শঙ্কু ও স্পিরিটোন
শঙ্কু ও স্পিরিটোন


২রা মে, ২০১৯
আজ সকাল থেকেই মনটা ঠিক লাগছিলো না , সত্যবাবুকে আজ ২৭ বছর হলো জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে পারছি না। রাশিয়ায় দীর্ঘজীবন লাভের ওষুধটা আবিষ্কার যে করেছি সেটা উনি লিখে যেতে পারলেন না । জগতের থেকে নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছি তাই এইসব মনখারাপের বালাই ছিলো না । গতমাসে ব্রিটেন থেকে পাওয়া চিঠিটার পর থেকে আবার ইচ্ছে করছে জগতের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে কিন্তু কার সাথে করবো ?
প্রদোষ , মগনলাল , হীরকরাজ , বিজ্ঞানী , তোপসে , অপু প্রমুখরা আজ তো কেউ নেই , কার সাথে বলব কথা ? মনটা ভার হয়ে ছিলো এমন সময় ভ্লাসেন এসে খবর দিলো যে বাইরের ঘরে আমার স্পিরিটোনটা নাকি বাজছে খানিক্ষণ ধরে ।
স্পিরিটোন - গত ৪০ বছরে এটা আমার প্রথম আবিষ্কার , কোনো ফলাফল এখনও পাইনি । মৃত্যুর পর কি মানুষের সাথে কথা বলা যায় ? এই ভাবনা থেকেই এটা বানানো কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো সিগন্যাল ধরেনি । আজ তবে ?
আমি ও ঘরে গিয়ে দাঁড়াতেই স্পিরিটোনটা ফের বাজতে শুরু করলো । একমুহূর্ত ভেবেই ফোনের রিসিভারের মত পার্টটা ধরলাম । ওপাশ থেকে প্রশ্ন , " কি শঙ্কু আঙ্কিল , কেমোন আছেন ? "
এই গলা আমার চেনা । মগনলালের । বন্ধু নয় তবে বেশ কয়েকবার প্রদোষের মুখে শুনেছি । একবার লণ্ডনের বিমানে ওনাকে দেখেছি । চোরা কারবারি করে করে ওনার যে পসার হয়েছিলো এবং মূর্তি চুরি , ড্রাগস ইত্যাদির জন্য যে ওনাকে হাতে নাতে প্রদোষ ধরেছিলো তা সত্যবাবু আর প্রদোষ অনেকবার আমায় বলেছে । তবু জীবনের শেষদিন অবধি উনি নানা নতুন জিনিস স্মাগল করার সাথে যুক্ত ছিলেন ।
উত্তর না দেওয়ায় ফের প্রশ্ন , " কি আঙ্কিল , হামাকে ইয়াদ করতে পারছেন না ? আজ আপকে সাথ ছোটামুটা বাত করার মন করলো অওর হামি জানতে ভি পারলাম স্পিরিটোনের কথা । তাই ... "
আমি বললাম , " হুমম , বুঝলাম । পরলোক কেমন লাগছে ? "
ফের উত্তর এলো , " দারুণ আছে পরলোক । আসবেন নাকি আঙ্কিল ? ইশ , হামি ভি ভুলে গেছে কি হামাদের প্রফেসর পরলোকে আর আসতে পারবেনই না । তো ভো দাওয়া ক্যায়সে মিলা ? "
আমি বুঝে গেছিলাম মগনলালের পারলৌকিক অস্তিত্ব কোন দাওয়ার কথা বলছেন । আমি তবুও নাটকের সুরে বললাম , " কোন দাওয়ার কথা বলছেন ? "
বললেন , " ভো যো আপকো ইতনাদিন জীবিত রেখেছে , অওর অমর ভি হোবেন সায়েদ । "
আমি বললাম , " মেঘরাজ জি ওই ওষুধ কোথাও প্রকাশ করিনি আর করবোও না কারণ সত্যবাবু যে জিনিসের কথা সকলকে লিখতে পারেননি । আর গোটা জগতে আমার বন্ধুবর্গের কেউই নেই , তো বৈজ্ঞানিক কিছু আমি প্রকাশ করবো না । আর আপনার দরকার কীসের বলুন তো ? না ওই নিয়ে বিজনেস করতে পারবেন না আপনি ওই নিয়ে নিজের আয়ু বাড়াতে পারবেন । তো ? "
মগনলাল বললেন , " হামি কীসের জন্যে চাইবে ? হামার উদ্দেশ কুছ অওরই আছে । "
আমি মগনলালের ইচ্ছা জানার পর রীতিমতো চমকে গেলাম ।
মগনলাল বললেন , " হামার বেটা জীবনলাল আভি ৭০ সাল উমর , এক মেডিসিন কোম্পানি কা ভো চিফ । হামি চাই কি ওকে আপনি ভো দাওয়াই দিবেন । মেঘরাজ ফার্মাসির নামে ও পুরা ওয়ার্ল্ডে ভো ফেয়লাও করবে । "
আমি সোজা না করে দিলাম । বললাম , " কোনোভাবেই একে নিয়ে ব্যবসা করবো না । "
আমি স্পিরিটোন ডিসকানেক্ট করে দিলাম । নিজেকে সবটার জন্য প্রস্তুত করে উঠতে পারছি না । এখানে একটা বিষয় বলে রাখা ভালো যে , স্পিরিটোন কাজ করে খানিকটা এভাবে । কোনো মৃত ব্যক্তির নাম ও মুখ স্মরণ করে তার শরীরের তরঙ্গ ও নিজের ব্রেনে স্মরণ করার সময়ের তরঙ্গ ম্যাচ হলে রিসিভার ধরে থাকলে ওপার থেকে পরলোক থেকে ওই ব্যক্তির কন্ঠস্বর শোনা যাবে । এর উল্টোটা অর্থাৎ পরলোক থেকে ইহলোকের কানেকশনও সম্ভব । এতদিন আমি আমার ক্লোজ ফ্রেণ্ডের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি । কিন্তু কোনোকারণে কম্পাঙ্ক ম্যাচ করেনি আজ উল্টোটা হঠাৎ সম্ভব হয়েছে ।
যদিও আতঙ্কের কিছু বড় কারণ ঘটেনি তবুও মনটা স্থির রাখতে পারলাম না । গোটাদিন অজানা আশঙ্কা ও নিজের লংজিভিটির উপর লেখা পেপার ও ওষুধ দেখতে দেখতে কেটে গেলো ।
৩ রা মে , ২০১৯
কাল রাতে যে জিনিসটা ঘটলো তারপর নিজেকে নতুনভাবে প্রকাশের ইচ্ছা জাগছে । রাত্রে শুয়েছিলাম হঠাৎ টেবিলের উপর খুটখাট শব্দ শুনে উঠে বসলাম । ইঁদুর বা অন্যান্য প্রাণীর উপদ্রব নেই এখানে , তবে ? হঠাৎ মনে হলো আমার ড্রয়ার খুলে দেখতে গেলাম কাগজপত্র ও ওষুধটা আছে কিনা । নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না । ড্রয়ারে কিচ্ছু নেই । আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পরলাম ।
হঠাৎ এক গম্ভীর কন্ঠস্বর । অন্ধকারে কাউকে দেখলাম না তবে কন্ঠ শুনে বুঝতে অসুবিধে হলো না এটা সত্যজিৎ বাবুর কন্ঠ । বললেন , " চিন্তা কোরো না শঙ্কু , আমি ফেলুকে ইতিমধ্যে বলে দিয়েছি । "
আমি বললাম , " স্যার আপনি , আহ আমার প্রাণ তৃপ্ত । শতকোটি প্রণাম নেবেন স্যার , শুভ জন্মদিন । "
ফের শোনা গেলো , " হুমম , আশীর্বাদ নিও । কিন্তু আমায় জানাতে পারোনি বলে নিজেকে বিজ্ঞানীরূপে গুটিয়ে নেওয়াটা উচিত নয় । স্পিরিটোন তুমি প্রকাশ করবে । ওই ওষুধের কথা ব্রিটেনের ওই ডাক্তার যিনি চিঠি পাঠিয়েছেন তাদের জানাতে পারো নির্দ্বিধায় , ওরা সত্যি বিজ্ঞানমুখী । "
আমি বললাম , " কিন্তু স্যার সেসব তো মগনলালের সূক্ষ্ম শরীরের জিম্মায় । আর আপনি কী করে জানলেন বিষয়টা ? "
উত্তর এলো , " আমরা আজ সকাল থেকেই কোনো একটা তরঙ্গ রিসিভ করছিলাম । যেটা পরে বুঝলাম তোমার থেকে আসছে । তোমারই এক বন্ধুবিজ্ঞানী যিনি ১৫ বছর আগে গত হয়েছেন তিনি জানিয়েছিলেন তুমি অমরত্ব পাওয়ার জন্য এক ব্যাকটেরিয়া থেকে ওষুধ বানিয়েছো এই রাশিয়ায় আমার মৃত্যুর ১০ বছর আগে । আমরা এই স্পিরিটোনের কথাটা আন্দাজ করতে পারিনি যতক্ষণ তুমি নিজে মগনলালের সঙ্গে কথা বলেছিলে । "
এদিকে রাশিয়ার তুষারমরুতে দুই অশরীরির যুদ্ধ বেঁধেছে । ফেলুদা এক লাথিতে আছাড় মেরেছে মগনলালকে । কাগজপত্র ও ওষুধ নিয়ে ফিরছে দুজনে । মগনলাল ওই অশরীরি মনেও যে খুনী মনোভাব রাখেন তা পদে পদে টের পেয়েছে ফেলুদা কিন্তু তারও মগজাস্ত্রের ধার পরলোকে গিয়েও কমে যায়নি ।
সত্যবাবুর সাথে কথা হতে হতে একটা সময় দেখলুম টেবিলে এসে কাগজপত্র ও ওষুধ জমা হচ্ছে । আমি বললুম , " ফেলু আমার ভালোবাসা নিও । "
ফেলুর কন্ঠেই জবাব এলো , " প্রণাম নেবেন প্রফেসর । আসলে কি বলুন তো মগনলালের মত দাগীদের পেছনে আমাদের মত গোয়েন্দাদের ইহকাল আর পরকাল দুটোই অতিবাহিত হয়ে গেলো । "
সত্যবাবু বললেন , " চলি শঙ্কু , যা বললাম যেন মনে থাকে । স্পিরিটোনে যোগাযোগ হবে । চলি । "
মগনলাল কেমন দাঁত কিরমিরে ভঙ্গিতে বললেন শুনলাম , " আঙ্কিল , হামি ফের আসবে , তখন আর ... " ব্যাস আর কোনো কন্ঠস্বর শুনলাম না ।
সকালবেলা ডায়েরি লিখছি আজ এমন সময় ভ্লাসেন ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেলো । ডায়েরি লেখা বন্ধ করলাম ।