শ্লীলতা
শ্লীলতা
সকাল ৭টার সময় এক কাপ গরম চা হাতে ব্যালকনিতে বসে আছে সমর। গতকাল রাত্রে আকাশ,এবং আকাশের বাবা এসে নিমন্ত্রণ পত্র টা দিয়ে গেছেন। পরশুদিন আকাশের বিয়ে। আকাশ সমরের থেকে প্রায় বছর তিনেক এর ছোট। অথচ সমরের শুভ বিবাহ সম্পন্ন হবার আগেই আকাশের বিয়ে। বয়সে ছোট বড় হলেও ওরা একই পাড়ায় থাকে।সেই কারণেই ২জনের মধ্যে বেশ ভালো বন্ধুত্ব।
পাড়ার চায়ের দোকানে একসাথে চা খাওয়া থেকে শুরু করে সিগারেট টাও শেয়ার করে খায়। সে যাই হোক!!.....
আকাশ মন দিয়ে পড়াশোনা করে বর্তমানে একটি ট্রাভেলিং এজেন্সীর বড় কর্তা। মাইনে টাও বেশ মোটা টাকার। বিয়ে হচ্ছে ওই কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর এর একমাত্র মেয়ের সাথে।
এদিকে সমর এখনও বেকার। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার বিষয় টা সমরের একদম ভালো লাগতো না। সমর সব সময় একটু ভাবুক প্রকৃতির। চোখের সামনে যা ঘটে সেটাই মনের মধ্যে কল্পনার সুতোই গেঁথে গল্প আবিষ্কার করে ফেলতে পারে সমর। সেই কারণেই অনেক ছোট থেকেই বাবার কাছে প্রায় লাথি-ঝাটা খেতে হয়। গতকাল রাতেও সেটার বিলম্ব হয় নি। আকাশের বাবার সামনে, সমরের বাবা সমরকে উদ্দেশ্য করে বললেন..
" আরে দাদা!!আপনার কপাল সোনায় মোড়া; তাই এমন হীরের টুকরো ছেলে পেয়েছেন। আমারটাতো অকালকুষ্মাণ্ড! জন্ম দিয়ে ভুল করেছি!!"..
যদিও সবার সামনে এসব কথা প্রতিনিয়ত শুনতে শুনতে সমরের কান কাটা হয়ে গেছে। আগে এসব অপমানজনক কথা শুনলে খুব খারাপ লাগতো। কিন্তু এখন একই কথা বারবার শুনতে শুনতে অভ্যাস হয়ে গেছে।.....
কিন্তু সহ্য ক্ষমতার ও একটা সীমা আছে। সেই উদ্দেশ্যেই আজকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। কিছু একটা হেস্তনেস্ত করেই আজ ফিরবে।
একটি নামজাদা পুস্তক প্রকাশনা সংস্থা এসেছে সমর পুরো নাম সমর সেন । ওর খুব ইচ্ছে ছিল একজন ভালো লেখক হওয়া। ওর বেশিরভাগ গল্প রহস্যঘেরা ভূতের গল্প। এদিকে বয়স বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন। কিন্তু লেখা ছাড়া এক মুহূর্ত নিঃশ্বাস ফেলতে পারে না সমর।
বাপে খেদানো মায়ের তাড়ানো হাল হয়েছে ওর। বসে বসে বাবার অন্নধ্বংস করতে কত ভালো লাগে। তাই ও ঠিক করেছে আজ বাড়িতে সুখবর নিয়ে ফিরবে। ওর শুধু মনে হচ্ছে কোন একটি ভালো পুস্তক কোম্পানিকে গল্পগুলো উপহার দেওয়া এবং ওর গল্পগুলো বই আকারে ছাপানো।
পথের ধারে বটগাছের তলায় বসে সেই সব ভাবছে; হঠাৎ সেখানে একজন ভদ্রলোকের প্রবেশ । তিনি আগে থেকেই যেন সমর এর মনের কথা জানতেন। কিছুক্ষণ আলাপচারিতার পর সমরের হাত ধরে উনি নিয়ে গেলেন একটি বড় প্রকাশনী সংস্থার কাছে । সেখানকার ম্যানেজারের সাথে কথা বলার জন্য পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের লিফটে উঠিয়ে দিলেন।
সমর বুঝতে পারছে না ব্যাপারটা কি হচ্ছে। যাইহোক সে ম্যানেজারের রুমের দিকে প্রবেশ করে। দরজায় টোকা দেয়;ভেতর থেকে একটি ভারী পুরুষালি কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। সমরের কাছে পুরোটাই স্বপ্নের মত । এই কারণেই নিজের গায়ে একটা চিমটি কেটে দেখে নেয় । ভেতরে চেয়ারে বসে থাকা একজন মোটা সোটা ভদ্রলোক বলেন ..."বসুন,নিন শুরু করুন আপনার গল্প। শুনে দেখি !ভাল লাগলে আমাদের কম্পানি আপনার গল্পগুলি বই আকারে ছাপাবে। আর হ্যাঁ একটা কথা আপনাকে বলে রাখি বই ছাপানোর জন্য ৩৬% টাকা আমরা রাখবো, বাকি ৪২% আপনি পাবেন। যদিও আপনার বই সাধারণ মানুষ কতটা কেনাবেচা করছে তার ওপর পার্সেন্টেজ টা হিসাব হবে। আপাতত এটা আপনাকে বলে রাখা উচিত সেই কারণেই! আর হ্যা বাকি১২% বই ছাপানোর খরচ। আমাদের কোম্পানিতে বই ছাপানোর জন্য আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে কোন অর্থ ব্যয় করতে হবে না। আমাদের এটাই রুল!... আপনি কি রাজী??"...
মাটিতে দাঁড়িয়ে হঠাৎ করে হাতে যদি আকাশের চাঁদ চলে আসলে ঠিক যেমন হবে সমরের ও ঠিক তেমনি অবস্থা। অন্যরকম কালবিলম্ব না করে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায় সমর। তারপর ম্যানেজার কে উদ্দেশ্য করে বলে....
"দেখুন স্যার আমার লেখা গল্পগুলো বেশিরভাগই ভুতুড়ে আর রহস্যে ঘেরা। আজ এখানে রহস্য সেখানে ভৌতিক আভাস তো থাকবেই"!!!.....
এই বলে সে শুরু করে.......
(পর্ব-১)
সমর বলে....
"গল্প শুরু করার আগে আপনাকে একটা কথা বলে রাখি স্যার। আমার গল্প গুলি মূলত নারী বিষয়ক।
আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি স্যার ??"......
কালো রং এর হাই ব্যাক চেয়ারে বসা মোটা কণ্ঠস্বর ধারী গোলগাল মানুষটি বললেন.....
" নিঃসন্দেহে !!বলুন কি জানতে চান??"....
আপনি একজন নারীর সৌন্দর্য হিসেবে সবার আগে কি দেখবেন???...বলে সমর।
এমন একটি অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন শুনে একটু ঘাবড়ে গেলেন স্যার। তারপর আমতা আমতা করে বললেন....
" তুমি আমার থেকে বয়সে ছোটই হবে তাই তুমি সম্বোধন করেই বলছি.....
দেখো এখন আমার বয়স হয়েছে। বাড়িতে বউ-বাচ্চা মা সবই আছে। একজন নারীর মধ্যে এখন আমি সবার আগে তার মাতৃ সত্তা টা দেখতে পছন্দ করি।..."
সমর হেসে ওঠে বলে.." স্যার এইটা কিন্তু আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর হলো না। আপনি খুব ভাল করেই বুঝতে পারছেন আমি ঠিক কী জানতে চাইছি?? এইসব ক্ষেত্রে আপনি আমি সবাই কিন্তু সমান!!! আশা করি এর থেকে বেশি ব্যাখ্যা আপনাকে দিতে হবে না!"....
ইতস্তত ভাবে হলেও স্যার বললেন
"তুমি যেটা ইঙ্গিত করছো সেটা ঠিক। একজন নারীর সৌন্দর্য হিসাবে সবার আগে আমরা দেখি তার সুন্দর মুখটা। তারপর মুখ থেকে ধীরে ধীরে নিচে নেমে যেটা আমি দেখি সেটা তুমিও দেখো!!..... কিন্তু তার সাথে তোমার গল্পের কি সম্পর্ক??"......
কথাটা শুনে সমর বলে....
"আমার প্রত্যেকটি গল্পের সাথেই এই নারীর দৈহিক সৌন্দর্যের বর্ণনা ওতপ্রোতভাবে আছে। আর সৌন্দর্যের ত্রুটি একটি নারীর কোমল হৃদয় কে কত রকম ভাবে আঘাত করতে পারে, তার বর্ণনা এবং সেই সূত্র ধরেই আমার প্রত্যেকটি কাহিনী ভৌতিক রূপ পেয়েছে।".......
কথাটা শুনে স্যার বললেন
""সত্যি খুব ইন্টারেস্টিং।... আমার মনে হয় না এর আগে এরকম বিষয়ের উপর কোন বই আমি ছাপিয়েছি কিনা। শুরু করো আমি আর নিজেকে সামলাতে পারছিনা।"..
সমর বলে "নারী শব্দটা এমন স্যার। যে শব্দটাতে এই পুরুষ জাতি ঘায়েল হয়ে থাকে। আমি নিজে একজন পুরুষ হয়ে সেটা স্বীকার করি।......
একজন নারীর সৌন্দর্য অবশ্যই তার চোখেই দেখতে হবে, কারণ এটিই তার হৃদয়ের দ্বার, এটিই সেই জায়গা যেখানে প্রেম থাকে।একজন সুন্দরী নারী পেন্টিংয়ের মতো এবং তিনি যতই বয়সী হন না কেন সুন্দর থাকেন।"
শুরু করছি আমার প্রথম গল্প.......
"পদ্মলোচন"

পুরুলিয়ার... শতদ্রু ব্লকের মলয় পুর গ্রামের অনেকটা ভেতরে হাতেগোনা দশ-বারোটি ঘর। সেখানেই....
পুরনো প্লাস্টার খসে যাওয়া ইটের বাড়ি। বাড়িতে কেবল মাত্র একটি ঘর । বাড়িতে ঢোকার সামনের দিকটায় ছোট্ট একটি জায়গায় বেড়া দিয়ে ঘেরা ভাঙাচোরা রান্নার জায়গা । এবং কিছুটা দূরে পলিথিন দিয়ে টাঙ্গানো বাথরুম ও এক দিকের দেয়াল ধসে যাওয়া শৌচালয় । যার এক টিনের দরজা টা একটা দমকা হাওয়ার ঝড় এযে কোন মুহূর্তে উড়ে যেতে পারে। আর সেইখান থেকে দশ হাতের দূরত্বে একটা টিউব অয়েল । এই বাড়িতেই থাকে পদ্মাবতী। মা ছাড়া ওর আর কেউ নেই। অনেক ছোট বয়সেই বাবা মারা গেছেন। বাবা পেশায় ছিলেন একজন হকার। গাড়ি দুর্ঘটনায় ট্রেনের তলায় চাপা পড়ে মারা যান। বিধবা মা কে নিয়ে পদ্মাবতী থাকে মলয় পুর গ্রামে। পদ্মা ছোট থেকেই বুদ্ধিমতী,লেখাপড়ায় বেশ ভালো। বাবা না থাকলেও ওর মা ওকে সযত্নে বড় করেছেন। ছোটবেলায় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াশোনা করিয়েছেন। কিন্তু এখন বয়স বাড়ার সাথে সাথে নানা অসুখে জর্জরিত পদ্মার মা। ঠিকঠাক খাওয়াই জোটে না ওদের।
এদিকে পদ্মা মাধ্যমিক পাস করে বসে আছে। ধীরে ধীরে একটু একটু করে যৌবন সমাগত তার শরীরে। পদ্মার মায়ের এখন ইচ্ছে ইহলোক ত্যাগ করার পূর্বে পদ্মাকে সুপাত্রে দান করে যাওয়া। সেইমতো ঘটক ঠিক করে রেখেছেন। প্রতিদিনই ঘটক কোন না কোন সম্বন্ধ নিয়ে আসেন পদ্মার বাড়ি। পদ্মার মা যথাসাধ্য চেষ্টা করে নিমকি, সিঙ্গারা,মিষ্টি, সহযোগে আপ্যায়ন করেন সেই সমস্ত ব্যক্তিদের। পদ্মার এসব একদম ভালো লাগেনা। ও জানে এইগুলো ইনকাম করতে ওর মায়ের কত কষ্ট হয়। ছোট ছোট দু একটা বাচ্চাকে টিউশনি পড়ায় পদ্মা কিন্তু তাতে আর কয় পয়সা ইনকাম হয়!! একদিন রাত্রে মায়ের পাশে শুয়ে শুয়ে পদ্মা মাকে বলে..
" মা এই মুহূর্তে আমার বিয়ে না দিলে কি নয়!! আমি এখন H.S কমপ্লিট করব, তারপর কলেজে পড়াশুনা করব।আমি চাকরি করতে চাই মা!!"...
পদ্মার কথা শুনে মা হাসেন।
দুদিন পর ঘটক পাঁচু কাকা এক সম্বন্ধ আনলেন।
পদ্মার মা সেই সময় বাড়ি ছিলেন না। গরিব ঘরের মেয়ে পদ্মা। অন্যসময় ঘটক খবর দিয়ে সম্বন্ধ আনলে পদ্মার মা পাশের বাড়ির কাকিমার কাছ থেকে মোটামুটি একটা শাড়ি এনে পদ্মা কে পরিয়ে সেইসব সজ্জন ব্যক্তি দের সামনে বসান। কিন্তু উনি বাড়ি না থাকায় আজ বাড়ির পোশাক পরিহিত অবস্থায় দেখল লোকগুলি পদ্মা কে।
দিন আনে দিন খাওয়া মায়ের মেয়ে পদ্মার পরনের কাপড় টা ছিল ছেঁড়া।
ছেঁড়া কাপড়ের ভেতর থেকে পাতলা ফিনফিনে হয়ে যাওয়া ব্লাউজের হালকা আকাশী রং টা বোঝা যাচ্ছিল। যেসকল ব্যক্তিবর্গ ওকে দেখতে এসেছিলেন, তাদের মধ্যে একজন লম্বা গোছের মোটা গোঁফওয়ালা ফর্সা ব্যক্তি পদ্মার মুখের থেকে বেশি ওই দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। লোকটির চাহুনির দিকে একবার চেয়ে,গায়ের ছেড়া কাপড় টা ভাল করে ঘুরিয়ে নিয়ে পিঠ সমেত ব্লাউজটা ঢাকে পদ্মা।
তারপর ঘটক কে উদ্দেশ্য করে বলে................
" কাকা তুমি এখন এনাদেরকে নিয়ে যাও। মা বাড়ি নেই। মা এলে তারপরে এস।!!"...
ওই ফর্সা দেখতে লোকটি ঘটক কে বলেন...
" দাদা আমার মেয়েকে পছন্দ হয়েছে। আপনি মেয়ের মায়ের সাথে বিয়ের কথা বার্তা ফাইনাল করে খবর দেবেন!!আমি একেই বিয়ে করব।!!"
ওই লোকটির পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন বয়স্ক ভদ্রলোক। হঠাৎ করে তিনি বলে উঠলেন.....
" না ভাই পাঁচু। আমার এই মেয়েকে পছন্দ হয়নি। তুমি বললে গরিবের মেয়ে। মায়ের সাথে থাকে। মেয়ে বেশ ভালই পড়াশোনা জানে। কিন্তু এটা তো বলোনি মেয়ের একটা চোখ ট্যারা????.....
দেখো শম্ভু আমার মেজ ছেলে। বড় ছেলে আমার পারমিশন না নিয়েই ভালোবেসে বিয়ে করেছে। যদিও সেই বৌমা খুবই রূপবতী। এবং মেয়ের বাড়ি থেকে অনেক দাম সামগ্রী,পন বাবদ নগদ আড়াই লক্ষ টাকা আমি না চাইতেই পেয়েছি। আমার মেজো ছেলের বিয়েতে আমি ওসব কিছু চাইছি না। তোমার কাছে এমন একটা নির্ঝঞ্ঝাট ফ্যামিলির কথা শুনে আমি ভাল ভেবেছিলাম। কারণ এক্ষেত্রে আমার পন লাগবে না।এমনি এর মা মারা গেলে মেয়ের জায়গা সম্পত্তি যেটুকু আছে সেটুকু তো আমার ছেলেই পাবে। আমার বড় ছেলে যে ঘরে বিয়ে করেছে সেই ঘরে তিন তিনটে বড় দাদা আছে। সেখানে আমার ছেলের সম্পত্তির ভাগ পাওয়াটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু তোমার কাছে এই সম্বন্ধটা পেয়ে আমি এই বিষয়টা আশ্বস্ত হয়েছিলাম। মেয়ে শিক্ষিত !আমি মানছি কিন্তু তাই বলে ,একটা ট্যারা মেয়ের সঙ্গে আমার ছেলেকে বিয়ে দেবো না। শুধু ট্যারা ই নয় মেয়ের গায়ের রং ও বেশ ময়লা।......
আমার ছেলের দিকে একবার চেয়ে দেখ !দুধে-আলতা গায়ের রং ।আমি জেনে শুনে আমার ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে পারি না। আমি আত্মীয়-স্বজনকে কিভাবে মুখ দেখাবো এই মেয়ের সাথে বিয়ে হলে!!!!.... তার উপরে দান সামগ্রী কিছুই পাবো না। মেয়ের ঘরবাড়ি দেখে সেটা আমি ভালভাবেই বুঝতে পারছি। না না না তুমি চলো অন্য কোথাও চলো!!! এই বাড়িতে সম্ভব নয় সম্বন্ধ করা।
ঘটক এই নিয়ে প্রায় খান ২৫ সম্বন্ধ এনেছেন । প্রত্যেকেরই পদ্মার ট্যারা চোখ দুটোর জন্যই বিবাহে আপত্তি।........
অনেকক্ষণ ধরে এমন অপমান সূচক উক্তি গুলো শুনেও উত্তর দেওয়ার মত ক্ষমতা নেই পদ্মার। পাচু কে উদ্দেশ্য করে সেই ফর্সা ছেলেটি বলে ওঠে....
" দেখুন! বাবা যা বলে বলুক!আমি এনাকেই বিয়ে করবো!"...
ছেলের মুখে এমন বক্তব্য শুনে বেজায় ক্ষেপে উঠেন শম্ভুর বাবা। তিনি বলেন...
"একেতো কালো তার উপরে ট্যারা!!.
তুই কি করবি মেয়েকে বিয়ে করে??? তুই একবার ও ভাবে দেখেছিস; আমার পরবর্তী বংশধর কেমন জঘন্য দেখতে হবে!!".....
কিন্তু শম্ভু বাবার কথায় পাত্তা দেবার ছেলে নয়। তার দৃষ্টি তো আর চোখের দিকে নেই। সে পদ্মার দৈহিক সৌন্দর্যে অভিভূত। হঠাৎই কথাবার্তার মাঝখানে পদ্মার মা এসে উপস্থিত হন।... পাঁচু বাবুকে দেখেই তিনি বলেন..
" আরে দাদা আপনি কখন এলেন???"....😢
"এইতো একটু আগেই এসেছি বৌদি!" বললেন ঘটক পাচু।
পদ্মার মাকে একবার আপাদমস্তক ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে নিলেন শম্ভুর বাবা। গায়ের ময়লা কাপড়ে হলুদের দাগ লেগে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোন বাড়ি থেকে রান্নার কাজ সেরে ফিরছেন উনি। ঠোঁট টা কি একটু বাঁকিয়ে নিয়ে পদ্মার মা কে উদ্দেশ্য করে বললেন..
" বলিহারি শখ আপনার!! ট্যারা মেয়ের নাম রেখেছেন পদ্মাবতী!!!হুম"..........
পদ্মার মা বলেন..." এই নাম ওর বাবার দেওয়া। নাগ পঞ্চমীর দিন আমাদের ঘর আলো করে ও এসেছিল। তখনও চোখ দুটো এমন ছিলনা। কিন্তু ছোটবেলায় একটা অ্যাকসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে একটা চোখ এমন হয়ে যায়। তখন থেকেই ওর বাবা ওকে পদ্মাবতী নাম দিয়েছিলেন!"....
"তা আপনি কোথা থেকে ফিরছেন এত অবেলায়??"....বললেন শম্ভু র বাবা।
পদ্মার মা মাথা নিচু করে বললেন..
" ঘটক বাবুর কাছে আশা করি আপনারা সবই শুনেছেন। সেই ভোরবেলা উঠে আমি বেরিয়ে যাই। ছটা বাড়িতে বাসন মাজার কাজ করি ।আর তিনটি বাড়িতে রান্নার কাজ। সেইসব সেরেই ফিরছি। কোনরকম দুটো নাকে মুখে গুঁজে আবার তিনটের সময় বেরিয়ে যাব।
তা আসুন আপনারা ঘরে বসুন।..... পদ্মা!!!..
যাতো মা!... আনন্দ কাকার দোকানে! সেখান থেকে খান ছয়েক চমচম আর নিমকি নিয়ে আয়।ও শোন বাড়ি আসার সময় হরি কাকার মুদি দোকান হয়ে আসবি।সেখান থেকে ২০০গ্রাম চিনি, ৫০ গ্রাম গুঁড়ো দুধ,আর ১০০চা পাতা মনে করে নিয়ে আসিস।.... বলবি লিখে রাখতে কদিন পরে আমি দিয়ে দেব।".....
রাগে দাঁত কটমট করে ওঠে পদ্মা। কিন্তু সম্পূর্ণ ঘামে ভেজা শরীরে দাঁড়ানো মায়ের ম্লান মুখটা একবার দেখে পদ্মা কিছু বলতে পারেনা। ঘাড় নেড়ে দোকানের উদ্দেশ্যে যাবার জন্য পা বাড়ায়..... আচমকাই পদ্মার ডান হাতটা চেপে দাঁড় করিয়ে দেয় ওই ছেলেটি। পদ্মার বিষয়টা ভালো লাগেনা। ছেলেটি বলে...
" ওসব কিছু করতে হবে না। আমি যা দেখার দেখে নিয়েছি। আপনি বিয়ের দিন ঠিক করুন।"....
পদ্মার মা খুব খুশি হন। শম্ভু পদ্মার থেকে বয়সে প্রায় দ্বিগুণ বড়। তাতে কি যায় আসে?? সোনার আংটি বাঁকাও ভালো। .....
শম্ভুর বাবা রাজি হন না। কিন্তু ছেলে যেখানে বিয়ে করার জন্য রাজি হয়ে গেছে সেখানে উনি কি করে বাঁধা দেবেন!!
কিছুক্ষণ কথা বার্তার পর পদ্মার মা পাশের বাড়ির কাকিমার কাছ থেকে একটা শাড়ী চেয়ে এনে.. মেয়ে পদ্মা কে পরিয়ে ওনাদের সামনে দাঁড় করালেন।
ছেলের বাবা অগত্যা রাজি হলেন।... দিনের দিনই বিয়ের ডেট ঠিক হয়ে যায়। মাত্র সাত দিন পরে বিয়ে।
বিয়ের ঠিক তিনদিন আগে সন্ধ্যেবেলায় পদ্মার বাড়িতে শম্ভু, শম্ভু বাবা এসে হাজির হন। একটা দলিল বার করে পদ্মার মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন....
" আজ বাদে কাল আপনার মেয়ে আমার বাড়ির বউ হবে। আপনার মেয়ের যেটুকু আছে,মানে এই সম্পত্তি... পরবর্তীকালে আমার ছেলেই পাবে। তা আমি বলছি দিদি! আপনি এই উইল টায় একটা স্বাক্ষর করে দিন।
ঘটক মশায়ের কাছে আমি শুনলাম...... গ্রামের বাইরে বাসকুড়ায় আপনাদের ৬কাটা পৈত্রিক জমি পড়ে আছে। চাষাবাদ কিছুই হয় না। অথচ ওই জমির পাশ দিয়ে চলে গেছে জাতীয় সড়ক। সেটা বিচার করলে ওই জমির বর্তমান মূল্য অনেক। দিন যত যাবে জমির দাম ততই বাড়বে। আপনার মেয়ে একে তো কালো তার ওপরে একটা চোখ আবার ট্যারা। আমি নেহাত ভালো মানুষ তাই বিনা পণে আপনার মেয়েকে আমার ছেলের বউ করে নিয়ে যাচ্ছি। দেখুন আত্মীয়-স্বজন সবাই যখন আমাকে প্রশ্ন করবে আমার ছেলেকে শ্বশুর বাড়ি থেকে কি দেওয়া হয়েছে! আমি তো তখন কিছুই বলতে পারব না।তাই বলছি আপনি যদি স্বাক্ষর করে দেন আমি জোর খাটিয়ে বলতে পারব আমার ছেলের শ্বশুরবাড়ি থেকে ৬কাঠা জমি দেওয়া হয়েছে। এই দুর্মূল্যের বাজারে ৬ কাটা জমির দাম অনেক।".....
বেতের মোড়ার মধ্যে বসে পায়ের নখ দিয়ে সমানে মাটি হেঁচড়ে যাচ্ছিল পদ্মা। মাথা নিচু করে বসে থাকলেও রাগে ওর সারা শরীর গর্জে উঠেছিল কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারছিল না। ও খুব ভালো করে জানে ওই সম্পত্তি টুকুই ওর মায়ের বেঁচে থাকার শেষ সম্বল। এইটাও লিখে দিলে ওর মায়ের আর কিছুই থাকবে না।......
পদ্মার মা বলেন..." আপনাদের মতো ভালো মানুষের ঘরে আমার মেয়েটা বউ হয়ে যাবে এটা দেখে যেতে পারলেই আমার শান্তি। দিন কোথায় সই করতে হবে। এইবার পদ্মা বলে ওঠে..." অনেক সহ্য করেছি আর নয়। মা তুমি ওই সম্পত্তি লিখে দেবে না। আর আপনারা শুনে রাখুন আমার মায়ের অবর্তমানে ও সম্পত্তির মালিক হব আমি। আপনার ছেলের সাথে আমার এখন বিয়ে হয়নি! অথচ তার আগেই সম্পত্তি লিখে নিচ্ছেন আপনারা।.. আমার বুদ্ধিতে যতটুকু মনে হয়.... আপনার বাড়ির বউ হয়ে যাওয়া মোটেই সুখকর হবে না আমার। আপনারা আসতে পারেন।".....
শম্ভুর বাবা চৌকির ওপর বসে ছিলেন। পদ্মার মুখে এমন কথা শুনে তিনি চিৎকার করে উঠে বললেন...
" আপনার মেয়ের আস্পর্ধা তো কম নয়। আমার বাড়িতে কখনো গিয়ে দেখেছে ও!!! আমার বাড়িতে ভাতের অভাব হয় না। চারতলা বিল্ডিং আমার।!!"..
কথা শেষ হওয়ার আগেই পদ্মা বলে ওঠে...
" আপনার বাড়ি কতটা বড় আমার দেখার দরকার নেই। আর চারতলা বিল্ডিং বলুন আর দশতলা বিল্ডিং!সবটাই তো গড়েছেন আপনি পনের টাকা দিয়ে নিজের টাকা দিয়ে তো নয়!!"...
"পদ্মা যেটা বুঝিস না সেটা নিয়ে কেন কথা বলিস না!! চুপ করে বস! আজ বাদে কাল উনি তোর শ্বশুর হবেন?".. বলে পদ্মার মা।
শম্ভুর বাবা বলেন "কে হবে শ্বশুর মশাই!!আমি আমার ছেলেকে আপনার মেয়ের সাথে বিয়ে দেব না।"
চল শম্ভু......
শম্ভু এতক্ষণ ধরে এসব কথা চুপচাপ শুনছিল কোন উত্তর দেয়নি। কিন্তু এইবার বলল..
" পদ্মা তুমি কাজটা ভালো করলে না। আমি চেয়েছিলাম তোমাকে বিয়ে করে আমার ঘরনি করতে। শেষ বয়সে তোমার মায়ের ভারও আমি নিতাম। কিন্তু কি করা যাবে অদৃষ্ট হয়তো অন্য কিছুই লেখা আছে???চলি......"
উনারা ঘর থেকে চলে যাওয়ার পরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন পদ্মার মা। বিছানার তলা থেকে কতগুলো রিপোর্ট বার করে পদ্মার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন...
" আজকে তোর পাকামোর জন্য এই দিন দেখতে হচ্ছে। কি হতো সম্পত্তি লিখে দিলে!!! আজ মরলে কাল দুদিন। সম্পত্তি আমি সঙ্গে নিয়ে যাব???? দেখ এই গুলো পড়ে দেখ!!! যে কটা দিন আছি!চেয়েছিলাম সুখে শান্তিতে থাকবো।অন্তত তোর বিবাহিত মুখটা দেখে যেতে পারব।
কিন্তু ভালই বুঝতে পারছি আমার কপালে সুখ ভোগ করা লেখা নেই????".....
এক এক করে রিপোর্টের পাতা উল্টে পড়তে থাকে পদ্মা।ও জানতে পারে গত ছয় মাস ধরে ওর মা ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। ডাক্তারি রিপোর্ট অনুযায়ী আর মাত্র একমাস ওর মায়ের আয়ু। মাকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে পদ্মা...বলে..
" তোমার কথার অবাধ্য হবো না আর ।তুমি আমায় আগে কেন দেখাও নি মা। আমি আরো দু-চারটে বাড়িতে বেশি টিউশনি ক্লাস করাতাম। তোমার চিকিৎসা কি আমি করতে পারতাম না???.... তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো কি করে!!'.....
পদ্মার মায়ের চোখের জল... তিনি বললেন...
" সেই কারণেই তো তোকে যোগ্য হাতে তুলে দিয়ে যেতে চাইছিলাম। যে তোর সারা জীবন খেয়াল রাখবে।!!".
পদ্মা বলে.." তুমি যদি চাও আমি ওই লোকটাকেই বিয়ে করি তাহলে আমি তাই করবো। তুমি যেটাই সুখী আমিও সেটাতেই সুখী!!".....
যথাসময়ে বিবাহের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। পাঁচু বাবুকে দিয়ে ছেলের বাড়ির খবর পাঠিয়ে রীতিমতো ক্ষমা প্রার্থী হয়েছেন পদ্মার মা।... তিনি বলেছেন বিয়ের দিন মেয়ের কপালে সিঁদুর দানের আগেই সম্পত্তিতে সই করে দেবেন। কিন্তু ছেলের বাবা বলেছেন বিয়ের আগের দিন সই করতে হবে। শম্ভু যাবে উইল নিয়ে। পদ্মা পুরো বিষয়টাকে মেনে নিয়েছে। ওর মা মৃত্যু পথযাত্রী। আর মায়ের শেষ ইচ্ছে পূর্ণ করতে চায় না এমন সন্তান এ বিশ্বে নেই। যাইহোক,বিয়ের আগের দিন রাত আটটা নাগাদ শম্ভু এসে দাঁড়ায় পদ্মার বাড়ির সামনে। পদ্মার মা বারবার বলে দিয়েছিলেন সকালবেলায় আসতে। এমনিতেই বিয়ের আগের দিন স্বামী স্ত্রী একে অপরের মুখ্য দর্শন করতে নেই। গ্রামেগঞ্জে এখন ও সেই নিয়ম অব্যাহত। তবুও যেহেতু ছেলেকে অন্য কিছু দিতে পারেননি! এই ছয় কাটা জমি যা সম্বল। সেটা দিনের আলো থাকতে থাকতেই লিখে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শম্ভু দিনের বেলা না এসে রাত্রেবেলা আছে। সেই সময় পদ্মার মা পাশের বাড়ির কয়েকজন দিদি, কাকিমা দের কে নিয়ে মা গঙ্গাকে নিমন্ত্রণ করতে গিয়েছিলেন। বাড়ি ফাঁকা।.....
পদ্মা বিছানায় শুয়ে ছিল। এমন সময় শম্ভুর আশাটাকে ও কল্পনাও করতে পারেনি। শম্ভু এসে সরাসরি ঢুকে ওদের ঘরে। আর পদ্মাকে বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থায় দেখে!!........ হাত দিয়ে চোখ ঢেকে শুয়েছিল পদ্মা।
জামার শার্ট এর ভিতর থেকে লোমশ বুকের উপর হাত বোলাতে বোলাতে,দাঁতে ঠোঁট কেটে একটা পাশবিক চাহুনি দিয়ে পদ্মার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে শম্ভু।তারপর ধীরে ধীরে পদ্মার কাছে এগিয়ে গিয়ে,বুক থেকে কাপড় টা খুলতে যাবে ঠিক সেই সময় পদ্মা চোখের উপর থেকে হাতটা সরিয়ে ফেলে......
শম্ভু পদ্মার চোখ দুটোকে ভালো করে দেখেনি.... অন্ধকার ঘরটায় পদ্মার চোখ দুটো দেখে ভয়ে আঁতকে ওঠে শম্ভু। পদ্মার মা এবং পাড়া-প্রতিবেশীরা সবেমাত্র গঙ্গা নিমন্ত্রণ করে বাড়ির উঠানে পা বাড়িয়েছেন অমনি চিৎকার করে শম্ভু ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে.......
ওর মুখ থেকে আর একটাও শব্দ বেরোয় না। ভয়ে হাত-পা গুটিয়ে,লম্বা মানুষটা কেমন যেন ছোট হয়ে যেতে থাকে।.......
পাড়া-প্রতিবেশীরা থেকে শুরু করে পদ্মার মা শম্ভু কে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। বিয়ে মাথায় ওঠে!!...
ঘটক পাঁচু কাকাকে দিয়ে তড়িঘড়ি ছেলের বাড়ির খবর পাঠানো হয়। ছেলের বাবা গাড়ি ভাড়া করে এনে দ্রুত ছেলেকে নিয়ে যান। যদিও যাবার আগে অনেক গুলো কথা শুনিয়ে গিয়েছিলেন পদ্মা কে উদ্দেশ্য করে। তিনি বলেছিলেন.....
" প্রথমেই বলেছিলাম এই ট্যারা মেয়েকে বিয়ে না করতে! আমার বাড়িতে ঢোকার আগেই অমঙ্গল শুরু করে দিয়েছে। দেখি আমার ছেলেটার এবার কি হলো??"..
টুকটাক পাড়া-প্রতিবেশী সহ পদ্মার মা গিয়েছিলেন ছেলের বাবার সাথে হসপিটালে।
এত কিছুর মাঝে পদ্মার খোঁজ একবার ও কেউ করেনি। ও কিন্তু বাইরে বেরোই নি। শম্ভু কে নিয়ে যাওয়ার পরে পদ্মা ধির পায়ে হেটে হেটে চলে গিয়েছিল বাঁশকুড়া আর সেই ছয় কাটা জমির কাছে।.....
জ্যোৎস্নার মিষ্টি আলোয় মাটির রাস্তা বেশ পরিষ্কার। বৈশাখের প্রখর গরম। জমির চারপাশে বড় বড় তালগাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের আলো এসে পড়েছে তাল গাছের পাতায়। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে প্রাকৃতিক সোনা চকচক করছে। চাঁদটা এখন ঠিক দুটো তালগাছের মাঝখানে। শহরের ঝিঝি পোকার ডাক শোনা যায় না বললেই চলে। কিন্তু গ্রামে এখনো এই ঝিঁঝিঁ পোকার কম্পমান ধনী শোনা যায়। আর বেশিরভাগই শোনা যায় এই মাঠে ঘাটে। কদিন ধরে বৃষ্টি হয়নি মাটি বেশ শুকনো। বৃষ্টিবাদল হলে ব্যাঙের ধ্বনি ও শোনা যেত। পদ্মা এসে পৌঁছেছে ওদের জমির পশ্চিম কোন বরাবর। এই পুরো জমির মাঝখানে একটাও গাছপালা নেই। কিন্তু পদ্মা যেখানে বসে আছে সেখানে রয়েছে একটা কাঁটাওয়ালা ক্যাকটাস। এই গাছটাকে ফনিমনসা ও বলা হয়। শুকিয়ে যাওয়া মাটির বুক চিরে ফনিমনসা গাছ টি জেগে আছে। গাছটিকে দেখে মনেই হচ্ছে না যে গত সাত দিন যাবত এক ফোঁটা বৃষ্টি হয়নি। গাছের পাতা গুলি বেশ ফুলে-ফেঁপে রয়েছে। আমরা জানি ক্যাকটাসের পাতা ভবিষ্যতের জন্য জল সঞ্চয় করে রাখে নিজের মধ্যে। গাছটা মূলত মরুভূমির গাছ। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক জায়গায় অনেক বাড়িতেও এই গাছ দেখা যায়। কিন্তু এই গাছটা;অন্যান্য গাছের থেকে একটু অন্যরকম।
পদ্মা গিয়ে বসলো গাছটার একদম পাশে। ফনিমনসা গাছের কাঁটা আছে প্রচুর। কিন্তু এই গাছটি এতটাই ভিন্ন,পদ্মা গাছটিকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে! অথচ ওর গায়ে এতোটুকু কাটার স্পর্শ হচ্ছেনা।......
হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে শম্ভু কে। ডক্টর একটি ইলেকশন দিয়েছেন। পদ্মার বাড়িতেই শম্ভু জ্ঞান হারিয়েছিল। ইনজেকশন দেওয়ার পরেই জ্ঞান ফেরে ওর। আর জ্ঞান ফিরতেই চোখ দুটো খুলে শম্ভু চিৎকার করে বলে "আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না??... বাবা তুমি কোথায় ??আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না!!..."
বাড়ির প্রত্যেকটি সদস্য ও পাশের কেবিনে বসে ছিলেন। ঘরের ভেতর থেকে শম্ভুর চিৎকার শুনে এই সকলে ছুটে গেলেন। ওর বাবা বললেন....
" কি হয়েছে বাবা?? চিৎকার করছিস কেন? কি অসুবিধা হচ্ছে বল?"...
কান্না করতে করতে শম্ভু বলে...
" বাবা আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না!!! সব অন্ধকার???"..
বাবা বললেন..." সেকি কথা!!!... ডাক্তার কে খবর দিন!! কি হল আমার বেটার??".....
চটজলদি ডাক্তার আসেন। টর্চ দিয়ে শম্ভুর চোখের মনি পরীক্ষা করে বলেন.....
" স্ট্রেঞ্জ!!!!.... রেটিনা দেখা যাচ্ছে না??"
শম্ভুর বাবা বললেন "সেটা আবার কি জিনিস??"..
ডাক্তার বললেন "রেটিনা হলো চোখের আলোক সংবেদী অংশ।চোখের স্পর্শকাতর একটি জায়গা। এটি চোখের সবচেয়ে পেছনে থাকে। এতে দশটি লেয়ার রয়েছে। এখানে আলোটা পড়ে, আলোটা থেকে ছবি তৈরি হয়ে স্নায়ুর মাধ্যমে আমাদের মস্তিষ্কে যায়। আমরা তখন দেখতে পারি। রেটিনা খুব স্পর্শকাতর। এখানে যখনই কোনো সমস্যা হয়, তখন মানুষের দৃষ্টি প্রথমে কমে যায়। এটি তাড়াতাড়ি হতে পারে। আবার ধীরে ধীরেও হতে পারে।"....
শম্ভু বলে ওঠে...." কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি না কেন??"
ডাক্তার একজন নার্সকে ডেকে পাঠালেন। শম্ভুর হাত থেকে এক সিরিঞ্জ রক্ত নেওয়া হলো। ডাক্তারের কথামত তাড়াতাড়ি সেই রক্ত পরীক্ষা করার জন্য পাঠানো হলো। পদ্মার মা সহ সকলেই সমবেত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
শম্ভুর বাবা বললেন ...
"রক্ত পরীক্ষা করলে কি হবে ডাক্তার??"..
ডাক্তার বললেন...
" রক্তে সুগার বাড়লে রেটিনার সরু রক্তবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সরু রক্তজালক চিরে যায়। সেখান থেকে রক্ত এবং অন্যান্য তরল লিক করে। ফলে রেটিনার টিসু ফুলে ওঠে। দৃষ্টিঝাপসা হয়ে আসে।.... সেই কারণেই আমি টেস্ট করতে দিলাম। ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করুন রিপোর্ট এক্ষুনি চলে আসবে।!".....
ডাক্তার বেরিয়ে গেলেন। নার্স অন্যান্য সবাইকে ঘরের বাইরে যেতে বললেন..
" আপনারা দয়া করে এখন বাইরে যান।স্যার এলে আপনাদের ডেকে পাঠানো হবে।".....
শম্ভুর বাবা নার্সের দিকে রূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন "আমি থাকি!আমি থাকলে কেউ কিছু বলবেনা।
উনি জানেন না যে টাকা থাকলেই সব জায়গায় নিজের মন মত যা খুশি করে বেড়ানো যায় । শম্ভুর বাবার এমন কথা শুনে নার্স শম্ভুর মাথার কাছে রাখা ফোনটা হাতে নিয়ে সিকিউরিটি গার্ডকে ফোন করে শম্ভুর বাবাকে নিয়ে যেতে বললেন।
"হ্যালো!আপনি এক্ষুনি ১৬নম্বর ঘরে চলে আসুন।পেশেন্টের বাবা বাইরে যেতে চাইছেন না।"....
ফোনটা রাখার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একজন হৃষ্টপুষ্ট ইয়ং ছেলে এসে খুব ভদ্রভাবে শম্ভুর বাবাকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বললেন । উনি হয়ত ভুলে গেছিলেন...
এটা হসপিটাল,এখানে ওনার কথা মত সবাই চলবে না। বাধ্য ছেলের মতো তিনিও বাইরে বেরিয়ে গেলেন।
সবাই বাইরে বেরোনোর মিনিট দশেক পর আবার চিৎকার করে ওঠে শম্ভু।...
চিৎকার শুনে সবাই ঘরের মধ্যে যেতেই শম্ভু বলে
" বাবা আমার চোখ জ্বালা করছে?? মনে হচ্ছে চোখের মধ্যে কে যেন কাঁটা ফুটিয়ে দিচ্ছি। বাবা আমার খুব জ্বলছে!!".....
শম্ভুর বাবা দেখলেন... ওর বাঁ চোখ দিয়ে টপটপ করে রক্ত পড়ছে। আর ডান চোখে কালো মনি টা উধাও।
যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে শম্ভু আবার বলে...
" ওকে আমার কাছ থেকে সরাও?? আমি ওর দিকে তাকিয়ে দেখতে চাই না!!! সরাও ওকে আমার চোখের সামনে থেকে!!!...."
ছেলের এমন কথা শুনে শম্ভুর বাবা বললেন...
" কি বলছিস তুই !কে এসেছে তোর সামনে???...
তোর ঘরে আমি আর নার্স ছাড়া আর কেউ নেই!"...
আবার চিৎকার করে ওঠে শম্ভু।....
"বাবা ওকে তুমি সারাও! ওকি বীভৎস!!.... বাবা আমি যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছিনা!!"..
অবস্থা খারাপ দেখে নার্স দ্রুত ডাক্তার কে ডাকতে গেলেন। ডাক্তার এসে একটা ইনজেকশন দিয়ে শম্ভু কে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। আর বাড়ির সকলের উদ্দেশ্যে বলে দিলেন...." দেখুন আপনারা বাড়ি যান। রক্তের রিপোর্ট আগামীকাল আসবে। এখন হাসপাতালে সবাই ঘুমোচ্ছে। দয়া করে আপনারা কাউকে অসুবিধা করবেন না। আগামীকাল সকালে ভিজিটিং আওার এ চলে আসবেন।"....
প্রথম বার নার্স এর কাছে অপমান হয়েছেন বলে এইবার তিনি বাইরে যেতে বিলম্ব করলেন না। সবাই মিলেই বাইরে বেরিয়ে গেলেন। পদ্মার মা এবং অন্যান্য পাড়া-প্রতিবেশীরা সকলেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হল। হাসপাতাল থেকে বেরোনোর আগে পদ্মার মা শম্ভুর বাবাকে বলে গেলেন....
" ঘটক বাবু আপনাদের বলেছেন কিনা জানিনা!!!.. তবে আমার পদ্মাকে চোখ নিয়ে কেউ অপমান করলে খুব দুঃখ পায়।...... শম্ভুর এমন অবস্থার জন্য সত্যিই আমি খুব দুঃখিত। কি আর করা যাবে দাদা অদৃষ্টের লেখন। এখন ঠাকুরের কাছে বলি তাড়াতাড়ি যেন শম্ভু সুস্থ হয়ে ওঠে।"......
সবাই চলে যাওয়ার পরে হাসপাতালে মেন গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। শম্ভু কেবিনে একাই ছিল। রাত্রির একজন নার্স এর সহায়তায় বাথরুমে গিয়েছিল শম্ভু। বাথরুমে ঢুকে ছিল ঠিকই!! কিন্তু বাইরে বেরিয়ে আসেনি। প্রায় আধ ঘন্টা কেটে যাওয়ার পর নার্স দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখেন....সারা মেঝেতে রক্তের স্রোত,আর সেই স্রোতে ভাসছে দুটো খুবলে বার করা চোখ।.....

শম্ভুর দেহটা কখনো ছটফট করছে । আর মুখ থেকে বের হচ্ছে একটি কথা..
" ওকে নিয়ে যাও বাবা! আমি ওর চোখের দিকে তাকাতে পারছিনা!!! ও কিভাবে এলো আমার কাছে?? আমিতো ওকে কতদিন আগে এই নিজের হাতে খুন করেছি!!...
"আহ!!!কি জ্বালা!! কি যন্ত্রণা!!উফফ....আর সহ্য করতে পারছিনা!".....
অনেক রাত্রে শম্ভুর বাবার কাছে হাসপাতাল থেকে জরুরি ফোন যায়। উনাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যাওয়ার কথা বলা হয়।...
রাতে পাঁচু ঘটক বাড়ি ফেরেনি। উনি শম্ভুর বাবার সাথে উনাদের বাড়িতেই ছিলেন। হাসপাতাল থেকে ফোন যাবার পরই শম্ভুর বাবার সাথে উনিও রওনা হলেন হাসপাতালের দিকে।
এদিকে বাড়ি পৌঁছাতে পদ্মার মায়ের অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। ঘরে পদ্মা একাই বসে ছিল। মা বাড়ি আসতেই পদ্মা বলে......" মা ওখানকার কি খবর?? উনি ভালো আছেন তো???"....
পদ্মার মা বললেন...
" আর ভালো!! দেখে যতদূর মনে হলো ছেলেটা আর কোনোদিন চোখে দেখতে পারবেনা!!".....
হঠাৎই পেছন থেকে একটি অল্প বয়সী মেয়ের কন্ঠস্বর ভেসে এলো।
এ যেন পদ্মার মাকে উদ্দেশ্য করে বলছে..
"মা!!!আমার খিদে পেয়েছে!খেতে দেবে না!.....
কতদিন তোমার হাতে ভাত খাইনি?"......
পিছনে ঘুরে পদ্মার মা মেয়েটিকে সাদরে কোলে তুলে নিলেন। তারপর রান্না করা সেদ্ধ ভাত নিজের হাতে খাইয়ে দিলেন। পদ্মা ওর মায়ের এমন আচরণে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আসলে ওর মা যাকে খাইয়ে দিচ্ছেন এবং যে মা সম্বোধন করে ডেকে চলেছে; তাকে পদ্মা দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু ওর মা খুব সহজেই সেই অদৃশ্যমান ব্যক্তির সাথে কথাবার্তা বলে চলেছেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলছেন তিনি। ওর মাকে এমন কাণ্ড করতে কোনদিন দেখেনি পদ্মা। এরপরে ঘটলো আরেক কান্ড। ওর মা গান গেয়ে ঘুম পাড়াতে লাগলেন অদৃশ্য মেয়েটিকে।....
ওর মায়ের মধ্যে বেশ একটা অস্বাভাবিক ভাব বুঝতে পারছে পদ্মা। একটু ভয়ে ভয়ে মায়ের গায়ে হাত দিয়ে ডাকে..
" মা!ওমা!তুমি কার সাথে কথা বলছ? আমি তো কাউকে দেখতে পাচ্ছি না???".....
পদ্মার কথায় ওর মা উত্তর দিলেন...
" সে কিরে??তোর বোন!!......তোর বোনকে..…
তুই দেখতে পাচ্ছিস না??"....
"কই না তো????"....বলে পদ্মা।
ওর মা এবার বলেন....".সুলোচনা!দিদির সাথে একটু কথা বলত??"....
এই বার পদ্মা শুনতে পায়!!!
"দিদি!!এই দিদি!!তুই আমায় ভুলে গেলি???....
তোর জন্য আমি পৃথিবী ছেড়েছি!!"....
সুলোচনা নামটা শুনে...গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে পদ্মার!!....একটা ঢক গিলে ও বলে....
"বোন তুই !!!.....তুই কিভাবে এলি?? তুই তো সেই কোন ছোটবেলায় মারা গেঝিস এক্সিডেন্টে!!!.... বাবা-মা তোকে অনেক খুঁজেছে!! কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি তুই?? আর তুই এত ছোট কি করে রয়েছিস??"....
খিলখিল করে একটা হাসির শব্দ ভেসে আসে। তারপর মেয়েটি বলে...."আত্মার বয়স বাড়ে না রে!!.... তাই আমি ছোটই রয়েছি। এইতো তোর আমার কথা মনে আছে।"..
এইবার পদ্মা বলে..." মা তোকে কোথা থেকে নিয়ে আসলো??"..
আবার সেই খিলখিল হাসিটা হেসে মেয়েটি বলে..
" সেই ছোটবেলার মতো এখনও বোকা রয়ে গেলি দিদি। মা আনবে কেন?? আমাকে তো তুই আনলি!!!"..
এইবার সত্যিই অবাক হয়ে পদ্মা।
ভ্রু কুচকিয়ে ও বলে.….." আমি তোকে কোথা থেকে আনলাম?? আমিতো সেই জমিতে গিয়ে বসেছিলাম??.. তোকে কি আমি ডেকেছি??"....
এইবার মেয়েটি একটু রেগে ওঠে। একটু মেজাজ দিয়ে বলে...." বারে তুই আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করলি!!আমি তোর দুঃখ মোছাতে আসবো না??"....
পদ্মা চুপ করে থেকে একটু মনে করার চেষ্টা করে.. খানিক পর ওর মনে পড়ে; একটা ফনিমনসা গাছ কে ধরে পদ্মা সত্যিই কান্না করেছিল; আজকের অপমানের জন্য। আর বিস্মিত ভাবেই ফনিমনসা গাছের একটা কাঁটাও ওকে স্পর্শ করেনি। পদ্মা বলে...
" তার মানে পুরো ফাঁকা জমির পশ্চিম দিকের ওই ফনিমনসা গাছ টায় তুই থাকিস???"....
মেয়েটি বলে "গাছটায় আমি থাকিনা!! গাছটার নিচে মাটি চাপা দেওয়া অবস্থায় আমি আজও আছি ওখানে!"..
সত্যিই অবাক পদ্মা।
ও কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওর মা বলে...
" জানিস শম্ভুর কি অবস্থা হয়েছে??"... পদ্মা চুপ করে শুনছিল। অদৃশ্য মেয়েটি বলে....." ওর অবস্থাটা আমি করেছি মা!!.. প্রথমেই চোখে কাঁটার খোঁচা দিয়ে রক্তপাত করিয়ে ওকে অন্ধ করেছি।তারপর আরো কয়েকটা গাছের কাঁটা নিয়ে ওর চোখ দুটো খুবলে বার করে দিয়েছি!"......
মেয়েটির এই কথাগুলো শুনে এবং ওর মায়ের কথা শুনে পদ্মার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায় ।অন্ধকার মুছে জোৎস্নার মৃদু আলোর মধ্যে ওই অদৃশ্য বোনকে দেখতে পায় পদ্মা। ও দেখে একেবারে ওর ছোটবেলার প্রতিবিম্ব কে??আর চোখ দুটো প্রত্যক্ষ করে ভয় পায় পদ্মা।
কারণ মেয়েটির ২টি চোখের মধ্যে একটি চোখ ছিল!!
আরেক দিকের চোখের জায়গাটা ছিল একটা বড় কালো গর্ত যেখানে এখনও রক্তের দাগ শুকিয়ে আছে!!
নিজের দুই চোখে একবার হাত দিয়ে স্পর্শ করে পদ্মা! পদ্মার যেই চোখের মনি স্বাভাবিক ছিল না মানে ট্যারা ছিল!!সেই দিকে এর চোখের জায়গাটাতেই গর্ত ছিল ওই মেয়েটির।.....
একটু একটু করে পদ্মার মনে পড়ে সেই ছোট বেলার কথা। পদ্মাবতী এবং সুলোচনা দুই বোন ছিল ।একবার মা বাবার সাথে ওরা দুই বোন ঘুরতে বেরিয়ে ছিল। তখন ওদের বয়স পাঁচ কি ছয় বছর। একটা গাড়ি দুর্ঘটনায় পদ্মার একটি চোখের মনি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ এটি স্বাভাবিক যে জায়গায় থাকা উচিত সেখান থেকে একটু উপর দিকে চলে গিয়েছিল। যার জন্য পদ্মাকে ট্যারা মনে হতো। পুরো ঘটনাটাই পদ্মা ওর মায়ের মুখে শুনেছিল। কারণ এক্সিডেন্ট এর পর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল পদ্মা। কিন্তু ওর বোন সুলোচনা'র কথা ওর মা-বাবাকে জিজ্ঞাসা করেও কোন উত্তর পাইনি। তারপর সময় যেতে লাগে!!দিন পরিবর্তন হতে থাকে;একটু একটু করে সুলোচনার কথা ভুলেই গিয়েছিল পদ্মা।...
এত বছর পরে ওর বোনকে দেখে পদ্মার মানসিক অবস্থা কিরকম ছিল সেটা ও নিজেও জানেনা। ও খুশি হবে না ভয় পাবে??..
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ওর মাকে জিজ্ঞাসা করে পদ্মা.
" আচ্ছা মা বোন এমন কথা কেন বলছে?? ও সত্যিই আমার জন্য প্রাণ দিয়েছিল?? তোমরা সবকিছু জানতে!!"..
পদ্মার মা বলেন...." অনেক ছোটবেলায় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল তাদের দুই বোনের। নাগ পঞ্চমীর দিন আমার ঘর আলো করে তোরা জন্মেছিলিস!!.. খুব খুশি ছিলাম আমরা। দিন ভালই চলছিল। কিন্তু সুখের মাঝখানে দুঃখের কালোমেঘ লুকিয়ে ছিল। তোর তো এক্সিডেন্টের কথা মনে আছে!!"...
পদ্মা বলে..." আমার ওসব কিছুই মনে নেই! ছোটবেলায় তোমাদের মুখ থেকে যেটুকু শুনেছি, সেটুকুই মনে আছে।"...
এইবার পদ্মার মা বলতে শুরু করলেন..
" আসলে সেইদিন এর এক্সিডেন্ট টাই, আমাদের কিছু হয় নি ঠিকই কিন্তু তোদের দুই বোনের ভীষণ ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল।তোর দুটি চোখের মধ্যে একটি চোখের মণি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আর তোর বোনের দুটি চোখের মধ্যে একটি চোখ গাড়ির ধাক্কায় মস্তিষ্কের খুলি থেকে বাইরে বেড়িয়ে গিয়েছিল!!!..
সেইখানেই প্রাণ হারিয়েছিল সুলোচনা।... ডাক্তার যখন আমাদেরকে বললেন তোর একটা চোখ নষ্ট হয়ে গেছে, আর সুলোচনার দেহে আর প্রাণ নেই!! তখন তোর বাবা একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ছিলেন সুলোচনার নষ্ট হওয়া চোখটি কোনভাবে কি পদ্মাবতীর চোখের মণির মধ্যে অপারেশন করে রাখা যাবে না!!!..."
ডাক্তার এই কথাটি শুনে তোর বাবাকে বলেছিলেন সেটা সম্ভব। তারপর সুলোচনার চোখের মনি তোর চোখে স্হাপন করা হয়।"...
এই কথাটা শোনার পরে পদ্মা বলে...
" তারমানে আমার এই চোখটির মধ্যে আমার বোন আজও জীবিত আছে!...... কিন্তু মা এর সাথে শম্ভুর কি সম্পর্ক??".. সুলোচনা আবার খিলখিল করে হেসে উঠে বলে....." শম্ভুর সম্পর্ক না থাকতে পারে সম্পর্ক আছে শম্ভুর বাবার সাথে!!.. শম্ভুর বাবা আমাদের বাবার শত্রু ছিলেন। যদিও মৃত্যুর পরে সেটা আমি জানতে পেরেছি।
বাঁকুড়ার ওই জমিটা নিয়ে বাবার সাথে অনেক বছরের বিবাদ এই শম্ভুর বাবার। একদিন মেলায় ঘুরতে যাবার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে রওনা হয়েছিলাম আমরা। শম্ভুর বাবা সবসময় আমাদের বাবার পেছনে একটি লোক লাগিয়ে রাখতেন;যার হদিশ বাবা কোনদিন জানতে পারেননি!!!... সেইদিনও মেলা থেকে ফেরার পথে শম্ভুর বাবা ইচ্ছে করে ধাক্কা মারে আমাদের চারজন কে। মা-বাবাকে পড়ে যায় রাস্তার ধারে। তুই গিয়ে পড়িস আমাদের জমির মাঝখানে। আর আমি ছিলাম গাড়ির এক্কেবারে সামনে।... গাড়িতে শম্ভুর বাবা একা ছিলেন না। গাড়িতে শম্ভুও ছিল।... ধাক্কা মেরে ওনারা বেরিয়ে যান। মা-বাবা দৌড়ে এসে আমাকে উদ্ধার করেন। আমার মাথা তখন অসহ্য যন্ত্রণা করছিল। আমি এক চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম, আর এক চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম না। জ্ঞান চলে যাওয়ার আগে এ বাবাকে বলেছিলাম বাবা আমি বাঁচতে চাই তুমি আমাকে বাঁচাও। আমি দিদিকে মাঠের দিকে ছিটকে পড়ে যেতে দেখেছি। তারপর আমার যখন জ্ঞান আসে তখন দেখি....আমার শরীরটা কে ঘিরে কান্না করছেন মা-বাবা। ডাক্তার কে বলছেন আমার চোখের মনি তোর চোখে লাগাতে। মনে মনে খুব দুঃখ পেয়েছিলাম ঠিকই; কিন্তু বুঝতে পেরেছিলাম বাবা চান আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে তোর মধ্যে।..... অ্যাক্সিডেন্টের মুহূর্তে গাড়ি থেকে বেরিয়ে শম্ভু আমাকে দেখেছিল। অসহ্য চোখে যন্ত্রণার মধ্যেও হয়তো আমার বেরিয়ে যাওয়া চোখের মনিতে শম্ভুকে একবার দেখতে পেয়েছিলাম। সেই থেকে ওদের বাবা ও ছেলের মুখ আমার চোখের মধ্যে গেঁথে যায়।....
প্রথম দিন তোকে যখন ওরা দেখতে আসে আমার চোখের দিকে শম্ভুর বাবা তাকালেও শম্ভু কিন্তু তাকায় নি। যদি ও একবার তাকাতো তাহলে আমি নিশ্চিত সেই দিনের কথা শম্ভুর মনে পড়ে যেত!!! কারণ অ্যাক্সিডেন্টের মুহূর্তে আমার বীভৎস চোখের মনি টা দেখে শম্ভু আঁতকে উঠেছিল। সেই কারণেই আজকে যখন তোর প্রতি কুদৃষ্টির দিয়েছিল শম্ভু! তখন একই রকমভাবে আমার চোখের মনি দেখে ও ভয় পায়।..
আমার খুব রাগ হয়েছিল ওর উপরে তাই ওকে ফলো করতে থাকি। এত বছর আগের পুষে রাখা যন্ত্রণাটা এইবার সুদে আসলে তুলে নিয়েছি।.... কি হত বল সেদিন যদি ওরা ইচ্ছা করে আমাদের গাড়ি দিয়ে ধাক্কা না মারতো??"... কথা শেষ করে আবার খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে সুলোচনা। এইবার পদ্মা বলে.." সবই তো বুঝলাম কিন্তু আমি তোকে এনেছি এই কথাটা কেন বললি!!"..
সুলোচনা বলে.." জমির পশ্চিম দিকে ওই যে ক্যাকটাস গাছ টা আছে না;ওই টার তলায় মা-বাবা আমার নিথর দেহটা কে পুঁতে রেখেছিলেন।... আমাদের বয়স কিন্তু ১২বছর হয়েছিল না। আর ১২বছরের নিচের শিশুদের কে মৃত্যুর পর কবর দেওয়া হয়!!সেটা তো তুই জানিস। সেই থেকে আমি ওখানেই থাকি। শম্ভু কে নিয়ে চলে যাওয়ার পরে তোর কান্না সহ্য করতে না পেরেই আমি শম্ভুর হাল করেছি।!!!!...... মা-বাবা আমাকে যে ওখানে রেখেছিলেন সেটা শম্ভু দেখেছিল।মা বাবা চলে যাবার পর আমার দেহটাকে ওইখান থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিল শম্ভু; তাই আগুন লাগিয়ে সেইখান থেকে চলে গিয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতি হয়তো সেটা চাইনি। তাই কিছুক্ষন পর বৃষ্টি শুরু হয়ে আগুন নিভে যায়। শম্ভু হয়তো ভেবেছিল দেহটা পুড়ে গেছে!!! কিন্তু প্রকৃতি যার সহায় তাকে কে আটকাতে পারে!!"...
খিলখিলিয়ে হাসিটা হেসে কেমন যেন অদৃশ্য হয়ে যায় ছায়ামূর্তিটি। পদ্মার মা বলেন "কোথায় যাচ্ছিস মা??"..
সুলোচনা বলে..." আমার মুক্তি হয়ে গেছে! আমি চলে যাচ্ছি!!".....
পদ্মাবতী এবং পদ্মাবতীর মা চোখের জলে বিদায় দিলেন সুলোচনা কে।
পরদিন সকালে পাঁচু ঘটক আসেন। পদ্মার মাকে ডাকেন
" ও বৌদি!!ঘরে আছেন??"...
পদ্মার মা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলেন...
" কি ব্যাপার এত সকাল-সকাল!!"...
পাঁচু ঘটক বলেন.." পদ্মার জন্য সম্বন্ধ এনেছি!! পাত্র ইঞ্জিনিয়ার। কোন দাবি-দাওয়া নেই। এমনকি আপনাদের জমিও লাগবেনা। শুধু পদ্মাকে চায়।"...
ঘর থেকে পদ্মা বেরিয়ে আসে বলে..
" তাই নাকি??...... কিন্তু শম্ভু বাবুর কি খবর!!"
পাঁচু ঘটক বলেন.." আর বলিস নে মা!! বাপ-বেটা দুটোই আস্ত পাগল। ছেলের চোখদুটো শেষ। আর ছেলের ঐ করুণ অবস্থায় বাবার মস্তিষ্কে ব্যামো হয়ে গেছে। গতকাল রাতে হাসপাতালে গিয়েছিলাম ওনার সাথে। তখনো স্বাভাবিক ছিল সবকিছু। কিন্তু হঠাৎ করে ছেলেকে ওরকম ভাবে দেখে চিৎকার করতে করতে হাসপাতাল থেকে ছুটে দৌড় মেরে কোথায় চলে গেলেন ;এখনো পর্যন্ত খোঁজ পাওয়া যায়নি!!... যাক ভালই হয়েছে... শেষে পাগলের ঘরে তোকে বিয়ে দিয়ে আমি বা কি করে থাকতে পারতাম শান্তিতে!! এই ঘটকালি করেই আমার পেট চলে। আমার বদনাম হয়ে যেত না!!"....
দুইদিন পর সন্ধ্যেবেলায় পাত্রপক্ষ দেখতে আসে পদ্মা কে। পদ্মার মা আগের মতোই পাশের বাড়ির কাকিমার কাছ থেকে একটা মোটামুটি শাড়ী নিয়ে পদ্মাকে পরিয়ে দেন। পদ্মা সামনে এসে বসার পর সকলেই পদ্মা কে দেখে।.. ছেলেটি পদ্মাকে একবার দেখে পাঁচু ঘটককে উদ্দেশ্য করে বলে...." কাকা আপনি বলেছিলেন মেয়ের একটা চোখে অসুবিধা আছে! কিন্তু কোথায় ওটা দুটো চোখে একেবারে ঠিক!!"...
ছেলের মুখে কথাটা শুনে পদ্মা নিজেই ঝম করে উঠে পড়ে চেয়ার থেকে। ভাঙ্গা আয়নায় নিজের মুখ দেখে; সত্যি দেখে অবাক হয়ে যায়। মনে মনে ভাবে..
" ওর বোন শান্তি পেয়েছে। সেই কারণেই চোখের মনি টা ঠিক হয়ে গেছে। হঠাৎ আয়নার মধ্যে পদ্মা দেখতে পায়!!...বা চোখের মণি টা উপর নীচ হচ্ছে এমনি এমনি। দেখে যেন মনে হচ্ছে পদ্মা কে বলছে "দিদি! তোর যোগ্য পাত্র এসেছে.... তোকেও ভালো রাখবে। আমি সবকিছু আগে থেকে জেনে শুনে রেখেছি। সত্যিই আমাদের বাবার সম্পত্তির ওপরে ওর কোন লোভ নেই। তুই ওকে স্বামী হিসাবে গ্রহণ কর। তুই সুখী হবি। আর তুই সুখী হলে আমিও সুখী হব!! তোর চোখ দিয়ে এই পৃথিবীটাকে দেখব!!"......

"সত্যিই এমন হতে পারে!!"... বললেন স্যার।
সমর বলল.." স্যার এটা একটা গল্প!! আপনি কি গল্পের ভেতর ঢুকে গেলেন নাকি??"...
সমরের গল্প শুনতে শুনতে চোখের সামনে পুরো ব্যাপারটাকে যেন দেখতে পাচ্ছিলেন স্যার। বেশ খানিকক্ষণ সময় লাগলো ওনার ধাতস্থ হতে। তারপর বললেন..
" তোমার গল্পের মধ্যে প্রাণ আছে। চোখ নিয়ে গল্প হল এর পরে কি??".....
সমর বলল "এরপর এর গল্প সেই জিনিসটা নিয়ে যে জিনিসটা হাসলে আমাদের মুখের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে!"..
স্যার বললেন..." তুমি বলতে চাইছো দাঁত!!"..
সমর বলল.." এগজ্যাক্টলি ঠিক তাই!... আমার পরের গল্পের নাম "হস্তী দন্তীনি"!..
স্যার বললেন.." আরে শুরু করো!! আমি যে কন্ট্রোল হতে পারছি না!!"....সময় একটু হেসে বলল..." শুরু করছি আমার দ্বিতীয় গল্প.....
"হস্তী দন্তীনি"
এই শুনছো??... ওঠ ট্রেন চলে এসেছে!... আমাদের এবার রওনা দিতে হবে!".... রোহিতের ডাকে চোখ মেলে তাকায় শ্রীপর্ণা। রোহিত হাত দিয়ে কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে দেয় শ্রীপর্ণার। তারপর আস্তে আস্তে ওর হাত দুটো ধরে দাঁড় করায়।গতকাল সারারাত ওরা বোলপুর রেল ষ্টেশনে কাটিয়েছে। ট্রেন লেট ছিল। ওয়েটিং রুমে ওদের পাশাপাশি আরও অনেক যাত্রীরাই বসেছিলেন ট্রেন আসার অপেক্ষায়। তাদের মধ্যে একজন কৌতূহলবশত রোহিত কে জিজ্ঞাসা করে..
" ও দাদা!!.... একটা কথা জিজ্ঞাসা করব কিছু মনে করবেন না তো??"...
সারারাত ঘুম হয়নি রোহিতের। শ্রীপর্ণা মুখের দিকে তাকিয়েই রাত কেটে গেছে ওর। একজন বাইরের লোকের কাছ থেকে এমন একটি প্রশ্ন শুনে বিব্রত হলেও ভদ্রতার খাতিরে রোহিত বলে "বলুন কি বলবেন??...
লোকটি বলে...." বলছি আপনার স্ত্রী অসুস্থ?? ওনার মুখটা অত ফোলা কেন??....
গতকাল রাত থেকেই দেখছি আপনি ওনাকে কেবলমাত্র তরল জিনিস খাওয়াচ্ছেন। উনার কি মুখের ভেতরে কোনো সমস্যা হয়েছে??"...
প্রশ্নটি শুনে ভ্রু কুচকিয়ে রোহিত বলে.....
" না না ও কিছু না!!.. আসলে ঠান্ডা গরম লেগে এমন হয়েছে। শ্রীপর্ণার ছোট থেকেই ঠান্ডার প্রবলেম।"....
লোকটির কেমন যেন কথাটা বিশ্বাস হলো না। দূরের সিটে উনি বসে ছিলেন। একটু এগিয়ে এসে রোহিতকে বললেন..." আমাকে বলতে পারেন। আপনার স্ত্রীর মুখের অবস্থা দেখে বাইরে থেকে আমি যতদূর বুঝতে পারছি ওনার সমস্যাটা হয়েছে দাঁতে!!"....
এইবার কিন্তু রোহিত একটু সমস্যার সম্মুখীন হল।কারণ আশেপাশের অন্যান্য মানুষগুলো ওদের কথা কান পেতে শুনছিলেন!!... রোহিত সেটা ভালোই বুঝতে পারছিল। এদিকে ট্রেনের সিগন্যাল হয়ে গেছে। রোহিত কে উঠতে হবে। লোকটির কথায় গুরুত্ব না দিয়ে শ্রীপর্ণাকে ধরে কাঁধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে স্টেশনের দিকে পা বাড়ালো রোহিত। কিন্তু লোকটি যেন নাছরবান্দা। রোহিত কে স্টেশনের দিকে রওনা হতে দেখে উনি ওনার ব্যাগটা নিয়ে রোহিতের পাশেই হাঁটতে শুরু করলেন।
তারপর বললেন.…." তা বলছি দাদা কোথায় যাওয়া হবে??"...
রোহিত মনে মনে ভাবে..." উফ!! সত্যিই বিরক্তিকর।".. লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলে...." দেখুন আমার গন্তব্যে আমি যাচ্ছি। আপনার যেদিকে যাওয়ার সে দিকে যান।"
কথা শেষ করেই ট্রেনে উঠে পড়লো রোহিত। তারপর রিজার্ভেশন কামড়াতে নিজেদের সীট নাম্বারটা চেক করে নিল। শ্রীপর্ণাকে আলতো করে সুইয়ে দিয়ে রোহিত বললো.." শ্রী তুমি চুপ করে বিশ্রাম নাও। একটু ঘুমোবার চেষ্টা করো। আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি।"..
ওদের কামরার থেকে একটু দূরেই ছিল ওয়াশরুমটা। রিজার্ভেশন ট্রেনের লাক্সারি ব্যবস্থা থাকে। খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে একজন প্যাসেঞ্জারের সমস্ত রকম সুযোগ-সুবিধা । যেটা লোকাল ট্রেন গুলোয় এক্কেবারেই থাকে না। রোহিতের টিকিট ছিল ফার্স্ট ক্লাসের। এসি কামরা ও ছিল। কিন্তু সময়টা শীতকাল। তাই সেখানে রুম হিটারের ব্যবস্থাও আছে। রোহিত যাবে মহারাষ্ট্র।.. একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির উচ্চ পদে আছে রোহিত। শ্রীপর্ণা রোহিতের সাথেই এসেছে।.. ওয়াশরুমে হাত-মুখ ধুয়ে পকেট থেকে পার্সটা বার করে একটা ছবি দেখে মুচকি হাসে রোহিত। তারপর সেই ছবিটা আবার পকেটের ভিতরে ভরে বাইরে বেরিয়ে আসে। শ্রীপর্ণার কাছে এগিয়ে যাওয়ার আগে রোহিত লক্ষ্য করে সেই লোকটি ওদের সামনের সিটে বসে আছেন। এইবার কিন্তু রাগ আর সামলাতে পারেনা রোহিত। ছুটতে গিয়ে লোকটির জামার কলার ধরে রীতিমতো হুমকি মারে.." মশাই আপনি আচ্ছা মানুষ তো?? সেই স্টেশন থেকে আমাদের লক্ষ্য করছেন!! এখন আমার সামনের সিটে এসে বসেছেন!!!"....
লোকটি মৃদু হাসেন। নিজের গলার কণ্ঠস্বর আস্তে করে ধীরে ধীরে রোহিত কে বলেন.." আমি দুঃখিত কিন্তু কি করবো বলুন, আমার টিকিটের নম্বর অনুযায়ী এই সিটটা যে আমার!আর দুর্ভাগ্যবশত আমার গন্তব্য মহারাষ্ট্র।"..
রোহিত সত্যিই লজ্জিত হয়। লোকটির জামার কলার ছেড়ে দিয়ে কণ্ঠস্বর ধীর করে আস্তে আস্তে বলে....
" সত্যিই আমি বুঝতে পারিনি কিছু মনে করবেন না দাদা।..
আসলে গতরাতে একটুও ঘুম হয়নি। শরীরটা খুব ঝিম ঝিম করছে।...."
লোকটি বললেন." আরে দাদা ঠিক আছে। আপনিও বাঙ্গালী আমিও বাঙ্গালী। এই দুই বঙ্গবাসী যদি একে অপরের মনের কথা না বুঝতে পারি তাহলে আর কেমন বঙ্গবাসী হলাম!".. রোহিতের ভেতর থেকে যেন ইতস্তত ভাবটা কাটে। মৃদু হেসে রোহিত নিজের পরিচয় দেয়..
" নমস্কার!! আমি রোহিত সেন। S.U.Lমাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি ক্যাশিয়ার ডিপার্টমেন্টে আছি।.."..
লোকটি বললেন..." ও আচ্ছা আচ্ছা!! আমি শীর্ষেন্দু রায়। পেশায় একজন ডেন্টিস্ট।"...
লোকটির পরিচয় পেয়ে রোহিত আরো লজ্জিত হয়ে পড়ে। পূর্বকৃত ব্যবহারের জন্য আবার ক্ষমা চায় লোকটির কাছে। এইবার শীর্ষেন্দু রায় বলেন...
" উনি আপনার স্ত্রী??... উনার কি সমস্যা হয়েছে আমায় বলতে পারেন!!.... একজন ডাক্তার হিসেবে এ এবং প্রায় কুড়ি বছরের প্র্যাকটিস এর উপর ভিত্তি করে আমি বলতে পারি ওনার ঠান্ডা লাগার সমস্যা হয়নি! ওনার সমস্যাটা হয়েছে দাঁতের গোড়ায়!!"...
রোহিত আগেই ডক্টর শীর্ষেন্দু রায়ের নাম যশ এর কথা অনেক শুনেছে। খবরের কাগজে প্রায় দিনই এই ব্যক্তির সম্পর্কে প্রশংসনীয় উক্তি পাঠ করেছে। কিন্তু কোনদিন ছবিতে দেখেনি বলে চিনতে পারেনি আজ।
সবাইকে ফাঁকি দিতে পারলেও একজন প্রকৃত ডাক্তারের নজর এড়ানো অসম্ভব ব্যাপার।....
একটু চুপ করে থেকে শ্রীপর্ণার দিকে তাকায় রোহিত। শ্রীপর্ণা একটা মাফলার দিয়ে কান মাথা জরিয়ে সিটের ওপর মাথা পেতে ঘুমিয়ে পড়েছে। আজ প্রায় বছর খানেক হতে আসলো এই কঠোর যন্ত্রণার মধ্যে একটি একটি করে দিন কাটাচ্ছে শ্রীপর্ণা। ওর বয়স বেশি না। ২৮কি ২৯বছর। যদিও একজন মেয়ে মানুষ হিসেবে জন্মেছে বলে এই বয়সটাই অনেক। আবার একজন পুরুষ মানুষের ক্ষেত্রে এই বয়সটা কোন কিছুরই যোগ্য নয়। কারণ এখনকার দিনে অনেক এই বয়সের ছেলে রা বাবার ঘাড়ে বসে বসে কাটায়। কিন্তু যার বাড়িতে এই বয়সের একটি মেয়ে থাকে সেই বাবা-মা তাকে পাত্রস্থ করবার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন।
যাইহোক!! শ্রীপর্ণার এমন অবস্থা ছিল না। ব্যাপারটা প্রথম শুরু হয়েছিল ঠোঁটে ঘা দিয়ে। ধীরে ধীরে সেটাই মারাত্মক আকার ধারণ করতে শুরু করে।
রহিদ নিজের মনের কথা কাউকে বলে উঠতে পারেনি। কিন্তু স্বনামধন্য ডাক্তার শীর্ষেন্দু রায় যখন নিজের থেকেই রোহিতের সমস্যার কথা জানতে চাইছেন তখন তাকে বলতে বাঁধা কিসের???.....
মাথা নিচু করে রোহিত বলতে শুরু করে.…...
" শ্রীপর্ণা আমার স্ত্রী নয়। আমার পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট। প্রায় বছর তিনেক আগে আমাদের পরিচয় হয়। শ্রীপর্ণা প্রথম যেদিন আমাদের কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিতে এসেছিল সেই দিনই আমার পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে ওকে জয়েন করতে বলা হয়।"... কথা শেষ করেই একবার শ্রীপর্ণা দিকে তাকায় রোহিত। শীর্ষেন্দু রায়ের দিকে তাকিয়েও রোহিত দেখে...
উনিও শ্রীপর্ণার দিকেই তাকিয়ে আছেন। শ্রীপর্ণা মেয়েটা মোটামুটি সুন্দরই। তবে সিনেমার নায়িকার মত জিরো ফিগারের নয়। বেশ মাংসপিণ্ড আছে শরীরে। কারণ স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় চাকুরী ক্ষেত্রে সিনেমার নায়িকার মত ডায়েট কন্ট্রোল করে চলতে হয় না।
শীর্ষেন্দু রায় জীবনের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন
" হুম বুঝলাম!!.. এটা কলিযুগ হলেও সাধারণত বিবাহিতা মেয়েরা শাঁখা-সিঁদুর এখনো পড়ে। আসলে এমনি শীতকাল গায়ে হাজার ঘন্টা সোয়েটার চাপানো থাকে। তাই আমি আগে লক্ষ্য করিনি। সত্যিই তো ওনার হাত তো খালি সিঁথি ও ফাঁকা। তা আপনারা কি লিভ ইনে আছেন???"...
রোহিত দাঁত দিয়ে জিভ কাটে। তারপর বলে..
" কি বলছেন??.. আমি ভেতো বাঙালি। বাড়িতে মা-বাবা আর আমার ৩বছরের ছোট্ট মেয়ে আছে।.. অফিস কাছারি করে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই জীবন কাটাই। এসব হাই-ফাই সোসাইটির লিভ-ইন;ঐ শব্দটা আমার পরিবারের কাছে আপত্তিকর ছাড়া আর কিছুই নয়। শুধু আপত্তি করে নয় সমাজের কাছে ওটা নিন্দনীয়। আমাদের দেশ এখনো এতটা আধুনিক হতে পারেনি পাশ্চাত্যের মত।"...
ডাক্তার শীর্ষেন্দু রায় বললেন.." এইটা আপনি একদম ঠিক কথা বলেছেন।তাহলে???...."...
কথাটা বলতেই একজন ওয়েটার এসে হাজির হন। রোহিত এবং শীর্ষেন্দু কে খাবারের অর্ডার করতে বলেন।
রোহিত বলে....." দুটো ব্রেড আর একটা চিকেন স্টু।". তার পর শ্রীপর্ণার দিকে তাকিয়ে বলে..
" আচ্ছা আপনাদের কাছে এক গ্লাস গরম দুধের অ্যারেঞ্জমেন্ট হবে?"...
ওয়েটার কিছু বলার আগেই শীর্ষেন্দু রায়ের গলা থেকে বেরিয়ে এলো..
" আরে মশাই অমন রিকোয়েস্টের সুরে বলছেন কেন?? রিজার্ভেশন কামরায় সমস্ত সুযোগ সুবিধা দেওয়ার জন্যই তো টিকিটের দাম এত টাকা নেয় ওরা।
আর গরম দুধ হবে না!" কথাটা শেষ করে ওয়েটারের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন.. "এইযে শোনো!আমার জন্য দুটো রুটি আর একটা চিকেন তরকা নিয়ে এসো। আর এই দাদা যা যা অর্ডার দিচ্ছেন তাই আনবে!"..
ছেলেটি বাধ্য ছেলের মত ঘাড় নেড়ে চলে যাচ্ছিল; আবার পিছন থেকে ডাক দিলেন শীর্ষেন্দু।
" এই যে শোনো ভাই দুধটা কিন্তু উষ্ণ গরমই আনবে। কারণ এখানে একজন অসুস্থ পেসেন্ট আছেন।"....
মিনিট পাচেক নীরব থাকার পর ওয়েটার হাজির হন খাবার নিয়ে। যার যেমন অর্ডার সেই মতো খাবার নিয়ে আসেন। রোহিত এবং শীর্ষেন্দু নিজেদের খাওয়াটা কমপ্লিট করে হাত ধুয়ে বসেন। তারপর রোহিত শ্রীপর্ণার কাছে দিয়ে শ্রীপর্ণাকে ডাকে.....
" শ্রী উঠে পড়ো। গরম দুধ এনেছি! একটু কষ্ট করে খেয়ে নাও!".....
কয়েক সেকেন্ডের মাথায় চোখ মেলে তাকায় শ্রীপর্ণা। রোহিতের হাত থেকে দুধের গ্লাস নিয়ে ধীরে ধীরে চুমুক দিয়ে খেতে শুরু করে। দুই-তিনবার ঢোক গিলে শ্রীপর্ণা বলে....." আর খাব না। আমার অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে!"...
এইবার শীর্ষেন্দু রায় এগিয়ে আসেন। শ্রীপর্ণা হাত থেকে গ্লাস টা নিয়ে শ্রীপর্ণাকে বলেন.." দেখি একটু হা করো তো!! মুখের ভেতরের কন্ডিশন তো একটু দেখি??"..
শ্রীপর্ণা ভারী অবাক হয়। রোহিত উনার পরিচয় জানে কিন্তু শ্রীপর্ণার তো জানেনা!!....
ভ্রু কুচকিয়ে রোহিতের মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে শ্রীপর্ণা। রোহিত বলে.." উনি স্বনামধন্য ডেন্টিস্ট শীর্ষেন্দু রায়। তোমার সৌভাগ্য যে এনার মতো একজন মানুষ তোমার ট্রিটমেন্ট করতে চাইছেন। যাকে দেখাতে গেলে প্রায় মাস ছয়েক আগে থেকে অ্যাপোয়েন্টমেন্ট করে রাখতে হয়।"... শ্রীপর্ণা কিছু বলার চেষ্টা করে..
তার আগেই শীর্ষেন্দু রায় বলেন..
" তোমার কথা বলতে হবেনা।তোমাকে আমি যেটুকু বলছি সেটুকুই করো। হাঁ করো,মুখের ভেতরটা আমি দেখি।"...
ডাক্তারের কথা শুনে বাধ্য মেয়ের মত হা করে শ্রীপর্ণা। ব্যাগ থেকে একটা টর্চ বার করে শীর্ষেন্দু রায় চেক করেন। শ্রীপর্ণার মুখগহবরের অবস্থা দেখে ডাক্তার শীর্ষেন্দু আঁতকে ওঠেন। চিৎকার করে বলেন...
"O my god!!! এরকম মারাত্মক অবস্থা কিভাবে হল!! এটা তো দেখছি!...."
এইটুকু বলতেই রোহিত বলে.." আপনি ঠিকই ধরেছেন। এটা ক্যান্সার। আমারও বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে শ্রীপর্ণার লাস্ট স্টেজ। এখন আপনি দেখুন ওকে সুস্থ করতে পারেন কিনা!!"....
ডাক্তার শীর্ষেন্দু রায় বলেন." এত অল্প সময়ের মধ্যে এমন অবস্থা স্ট্রেঞ্জ??? আমার এত বছরের প্র্যাকটিসে এত কম সময়ের মধ্যে এমন অসুখ আমি প্রথমবার দেখছি। উনি আগে থেকেই ট্রিটমেন্ট করাতেন তাহলে এমন মারাত্মক অবস্থা হওয়ার কোনো কথাই ছিল না।
আর দাঁতগুলো এমন সরু সরু ছোট্ট ছোট্ট কি করে হয়ে গেল???"....
রোহিত বলে..." আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা আমি জানিনা। তবে আমি নিজের চোখে যেটা দেখেছি সেটা আর পাঁচজনের বিশ্বাস করার মত কথা নয় । কিন্তু এটা আপনাকে বলতে পারি....
শ্রীপর্ণাকে চিকিৎসা করে সুস্থ করার দায়িত্ব আমার। সেই কারণে এই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে শ্রীপর্ণাকে এনেছি। শুনেছি মহারাষ্ট্রে অনেক ভালো ভালো ডেন্টিস্ট আছেন।শেষবারের মতো চেষ্টা করে দেখতে চাই যদি মেয়েটাকে সুস্থ করতে পারি, তাহলে সারা জীবনের আত্মগ্লানি টা একটু হলেও কমবে।"...
ডাক্তার শীর্ষেন্দু বলেন.." আমি তো বুঝতে পারছি না এমন হলো কি করে???"....
রোহিত বলে..." স্যার আপনি ভূতে বিশ্বাস করেন!! শ্রীপর্ণার কথাটা আমি যাকে যাকে বলেছি সে আমাকে বলেছে ওসব ভূত বলে কিছু হয় না। সবটাই মনের কল্পনা ,অলীক কল্পনা। কিন্তু যেদিন আমি প্রথম নিজের চোখে দেখি!! সেদিনের পর থেকে আমার এই ধারণা সম্পূর্ণ ভাবে চলে গেছে!!"...
ডাক্তার শীর্ষেন্দু বেশ বিরক্ত হয়ে বললেন..
" আচ্ছা রহিত বাবু!আপনি কি কি বলতে চাইছেন আমাকে একটু ক্লিয়ার করে বলুন! আমি একজন ডাক্তার।চিকিৎসা করার আগে ওর অতীত টা ভালো করে না জানতে পারলে আমি কি করে ট্রিটমেন্ট করবো বলুন তো????...."
রোহিত বলে "সেই কথাই তো বলছি স্যার!. শ্রীপর্ণার আর আমার অতীতের ঘটনা জানতে গেলে আপনাকে একদম গোড়া থেকে শুনতে হবে।"....
শীর্ষেন্দু বলেন..." আপনি শুরু করুন আমি শুনছি। তার আগে আমি একটা ওষুধ দিচ্ছি এটা আপনি শ্রীপর্ণাকে খাইয়ে দিন। এ ওষুধটা খেলে একটু ব্যথা কমবে।".....
ব্যাগ থেকে একটা কন্টেইনার বার করেন ডক্টর। এয়ার টাইট কনটেনার। সেটা বিভিন্ন রকম ওষুধে ঠাসা। ওষুধ-পত্র উল্টে-পাল্টে একটা ছোট ট্যাবলেট বার করে রোহিতের হাতে দিয়ে শ্রীপর্ণা কে খাইয়ে দিতে বললেন।.. ডাক্তারের কথা মতই রোহিত শ্রীপর্ণাকে ওষুধ খাইয়ে দেবার কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্রীপর্ণা ঘুমিয়ে পড়ল। ভালো ভাবে ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা সেটা দেখার জন্য শ্রীপর্ণাকে কয়েকবার ডাকলো রোহিত । শ্রীপর্ণা সাড়া না দেওয়ায়; রোহিত বললো ডাক্তার কে...
" বাহ!!!দারুন নাটক করতে পারিস তো তুই?? কোথায় ডাক্তার শীর্ষেন্দু আর কোথায় যাত্রাপালায় অভিনয় করা শীর্ষেন্দু??? এত ট্যাবলেট কেন রেখেছিস তুই?? আর এতগুলো ট্যাবলেট এর মধ্যে কি ট্যাবলেট খাওয়ালি রে!!!...."..
শীর্ষেন্দু বলে....."Sedil .5.... কড়া ডোজের ঘুমের বরি। আগামীকাল সকাল হওয়ার আগে ওর ঘুম আর ভাঙবে না!! এবার চল দেরি না করে মেয়েটার ব্যাগ থেকে যাবতীয় মূলধন দুজনে মিলে বার করেনি!!........"....
রোহিত বলে আমার ভাগটা কিন্তু বেশি। কারণ গত তিন বছর ধরে বহু কষ্টে মেয়েটার মনের মধ্যে ভয় সঞ্চার করাতে করাতে তবে কিন্তু এই পজিশন এ আনতে পেরেছি। একটা সুস্থ মানুষকে; ভুল সার্টিফিকেট দেখিয়ে ক্যান্সারের পেশেন্ট বানিয়ে, তাকে বাড়ি থেকে নিয়ে আসা, কতটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার!সেটা আমি ছাড়া কেউ বুঝতে পারবে না! ভাগ্যিস ওয়েদার চেঞ্জ এর কারণে শ্রীপর্ণার জোর ঠান্ডাটা লেগেছিল। না হলে তো কোন ভাবেই ওর বাড়ির লোকের কাছ থেকে ওকে আলাদা করে আনতে পারছিলাম না!!...
রোহিত শ্রীপর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে... বেচারী শ্রীপর্ণা.... ও জানতেও পারল না ওরে বস ই ওর ব্যাগ থেকে যাবতীয় টাকা-পয়সা গয়নাগাটি লুট করবেন।ওকে ঠকাবেন!!!...
রোহিত একদিকে যেমন ছিল কম্পানির ক্যাশ ডিপার্টমেন্টে অফিসার তেমনই ওর দুই নম্বরি ব্যবসা ও ছিল। প্রায় তিন বছর ধরে শ্রীপর্ণাকে নানারকম মিথ্যে কথা বলে মিথ্যে প্রেমের জালে ফাঁসায় রোহিত। তারপর অনাথ আশ্রম থেকে একটি শিশুকে ভাড়া করে এনে নিজের মেয়ে সাজিয়ে পরিচয় দেয়। স্ত্রী মারা গেছেন বলে শ্রীপর্ণার মনে নিজের সম্পর্কে সমবেদনা ফুটিয়ে তোলে। তারপর রাস্তার ভিখারিদের টাকা খাইয়ে মা-বাবা সাজিয়ে একটা নকল বাড়ি; একদিনের জন্য ভাড়া নিয়ে নিজের সাজানো সংসার দেখায়। সংসারের সব থাকলেও একজন এরই অভাব। সেটা হলো একজন সঙ্গিনী। ধীরে ধীরে শ্রীপর্ণার মন নরম হতে শুরু করে। এর পর শ্রীপর্ণার সাথে প্রথম ডেটিং এ যায়। রোহিত অত্যন্ত চালাক ছেলে। এর আগেও শ্রীপর্ণার মত অনেক মেয়ের সাথে বেঈমানি করেছে ও। সেই কারণেই এক অফিসে বছর তিন চার এর বেশি রোহিত কাজ করতে পারে না।.....
শ্রীপর্ণা এমন ধীরে ধীরে নরম হতে থাকে আরো। এরপর একদিন ড্রিঙ্ক এর মধ্যে একটা ওষুধ মিশিয়ে খাইয়ে দেয় রোহিত। ড্রাগের নেশা খুব মারাত্মক। শ্রীপর্ণাকে ড্রাগে আক্রান্ত করে। শ্রীপর্ণা শরীর ধীরে ধীরে খারাপ হতে শুরু করে । রোহিতকে মন দিয়ে বসেছিল শ্রীপর্ণা তাই অসুস্থ হবার সাথে সাথেই রোহিত কে ফোন করে,বলে....
" রোহিত! কয়েকদিন যাবৎ আমার শরীরটা খুব খারাপ করছে। মাথাটা ঝিমঝিম করে। আজ স্নান করতে গিয়ে দেখি নাক থেকে রক্ত বেরোচ্ছে। বাড়িতে মা বাবা ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। কথায় কথায় গাটা গুলিয়ে বমি বমি ভাব হয়। তোমার চেনা জানা কোন ডাক্তারের সাথে আমার একটা অ্যাপোয়েন্টমেন্ট করাও না!!"....
রোহিত বলেছিল." সে কি তোমার এত শরীর খারাপ!! আমাকে জানাওনি কেন?? আমি যাচ্ছি তোমাকে আনতে। আমার চেনা পরিচিত একজন ডাক্তার আছেন,তার কাছে নিয়ে যাবো।".....
রোহিতের ভালো ব্যবহার শ্রীপর্ণার মা-বাবার মনকেও গলিয়ে দিয়েছিল। ধীরে ধীরে ওনারা রোহিত কে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন সেই কারণেই নিশ্চিন্ত মনে শ্রীপর্ণাকে রোহিতের সাথেই ডাক্তার দেখাবার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
ডাক্তার কে দেখানোর পর .... শ্রীপর্ণাকে ব্লাড টেস্ট করতে দেওয়া হয়। ডাক্তার বলেছিলেন
" রক্ত পরীক্ষা না করলে অসুখ ধরা যাবেনা!!"..
আসলেই ডাক্তারকে রোহিত আগেই অনেক টাকা খাইয়ে মুখ বন্ধ করে রেখেছিল।
এরপর একটা নকল ক্যান্সারের সার্টিফিকেট বার করে শ্রীপর্ণাকে দেখায়। সেটাও আবার শ্রীপর্ণার মুখগহবরের ভিতরে দাঁতের মাড়িতে।
বাড়িতে সবাই খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। রোহিত ছলচাতুরি করে শ্রীপর্ণার মা-বাবার কাছ থেকে যাবতীয় টাকা-পয়সা গয়নাগাটি সমস্ত কিছু শ্রীপর্ণার কাছে দিয়ে দিতে বলেন কারণ ট্রিটমেন্ট করতে যে পরিমান টাকা খরচ হবে তত টাকা দেবার মত সামর্থ্য রোহিতের নেই।
আর সত্যিই তো কর্কট অসুখ খুবই মারাত্মক। শ্রীপর্ণা ড্রাগের নেশায় এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েছিল যে প্রতিদিন ওকে ড্রাগ না দিলে ওর খাবার হজম হতো না। রোহিতের সুবিধা আরো বাড়ে। এরপর একদিন শ্রীপর্ণার মা-বাবাকে বলে ভালো ট্রিটমেন্ট করবার আশায়, শ্রীপর্ণাকে নিয়ে মহারাষ্ট্র পাড়ি দেয় রোহিত। অফিস থেকে ফেরার পথে, হেড অফ ডিপার্টমেন্টে রেজিগনেশন লেটার আগেই লিখে দিয়েছিল রোহিত। শ্রীপর্ণা জানতো না। রোহিত কে ভালবেসে ফেলেছিল শ্রীপর্ণা!সেই কারণে ওকে বিশ্বাস করে ওর সাথে পাড়ি দিয়েছিল মহারাষ্ট্র।
"নে রোহিত তাড়াতাড়ি কর!"... বলে শীর্ষেন্দু।
কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল রোহিত। শীর্ষেন্দুর ডাকে ঘোর কাটে। ব্যাগ থেকে যাবতীয় টাকা-পয়সা এবং গয়নাগাটি লুট করে ওরা ঠিক করে পরের স্টেশনে নেমে যাবে। এমনিতেই দূরপাল্লার গাড়ি গুলি সমস্ত স্টেশনে থামে না। কিন্তু শীর্ষেন্দু আর রোহিত এর কাছে নেমে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
গাড়ি থেকে নামার আগে.......
পিছন ফিরে ওর মুখের দিকে একবার তাকায় রোহিত। এর আগে অনেক মেয়ের সাথেই এমন বেইমানি করেছে ও কিন্তু শ্রীপর্ণাকে ছেড়ে যেতে বুকের ভেতরটা কেমন যেন খোঁচা দিচ্ছে। ওর বারবার মনে হচ্ছে সত্যিই শ্রীপর্ণার মুখের ভেতরে কোন খারাপ অসুখ হয়নি তো???...
নেমে যায় ওরা দুজন। ট্রেনটা মিনিট পনেরো মতো দাঁড়িয়ে আবার চলতে শুরু করে। এই ১৫মিনিটে শীর্ষেন্দু এবং রোহিত একে অপরের মধ্যে টাকা-পয়সা গয়নাগাটি ভাগ বাটোয়ারা করে যে যার গন্তব্যের দিকে রওনা হয়েছে।....
ট্রেনটা যখন টেশান ছাড়ছে তখন রোহিত প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে মেইন রাস্তায় উঠে। ট্রেন ছাড়ার আগে একটা হুইসেল বাজায় মুহূর্তের মধ্যেই রোহিত পেছনে ঘুরে একবার তাকায়। তারপর লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে হাঁটতে শুরু করে। রোহিতের কেউ নেই। অনেক ছোটবেলায় মা চলে গিয়েছিলেন পরলোকে। আর বাবা একজন মাতাল। জীবিত আছেন কিন্তু কোথায় আছেন রোহিত তা জানেনা। কারণ ওই মদের নেশায় চুর হয়ে' একদিন ট্রেনে উঠে পড়েছিলেন;তারপর ওনার গন্তব্য কোথায় হয়েছে রোহিত জানেনা। রোহিতের বয়স তখন অনেক কম। ও বেড়ে ওঠে ওর মামার বাড়িতে। মামারা এই নিজের সন্তান সম ভালোবাসা দিয়ে ওকে বড় করে তোলেন।.... কিন্তু যেই সমস্ত অল্প বয়সের ছেলে মেয়ের মা-বাবা থাকে না তারা সঙ্গদোষে খারাপ হয়ে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাই হয়। রোহিতের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। শীর্ষেন্দু তাদের মধ্যে অন্যতম। যাত্রাদলে অভিনয় করা এই শীর্ষেন্দু;দুই নম্বরি ভাবে মানুষকে লুট করে বড়লোক হবার পন্থা শিখিয়েছিল রোহিতকে।
এখন রোহিত নিজস্ব ফ্ল্যাট এ থাকে। গয়নাগাটি গুলো একটি সোনার দোকানে দেখিয়ে বেশ মোটা টাকা পায় রোহিত। তারপর নিশ্চিন্ত মনে ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ফ্লাটের সামনে গিয়ে পকেট এ্ হাত দেয় রোহিত।
" এই যা!! ফ্লাটের চাবিটা তো শ্রীপর্ণার ব্যাগে ভুল করে রেখে দিয়েছি!!. ইস এবার কি করে ঘরে ঢুকবো??"..
ভাবে রোহিত। ভাবতে ভাবতে আবার একবার পকেট এ্ হাত দেয়;দেখে.." আরে!!এইতো চাবিটা!... আমিও যে কি?"..
চাবি দিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে রোহিত। আলোটা জ্বালায়। আজকের সমস্ত টাকা-পয়সা ঢুকিয়ে রাখে। তারপর হাত মুখ ধুয়ে ফোনটা হাতে নেয়। গতকাল রাত থেকেই রোহিতের মোবাইলটা সুইচ অফ। ফোনটা হাতে নিয়ে সিম কার্ড টা চেঞ্জ করে চার্জে বসায় রোহিত। সিমকার্ড চেঞ্জ করার একটাই কারণ সেটা হল শ্রীপর্ণার সাথে আর কোনরকম যোগাযোগ না রাখা।
নিজের জন্য কোনরকম দুটো সিদ্ধ ভাত ফুটিয়ে খাওয়া অভ্যাস আছে রোহিতের। কিন্তু আজ সেটা করতে একদম ইচ্ছে করছে না। সেই কারণে খাবার অর্ডার করে রোহিত। প্রায় ৪৫ মিনিট পর একটি ছেলে এসে খাবার দিয়ে যায়। ধবধবে সাদা ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, পাতলা করে মুগের ডাল, বাদাম সহকারে ঝুড়ি আলু ভাজা, রুই মাছের পাতলা করে ঝোল, ও শেষ পাতে আবার এক টুকরো কাঁচা আমের চাটনি ও আছে। "ভাতটা বোধ হয় বাসমতি চালের!" ভাবে রোহিত। তারপর রান্নাঘর থেকে একটা কাচের প্লেট এনে খাবারটা সাজিয়ে ফেলে। বেশ তৃপ্তি সহকারে খেতে শুরু করে । প্রথম দুই তিনবার ডাল সহযোগে ভাত মেখে মুখে দিয়ে তৃপ্তিতে চোখ জুড়িয়ে আসে ওর। আচমকাই মুখের ভেতরে কটমট করে শব্দ হয়ে ওঠে।"আহ!!".. বলে চিৎকার করে ওঠে রোহিত। তাড়াতাড়ি আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। হা করে মুখের ভেতরে টর্চ মেরে রোহিত দেখে একটা মাড়ির দাঁত ভেঙে গেছে। একটু রক্ত বেরোচ্ছে। রোহিত বলে......
" কাউকেই ভরসা করা যায় না। খাবার অর্ডার করে আনলাম! এই খাবারের মধ্যেও কনা রয়েছে। ইস আমার দাঁতটা ভেঙে গেল।"....
ভালোভাবে আর খাওয়া হলো না। টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ে ও। তারপর হাত মুখ ধুয়ে বেডরুমে ঘুমোতে চলে যায়।.....
রাতে কিছুতেই ঘুম আসছে না রোহিতের। খালি এপাশ ওপাশ করছে। মুখের ভেতরটা মারাত্মকভাবে যন্ত্রণা করছে। মনে হচ্ছে যেন মাড়ি থেকে দাগগুলো বড় হয়ে যাচ্ছে। রাত আড়াইটে নাগাদ বিছানা ছেড়ে উঠে বসে রোহিত। তারপর ঘরের আলোটা জ্বেলে বাথরুমে যায়। আর বাথরুমের দেওয়ালে লাগানো আয়নায় নিজের মুখ দেখে অবাক হয়ে যায় রোহিত।...
ও দেখে ওর চোয়াল থেকে গলার নিচ পর্যন্ত মারাত্মকভাবে ফুলে গেছে।... এইবার সাহস করেই হা করে রোহিত। আর যেটা ও দেখে তাতে বিস্ময় ওর চোখ দুটো বেরিয়ে যাবার উপায় হয়!!...
আয়ার দিকে তাকিয়ে রোহিত দেখে...
" কবিতাগুলো অস্বাভাবিক রকম ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতটাই বড় হয়ে গেছে ওগুলো যে ঠোঁট বোঝা অবস্থাতেও ঠোঁটের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। আর যন্ত্রনাটা একটু একটু করে বেড়েই চলেছে।.... সারা মুখ রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছে।"...
নিজের মুখ দেখেই ভয়ে আঁতকে ওঠে রোহিত। যন্ত্রণা এতটাই প্রবল হতে শুরু করে যে!একসময় ওর মনে হয় দাঁতগুলো যদি ও টেনে ছিড়ে ফেলতে পারতো তাহলে খুব ভালো হতো।....
" আমি আর পারছিনা!! এত যন্ত্রণা আমি আর সহ্য করতে পারছি না!!".... কথাটা বলে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা হাতুড়ি জাতীয় জিনিস বার করে নিজের মুখের মধ্যে বসিয়ে দেয় রোহিত। সঙ্গে সঙ্গে রক্তপাত হতে শুরু করে। এরই মধ্যে হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠে। রোহিতের তখন মাথা ঠিক নেই। যন্ত্রণায় ঘরঘর করছে ও। বারবার ফোনটা বেড়ে যাওয়ায় ফোন রিসিভ করে। ফোনের ওপার থেকে ভেসে আসে...
" রোহিত রোহিত!! টিভিটা চালা, খবর দেখ!!... যেই ট্রেনে করে আমরা আজকে এসেছি!সেই ট্রেনটা পরের স্টেশনেই একসিডেন্ট করেছে; কেউ বেঁচে নেই!"...
বলেই ফোনটা কেটে যায়। ফোনটা করেছিল শীর্ষেন্দু। রোহিত কিছু বলার আগেই ফোন কেটে যায়। অসহ্য যন্ত্রণায় মাঝখানেও রোহিত টিভিটা অন করে। ও দেখতে পায় ট্রেনটা উল্টে পড়ে আছে সমস্ত যাত্রীরাই মৃত বলে ঘোষিত। মৃত যাত্রীদের নামের লিস্ট দেখানো হচ্ছে। আর সেই লিস্টে রয়েছে শ্রীপর্ণার নাম। রোহিতের বুকের ভেতরটা আবার খোঁচা দিয়ে ওঠে।... টিভির মধ্যে খবর চলাকালীনই রোহিতের মনে হয় যেন শ্রীপর্ণাকে ও বারবার দেখতে পাচ্ছে। ট্রেনটা ছাড়ার আগে শ্রীপর্ণার মুখের দিকে রোহিত বারবার তাকাচ্ছিল কারণ যে ডাক্তারের কাছ থেকে ভুল রিপোর্ট ও করিয়েছিলো সেই ডাক্তার পারসোনালি ভাবে ও কে বলেছিলেন..
" লাস্ট কয়েক বছরে তুমি যেই কয়জনকে আমার কাছে এনেছো!তারা প্রত্যেকেই শারীরিকভাবে সুস্থ ছিল।কিন্তু এই মেয়েটির রিপোর্ট করার আগে, ওর ব্লাড টেস্ট করে আমি জানতে পারি ও সত্যিই ক্যান্সারে আক্রান্ত। আর সেটা প্রতিদিন ড্রাগ নেওয়ার কারণে হয়েছে। ওর দাঁত গুলি বিষাক্ত হয়ে গেছে। এবং ওই দাঁতের কামড়ে ওর ঠোঁটে ঘা হয়েছে।সেই ঘা থেকেই সারা মুখে এই মারান অসুখ ছড়িয়ে পড়ছে।... তোমার টাকার লোভে আমি অনেক পাপ করেছি কিন্তু এই মেয়েটির রিপোর্ট এক্কেবারে সত্যি কারের রিপোর্ট। তুমি পারলে ওকে টিটমেন্ট করাও। এখনো টিটমেন্ট করালে ও সুস্থ হয়ে যাবে। অনেক মেয়ের জীবন নিয়েই তো খেলা করেছ;একটি মেয়েকে না হয় জীবন দান দিলে।!!"....
কিন্তু টাকার মারাত্মক লোভ রোহিতকে আসক্ত করে রেখেছিল। শ্রীপর্ণা মা-বাবার একমাত্র কন্যা সন্তান হলেও অবস্থা কিন্তু অন্যান্য মেয়েদের মত সচ্ছল ছিল না। অর্থাৎ যে কয়টি মেয়ের জীবন নষ্ট করেছিল তাদের মধ্যে। অন্যান্য মেয়েগুলি কোটিপতি বাবা-মায়ের সন্তান ছিল। এতদিনে সেই সব মেয়েরা রোহিতের কথা হয়তো ভুলে গেছে। কিন্তু শ্রীপর্ণার তাদের থেকে একেবারে ভিন্ন;সেটা ভালো করেই জানত। কিন্তু অর্থের নেশা ড্রাগের নেশার থেকেও বেশি মারাত্মক।....
ডাক্তারের কথায় কোনরকম পাত্তা না দিয়ে রোহিত শীর্ষেন্দু সহায়তায় শ্রীপর্ণাকে লুট করে।
কথাগুলো চিন্তা করতে করতেই রোহিতের কলিং বেল বেজে ওঠে। দরজা খোলে রোহিত। কিন্তু দরজার সামনে কেউ নেই। যন্ত্রনা নিয়ে দরজা বন্ধ করে শোবার ঘরে চলে যায়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে রোহিত ভাবে সেই দিনের একটি সন্ধের কথা। শ্রীপর্ণা সাথে প্রথম ডেটিং এর দিন ওরা একে-অপরের অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছিল। এত মেয়ের জীবন নষ্ট করলেও রোহিত কখনো কোন মেয়েকে টাচ করে নি। শ্রীপর্ণাকে প্রথম চুম্বন করেছিল রোহিত। এইসব কথা চিন্তা করতে করতে কখন যেন রাত কেটে ভোর হয়ে আসে। বিছানায় উঠে ডাক্তার দেখাবার জন্য তৈরী হয় রোহিত। একজন ভালো ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। মোবাইলটাই অনলাইনে ভালো ডেন্টিস্টের সন্ধান করতে থাকে ও। হঠাৎই সেখানেই শীর্ষেন্দু রায়ের নাম দেখতে পায়। সত্যিই তো এনি সেই স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। অ্যাপোয়েন্টমেন্ট হয়ে যায় রোহিতের। তারপর ডাক্তারের কাছে যায় রোহিত। ২,৩ জনের পরে ওর নাম আসে। ডাক্তারের মুখোমুখি বসেছে রোহিত। কিছুটা চেকআপ করার পর ডাক্তারবাবু ব্লাড টেস্ট করতে বললেন। দুই দিন পর ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের কাছে আবার যায় রোহিত। ডাক্তার রিপোর্ট দেখে বলেন...
" আপনার ক্যান্সার হয়েছে। খুব দুঃখের সহিত বলতে হচ্ছে এটা আপনার থার্ড স্টেজ।"..
ডাক্তারের কাছে বসে এই ভয়ে কাঁপতে থাকে রোহিত। ও বলে.." কিন্তু স্যার আমার তো কয়েকদিন আগেই দাঁতে এমন যন্ত্রণা হলো।আচমকাই দাঁত বড় হতে শুরু করল!এত তাড়াতাড়ি ক্যান্সার কি করে হয়ে গেল স্যার!!"....
ডাক্তার বললেন.." কে বলেছে এটা দু-একদিনের মধ্যে হয়েছে আপনার। দেখুন গত কুড়ি বছর ধরে এই লাইনে রয়েছি। আপনার শরীরে অসুখটা বাসা বেধেছে প্রায় তিন বছর আগে। সেটাই ধীরে ধীরে আপনার দাঁতে তৈরি করেছে মারাত্মক বিষ। এবং খেতে বসে আপনি মুখে যে কামড় খেয়ে ছিলেন সেই কারণে দাঁতের বিষ থেকেই মুখের ভেতরে ছড়িয়ে পড়েছে অসুখ!"...
ডাক্তারের কাছ থেকে কথাগুলো শুনে এ রোহিতের মাথাটা ঝিমঝিম করতে থাকে। খুব আস্তে আস্তে ও জিজ্ঞাসা করে.." ডাক্তার! আর কদিন আছে আমার কাছে?"... ডাক্তার বলেন.." বেশিদিন নয়! খুব জোর হলে আজকের রাত!"...
ডাক্তারখানা থেকে বাড়ি ফিরতে প্রায় ঘন্টা দুয়েক সময় লেগে যায় রোহিতের। সারা রাত কাটায় রোহিত শ্রীপর্ণার কথাই মনে করেছিল। বাড়ি এসে মুখের ভেতরটা আবার চেক করে। দাঁতগুলো কেমন যেন এবড়ো খেবড়ো হয়ে আছে। রোহিতের মনে পড়ে শ্রীপর্ণার দাঁতগুলো সমান ছিল না। মাঝে মাঝে শ্রীপর্ণাকে রাগানোর জন্য রোহিত হস্তীদন্তিনি বলতো!!.. আর শ্রীপর্ণা রাগ করে বলতো
" এই হস্তী দন্তই তোমাকে শেষ করবে একদিন!"...
বিছানায় বসে রোহিত চুপ করে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎই রোহিতের হাতে পরে একটা ঠান্ডা হাতের স্পর্শ।ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে রোহিত.. শ্রীপর্ণা ওর কাঁধে মাথা রেখে বলছে.." আর কোন চিন্তা নেই। তোমার সব চিন্তা এবার ফুরোবে। রাত পোহালেই আমার সঙ্গে তোমাকে নিয়ে যাব আমার দেশে। যেখানে কোন জ্বালা-যন্ত্রণা নেই।শুধু আনন্দ আর মজা। তুমি আমার জন্য এত চিন্তা করতে!!!! আমার অসুখ টাও নিজে বহন করে বেড়াচ্ছো!!"... কথাটা বলেই শ্রীপর্ণা দাঁত বের করে হেসে উঠলো.... রোহিত আবার দেখলো!!!!...
সেই হস্তীদন্তীনি হাসিটা....☠️
এরপরে শ্রীপর্ণা বলে....
" ভুল করে ফ্লাটের চাবিটা আমার ব্যাগে রেখে দিয়েছিল!! ভাগ্যিস আমি এসেছিলাম চাবিটা তোমার পকেট এ দিতে!!"....
রোহিত অনুভব করে ওর মুখে যন্ত্রনা আবার বাড়ছে। শ্রীপর্ণার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে রোহিত বলে....
" শ্রী আমি অন্যায় করেছি। তুমি আমায় ক্ষমা করো!"..
কথাটা বলার সাথে সাথেই আবার শীতল হাতের স্পর্শ অনুভব করে রোহিত। এইবার শ্রীপর্ণার হার রোহিতের ঠোঁট স্পর্শ করেছে। শ্রীপর্ণা বলে...
" ইস!!!.. ক্ষমা চাইছ কেন???..."..
রোহিত বলে.." আমি তোমাকে ড্রাগের নেশা ধরিয়ে... মারাত্মক অসুখে আক্রান্ত করেছি। আমি সত্যিই খুব ভুল করেছি।"..
অট্টহাসিতে হেসে ওঠে শ্রীপর্ণা। তারপর বলে..
" কি বলছ কি তুমি!!... তুমি আমাকে নেশা ধরিয়েছ??"..
শ্রীপর্ণার হাসি দেখে খুব অবাক হয়ে যায়। শ্রীপর্ণা বলে
" কে বলেছে তোমাকে আমার অসুখ এর জন্য তুমি দায়ী??.... আমি তো জানতাম আমার অসুখ আছে!"..
খাটে বসে ছিল রোহিত। শ্রীপর্ণা এহেন বাক্য শুনে একটু নড়েচড়ে বসে। তারপর বলে…..
" তারমানে তুমি জেনে আমাকে অসুস্থ করলে??"..
শ্রীপর্ণা বলে.." তুমি না আমায় ভালোবাসো?? যে ভালোবাসে সে বুঝি অসুখের ভাগ বহন করেনা??"..
রোহিত ক্ষেপে উঠে বলে..." আমার সুস্থ স্বাভাবিক জীবন টা নষ্ট করার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে??"..
শ্রীপর্ণা কিন্তু এবার হাসেনা। কণ্ঠস্বর টা বেশ ভারী করেই বলে.." অল্প বয়সী নিরীহ মেয়েগুলোর জীবন নষ্ট করার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে???...... আমি ভেবেছিলাম হয়তো তোমার আত্মগ্লানি হয়েছে। কিন্তু না;আমি ভুল। ভেবেছিলাম এই সারা রাত টা তোমার সাথে কাটিয়ে তারপর তোমায় নিয়ে যাব সে অজানা দেশে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয় চলো তুমি এখনই চলো।"..
কথাটা শেষ করেই শ্রীপর্ণা ওর ব্যাগ থেকে একটা হাতুড়ি বার করে ঠাস করে রোহিতের মুখে মারে। গল গলিয়ে রক্তপাতের সাথে সাথে রোহিত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। এরপর রোহিতের এক একটি দাঁত সহ যত্নসহকারে হাতে তুলে নিয়ে একটা প্যাকেটের মধ্যে ভরে শ্রীপর্ণা।..
ফোন হাতে নিয়ে একটা নাম্বার ডায়াল করে....
ফোনটা রিসিভ হয়...
শ্রীপর্ণা বলে...." হ্যাঁ শীর্ষেন্দু!! তোমার কাজ হয়ে গেছে। আমার কিন্তু টাকা বেশি লাগবে। শরীর টাকে ঠান্ডা করতে অনেক খাটুনি করতে হয়েছে আমায়। আর মুখে মেকআপ লাগাতেও।"...
ফোনের ওপার থেকে ভেসে আসে শীর্ষেন্দুর কণ্ঠস্বর। সে বলে.." নাটকে আমার থেকে কোন অংশে কম যাসনা তুই। কি দারুন অভিনয়টা করলি! বেচারা রোহিত আর কোনদিনই জানতে পারবে না ওর সব থেকে কাছের বন্ধুই শত্রু। ব্যাটা অনেক মেয়েকে পটিয়ে আর লুট করে অনেক ইনকাম করেছে। আমাকে সেই হিসাবে টাকায় দেয়নি। কিন্তু ও জানে না মানুষের দাঁতের দাম,ও হাতির দাঁতের দাম সমান। এবার ওইগুলো বিক্রি করে আমিও বড়লোক হব!!.... ওওও... ডাক্তারবাবুকে টাকা দেওয়ার কথাটা মনে করিয়ে দিবি। ওনার কাছে কিন্তু পুরো ব্যাপারটার ভিডিও আছে!"..
ফোন রেখে দেয় শ্রীপর্ণা। তারপর রোহিতের লকার খুলে যাবতীয় টাকা-পয়সা বার করে ঘর থেকে বিদায় হয়।...
গল্প শুনতে শুনতে হঠাৎই চেয়ার থেকে উঠে পড়েন স্যার। বাথরুমে যান। প্রায় কয়েক সেকেন্ড পরে বাইরে আসেন।
সমর বলে.." কি ব্যাপার স্যার আপনি গল্প শুনতে শুনতে উঠে গেলেন কেন???".
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে স্যার বলেন.." বাপরে বাপ! তোমার গল্প শুনে আমার কেমন একটা লাগছিল। তাই আমার দাঁত গুলো চেক করে আসলাম। এগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা!!"..
হা হা করে হেসে ওঠে সমর। তারপর বলে...
" আপনি যে কি বলেন?.. আরে এটাতো একটা গল্প। বাস্তব নাকি!!"....
স্যার বলেন.." কিন্তু গল্প শুনতে শুনতে অজান্তেই আমার মুখের ভেতরেও যন্ত্রণা শুরু হয়ে গিয়েছিল! কি করব বল!!.. নাও এবার শুরু করো!!"..
সমর বলে...." এই গল্পটা এই পর্যন্তই শেষ।"...
স্যার বলেন.." তার মানে রোহিত ওর পাপের ফল পেল! এইতো?"...
সমর বলে "এক্কেবারে ঠিক তাই।".....
স্যার বলেন.." এইবার পরবর্তী গল্প কোন অংশ নিয়ে??"..
সমর বলে..... এর পরের গল্প..... আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়ের মধ্যে অন্যতম ইন্দ্রিয় নাসিকা নিয়ে।
পরবর্তী গল্পের নাম..
"ঘ্রাণশক্তি"
মধুরিমার নাকটা বোঁচা। ও যখন জন্মেছিল তখন প্রথমবার ওকে দেখেই ওর ঠাকুরমা বলেছিলেন..
" আমার ছেলে আর বৌমার না কত টিকালো!! আর নাতনি তার নাকটা দেখো মালগাড়ি চলে গেছে"..
ছোট বয়সে প্রত্যেকের ঠাকুরমা-দিদিমা এমন একটু-আধটু ঠাট্টা করে থাকেন। কিন্তু সেই ঠাট্টা যদি বড় হবার পরও শুনতে হয়; তখন অত্যন্ত বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে। বিশেষ করে বয়সন্ধির পরমুহুর্তেই যখন মস্তিষ্কে মান,অভিমান,ঘৃণা,অপরাধবোধ এই গুলো আরো বেশি করে জাঁকিয়ে বসতে থাকে।
মধুরিমার ক্ষেত্রেও সেইসব এর বিকল্প হয়নি। ছোটবেলায় স্কুলে ওর নাক বোচা নিয়ে ওকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। এখন মধুরিমা বড় হচ্ছে মাধ্যমিক দেবে। অথচ বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী যেই আসুক না কেন সবার নজর মধুরিমার নাক টায়। রাগে অভিমানে মাঝে মাঝে মধুরিমার মনে হয় যদি সূর্পনখার মত লক্ষণ নাক টা কেটে ফেলতো;তাহলে কত ভালো হতো!.
বাড়ির সকলের উপরে খুব রাগ হয় মাঝে মাঝে। কিন্তু কি করবে!! নাকটা তো আর ও ইচ্ছে করে তৈরি করেনি??
মাসখানেক পর....
টিভিতে প্রত্যেকটা নিউজ চ্যানেলের হেডলাইন..
" মিড ডে মিলের খাবারে বিষ মেশানো থাকায় শিশুরা সেই খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অনেক স্কুলে বাচ্চাদের অবস্থা সঙ্কটজনক। জানা গেছে রান্না করার সময় খাদ্যে বিষক্রিয়া হয়েছিল।"
একই খবর প্রত্যেকটা নিউজ চ্যানেলে দেখতে দেখতে একঘেয়ে হয়ে পড়েছে মধুরিমা। টিভিটা বন্ধ করে ছাদে আসে। মিস্টি মৃদু মন্দ হাওয়া বইছিলো। সেই হাওয়ায় একটা লম্বা নিঃশ্বাস নেয় মধুরিমা। কিন্তু একি !!
একটা বাজে গন্ধ আসছে ওর নাকে!!!.. গন্ধটায় মনে হচ্ছে পচা গলা কোন বস্তু?? গা গুলিয়ে ওঠে ওর। এমন বিকট গন্ধ আজ পর্যন্ত ওর নাকে আসেনি। গন্ধটা এতটাই মারাত্মক যে মধুরিমা; ছাদে জ্ঞানশুন্য হয়ে পড়ে!!!...
মেয়েটা যখন একটু একটু করে জ্ঞান হারাচ্ছিল!তখন ও বুঝতে পারছিল,একটা বাজে গন্ধের জগতে প্রবেশ করছে !!!!!....
মধুরিমার জ্ঞান ফেরে ওর মা বাবার ডাকে।চোখ খুলে ও দেখে.... নিজের ঘরেই শুয়ে আছে। স্থানীয় একজন ডাক্তারকে ডেকে এনেছেন ওর বাবা। তিনি একটা রেগুলার চেকআপ করে বলেছেন-
" কয়েকদিনের জন্য ওকে নিয়ে কোথাও বেরিয়ে আসুন। ঘরের মধ্যে থাকতে থাকতে হয়তো একঘেয়েমি হয়ে গেছে।তারপরে ইয়াং জেনারেশন। ওদের মানসিক অবস্থাটা দেখার দায়িত্ব আমাদের মতো মা বাবারই!!...."..
মধুরিমার মা বললেন.." সামনেই ওর মাধ্যমিক পরীক্ষা। এখন আপনি বেড়াতে যেতে বলছেন!"...
ডাক্তার বললেন.." মাধ্যমিক পরীক্ষা বলে কি;বেড়াতেও যেত নেই?? পরীক্ষা টা ও দেবে!! সেটা নিয়ে আপনি-আমি মাথা ঘামিয়ে কি করতে পারি?? নিজের ভেতর ট্রেস নেবেন না। আর অন্য কেও দেবেন না। স্বাভাবিক ভাবে থাকুন, দেখবেন সবকিছুই হাল্কা লাগবে।".....
এই বলে ডাক্তার চলে গেলেন। মধুরিমার বাবা মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলেন........" কোথায় যাবি বল!! ডাক্তারবাবু ঠিকই বলেছেন;অনেক দিন আমাদের হাওয়া বদল হয় না।"... মধুরিমার না কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। এবং রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। মধুরিমা ওর বাবাকে বললো..." বাবা বর্ধমান গেলে কেমন হয়!!"...
"বর্ধমান!!!..এত জায়গা ছেড়ে শেষে কিনা বর্ধমান!!"...
বললেন মধুরিমার বাবা।
"কেন বাবা??তুমি তো বলেছিলে ওখানে আমাদের পূর্বপুরুষের জমিদার বাড়ি আছে!!"..বলে মধুরিমা।
মেয়েটির ঠাকুরদা ওখানেই ছিলেন।তিনি বললেন.
"যা না!!ও যখন যেতে চাইছে!!"....
ওর বাবা বললেন.."কিন্তু,ওখানে যে!!"..
"আহ!!ওসব কথা থাক না;তা ছাড়াও সেই সব ঘটনা তোর প্রপিতামাহের আমলের!!এখন ওসব কিছুই নেই??'..বললেন ঠাকুরদা।
চুপ করে সব কথা শুনছিলো মধুরিমা।ও বললো..
"ওখানে কি কোনো রহস্য আছে??"...
"না না দিদি ভাই!তুমি নিশ্চিন্তে যেতে পারো।"....বললেন ঠাকুরদা।....
সাতদিন পরে সমস্ত গোঝগাছ কমপ্লিট করে মধুরিমা ওর মা বাবার সাথে রওনা হল বর্ধমান।.....
রানাঘাট থেকে বর্ধমান.. একটা গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিলো ওরা। এতদিন পর মা বাবার সাথে ঘুরতে যাবে ভেবে এই আনন্দে মন ভরে উঠছে মধুরিমার।
রাস্তার জ্যাম থাকার কারণে বর্ধমান পৌঁছাতে প্রায় রাত হয়ে গেল । রাত্রেবেলা অমাবস্যার ঘোর অন্ধকারের মধ্যে গাড়িটা এসে থামে একটা মাঠের মাঝখানে।.....
"বাবা!!আমরা কি চলে এসেছি!!"..বলে মধুরিমা।
"হ্যাঁ মা!আমরা পৌঁছে গেছি।"...বললেন ওর বাবা।
তারপর তিনজনে মিলে গাড়ি থেকে নামলেন। মধুরিমার মা ও বিয়ের পর এই প্রথম এসেছেন বর্ধমান। তিনি শ্বশুর-শাশুড়ির মুখে অনেকবারই এই পৈত্রিক ভিটা এর কথা শুনে ছিলেন। কিন্তু সংসারের চাপে কোনদিনই বেড়াতে আসা হয়নি। মনে মনে উনিও বেশ আনন্দিত। একই এই জ্যৈষ্ঠের গরম। তার ওপরে পরিত্যক্ত বাড়িতে কারেন্টের ব্যবস্থা নেই। ঘোর কালো অন্ধকারের মধ্যে একটা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে কে যেন এগিয়ে এলো গাড়িটা সামনে। প্রথম অবস্থায় দূর থেকে হ্যারিকেনের আলোটা দেখে মধুরিমা ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিল। ও বলেছিল
" ও বাবা!!ওটা কে??"...
মধুরিমার এমন অবস্থা দেখে হেসে উঠেছিলেন ওর মা-বাবা। তারপর বলেছিলেন.." ভয় পাস না মা!! উনি আমার মদন কাকা। উনার বংশধরেরাই আমার প্রপিতামহের সময়কাল থেকেই এই বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছেন, আমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে এসেছেন উনি।".....
মদন কাকা কাছে এসে দাঁত বের করে হাসলেন। হ্যারিকেনের আলোয় সাদা দাঁতগুলো বেস চকচক করছিল। মদন কাকা বললেন...
" আসুন বাবু!! সেই যেদিন আপনি ফোন করলেন পোস্ট অফিসে; ওই দিন থেকেই আমি একটু একটু করে ঘর গোছাতে শুরু করেছি।"..
মধুরিমা ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল..
" বাবা তুমি পোস্ট অফিসে ফোন করেছিলে কেন?? এখানে কি ফোন নেই??"...
মধুরিমার বাবা বললেন.." এখানকার পোস্ট অফিসের ম্যানেজার আমার চেনাজানা। আমি ওনার কাছে ফোন করেই মদন কাকার কাছে খবর পাঠিয়ে ছিলাম। যেখানে বৈদ্যুতিক আলোই নেই সেখানে টেলিফোন ব্যবস্থা আসবে কি করে!"..
বাবার মুখে কথাটা শুনে মধুরিমা বলে..
" কি বলছ কি বাবা! আমরা কি দূর গ্রামে চলে এসেছি নাকি!!".. মদন কাকা বললেন..." মামনি মনে হয় বুঝতে পারেনি??? এটা বর্ধমানের গোলাপপুর গ্রাম। শহর থেকে অনেকটা দূরে। গ্রামে কিছু কিছু বাড়িতে বৈদ্যুতিক আলো আছে। কিন্তু এই বাড়িতে নেই। সেই রাত মহারাজাদের আমল থেকেই এই বাড়িতে ঝাড়লন্ঠন জ্বলে.... মোমবাতির বা লন্ঠনের আলোয়!".....
মধুরিমা সত্যিই বুঝতে পারেনি এমন একটা জায়গায় এসে পড়েছে। আসলে চারদিকে ঘুটঘুটে অমাবস্যার অন্ধকার। রাস্তা পার হবার সময় চারপাশে জমে খেত দেখতে পেয়েছিল মধুরিমা গাড়ির আলোতে। কিন্তু বৈদ্যুতিক আলো থাকবে না এটা সত্যিই অপ্রত্যাশিত।।
প্রায় মিনিট পনেরো হাঁটা পথ। মাটির কাঁচা রাস্তার ওপর দিয়ে হেঁটে জমিদার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো ওরা।
রাস্তায় যেতে যেতে মধুরিমার নাকি খুব সমস্যা হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল একটা পচা দুর্গন্ধ ওর নাকের চারপাশ ঘিরে রেখেছে। মা-বাবাকে ও বারবার জিজ্ঞাসা করছিল..
" বাবা কেমন একটা গন্ধ আসছে না!!".. উনারা বললেন
" কই নাতো!!"..
মদন কাকা বললেন.." মামনি এটা গ্রাম। এখানে বেশিরভাগ বাড়িতে গরু ছাগল হাঁস মুরগি থাকে। তুমি হয়তো কোনদিনো গুগলের গন্ধ পাওনি নাকে।"... বলে একটু হাসলেন। মধুরিমার মা বলল...
" ঠিক বলেছেন কাকাবাবু। এটা গোবর সারের গন্ধ।"..
মধুরিমার কেমন যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। ও থাকে রানাঘাটে। শহরাঞ্চল হলেও রানাঘাটের অনেক বাড়িতেই গরু, ছাগল,মুরগি,এসব থাকে। একদিন কালী পূজার সময় আইসতলা চরপাড়ায় ২৩ বিঘার ঠাকুর দেখে ফেরার পথে একটি বাড়িতে গরু দেখেছিল মধুরিমা। আর সেখান থেকেই গোবরের ঘ্রাণ পেয়েছিল। সেই গন্ধের সাথে গন্ধের কোন মিল নেই। তবুও মধু কিছু বলল না। চুপ করে মা-বাবা এবং মদন কাকা কে অনুসরণ করতে থাকলো।...

দূর থেকে দেখা যাচ্ছে প্রায় চার তলা সমান মস্ত বড় বাড়ীটা। বাড়ির ভেতরে জানলা দিয়ে হারিকেনের আলো জ্বলছিল,জানলার কাঁচ ভেদ করে সেই আলো বাইরে এসে পড়েছে।..
"কি দারুন!!".. বলে চিৎকার করে ওঠে মধুরিমা।
" বাবা তুমি এত বছর কেন আনোনি আমাকে এখানে!!. বাড়িটা দেখেই এক্সাইটমেন্ট-এ আমার কেমন যেন হচ্ছে! গতবছর ঈশানি গিয়েছিল গোয়ালিয়র ঘুরতে। তুমি জানো না বাবা!! পড়ার ব্যাচে এসে; সেই ঘুরতে যাবার কথা কতবার যে আমাকে শুনিয়েছে! তা কি বলবো। এইবার এইখান থেকে ঘুরে গিয়ে আমি ওকে বলতে পারব!আমাদের নিজস্ব পৈত্রিক জমিদার বাড়ি আছে জানিস!আমি জমিদার বংশের মেয়ে!!"..
মেয়ের কথা শুনে"হা হা হাহা"... করে হেসে ওঠেন সকলে।
প্যাচ শব্দ করে .. লোহার গেট টা খুলে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে সবাই। অর্থ বড় বাড়িতে আর ঢোকার মুখে একটা বিশাল বড় সেগুন কাঠের দরজা। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে মধুরিমা।
আচমকা একা একাই বলে ওঠে...." হরর ফিল্ম এমন ঝাড়লন্ঠন দেখেছি!!".....

"আচ্ছা দাদু এই গ্রামটার নাম গোলাপ পুর কেন??"
মদন কাকা কে উদ্দেশ্য করে বলল মধুরিমা।
প্রশ্নটা শুনে মদন কাকার মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তিনি বললেন
" ওসব কথা এখন জানলেও চলবে,পরে বলবো। এখন চলো দেখি! স্নান সেরে খাওয়া-দাওয়া করে নাও। সেই দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করেছ! খুব খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই??....
মদন কাকা মধুরিমা কে একটা ঘর দেখিয়ে দিলেন । ওই ঘরটা উনি মধুরিমা জন্য সাজিয়ে রেখেছেন। অন্যান্য আর পাঁচটা ঘরের থেকে এই ঘরটা তুলনা মাফিক বেশ বড়। লন্ঠনের আলোয় মধুরিমা দেখল ঘরের ভেতরে রয়েছে অসংখ্য পশুর মাথা। অনেক সিনেমায় ও দেখেছে ,বড় বড় রাজা-জমিদারদের বসার ঘরে এমন জীবজন্তুর মাথা,দেহের ঝাল দেওয়ালে ঝোলানো থাকে। ওগুলো সেই সকল পূর্বপুরুষদের পশু শিকারের নিদর্শন এবং প্রমাণ। "জঙ্গলের নিরীহ প্রাণী গুলোকে মেরে কি শান্তি পেতেন ওনারা কে জানে?" ভাবে মধুরিমা।
একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে ;ঘরে রাখা লণ্ঠন টা হাতে নিয়ে স্নানঘরের দিকে চলে যায়। স্নানঘর টাও ছিল বেশ বড়। ওখানে আবার বিদেশে আদব কায়দায় বাথটাব রাখা ছিল। মধুরিমা র রানাঘাটের বাড়িতে বাথরুমের ভালো বন্দোবস্ত আছে ঠিকই; কিন্তু সেখানে বাথটাব নেই । বাথটাবে স্নান করার জন্য মধুরিমার মন হালুক-ফালুক করতে থাকে ।সবে পোশাকটা খুলে বাথটাবের রাখা ঠান্ডা জলে নিজের শরীরটাকে নিম্মজিত করবার জন্য নামতে যাবে; অমনি দরজায় টোকা পরে.." মামনি শুনতে পাচ্ছ!!"...
মধুরিমা ভাবে "এটা মদন দাদুর ডাকনা!!.."..
তাড়াতাড়ি বাথরুম থেকে বেরিয়ে মধুরিমা ঘরে প্রবেশ করে। ও দেখতে পায় হাতে লন্ঠন নিয়ে মদন দাদু দাঁড়িয়ে আছে। তিনি মধুরিমা কে উদ্দেশ্য করে বললেন
" মামনি তোমার স্নানের জন্য বালতিতে জল এর বন্দোবস্ত করে রেখেছি। ওখানে অনেক জল আছে। তোমার স্নান হয়ে যাবে।".... বাথটাবে স্নান করার আশায় মধুরিমার মনটা আনন্দিত হয়ে উঠেছিল কিন্তু সেই আশা ভেস্তে যাচ্ছে। একটু বিরক্তিকর কন্ঠে মধুরিমা বলল..
" কেন গো?? ওই বাথটাব টার ঠান্ডা জলে স্নান করি না আমি!!"...
মদন কাকা একটু জোরেই বললেন..
" যেটা বলছি সেটাই করবে। বড়দের কথা শুনতে হয়।"..
"ধুর ভালো লাগেনা!".. বলে মধুরিমা। মদন কাকা যাবার আগেই লণ্ঠন টা রেখে গিয়েছিলেন। সেই জন্য লণ্ঠনটা হাতে নিয়ে এই বাথরুমে যায় মধুরিমা। বালতির জলে স্নান করলেও বার বার ওর চোখটা;ওই বাথটাবের দিকে যাচ্ছিল। একটা সুগন্ধী সাবান দিয়ে স্নান করছিল মেয়েটা। কিন্তু হঠাৎই ওর নাকে সেই তীব্র গন্ধ ভেসে আসে। বাথরুমে গন্ধটা এত বেশি ছিল যে ;বেশিক্ষণ মজা করে স্নান করা আর হলো না। অসহ্য গন্ধে শরীর খারাপ করছিল। কোনরকম স্নান করে তাড়াতাড়ি বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে মধুরিমা।
" বাপরে বাপ!!কি বিকট গন্ধ রে বাবা!!"... বলে মধুরিমা। তারপর ব্যাগ থেকে জামাকাপড় বার করে পরতে শুরু করে। দরজা খুলে বাইরে বেরোতে যাবে তার আগেই ওর মা এসে ডাকলেন.." কি রে তোর হলো ??এবার খাবি চল!রাত তো কম হলো না!!".....
"হুমম...এইতো আসছি!!'...বলে মধু।
কিন্তু ঘর থেকে যাবার আগে, আবার একবার বাথরুমে গিয়ে বাথটাব টার দিকে তাকায় মধুরিমা। ও বুঝতে পারে এখন সেই গন্ধটা আর নেই। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ করে নাকে কেন এরকম উদ্ভট গন্ধ আসছে!!বুঝতে পারে না মেয়েটা।....
একটা মস্ত বড় সেগুন কাঠের খাবার টেবিলে খেতে বসেছে সকলে। খাবারগুলো পর পর সাজানো রয়েছে। মধুরিমা দেখল প্রচুর খাবার রয়েছে এখানে। নাক টেনে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিল মধুরিমা। খাবারের গন্ধেই পেট গুড়গুড় করে উঠছে। মধুরিমা বলল...
" এত অল্প সময়ের মধ্যে, এত কিছুর আয়োজন কি করে করলে ??"....
মদন কাকা বললেন..." সব খাবারের আয়োজন করে রেখেছে কচির মা। সবকিছু আগে থেকেই তৈরি করে রেখেছিল। ভাত রান্না করবার জন্য প্রায় আধঘন্টা আগে চাল ভিজিয়ে, মুগ ডাল সেদ্ধ করে, সবজি কেটে ,মসলা বেটে আগেই রেখে দিয়েছিল। তোমরা আসার পরে গরম গরম তৈরি করে দিল।"...
এক টুকরো পনির মুখে দিয়ে মধুরিমা বলে..
" ভেটকি মাছ টা খুব সুস্বাদু হয়েছে।"...
হা হা করে হেসে মদন কাকা বললেন.." এই বাড়িতে মাছ,মাংস, ডিম, কিচ্ছু আনা হয় না।আর তুমি ভেটকি মাছের কথা বলছো!! তুমি যেটা খাচ্ছ ওটা পনির।"...
সত্যিই! এই ব্যাপারটা মধুরিমার মা ও জানতেন না। তিনি বললেন.." কি বলছেন কাকা! আমি বুঝতে পারিনি!"..
মধুরিমার বাবা বললেন...." দেখ তাহলে!! নিরামিষ খাবার ঠিকমতো রান্না করতে পারলে আমিষ এর থেকেও সুস্বাদু হয়। কি বলব কাকা তোমাকে, আমার মেয়ে মাছ মাংস ডিম ছাড়া একদিন খেতে পারে না। সপ্তাহে একটা দিন নিরামিষ হলে ওর খাওয়া দেখার মত হয় !!"..
সকলে মিলে হেসে উঠলেন। খাওয়া-দাওয়া করে হাত-মুখ ধুয়ে মধুরিমা ওর ঘরে ঘুমোতে চলে গেল। সারা দিনের ক্লান্তিতে ঘুমে চোখ জুড়িয়ে আসছিল। তার ওপরে পেট ভর্তি করে সুস্বাদু খাবার খেয়েছে। তৃপ্তিতে মন প্রাণ ভরে
আছে। ঘরে এসে একটা লম্বা ঢেকুর তুলে বিছানায় বসলো মধুরিমা। মধুরিমা লক্ষ করে বিছানার ঠিক সামনে একটা মস্ত বড় পেইন্টিং রাখা আছে। সারা দেওয়ালটা জুড়ে পেন্টিং টা ঝুলছে।লণ্ঠনের ক্ষিণ আলোয় ছবিটা দেখে মধুরিমার মনে হয়...দেওয়ালে ঝোলানো ছবিটা কিছু বলতে চাইছে মধুরিমাকে।ছবিটায় বন্দুক হাতে বসে আছেন এক ব্যক্তি। ইনি হয়তো মধুরিমার পূর্বপুরুষ।

একটা বড় রাইফেল ওনার কাঁধে ঝুলছে। আর পায়ের তলায় রয়েছে মৃত পশুর মস্তিষ্ক। মস্তিষ্কের পাশে পড়ে আছে শরীর থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার ছালটা। লন্ঠনের মৃদু আলোয় দূর থেকে স্পষ্ট ভাবে ছবি টা বুঝতে পারছিল না মধুরিমা। বিছানা ছেড়ে উঠে এই ছবিটার সামনে এসে দাঁড়ায়। লন্ঠন টাও হাতে করে এনেছিল। আপাদমস্তক ছবিটাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে মেয়েটা। ছবিটা আর রঙিন ছিল না। আবার সাদা কালো নয়। বহু পুরনো ছবি সেই কারণে ভালো বোঝা যাচ্ছে না। কয়েক সেকেন্ড ছবিটাকে দেখার পর মধুরিমার মাথাটা ঝিম করে ওঠে। যে ব্যক্তি বন্ধু খাতে ওখানে বসে আছেন তিনি একটি শিকার করেননি করেছেন অসংখ্য শিকার।
উনার আশেপাশে পড়ে আছে অনেকগুলো মৃত পশু। লণ্ঠন টা আরেকটু সামনে এগিয়ে নিয়ে মধুরিমা দেখে.... সেই মৃত পশু গুলোর মাঝখানে বসে আছে একজন নারী। মাথা নিচু করে বসে আছেন উনি। ওই লোকটির থেকে বেশ দূরে। সেই কারণে ওই নারীটির মুখশ্রী স্পষ্ট নয়। কিন্তু মধুরিমার যতোটুকু মনে হচ্ছে ওই বসে থাকা নারীটি রক্ত পান করছেন। পড়নে পোশাক নেই।উনি সম্পুর্ন নগ্ন।ওনার হাত দুটোয় লেগে আছে মৃত পশুর রক্ত। ছবিটা দেখার সাথে সাথেই মধুরিমা নাকে আসে, সেই পচা উদ্ভট গন্ধটা!!.....
গা গুলিয়ে ওঠে মধুরিমার। মধুরিমা দেখে ওই মহিলা যে জিনিসটার উপর বসে আছেন সেই জিনিসটা ওর চেনা!!
মধুরিমার মনে পড়ে.. ওই জিনিসটি বাথরুমে রাখা বাথটাবটা!!! লাল রক্তে পূর্ণ সেটা। আর সেটা ঠিক মাঝখানে বসে আছেন ওই নারীটি!!..
মধুরিমার নাকে ওই গন্ধটা আরো তীব্র হয়ে আসতে থাকে। এইবার ছবিটাকে দেখে মধুরিমা চমকে ওঠে। ছবির পাশে রাখা আয়নাটায় লন্ঠনের আলোয় নিজের মুখ দেখে ঘাবড়ে যায় মধুরিমা। কারণ ছবির মধ্যে যে মহিলাটি রক্ত পান করছেন তিনি ওরই প্রতিবিম্ব!!!...
মধুরিমা জ্ঞান হারায়।
তারপর রাতে কখন জ্ঞান ফিরেছিল ও জানে না। অন্ধকারে হাতরে হাতরে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েছিল। ভীষণ ভয় করছিল ওর। নাকের কাছে বারবার ভেসে আসছিল উদ্ভট গন্ধটা। নাকে, মুখে হাত চাপা দিয়ে বহুকষ্টে শুয়েছিল মধুরিমা। কখন যে চোখ লেগে এসেছে টের পাইনি ও।
ভোরবেলা যখন মধুরিমার ঘুম ভাঙ্গে তখন ও দেখে;বিছানার ওপর শুয়ে আছে। ঘরের জানালার কার্নিশে বসে একটা পাখি গান গাইছে। আচমকা একটা গুলির শব্দ। পাখিটার গান গাওয়া থেমে গেল। থাপ্ করে মৃত পাখির দেহটা পড়ে গেল নিচে।
মধুরিমা দৌড়ে গেল জানালার কাছে। তিনতলার পশ্চিমের ঘরটায় শুয়েছিলো মধুরিমা। ছোট্ট পাখি টার দেহটা কোথায় যে পড়েছে বুঝতে পারল না।
কিছুক্ষণ পর মদন কাকা এলেন ওকে ডাকতে।
" মামনি ওঠো!! ঘুম ভেঙেছে তোমার?... হাতমুখ ধুয়ে নিচে চলে এসো।খাবারের বন্দোবস্ত করেছি।"....
মদন কাকার ডাকে সাড়া দিলো না মধুরিমা। ওর মন তখন খুব খারাপ। ঘুম থেকে উঠেই একটা পাখি কে মরতে দেখেছে। ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে বাথরুমে গেল মধুরিমা। হাতমুখ ধুয়ে এসে নিচের ঘরে যাবে;তার আগে এই ছবিটার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ বুলিয়ে নিল।
আগের দিন রাতে ছবিটির মধ্যে ও যা যা দেখেছিল তার মধ্যে কিছু কিছু জিনিস এখন উপস্থিত নেই।
সেই উলঙ্গ নারী টিও নেই। এমনকি এখন সেই পূর্ব পুরুষ লোকটি যে জিনিসটার ওপর বসে আছেন, সেটা একটা কাঠের চেয়ার ছাড়া আর কিছুই নয়।অথচ মধুরিমা গতকাল রাতে দেখেছিল একটা মৃত পশুর মাথা, এবং চামড়া। সকালের ছবি টাই সেই সব ও নেই।..
নাকটা ছবিটার কাছে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে মধুরিমা দেখে; ছবিটার মধ্যে থেকে একটা ভ্যাপসা গন্ধ আসছে। কিন্তু গতকাল রাতেও এই ছবিটার মধ্যে কি কি আসছিল একটা পচা গন্ধ।
যাইহোক মধুরিমা ভাবে; হয়তো সারা দিনের জার্নিতে মাথাটা ঘুরে ছিল।তাই ওরকম উল্টোপাল্টা দেখেছে। সারাদিন গাড়িতে থাকবার জন্য, পচা গন্ধটা নাকে আসছিল।..
একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে নিচে যায় মধুরিমা। খাবার টেবিলে ওর মা-বাবা বসে আছেন। মধুরিমা এসে বসলো। ও দেখে... টেবিলে সাজানো রয়েছে গরম গরম ফুলকো লুচি, ছোলার ডাল, এবং এক ধরনের কুড়মুড়ে পাকোড়া জাতীয় জিনিস।খাবার মুখে তুলে মধুরিমা বলে.....
"বাহ!!কি দারুন!!এই টা কি জিনিস??"...
পিছন থেকে একটি মেয়ের কন্ঠস্বর ভেসে আসে। সেই মেয়েটি বলে..." এটা ছানার বড়া!!"..
মধুরিমা পিছন দিকে একবার দেখে তারপর বলে..
" খুব সুন্দর হয়েছে খেতে!"..
মেয়েটি কাছে এগিয়ে এলে মদন কাকা পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি বলেন...." বাবু কে হল কচি। আর এই সমস্ত রান্নাগুলো করেছে ওর মা।"...
সকলেই রান্নার খুব প্রশংসা করলেন। সবাই মিলে খাওয়াদাওয়া করছিলেন হঠাৎ..
টেবিলের ওপর ফলের ঝুড়িতে ,চাকু দিয়ে একটা আপেল কাটতে গিয়ে মধুরিমার আঙুলটা কেটে যায়।
"আহ!!....".. বলে মধুরিমা।
তারপর সেই কাটা আঙুলটা মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। মধুরিমার মা বলে ওঠেন...." কই দেখি কতটা কেটে গেছে??".....
মধুরিমা মুখের ভেতর থেকে আঙ্গুল টা বার করে মাকে দেখায়।
ওর মা বলেন.." ইস অনেকটা কেটে গেছে!"..
মধুরিমা বলে.." কই তেমন কিছু না তো?? রক্ত বের হচ্ছিল আমিতো খেয়ে নিলাম!!"..
এই কথাটা বলার সাথে সাথেই টেবিলের সামনের দেয়ালে টাঙানো মস্ত বড় আয়নার মধ্যে নিজের মুখটা দেখে মধুরিমা ভয় পায়। কারণ ওর ঠোঁট চুইয়ে রক্ত পড়ছিল। মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো। নাকে আবার ভেসে আসতে থাকলো সেই বিকট গন্ধ টা।..
গা গুলিয়ে ওঠে মধুরিমা। বমি ভাব তুলে সোজা বাথরুমের দিকে ছোট মেয়েটা। বাথরুমের আয়নাটায় প্রতিবিম্ব দেখে কাঁপতে থাকে মধুরিমা। কারণ আয়নার ওপারে ও দেখে;ওর প্রতিবিম্ব ওকে দেখে একটা পৈশাচিক হাসি হাসছে। তার ঠোঁট চুইয়ে পড়ছে রক্ত। কিন্তু সেই প্রতিবিম্ব টি সেই রক্তের স্বাদ আনন্দের সহিত আস্বাদিত করছে।
ছুটে পালাতে গেল মধুরিমা আয়নার সামনে থেকে কিন্তু পারল না। কারন একটা শক্তি ওকে আটকে রেখেছে। এবার সেই প্রতিবিম্ব বলতে শুরু করে..
" কিরে সব কিছু ভুলে গেলি নাকি?? এত বছর ধরে এই বাড়িতে আমি তোর জন্য অপেক্ষা করছি। তোর মনে নেই বোঁচা নাক নিয়ে কত কথা শুনতে হয়!!...
আমাকে আমার বাবা শুধু বলতো আমি নাকি বংশের থেকে আলাদা হয়েছি। নাক বোচা দের নাকে নাকি গন্ধ যায় না!!
তোর কী কিছুই মনে নেই??".....

মধুরিমা ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। চিৎকার শুনে বাড়ির সকলে ছুটে যায়। তারা গিয়ে দেখে মধুরিমা বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপছে।.....


