Sangita Duary

Classics Others

3  

Sangita Duary

Classics Others

সই

সই

5 mins
216



তিনমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে ঘনঘন ঘড়ি দেখছে রুকমা, ঝিলমিলটা আসতে পারবে তো? কাকিমার যা নজরদারি! বাপরে! একসংসারে থাকতে রুকমা দেখেছে, হেঁসেলের দায়িত্ব শাশুড়িমা নিলেও ভাড়ার দায়িত্বে ছিলেন ঝিলমিলের শাশুড়ি, মানে রুকমার খুরশাশুড়ি।

একবার, বারোমেসে কাজের দিদি নমিতা চা করতে গিয়ে লুকিয়ে একচামচ গুঁড়ো আমূল দুধ খেয়ে ফেলেছিল লোভে, বাপরে! কাকিমা টানা একসপ্তাহ তাকে চা খেতে দেয়নি, এমনকি বাড়ি থেকেও চিরকালীন ছুটি হয়ে গিয়েছিল নমিতার।

সেই কাকিমার চোখ এড়িয়ে আসতে পারবে তো ঝিলমিল?

যখন পরিবার ভাঙলো, রুকমার শ্বশুরমশাই এবং ঝিলমিলের শ্বশুরমশাই একবাড়িতে পার্টিশন তুললেন, সম্পর্কগুলোও কি রকম পার্ট পার্ট আলাদা হয়ে গেল!

ঝিলমিলের বিয়ের সময় সপরিবারে নেমন্তন্ন হলেও নেমন্তন্ন করতে গিয়েছিলেন কেবল রুকমার শ্বশুরমশাই। নতুন বউয়ের হাতে একটা গয়নার কৌটো ধরিয়ে না খেয়ে বাড়ি ফেরত এসেছিলেন।

কুণাল, মৃণাল তো একসঙ্গে বড় হয়েছে, দুই ভাইয়ের মধ্যে সদ্ভাবও কম ছিল না, একমাত্র দেওরের বিয়েতে কি আমোদ আহ্লাদটাই না করতে পারতো রুকমা!

কবে যেন ঝিলমিলের সাথে বন্ধুত্ব হলো রুকমার?

হ্যাঁ, মনে পড়েছে। বাড়ির ঘরগুলো ভাগ হলেও চিলেকোঠার ঘরখানি অভিন্ন রয়ে গিয়েছিল। কোনোকালে বাড়তি জিনিস ভরানো ছাড়া আর কেউ ওই ঘর মাড়াতো না। রুকমার ঠিক ওই ঘরটিই প্রথম থেকেই বড্ড প্রিয় ছিল, একখানা গল্পের বই হাতে প্রায়ই সে চলে যেত চিলেকোঠার ঘরে। সেদিনও দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চিলেকোঠায় গিয়েই অবাক। ওমা! এই অন্ধকার ঘরে টেবিলে মুখ গুঁজে কে ও?

সেদিন খুব কাঁদছিলো ঝিলমিল। দুই গালে অশ্রু মেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল। অতো বড় বাড়িতে বয়স্ক শ্বশুর শাশুড়ি ছাড়া আর কেই বা আছে কথা বলার মত? মৃণাল সেই যে সকালে বেরিয়ে যায় ফেরে রাত করে। অনেকদিন থেকে বাপের বাড়ির জন্য মনখারাপ করছিল। মৃণাল কে বলায় সেও সাফ না জানিয়ে দিল। নতুন বউয়ের মন তো ভাঙবেই।

সেইদিনই বোধহয় দুই বউ দুটি বন্ধু পেয়েছিল। একে অপরের ঘরে গেলে সবাই জানবে, অশান্তি বাড়বে, তাই দুপুরের খাওয়া সাঙ্গ করে দুই বউ ভিতর থেকে ঘরে খিল এঁটে ভিতর দরজা দিয়ে চিলেকোঠায় হাজির হয়। বাকিরা ভাবে, হয়তো বউরা ঘুমোচ্ছে। 

চিলেকোঠায় দুজনে গপ্পো করে, গান গায়, শ্বশুর শাশুড়ির নিন্দে মন্দ করে, ছোটবেলার গল্প শোনায়, প্রেমের গল্প করে, বাহারি চুলের খোঁপা বাঁধতে শেখে, নিত্য নতুন রান্নার রেসিপি শেখে।

রুকমা আঁচলে লুকিয়ে ঠোঙায় করে চানাচুর আনে, ঝিলমিল নিয়ে আসে নিমকি।

আর একঘেঁয়ে লাগেনা দুজনের। পার্টিশন দেওয়া দুই সংসার দুপুরবেলায় রোজ এক হয়ে যায় চিলেকোঠার ঘরে।

পুজো আসছে সামনে, ঝিলমিলই প্রস্তাব দিয়ে ছিল," শপিংয়ে যাবে দিদি? গড়িয়াহাট, কিংবা নিউ মার্কেট? ওখানে তো কেউ নজরদারি ফলাবে না, চলোনা, একসঙ্গে লাঞ্চ করবো, সম্ভব হলে একটা মুভিও... যাবে? দিদি?"

-" কিন্তু কাকিমাকে কি বলবে? মা ও তো..."

-" আরে, ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়, বলবে মায়ের কাছে যাবে একবার, কিংবা বলবে ,একটু কেনাকাটা আছে...

কেনাকাটা তো করতে যেতেই পারো নাকি? শুধু আমরা দুজন একসঙ্গে যাচ্ছি,এটা না জানলেই তো হলো!, কিগো দিদি, যাবে..?"


ওই তো ঝিলমিল আসছে...

রুকমার সামনে এসে হাঁফাচ্ছে ঝিলমিল," চটপট ট্যাক্সি ডাকো একটা, ফেরার সময় নাহয় বাস ধরবো!"

ট্যাক্সিতে বসে পিছনের সিটে শরীর ছেড়ে দিলো ঝিলমিল, হাঁফাচ্ছে তখনও। রুকমার চোখে উদ্বেগ," কি রে? কি হয়েছে? এত দেরি করলি? আমি তো ভাবলাম আর আসবিই না!"

ঝিলমিল এবার সমে ফিরেছে, "আর বলোনা, চেন তো তোমার খুরশাশুড়িকে। বেরোতে যাবো, একটা নারকেল ধরিয়ে দিলো, বললো কুরে দাও, নাড়ু বানাবো। বোঝো! জ্যেঠাইমাকে গড়, কি করে যে এত বছর একসঙ্গে সংসার করলেন দুজনে!"

রুকমা হোহো হেসে ওঠেন, "ভাগ্যিস, দুই বাড়ি ভিন্ন হয়েছিল, নাহলে একসংসারে থেকে তুইও পরবর্তী কালে আমার মাথার ওপর দাঁড়িয়ে নাচতিস"।

দুই জায়ের হাসি আর থামেনা।


ধর্মতলা চত্বরে সারাবছর নানান পসরা ছড়িয়েই থাকে, জামাকাপড়, ব্যাগ, জুতো, খুচরো গয়না।

লাঠিতে ঝোলানো প্রায় শ পাঁচেক গয়না সাজিয়ে দাঁড়ানো লোকটির সামনে দরদাম করছে ঝিলমিল। এখনকার বাজারচলতি জাঙ্ক জুয়েলারি, লোকাল দোকানের তুলনায় অর্ধেক দাম। ইচ্ছে করে পুরো লাঠিটাই কিনে ফেলতে। আজকাল তো অক্সিডাইজড গয়নার দারুন চল, হাতে বানানো সুতো, কাপড় কিংবা দড়ির লেখাজোকা গয়নাও বেশ চলছে, হালকাপুলকা, শাড়ি সালোয়ার কিংবা যে কোনো মডার্ন আউটফিটে দারুন যায়।

বেছে বেছে ডজন খানেক কিনে ফেললো ঝিলমিল, কিনলো রুকমাও, শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে বেশ কয়েকটা হার কানেরের সেট।

ব্যাগের দোকানের লোকগুলো বড্ড দাম বাড়িয়ে বলে। মেরুন একখান ভারী পছন্দ হয়েছিল রুকমার। দাম শুনে পিছু হাঁটা ইচ্ছে হলো। ঝিলমিল দেড় হাজারের ব্যাগটা তিনশো টাকায় পাইয়ে দিলো। ভাবা যায়! জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে।

আজকাল তো অনলাইনে সব পাওয়া যায়, কোনো ক্রাউড নেই, ঘাম নেই, কষ্ট নেই, শুধু ঘরে বসে মোবাইলে একটা ক্লিক। তবু এইযে দরদাম করে ঘেমে নেয়ে ঘুরে ঘুরে বাজার করার একটা মজা আছে, একটা ফিল আছে, বাঙালিয়ানা আছে।

নিউমার্কেটে পছন্দের বুটিকে ঢুকে একটা কাঁথা স্টিচ খুব মনে ধরেছে ঝিলমিলের। দাম জিজ্ঞেস করতে যাবে, পিছন থেকে রুকমা দোকানদারকে বলে নামিয়ে নিলো শাড়িটা। মনটা খারাপ হয়ে গেল ঝিলমিলের, ইশ! দিদির ওটাই পছন্দ হতে হলো?

মুখে বললো, "খুব সুন্দর, তোমায় দারুন মানাবে।"

রুকমা মুচকি হেসে শাড়িটা ঝিলমিলের গায়ে ফেলে বললো, "সত্যিই রে, দারুণ মানিয়েছে তোকে।"

ঝিলমিল আনন্দে জড়িয়ে ধরে রুকমাকে,"থ্যাংক ইউ দিদি!"

স্ট্রিট ফুডের একটি দোকানের মুখোমুখি দুটো চেয়ারে বসে আছে ওরা দুজন, সামনে সমুদ্র নীল ঠান্ডা পানীয়। স্ট্র দিয়ে চুমুক টেনে ঝিলমিল বলে, "কি সুন্দর দিনটা কাটলো আমাদের, বলো দিদি? আমরা যদি একসঙ্গে এক সংসারে থাকতাম কত মজা হত বলো তো?"

রুকমা মৃদু হাসে, "না রে, একসঙ্গে থাকলে হয়তো হতো না! আসলে তোর আমার সম্পর্ক টা এমনই এক সম্পর্ক যেখানে দাঁড়িপাল্লায় অধিকার মাপা হয়, দায়িত্ব কর্তব্য মাপা হয়, কাজের হিসেব মাপা হয়।

প্রথম প্রথম ভালো থাকলেও একটা সময় এসে আমার মনে হতই, দুবেলা আমি একাই বা কেন রান্নাঘর সামলাব কিংবা খাবার পরিবেশনের ভারটা আমি একাই বা কেন নেব?

তোরও একটা সময় মনে হতেই পারতো, দিদি আগে বউ হয়ে এসেছে বলে ওর কথা সবাই মানবে কেন? হতই রে, আমরা তো মানুষ, খারাপ জিনিস যেমন বেশিদিন বুকে জমিয়ে রাখতে পারিনা, তেমনি ভালো জিনিসও খুব বেশিদিন বুকে আগলে রাখতে পারিনা রে। এটাই বাস্তব। ভালো জিনিস ঠিক চাটনির মত, চুকচুক করে আঙ্গুল দিয়ে চেটে চেটে আয়েশ করে খেতে হয়, একেবারে শেষ পাতে। বুঝলি?"

-" বুঝলাম, আর এও বুঝলাম, শেষ পাতে চাটনির মত মাঝে মাঝে টকও খেতে হয়, স্বাদ বদলের জন্য।"

রুকমার ভ্রুতে ভাঁজ, "মানে?"

-" আহা মানে বুঝলে না? এই যে দুজন বাড়িতে গাপ্পি দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, এটাই তো টকের মত চটকদার, নয় কি বলো?"

ঝিলমিল রুকমার হাতের উপর হাত রাখে, "দিদি, দুই পরিবারে মধ্যে যাই হয়ে থাকুক, আমরা কিন্তু এক থাকবো, দুজন দুজনের সুজন হয়ে, বন্ধু হয়ে, থাকবে তো?"

-" থাকবো, দুজনের মধ্যে বিবাদের আর তো কোনো কারণ দেখছি না।"

গ্লাসের তলানি শেষ করে উঠে পড়ে দুজন। এবার গন্তব্য বাড়ি, আর অপেক্ষা একটা বাসের জন্য। দুজন পাশাপাশি বসবে, নামবেও একসঙ্গে, কিন্তু বাড়ি ফিরবে আলাদা। দুজনের ঠিকানা যে আলাদা। মস্ত বাড়ির মাঝে একটা পার্টিশনের মত ওদের সম্পর্কেও একটা বিশাল পার্টিশন। শুধু একটা জায়গা নিরবিচ্ছিন্ন, চিলেকোঠা, ওদের বন্ধুত্বের আঁতুরঘর, একটা পবিত্র সম্পর্কের ঠিকানা।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics