STORYMIRROR

Baishakhi Biswas Debnath

Drama Classics Fantasy

3  

Baishakhi Biswas Debnath

Drama Classics Fantasy

শান্তনুর সমাপ্তি

শান্তনুর সমাপ্তি

6 mins
338

  • হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনু....


একদিন ছদ্মবেশী গঙ্গাদেবীর প্রেমে পড়ে তাকে বিবাহের প্রস্তাব দিলে গঙ্গাদেবী এই শর্ত দেন যে তার কোনো কাজে রাজার নিষেধ থাকবে না। সেই শর্তে রাজি হয়ে বিবাহের পর রাজা দেখেন যে এক একটি পুত্র জন্ম নিলে তার স্ত্রী তাদের গঙ্গা নদীতে ভাসিয়ে আসেন। পর পর সাত বার এই কষ্ট সহ্য করার পর অষ্টম বার আর থাকতে না পেরে প্রতিবাদ করলেন রাজা। তখন গঙ্গাদেবী নিজের পরিচয় দিয়ে শর্তানুযায়ী বিলীন হয়ে যান। পুত্র বড় হলে ফেরত দেবেন বলে প্রতিজ্ঞা করে সাথে পুত্রকেও নিয়ে যান।এর পিছনের ঘটনাক্রম অনুযায়ী একদিন অষ্টবসুরা আট জন মিলে বশিষ্ঠ মুনির আশ্রমে সস্ত্রীক আতিথেয়তা গ্রহণ করতে গেছিলেন। এঁদের স্ত্রীদের একজন মুনির গাভী নন্দিনী-র লোভে পড়লে তিনি তার স্বামী প্রভাসকে গাভীটি চুরি করার অনুরোধ করেন। প্রভাস বাকিদের সাহায্য নিয়ে গাভীটি চুরি করে স্ত্রীকে উপহার দিলেন। ক্রমে বশিষ্ঠ মুনি ঘটনাটা জানতে পেরে সবাইকে মর্ত্যে জন্মগ্রহণের অভিশাপ দিলেন। কিন্তু অস্টবসুদের মিনতিতে প্রভাস ছাড়া সকলকেই কয়েক মুহুর্তের জন্য মানব জন্ম গ্রহণ করতে হবে এবং প্রভাস মর্ত্যে বিখ্যাত হবে বলে কিছুটা শাস্তি লাঘব হল। সেই অনুযায়ী দেবব্রত একমাত্র বসু যিনি মর্ত্যে মানব জীবন যাপন করেছিলেন।



মায়ের সাথে থাকাকালীন ভীষ্ম দেবগুরু বৃহস্পতির কাছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, বশিষ্ঠ মুনির কাছে বেদ ও বেদাঙ্গ এবং পরশুরাম মুনির কাছে ধনুর্বিদ্যা শিখে একজন আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক হয়ে ওঠেন। এমনকি তিনি গুরু পরশুরামের বিরুদ্ধেও বিজেতা হন। সে যুদ্ধ ২৩ দিন ব্যাপী চলেছিল।


ভীষ্মের ভীষণ প্রতিজ্ঞাসম্পাদনা



ভীষণ প্রতিজ্ঞা গ্রহণ এবং তা সর্বাত্মকভাবে পালন করার জন্য রাজকুমার দেবব্রত ভীষ্ম নামে ভূষিত হন। রাজা শান্তনু ধীবর (জেলে) রাজকন্যা সত্যবতীর প্রেমে পড়ে তাকে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। ধীবর রাজ বলেন যে যেহেতু দেবব্রত শান্তনুর প্রথম পুত্র তাই সত্যবতীর ছেলের কোনদিন রাজা হওয়ার সুযোগ আসবে না। সুতরাং তিনি রাজা শান্তনুর এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। তখন রাজকুমার দেবব্রত প্রতিজ্ঞা করলেন যে তিনি কোনদিন রাজা হবেন না। দূরদর্শী ধীবর রাজ তার পর বলেন, যদি দেবব্রতর উত্তরসূরিরা রাজসিংহাসন দাবি করে তাহলেও এ বিয়ে সম্ভব নয়। তখন দেবব্রত আরো প্রতিজ্ঞা করলেন যে তিনি কোনদিন বিয়েই করবেন না। এই ভীষণ প্রতিজ্ঞার জন্য তার নাম হলো ভীষ্ম। ধীবর রাজ এই দুই শর্তে রাজি হয়ে রাজা শান্তনুর হাতে কন্যাদান করেন। রাজা শান্তনু খুশি হয়ে ভীষ্মকে স্বেচ্ছামৃত্যুর বর দিলেন। এই সময় ভীষ্মর এই প্রতিজ্ঞার আসল রহস্য নিয়ে স্বর্গ এবং মর্ত্যলোকে নানা রটনা রটতে লাগলো। অনেকে বলতে শুরু করলেন যে রাজসিংহাসনের আসল উত্তরাধিকারকে সরানোর ক্ষমতা রাজার থাকেনা বলে রাজা শান্তনু দেবব্রত কে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছেন। তখন ভীষ্ম নিজে সমস্ত ব্যাপার খুলে বলেন এবং একান্ত নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী প্রতিজ্ঞা করেছেন বলে জানালেন। কিন্তু আগামী রাজকুমার সিংহাসনের অযোগ্য হলে কি হবে বলে প্রশ্ন তোলেন কুলগুরু। তখন ভীষ্ম আবার প্রতিজ্ঞা করলেন যে, যেই রাজা হোক না কেন, তিনি সবসময় রাজার প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করবেন এবং রাজা শান্তনুর বংশের কোনো অপমান হতে দেবেন না।

স্বয়ম্ভর সভা থেকে তিন রাজকন্যা অম্বা, অম্বিকা এবং অম্বালিকা-কে অপহরণ করছেন ভীষ্ম



বৈমাত্রেয় ভাই বিচিত্রবীর্য-র বিয়ে দেওয়ার জন্য ভীষ্ম কাশী রাজার আয়োজিত স্বয়ম্ভর সভা থেকে তিন রাজকন্যা অম্বা, অম্বিকা এবং অম্বালিকা-কে জয় করে আনেন। এঁদের মধ্যে বড় মেয়ে অম্বা সৌবলের রাজা শল্ব-র প্রনয়ী ছিলেন। হস্তিনাপুরে পৌছে অম্বা ভীষ্মকে সে কথা জানালে ভীষ্ম অম্বাকে শল্বর কাছে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু শল্ব তখন বলেন যে, যেহেতু অম্বা অন্য একজন পুরুষের সাথে অনেকটা সময় কাটিয়েছেন, সুতরাং অম্বাকে বিয়ে করা তার পক্ষে অপমানজনক। আসলে শল্ব-ও স্বয়ম্ভর সভায় এসেছিলেন এবং ভীষ্মের কাছে খুব খারাপভাবে পরাজিত হয়ে খুব অপমানিত বোধ করেছিলেন। এমতাবস্থায় অম্বা ভীষ্মকে বলেন যে, যেহেতু তিনিই অম্বাকে স্বয়ম্ভর সভা থেকে জয় করে এনেছেন, সেহেতু ভীষ্মের উচিত অম্বাকে পত্নীরূপে গ্রহণ করা। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ভীষ্ম তার প্রতিজ্ঞার কথা মনে করিয়ে অম্বার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। নিদারুণ অপমানিত হয়ে নিরুপায়ী অম্বা তখন ভীষ্মের বিনাশের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে পাগলপ্রায় হয়ে যান। অনেক চেষ্টার পর অবশেষে অম্বা শিবের থেকে বর পান যে পরজন্মে তিনি ভীষ্মের মৃত্যুর কারণ হবেন। এই অম্বাই পরজন্মে শিখন্ডি হয়ে জন্মেছিলেন, যাকে দেখে ভীষ্ম কুরুক্ষেত্রে অস্ত্রত্যাগ করেছিলেন। কারণ, তিনি শিখন্ডিকে দেখে চিনতে পেরেছিলেন এবং কোনো মহিলার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ তার নীতিবিরুদ্ধ ছিল।


অম্বা যখন ভীষ্মের বিনাশের জন্য পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছিলেন, সেই সময় অম্বা ভীষ্মের গুরুদেব পরশুরাম মুনির কাছেও গিয়েছেলেন। পরশুরাম মুনি তার শিষ্য ভীষ্মকে অম্বাকে বিবাহের আদেশ দিলেন। ভীষ্ম প্রতিজ্ঞার প্রসঙ্গ তুলে গুরুদেবের আদেশ মানতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, প্রয়োজন হলে তিনি গুরুদেবের জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত আছেন, তবু প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে পারবেননা। যথারীতি গুরুদেব শিষ্যর বিরুদ্ধে কুরুক্ষেত্রের প্রাঙ্গনে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে ভীষ্ম রথ নিয়ে অবতীর্ণ হয়ে দেখলেন যে পরশুরাম কোনো বাহন নেননি। গুরুদেবকে এই অবস্থায় দেখে ভীষ্ম ভাবলেন তিনি বুঝি যুদ্ধে অনায্য সুবিধা ভোগ করতে চলেছেন। তাই তিনি গুরুদেবকে অস্ত্রভুষিত হয়ে রথ নিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করলেন। পরশুরাম তখন শিষ্যকে দিব্যদৃষ্টি দান করলেন এবং আবার তাকিয়ে দেখতে বললেন। তখন ভীষ্ম দেখলেন যে পৃথিবীটাই তার গুরুদেবের রথ, চার বেদ সেই রথের চার ঘোড়া, উপনিষদগুলি তার বল্গা, বাতাস তার সারথী, আর গায়াত্রী, সাবিত্রী, সরস্বতী এই বৈদিক দেবীরা তার বর্ম। ভীষ্ম রথ থেকে নেমে এসে গুরুপ্রণাম করে গুরুদেবের কাছে ধর্মকে জয়ী করতে পারার আশির্বাদ চাইলেন এবং যুদ্ধের জন্য অনুমতি চাইলেন। পরশুরাম খুব খুশি হয়ে বললেন যে, ভীষ্ম এটা না করলে তিনি অভিশাপ দিতেন, কারণ, মহারথী হিসাবে গুরুজনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাটা কর্তব্য বলে, তার সাথে সাথে গুরুজনের প্রতি সমস্ত মানসম্মান এবং মানবিকতার জলাঞ্জলি দেওয়া খুবই অন্যায়। পরশুরাম শিষ্যকে তার ব্রহ্মচর্য়ের ধর্ম পালনের আশীর্বাদ করলেন। সাথে সাথে নিজেও অম্বা কে দেওয়া শপথের ধর্ম পালনের জন্য যুদ্ধ করবেন বলে জানালেন। এই যুদ্ধ ২৩ দিন ব্যাপী চলেছিল যেখানে একাধারে পরশুরাম ছিলেন চিরঞ্জীবি (অমর), অন্যদিকে ভীষ্মের ছিল স্বেছামৃত্যুর বর। যাই হোক, এই যুদ্ধের অমীমাংসিত পরিণতি নিয়ে দুই রকমের মতবাদ পাওয়া যায়।

এক মত অনুযায়ী, ২২তম দিনে ভীষ্ম যুদ্ধে জিততে সাহায্য পাবার জন্য তার পুর্বপরুষদের প্রার্থনা শুরু করলেন। পূর্বপুরুষরা তাকে পাশুপতাস্ত্র নামে এক অস্ত্র প্রদান করলেন। এই অস্ত্র প্রয়োগে তিনি পরশুরামকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারতেন। আর, বেদ অনুযায়ী, যুদ্ধক্ষেত্রে ঘুমিয়ে গেলে তাকে মৃত বলে ধরে নেওয়ার বিধি ছিল। কিন্তু এই অস্ত্রের ব্যবহার ভীষ্ম পূর্বজন্মে জানতেন। এই জন্মে তা তিনি ভুলে গেছিলেন। অপর পক্ষে, দেবতারাও তাকে এই অস্ত্র প্রয়োগে মানা করছিলেন। কারণ, গুরুদেবের বিরুদ্ধে এই অস্ত্র হানা গুরুদেবের পক্ষে বড়ই অপমানজনক কাণ্ড। পশুপতাস্ত্র ক্ষেপণ না হাওয়ায় পরশুরাম তার শিষ্যের জন্য খুব গর্ব বোধ করলেন। কিন্তু তিনি বললেন, হয় তিনি মরবেন নাহলে ভীষ্মকে মরতে হবে এই যুদ্ধে। শেষমেষ ২৩তম দিনে ভীষ্ম যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে বললেন যে, তিনি কোনদিন-ই তার গুরুদেবের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের পক্ষে ছিলেননা। তিনি গুরুর আদেশ পালন করতে গিয়ে যুদ্ধে বাধ্য হয়ছিলেন মাত্র।

এদিকে অম্বা বিফলমনোরথ হয়ে শিবের প্রার্থনা শুরু করলেন। মহাদেব খুশি হয়ে তাকে বর দিলেন যে, পরের জন্মে অম্বা তার পূর্বজন্মের কথা মনে করতে পারবেন এবং সেই কারণে ভীষ্মের মৃত্যুর কারণ হবেন।





  • শ্রীখণ্ডির আবির্ভাব


পূর্বজন্মে শিখণ্ডী ছিলেন কাশীরাজার বড় মেয়ে অম্বা। হস্তিনাপুরের রাজা বিচিত্রবীর্য এর সাথে বিয়ে দেয়ার জন্য ভীষ্ম তাঁর দুই বোনসহ তাঁকে স্বয়ম্বর সভা থেকে জয় করে নিয়ে যান। কিন্তু তিনি সুবলের রাজ শাল্বকে ভালোবাসেন জেনে বিচিত্রবীর্য তাঁকে বিয়ে করেননি। শাল্বও পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে তাঁকে বিয়ে করতে রাজী না হওয়ায় তাঁর দুর্দশার জন্য তিনি ভীষ্মকে দায়ী করেন এবং ভীষ্মের মৃত্যু কামনায় সাধনা করে শিবের বর লাভ করে শিখণ্ডী নামে দ্রুপদ রাজার মেয়ে হিসেবে জন্ম গ্রহণ করেন।


কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধে শিখণ্ডী পুরুষ যোদ্ধা হিসেবে অংশগ্রহণ করে। ভীষ্মের সাথে যুদ্ধের সময় ভীষ্ম তাকে দ্রুপদের মেয়ে হিসেবে জানতে পেরে অস্ত্রপরিত্যাগ করে শরাক্রান্ত হয়ে শরশয্যায় শায়িত হয় এবং মৃত্যুবরণ করে। যুদ্ধের অষ্টাদশ দিনে অশ্বত্থামার সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শিখণ্ডী মৃত‌্যুবরণ করে।



কোন কোন স্থানে বলা হয়েছে, শিখণ্ডীকে শুধু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ১০ম দিন এই দেখা যায়, সে তার প্রতিজ্ঞা পূরণ তথা ভীষ্মদেবকে নিরস্ত্র করতে যুদ্ধে পদার্পণ করেন, সে যুদ্ধক্ষেত্রে যে প্রবেশ করবে একথা আগেই জানিয়া শকুনি শিখণ্ডীকে রুখতে মায়াস্ত্র যোজনা করেন এবং শিখণ্ডীকে তার রচিত সংক্ষিপ্ত বূহ্যে বন্দী করেন, যার মহারথী হিসেবে ছিলেন রাজকুমার দুঃশাসন, মহাবীর অশ্বত্থামা, আর গান্ধার রাজ শকুনি। শিখণ্ডীকে নিরস্ত্র করা সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। আর তার সামনে তারা টিকতেও পারছিলেন না। শেষ পর্যায়ে মিলিত আক্রমনে শিখণ্ডী মারাত্মক আহত হলেন এবং মূর্ছা গেলেন। তারা শিখণ্ডীকে মৃত ভেবে চলে গেলেন। কিন্তু শিখণ্ডীর দেহে তখনও প্রাণ অবশিষ্ট ছিল যা হয়ত মহাবীর ভীষ্মদেবকে নিরস্ত্র বা পরাজিত করার জন্যই, শেষ পর্যন্ত সে তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করলেন এবং ভীষ্মদেব শরশয্যায় শায়িত হলেন। অনেকে বলেন এর পরই শিখণ্ডী মৃত্যুবরণ করেন। কারণ ১০ম দিনের পর আর কখনো তাকে রণাঙ্গনে দেখা যায়নি।





Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama