি মনে হতো শশুরবাড়ি মানেই অত্যাচার , তোর এখনকার মণিমা আর তখনকার মণিমার মধ্যে ফারাক ছিল বিস্তর। তখন আমি সব কথাতেই বড় বেশী ভয় পেতাম। তা যারা আমাকে দেখতে এসেছিল তারা বোধহয় এই ভয় পাওয়া দেখেই পছন্দ করে ফেলেছিল। হাজার হোক বউ মানুষ , ভীতু হলেই তার দাম বাড়ে । সে আলাদা বিষয় , মোট কথা সামনের মাঘেই বিয়ে করে পাড়ি দিলাম হালিশহরে। শশুরবাড়িতে এসে বুঝলাম প্রথমদিন যত লোক এসেছিল তারা সবাই দুরের আত্মীয়। এমনিতে শুধু বর আর শাশুড়িকে নিয়েই আমার সংসার। আমার বাপের বাড়ি ছিল একান্নবর্তী পরিবার, শ্বাস ফেলার এতটুকু জায়গা ছিল না তাই আমি ভেবেছিলাম ছোট পরিবারে নিজের মনের মতন থাকতে পারব। হায় রে পোড়া মন! সে সব আর হল কই? 


মৃণালিনী দেবী বলে চললেন, "তো যা বলছিলাম , স্বর্ণ মানে স্বর্ণলতাকে আমি প্রথম দেখি বধূবরণ-এর সময়। যখন সবাই দুধে- আলতার পাত্রে পা ডুবাতে বলেছিল তখন ভারী ভয় পেয়েছিলাম, যদি থালা উল্টে পড়ে যাই? ইতিউতি চাইছিলাম একটু ভরসার খোঁজে তখনই চোখ যায়, সিঁড়ির একদম কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা দূর্গা প্রতিমার মতো মেয়েটার দিকে, একটু ভয় ভয় কোনোমতে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিল, কেন রেখেছিল তা তখন বুঝিনি, বুঝেছিলাম অনেক পরে, যে বিধবাদের শুভ কাজে থাকতে নেই। 

ওই অপরিচিতদের মাঝে একমাত্র সেই মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়েই যা একটু ভরসা পেয়েছিলাম।


পরে জেনেছিলাম ওর নাম স্বর্ণলতা, আমাদের পাশের বাড়িতেই থাকত। একা বিধবা মেয়ে, বয়স তখন আমারই মতন , বাসর রাতে স্বামী মারা যায়, তাই সেই দোষেই তাকে বাড়ি ছাড়তে হয়, তারপর আমাদের গ্ৰামের মন্দিরে গান গেয়ে একা মানুষের খরচ উঠে যেত। আমার স্বর্গীয় শশুড়ঠাকুর দয়ায়ে পড়ে তার পাশের জমিতে ঠাঁই দিয়েছিল।


বধুবরণ, কালরাত্রী, স্ত্রী আচার সবকিছুর পরে আসল সেইদিন, সেই ক্ষন যেটা নাকি প্রত্যেকটা মেয়ের জীবনের স্মরণীয় মুহূর্ত সেটা আসলো, ফুলসজ্জা। বিয়ের আগের থেকে শুনছি এই দিনের প্রশংসা। তা আমারও হল ফুলসজ্জা, স্মরণীয় মুহূর্তই বটে। একজন অপরিচিত পুরুষ যে কিনা আমার স্বামী সে আমার শরীরটা খুবলে খেলো‌। 


লোকে বলে এ নাকি ভালোবাসা।


আমার বর ঘুমিয়ে পড়ার পরে খুব কেঁদেছিলাম জানিস। সেইদিন হঠাৎ করে বড় হয়ে গিয়েছিলাম, বুঝে গিয়েছিলাম মেয়েমানুষের সমাজে বা সংসারে কোনো দাম নেই, মানিয়ে নিতে পারলেই তার ভালো। 


এরপরের দিন সব আচার, নিয়ম শেষ হওয়ার পর, আত্মীয়রা সব একে একে চলে গেল, ওই বিশাল রাক্ষসের মত ইঁট, কাঠের পাকা বাড়িটা হয়ে গেল ফাঁকা, যদিও আমি ফাঁকা সময়টা পেতাম না, ভাতের হাঁড়ি ঠেলেই দিন যেত, আর রাতে স্বামীর কাছে সোহাগের নামে নিজের ক্লান্ত শরীরটা সমর্পণ করা। আর আমার এই একঘেয়ে, পরিশ্রান্ত, বিক্ষিপ্ত জীবনে এক চিলতে রোদ্দুরের মতন প্রবেশ ঘটেছিল স্বর্ণলতার। 


বধূবরণের অনুষ্ঠানের পর আর স্বর্ণর সাথে দেখা হয়নি। দেখা হয়েছিল প্রায় তার এক সপ্তাহ পর। একদিন ছাদে কাপড় তুলতে গিয়ে দেখি সেও কাপড় তুলছে, সেইদিনই প্রথম ভালোভাবে দেখি ওকে । ধবধবে সাদা থান আটপৌরে করে পড়া, আর এক ঢাল কালো চুল পিঠের উপর পড়ে আছে। অবাক হয়ে দেখছিলাম ওকে, একটা মেয়ে কত সুন্দর হতে পারে, সাধারণ হয়েও কতটা অসাধারণ। 

কতক্ষণ ওর দিকে অমন করে তাকিয়েছিলাম জানিনা, সম্বিত ফিরে পেলাম ওর কথাতেই।


"নতুন বউ বুঝি এই প্রথম আমাকে দেখলে? আমি কিন্তু তোমায় এর আগেও দেখেছি ‌।" বলে এক ভুবন ভোলানো হাসি হেসে উঠলো। সাথে আমিও হাসলাম। ওই দিয়েই কথার শুরু। এরপর ওর সাথে সই পাতাতে বেশি সময় লাগেনি। প্রত্যেকদিন দুপুরে যখন আমার শাশুড়িমা ভাতঘুম দিতেন আর পতিদেব কোর্টে থাকতেন তখন আমি সইয়ের বাড়ি চলে যেতাম। কত কথা হত দুজনের।" 


এতটা বলে থামলেন মৃণালিনী দেবী।


"তারপর?" রূপ জিজ্ঞেস করে উঠলো।


"তারপর আর না, রাত এগারোটা বাজে , বাকিটা কালকে শুনবি , এখন শুতে যা।" মৃণালিনী দেবী কপট রাগ দেখিয়ে বলেন।


রূপ জেদ করলেও, তা ধোপে টেকে না, শুতে যেতেই হল, আর শোওয়া মাত্র ঘুমের দেশে পাড়ি দিল। 


পরের দিন সকাল থেকে রূপ ওর মণিমাকে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে কখন বাকি গল্পটা বলবে। 


"ওরে বাবা দাঁড়া একটু , পুজোটা দিয়ে নিই , আজ আবার পত্রলেখা পত্রিকার সম্পাদক এসে লেখা চেয়ে নিয়ে গেছে, এদের জ্বালায়ে ঠাকুরকে দুটো জল মিষ্টি দেওয়ার যো নেই বাপু।" 

মৃণালিনী দেবী বিরক্তি ভরা গলায় কথাগুলো বলেন ।


রূপ হেসে ফেলে ওর মণিমার কথা শুনে। লেখিকা হলে কি হবে? ওর মণিমা এখনও ঘোর সংসারী, শুধুই লেখালেখির দিকে মন দেওয়া ওনার পক্ষে সম্ভব না।


পুজো টুজো দিয়ে নাতনীকে আবার নিজের মেয়েবেলার কথা শোনাতে বসলেন উনি ‌।


"তো যেটা বলছিলাম কালকে, স্বর্ণ মানে সইয়ের কাছেই আমি আমার মনের কথা যা একটু বলতে পারতাম। 


সই যখন শুনেছিল আমি লিখতে পড়তে পারি না, ও নিজে হাতে আমার অক্ষর পরিচয় করিয়েছিল। সেইদিন সইয়ের বিষয় নতুন কিছু জেনেছিলাম। সইয়ের বাবা নাকি মেয়েদের লেখাপড়ায় ভারী আগ্ৰহী ছিলেন, সইকেও তাই পড়াতেন। ইংরাজী, বাংলা দুই ভাষাতেই তাই সইয়ের ছিল দারুন দখল। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর কাকারা সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিল, আর তারপরে তো সবটা জানাই। 


একদিন দুপুরে গিয়ে দেখি সই একটা মোটাসোটা বই নিয়ে বসে আছে, সেই বই পড়ছে আর চোখের জল ফেলছে ।

আমি কাছে গিয়ে শুধোলাম, "ও কি রে সই, কাঁদছিস কেন? কেউ কিছু বলেছে?"


সই তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে বলল, " নারে, কে আবার কি বলবে। আসলে এই বইটা পড়ে একটু কষ্ট হচ্ছিল আর কি।"


আমি অবাক হয়ে শুধোলাম,"বই পড়ে আবার কারো কান্না পায় নাকি? কেমন বই এটা? কি নাম এটার?"


আমার এহেন বোকা বোকা প্রশ্নে সই হেসে বলে,"হয় রে হয়, বই পড়লে যেমন হাসি পায় তেমন কান্নাও পায় । এই বইটা রবি ঠাকুরের লেখা, "দেনা পাওনা"।


"দেনা পাওনা?", আমি আরও অবাক হলাম নামটা শুনে। আসলে লিখতে পড়তে শিখে গিয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু আমার দৌড় তখন ছিল ওই রামায়ণ মহাভারত অব্দি। 


সই বলল, "দেনা পাওনার নিরুপমার জীবনটা কোথাও গিয়ে সব মেয়েদের সাথেই মেলে জানিস তো। আমাদের বাড়ির লোকেরা আমাদের পরের বাড়িতে দান করে দেয় পণ দিয়ে।" 

আমি হেসে বলেছিলাম, "ওমা, পণ না দিলে বিয়ে হবে কি করে? মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছো বই তো নয়, এইটুকু সহ্যি করবে নে ? আর সহ্যেরই বা কি আছে? মেয়েদের জীবন তো এমনই হয়।"


সই বলেছিল, "কেন? কেন মেয়েদের জীবন ওইরকম হবে? কোন শাস্ত্রে লেখা আছে এমনটা?"


আমি বলেছিলাম, "ওরে থাম দেখি মা থাম, শান্ত হ'তো। এসেছেন আমার মা কালী।" 

তারপর ওর মাথা ঠান্ডা করার জন্য বলেছিলাম, "আচ্ছা, এখানে যে এত বই আছে তোর, আমাকে এগুলো পড়াবি?"

সই উৎসাহের সাথে বলেছিল , "তুই সত্যিই পড়বি সই? তাহলে কাল থেকেই এই বইগুলো তোকে পড়াবো, দেখবি তোর খুব ভালো লাগবে।"


এরপর থেকে প্রতিদিন সইয়ের বাড়ির উঠোনে বসে বসে ওর মুখে গল্প শুনতাম। সত্যিই ভালো লাগতো।"


একটু থেমে মৃণালিনী দেবী আবার বলা শুরু করলেন,"জানিস, একদিন সইয়ের মুখে গল্প শুনছি, হঠাৎ দত্তবাড়ির ছোট বউ সামনে দিয়ে যেতে যেতে একবার আমার দিকে তাকিয়ে সইকে বলল, "বলি তোমার কি কাণ্ডিজ্ঞান বলে কিছুই নেই, নিজে তো ওই বইপত্তর ঘেটেই সোয়ামিটারে খেয়েছো, এখন এই নতুন কচি বউটার মাথাটাও খাবে? সুন্দরী বলে তো খুব দেমাক, তা সোয়ামিটারে তো বিয়ের রাতেই গিললে, ওই কথায় আছে না, অতি বড় সুন্দরী না পায় বর, তোমার হয়েছে বাপু ওই দশা। শোনো নতুন বউ তোমাকে বলছি, সিঁথির সিঁদুরের যদি মায়া থাকে তাহলে এই অভাগীর বাড়িতে আর এসো নে।"


শেষের কথা গুলো আমার উদ্দেশ্যে বলে বউ চলে গেল।


আমি সইয়ের দিকে তাকালাম, তাকিয়ে চমকে উঠলাম, ভেবেছিলাম সইয়ের চোখে জল দেখবো, কিন্তু না! দেখলাম সেই অপূর্ব সুন্দর চোখদুটো তে এক অদ্ভুত কঠোরতা আর একরাশ ঘৃণা, এই সমাজের প্রতি একরাশ ঘৃণা।


আমার দিকে চেয়ে সই বলল, "তুই এখন বাড়ি যা, বেলা হয়েছে ঢের, এরপর তোর খোঁজ পড়ল বলে।"


আমি তাও স্থির হয়ে বসে আছি দেখে সই মুখে ব্যাঙ্গের হাসি টেনে বলল," আমার এসব কথা শোনার অভ্যাস আছে সই, আমার কথা ভাবিস না, বিধবা মানুষের জীবনে এর চেয়ে বেশি কি বা আশা করা যায়, তায় আবার যুবতি বিধবা, আমরা মেয়েরাই না মেয়েদের সবচেয়ে বড় শত্রু জানিস তো।

একটা মেয়েই সবসময় আরেকটা মেয়েকে খোঁটা দেয়। মেয়ে জাতটার কিছুই হবে না, যতদিন না তারা নিজে একেঅপরের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে , কোনো বিদ্যাসাগরই কিছু করতে পারবেন না। "


আমি অবাক চোখে মেয়েটার দিকে তাকালাম, সেইদিন ওকে আমার আর নিজের সই বলে মনে হচ্ছিল না, মনে হচ্ছিল এক পরিপূর্ণ মুক্ত নারী, যে আমাকে সমাজে নিজের জায়গাটা দেখিয়ে দিয়ে গেল। 

সেই প্রথম আমার নিজেকে মেয়েমানুষ না ভেবে মানুষ ভাবতে ইচ্ছে হল, সেই প্রথম আমার নিজেকে পুরুষতন্ত্রের বাঁধন থেকে আলগা করতে ইচ্ছে হল, সেই প্রথম আমার বাঁচতে ইচ্ছে হল। 


এক অদ্ভুত মন নিয়ে সেইদিন আমি বাড়ি ফিরে এলাম, কিন্তু বিধাতা বোধহয় স্থির করে ফেলেছিলেন যে আমায় উনি মেয়েমানুষ থেকে মানুষ করেই ছাড়বেন। 


বাড়ি ফিরতে একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল সেইদিন। ফিরে দেখি আমার দেবতা সমান স্বামী আর শাশুড়িমা মুখ ভার করে দালানে দাঁড়িয়ে আছেন ।

আমাকে দেখেই জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো, "কোথায় ছিলে এতক্ষণ? ওই বিধবা বেশ্যার বাড়িতে?"


আমাকে পাঁচটা কথা শোনালেও বোধহয় চুপ করে থাকতাম, কিন্তু সইয়ের বিষয় সেইদিন আর একটা খারাপ কথাও সইতে পারলাম না । 


চিৎকার করে বললাম," মুখ সামলে কথা বলুন, কাকে বেশ্যা কইছেন আপনি? ওই ফুলের মতন পবিত্র মেয়েটাকে? ছিঃ!"


আমার এই রূপ দেখে ওরা দুজনেই চুপ করে গেল।


শাশুড়িমা বলে উঠলেন," দেখ খোকা দেখ, আরও মাথায় তোল বউকে, দুদিন আগেও যে সাত চড়ে রা কাটত না সে এখন মুখে মুখে তক্ব করছে।"


আমিও সেইদিন চুপ করে থাকলাম না, বললাম,"মেয়েরা চুপ করে থাকে বলেই মেয়েদের এই দুর্দশা , আচ্ছা মা, আপনিও তো একটা মেয়ে, আরেকটা মেয়ের সাথে এমন ব্যাবহার কি করে মেনে নেন আপনি?"


ঠাস! সশব্দে একটা চড় নেমে আসল আমার গালে ....... 


আর চড়টা মারল আমার সভ্য, শিক্ষিত, চরিত্রবান স্বামী। অবশ্য শুধু চড়েই থেমে থাকেনি, অকথ্য ভাষায় গালি আর জুতো দুটোই একসাথে চলছিল। 


মাথা ফেটে রক্ত বেরোচ্ছিল আমার আর সেটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছিলেন আরেকটা মেয়ে , আমার শাশুড়িমা। 

বলা বাহুল্য আমি এক ফোঁটাও চোখের জল ফেলিনি, একবারও ব্যাথায় চিৎকার করিনি। আমার স্বামী আমায় মারতে মারতে হাঁপিয়ে গেছেন কিন্তু আমি মার খেতে খেতে হাঁপাইনি। এটা দেখে উনি আরও রেগে গেলেন। টানতে টানতে ঘরে নিয়ে বিছানায় ছুড়ে ফেললেন, দরজা বন্ধ করে আমায় আদরে আদরে ভরিয়ে দিলেন। 


হ্যাঁ, সমাজের চোখে সেটা ভালোবাসাই বটে কিন্তু আমার কাছে সেটা ধর্ষণ।


নিজের পুরুষত্বের স্বাদ মিটিয়ে উনি ঘুমিয়ে পড়লেন। আমিও আর না পেরে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিলাম।" 


বলতে বলতে গলাটা ঈষৎ কেঁপে উঠলো মৃণালিনী দেবীর, এতটা বলে উনি একটু থামলেন।


হঠাৎ রূপ ওর মণিমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। মৃণালিনী দেবী ওকে থামালেন না, বরং সস্নেহে মাথায় হাত রাখলেন।


খানিক বাদে রূপ চোখ মুছে বলল," তারপর কি হল মণিমা?"


হালকা হেসে মৃণালিনী দেবী আবার বলা শুরু করলেন," ভোরের আলো তখন সবে ফুটছে, ঘুম ভেঙে গেল আমার, নিজের অবসন্ন শরীরটা টেনে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। নিজেকে দেখে হাসিই পেলো , হাসি পেল নিজের ভাগ্যকে দেখে, শরীরটা খুবলেই খেয়েছে বটে জানোয়ারটা । কিন্তু সংসার তো এসব কথা শুনবে না। স্নান সেরে আবার ঘরের কাজে লেগে পড়লাম। আমার স্বামী বা শাশুড়ির কালকের ঘটনা নিয়ে কোনো তাপ উত্তাপ নেই।


সেইদিন দুপুরে আবার গেলাম সইয়ের কাছে। সই আমাকে দেখে আঁতকে উঠলো, দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করল,"একি সই , তোর এই অপস্থা কি করে হল?"


আমি হেসে বললাম," সইরে সধবা আর বিধবার মধ্যে কোনো তফাতই নেই, শুধু একটাই ফারাক, বিধবা নির্যাতিত হয় ফাঁকা সিঁথির জোরে আর সধবারা অত্যাচারিত হয় ভরা সিঁথির জোরে।" বলে জোড়ে হেসে উঠলাম। 


সই বোধহয় কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিল তাই আর কিছু বলল না।

আমিও আবার বাড়িতে। ফিরে এলাম। এসে ঘরে পড়ে গেলাম। জ্ঞান যখন ফিরল দেখি আমার বর আর শাশুড়ি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। জানতে পারলাম আমি মা হতে চলেছি।"


" সেইদিন থেকে যত্নআত্তি শুরু হয়ে গেল আমার, সবার তখন আমাকে নিয়েই চিন্তা, সইও খুব খুশি ছিল খবরটা শুনে তবে ওর বাড়ি আর বেশী যাওয়া হত না।" 


মৃণালিনী দেবী বলে চলেছেন,"বলতে বাধা নেই, অত যত্ন পেয়ে আমি দুদিন আগের সব বিষাদ মাখানো স্মৃতি নিমেষে ভুলে গেলাম, মনে হল এর বেশী আর কি চাই জীবনে? আর এই ভুলে যাওয়াটাই আমার কাল হল এরজন্যই আমি....." 


আর বলতে পারেন না মৃণালিনী দেবী। কেঁদে ফেলেন ঝরঝর করে। 

রূপ বলে, "মণিমা আর শুনতে চাই না গো, যা শুনিয়েছো তাই অনেক, এর চেয়ে বেশি কষ্ট নিতে পারব না গো।" 


মৃণালিনী দেবী বলেন,"নারে মা, আজ আমায় সবটা বলে একটু হালকা হতে দে , এই ভার আর বইতে পারছিনা।"

বলে আবার বলা শুরু করেন," তখন আমার তিন মাস চলছে, সেইদিন দুপুরে আবার একটু সইয়ের বাড়ি গেলাম।

গিয়ে একটু অবাকই হলাম, বরাবর দেখেছি, সই দুপুরের দিকে দালানে এসে বই পড়ে , কিন্তু সেইদিন সারা নীচতলাতে খুঁজেও ওকে কোথাও পেলাম না। 


হঠাৎ কানে এলো, একটা মেয়ে কোনো পুরুষের সঙ্গে কথা বলছে, মেয়েটার গলাটা যে সইয়ের তাতে তো কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু পুরুষের গলাটাও যেন ভারী চেনা চেনা ঠেকলো। কৌতূহলবশত উপরে সইয়ের ঘরে গেলাম।


কিন্তু গিয়ে যা দেখলাম তার জন্য আমি একটুও প্রস্তুত ছিলাম না । সই আর আমার স্বামী একই ঘরে, একই খাটে, একসাথে এমন অন্তরঙ্গ মুহূর্তে শুয়ে আছে।


আমার মুখ থেকে নিজের অজান্তেই বেড়িয়ে গেল,"ছিঃ" কাঁদতে পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিলাম আমি। আমার আওয়াজে ওরা দুজনেই চমকে তাকালো আমার দিকে, আমার স্বামী ভয় চমকে উঠল আর সই শুধু শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো।


"আমার বর আমায় দেখে তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে গেল বাড়ির থেকে।


সই খালি একবার অস্ফুটে বলল,"সই!"

আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না, বললাম,"আমার এই সর্বনাশটা না করলেও পারতি।"

বলে বেড়িয়ে এলাম।


বাড়িতে এসে দেখি আমার বর বাড়িতে ফেরেনি । ভালোই হল, ওই সময় একটু একা থাকা আমার দরকার ছিল।


বারবার সমস্ত ঘটনাটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল, যেটা বারবার এড়িয়ে যাচ্ছিলাম সেটা হল সইয়ের বেদনা মাখানো দুটো চোখ। 


আমি যে সইকে কতবড় আঘাতটা দিয়ে ফেলেছি সেটা সেই রাতেই বুঝতে পারলাম। আমার স্বামী সেইদিন রাতে আকণ্ঠ মদ গিলে ঘরে ঢুকলো। 


ঢুকেই আমার গলা ধরে জড়ানো গলায় বলে উঠলো, "এই শালী! আমি... আমি আজ তোকে মেরেই ফেলবো, স.... সব সময় ভুল জায়গায় , ভুল সময় যেতে হয় তোকে। কি হয়েছিল ওই মাগীটার সাথে একটু ফূর্তি করছিলাম তো? সোজা ঘরের ভিতর ঢুকে এলি? আর ওই শালা মেয়েমানুষটা হয়েছে আরেক জ্বালা , বারবার বাধা দিচ্ছিলো, আবার বলে কিনা, আমার সইটাকে এত কষ্ট দেবেন না, এতকাল আপনাকে আমার মান নিয়ে খেলতে দিয়েছি, কেবল ঠাঁইয়ের আশায়ে, কিন্তু আমার সইটার কপাল পোড়াবেন না" আরে ধুর! বিধবা বেশ্যা, তার আবার মান সম্মান।"


আমি আর সহ্য করতে না পেরে সজোড়ে একটা চড় কষিয়ে দিলাম অমানুষটার গালে। 


আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না রে রূপ, আমি আমার অমন ভালো সইটাকে এত নীচ চোখে দেখলাম? আরে ওর তো কোনো দোষই ছিল না।


রাগে, লজ্জায়, কষ্টে আমার মনটা পুড়ে যাচ্ছিল। আমার স্বামী কিনা একটা মেয়ের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিল? 


পাগলের মতন ছুঁটে গেলাম সইয়ের বাড়িতে , ওর কাছে যে আমায় ক্ষমা চাইতে হবে, কিন্তু সইয়ের ঘরে ঢুকে দেখি কার কাছে ক্ষমা চাইব? সে যে আর নেই।


"নেই মানে?" রূপ উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করে।


" সইয়ের নিথর দেহটা মেঝেতে পড়ে আছে, সাদা থানটাও রক্তে লাল হয়ে গেছে, হাতের শিরাগুলো এলোমেলো ভাবে কাটা ব্লেড দিয়ে, আমার সই....... আমার সই আত্মহত্যা করেছে।" 

বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন মৃণালিনী দেবী।


"আমি চিৎকার করে উঠলাম, তাড়াতাড়ি ওর কাছে গিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতন ওকে ডাকতে লাগলাম, কিন্ত কোনো সাড়া পেলাম না রে। 


হঠাৎ চোখে পড়ল পাশে রাখা চিঠিটা । মনে হল ওটা আমাকে উদ্দেশ্য করেই লেখা, খুলে ফেলে পড়তে শুরু করলাম।"


প্রিয় সই,

আমি জানি তুই এতক্ষণে বুঝে গিয়েছিস আমি নির্দোষ, হয়ত পাগলের মতো আমার কাছে এসেছিস কথা বলার জন্য, আর এসে দেখছিস আমি আর নেই। কি তাই তো? 


তাই তো নীরবে, নিঃশব্দে চলে যেতে পারছিনা, তোকে বেশ কিছু কথা বলার আছে যে, আজ দুপুরে তোর সোয়ামীর সাথে আমাকে অমন ভাবে দেখে যে তুই কতটা কষ্ট পেয়েছিস তা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না, আর ঠিক ততটাই কষ্ট আমিও পেয়েছি ধর্ষিতা হয়ে, নিজের পবিত্রতা নষ্ট করে। 


আমার আত্মসম্মান বোধ কতটা তা তো তুই খুব ভালো করেই জানিস, তাই বলতে দ্ধিধা নেই তোর জায়গায় অন্য কারোর স্বামী হলে আমি তাকে খুন করতে দুবার ভাবতাম না, কিন্তু তুই আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ, তাই তো তোর সিঁথিটা ফাঁকা করতে পারলাম না, তাই আমিই এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছি। 


দুদিন পর তোর সন্তান এই পৃথিবীতে আসবে সই , সে ছেলে হোক বা মেয়ে, ওদেরকে সঠিক দিস সই , কোনো তফাত করিস না ছেলেতে বা মেয়েতে। আরেকটা অনুরোধ রাখবি? মেয়ে হলে ওর নাম স্বয়ংসম্পূর্ণা রাখবি? যাকে সম্পূর্ণ করতে কোনো পুরুষ লাগে না, যে নিজেই নিজের পরিপূরক। এর বেশী আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই রে।


ভালো থাকিস, ভালো রাখিস।


                        ইতি,

                 তোর, শুধু তোর,

                        সই



মৃণালিনী দেবী একটু থেমে, চোখের জলটা মুছে ফেললেন, তারপর বললেন,"চিঠিটা পড়তে পড়তে আমার হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু না আমি ততদিনে নিজেকে শক্ত করতে শিখে গিয়েছিলাম, আমি ততক্ষণে স্থির করে ফেলেছিলাম, আমাকে কি কি করতে হবে। 


পাড়ার লোকদের ডেকে সইয়ের মৃত দেহটা সৎকারের ব্যবস্থা করলাম। সবাই তো সইয়ের চরিত্র নিয়ে বাজে কথা বলছিলই, সেটা আরও বেড়ে গেল যখন আমি সবার বিরুদ্ধে গিয়ে সইয়ের মুখাগ্নি করলাম। 


বাড়িতে ফিরে শাশুড়িমা আরেকপ্রস্ত খারাপ কথা শোনালেন। কিন্তু গায়ে হাত তুলতে পারলেন না কারণ আমার পেটে তখন একটু একটু করে বেড়ে উঠছে ওনার বংশধর।


কিন্তু আমি এইটুকুতেই থেমে থাকলাম না রে, আসল কাজ যে তখনও বাকি।

সই মারা যাওয়ার ঠিক তিনদিন পরে ওর শ্রাদ্ধ হলো, অপঘাতে মৃত্যু রে।


সেইদিন রাতেই আমি যা করার করলাম, আমার স্বামীর রাতের খাবারে এক শিশি ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিলাম, সেই যে ঘুমালো, ওই ঘুম আর ভাঙলো না।

কি? 


অবাক হচ্ছিস তো কথাটা শুনে? সত্যিই বলছি, আমি আমার স্বামীকে নিজে হাতে খুন করেছি, মেরে ফেলেছি ওকে , কেউ বুঝতেও পারেনি। ডাক্তার বলেছে হার্টফেল করেছে। হ্যাঁ, আমিই ওই ধর্ষকটাকে মেরে ফেলেছি।"


"মণিমা, তুমি?" অবাক গলায় বলে রূপ।


" হ্যাঁ রে, আমি। জানি তোর এখন আমার প্রতি ঘৃণা জন্মাচ্ছে, কিন্তু এই নিয়ে আমার কোনো আফশোস নেই, আমার সই আমার সিঁথির সিঁদুরের জন্য নিজের মান, নিজের জীবন ত্যাগ করেছিল, তাই আমিও ওর মানের জন্য নিজের সিঁথির সিঁদুর ত্যাগ করলাম‌‌। পুত্রশোকে কাতর হয়ে আমার শাশুড়িমাও মারা গেলেন। 


লোকে বলাবলি শুরু করল সইয়ের নাকি আমাদের বাড়ির উপর কুনজর পড়েছে।


আমি সহ্য করতে না পেরে হালিশহরের পাট চুকিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসি। সেখানেই জন্ম হয় তোর মায়ের, সইয়ের কথা মত তার নাম রাখি স্বয়ংসম্পূর্ণা‌।

বাড়ির অনেকে অনেক কথা বলত, তোর মাকে লেখাপড়া শেখানো নিয়ে কিন্তু আমি কারোর কথায় কান দিতাম না। তোর মাকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়েছিলাম‌, মানুষ করেছিলাম একার উপার্জনে। তোর মায়ের যখন দু বছর বয়স তখন প্রথম আমার কবিতা ছাপা হয়। ওই দিয়েই এখনও চলছে। "


"জানি তুই আমাকে খুনী ভাবছিস, কিন্তু আমার আর কিছু করার ছিল না রে।" বলে চোখের জলটা মুছলেন মৃণালিনী দেবী।


এবার মুখ খুলল রূপ," না গো মণিমা, তুমি কোনো ভুল করোনি মা করেছো একদম ঠিক করেছো , এমন সাহস থাকে বলতো?"


একটু হেসে নাতনীর মাথায় হাত রাখলেন মৃণালিনী দেবী, বললেন, "এই কথাগুলো না কাউকে বলে হালকা হওয়ার দরকার ছিল রে সোনা। কিন্তু এখন অনেক রাত হয়েছে, আর একটু পরেই ভোর হবে, এখন গিয়ে একটু শুয়ে নে, কাল তো আবার চলে যাবি।"


রূপ ঘরে চলে গেল। মৃণালিনী দেবী টানা বারান্দাটায় এসে দাঁড়ালেন।


সূর্য তখন সবে উঠছে, হঠাৎ মনে হল সূর্যর পাশে আরেকটা মুখ ভেসে উঠল।


অবাক চোখে দেখলেন মৃণালিনী দেবী, মুখটা অবিকল তাঁর সইয়ের, সেই অপূর্ব চোখ, মায়া মাখানো মুখ, সেই পবিত্র হাসি। সম্পূর্ণ স্বর্ণলতা। মুখটা যেন মৃণালিনী দেবীকে বলছে-


"তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি,

সকল খেলায় করব খেলা এই আমি।

নতুন নামে ডাকবে মোরে বাঁধবে,

বাঁধবে নতুন বাহু ডোরে,

আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।

তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,

তারার পানে চেয়ে চেয়ে,

নাই বা আমায় ডাকলে।।"



সমাপ্ত











Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics