শেষ প্রহরের ডাক
শেষ প্রহরের ডাক


(সত্তর দশকের প্রেক্ষাপট)
পাশের গাঁ হরিহরপুর।কদিন ধরেই একেবারে জমজমাট হয়ে আছে।
হওয়ারই কথা।
নির্দিষ্ট কোন ফিজ নেই।
যে যা পারছে উঠোনে পাতা কাপড়ের উপর রেখে যাচ্ছে।
চাল,ডাল,তরি,তরকারি।খুচরো,নোট কেউ আবার খুশি হয়ে পাশের বাক্সে এক গুচ্ছ টাকা না হলে গয়নাগাঠিও ঢুকিয়ে প্রণাম সেরে মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসছে।
বিঁধু মান্ডি।বয়স আঠাশ,তিরিশ হবে। বেশ আটোসাটো গায়ের গড়ন।
আগের স্বামীটা একমাস থেকে রাতের বেলায় পালিয়ে যায়।দ্বিতীয়বার সাঙা হয়।পাশের বাড়ির রবিনের সাথে।ট্রাক্টর চালায়।
বিঁধু নিজেও ইটভাটায় কাজে করে।
জীবনটা ফাগুনের হাওয়ার মতই এলোমেলো বইছিল।
....হঠাৎ একদিন বিঁধু রাতের বেলায় চোখদুটো গোল,গোল করে হাতে শুয়োর মারা বর্শাটা ধরে একটা পায়ে ঘুঙুর পরে কাঁচা উঠোনটাতে নাচতে শুরু করল।মাথার
চুলগুলো ফেপে উঠেছে।
জোৎস্না রাত।
রাজ্যের যত কুকুর এসে ভুকভুক করে ডাকতে লাগল।
পাড়াময় জেগে উঠল।কী হল দেখার জন্য।মাঝ রাতে সব কুকুর একসঙ্গে,এভাবে কোনদিন চিৎকার করেনা।
তাই সকলের বুকগুলো ঢিবঢিব বেঁজে উঠল।
একটু পরেই খবর এল।বিঁধুর মাথায় "বঙা" ঠাকুর চেপেছে।আদিবাসিদের সবথেকে জাগ্রত দেবতা।
সবাই ওকে মান্য করে চলে।সময়,সময় পুজো দিতে হয়।
যে কোন গাছের নিচে বাস করে।কখনো বা বাঁশ ঝাড়ের ভেতরেও থাকে।
গাছ কাটলে ক্ষতি নেই। মোটের উপর ওর পুজো যেন বন্ধ না হয়।
অন্যথা,হলেই বিপদ।
বিধুদের ছোটমত দুচালা খড়ের একটা ঘর আছে। তার সামনে অল্প পরিসর আঙ্গন।
সারা গ্রাম উজাড় হয়ে আঙ্গনে এসে ভিড় জমাল।
একটু পরেই ধূপ,ধুনো,মাদল সব আনা হল।গোটা কয়েক তাজা ফুলও ছড়ানো হল উঠোনে।
সবাই দেবতাকে তুষ্ট করার গান ধরল।
কয়েকজন মিলে জোরে,জোরে মাদল বাঁজাতে শুরু করল।
রাতের নিস্তব্ধতা খান,খান করে সেই আওয়াজ আশেপাশের সব গাঁয়ে ছড়িয়ে পড়ল।
...অভিজ্ঞ বুড়োরা বলে উঠলেন,কোন গাঁয়ে এত রাতে বঙা জাগল দেখ রে...!!
...সকাল যখন হল।বিঁধু তখন খোলা মাথা আস্তে, আস্তে ঘোরাচ্ছে।সারা গা টলছে।
সামনে একবাটি চুল্লু মদ নামানো আছে।
মাঝে,মাঝে চুমুক দিয়ে অপলক চোখে চারিপাশটা দেখছে।
একটু বাদে আকাশটার দিকে তাকিয়ে আদিবাসি ভাষায় বলে উঠল,...আজ বৃষ্টি হবে।ওই তাল গাছটাই বাজটা পড়বে।তোরা সাবধানে থাকিস।
একজন লোক গলায় গামছা জড়িয়ে বিঁধুর পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ল।
---ঠাকুর আমি কি আমার ছেলেকে খুঁজে পাব না?
বিঁধু এক ঢোক চুল্লু খেয়ে বলে উঠল,আলবাত পাবি।...ও দুদিন পরই ফিরে আসবে ।
অন্য একজন বলে উঠল,আমার সোনার একটা বালা পাচ্ছি না। আজ তিনদিন ধরে খুঁজছি।কোথাও পাইনি।একটু যদি বলে দাও।
---ওটা বিক্রি হয়ে গেছে। টাকা কটা তোর কুপের পাশে দোমড়ানো রাখা আছে। যা তাড়াতাড়ি গিয়ে উঠিয়ে নে।
কাজটা কে করেছে...এসব প্রশ্ন একদম করবি না।
সেদিন বিকেলে কালবৈশাখী এল।বাজ পড়ল।
অন্য জন টাকাটাও পেল।
দুদিন পর হারানো ছেলেটাও পাগল অবস্থায় ঘরে ফিরল।
...তারপর থেকে বিঁধুর ঘর একদিনও ফাঁকা নেয়।রাতদিন দূর,দূরান্ত থেকে মানুষের ঢল লেগেই চলল।
বেশির ভাগ আদিবাসি।
সুদূর ঝাড়খন্ড,আসানসোল,দূর্গাপুর থেকে মানুষ গাড়ি,ঘোড়া করে আসতে লাগল বিঁধুর কাছে।
দিন দশ এভাবে যাওয়ার পর,বিঁধু হটাৎ একদিন ঘরভর্তি লোকজনের সামনে চিত হয়ে পড়ে গেল।
সবাই দৌঁড়ে এল।জল ছিটানো হল।চোখে,মুখে।হাতপাখায় বাতাস করা হল।কেউ,কেউ
হাত,পায়ের তালুতে সরষের তেল মালিশ করে দিল।
...এভাবে মিনিট কুড়ি যাওয়ার পর বিঁধুর জ্ঞান ফিরল।চোখ,মুখ স্বাভাবিক।একদম আগের মতই।
চোখের তারায় সেই তীক্ষ্ণ ফলার মত নজরটাও একদম ভোতা হয়ে গেছে।
ঠিক,আর পাঁচজন সাঁওতাল রমনীর মতই।
কারু বুঝতে অসুবিধা হল না।
ঠাকুর নেমে গেছে।
তারমানে আর ভিড় করে কোন লাভ হবে না। এখন ও স্বাভাবিক।কারু কোন ভূত,ভবিষ্যত নিয়ে কথা বলার শক্তি নেই।
...সাধারণ মানুষের সে ক্ষমতা থাকে না বলেই তো জানার প্রবল আগ্রহ নিয়ে দৌঁড়ে আসে।
দেখতে,দেখতে ভিড়টা পাতলা হয়ে গেল। মাদল থেমে গেল।
সুগন্ধ দ্রব্যাদী ওঠিয়ে নেওয়া হল।
আঙনটা ফিরে পেল তার পুরনো শূণ্যতা।গোটা কয়েক পেঁপে আর কলাগাছ লাগানো ছিল।এখন সেগুলো হতশ্রী অবস্থায় পড়ে আছে।
সামনের বর্ষায় ফল আসত।
বিঁধু সেদিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ আনমোনা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
বেরুতেই যাচ্ছিল।
...ততক্ষণে ভেতর থেকে তার স্বামী গলায় একরাশ লালা মিশিয়ে ডাক দিল,..কোথায় যাচ্ছিস?এদিকে এসে দ্যাখ।...দেখে যা।আমরা যা জীবনভর সঞ্চয় করতে পারতাম না।আজ কদিনেই তার কয়েকগুণ পেয়ে গেছি।আজ থেকে আমরাও বড়লোক।
বিঁধু চোখের সামনে দুহাঁড়ি টাকা,পয়সা আর গয়নাগাঠি দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে উঠ,বলো কি! এসব কোত্থেকে এল গো?
---আরে বাবা...আজ দশদিন হল। তোর মাথায় দেবতা ভর করেছিল।কত জনের ভূত,ভবিষ্যতের কথা গড়গড় করে বলে দিচ্ছিলি!!কত লোক তাদের হারানো জিনিস খুঁজে পেয়েছে!!...রোগ,ব্যাধী সব তোর কৃপায় ভাল হয়ে গেছে!!... তাইতো তারা খুশি হয়ে এসব জিনিস দান করে গেছে।
বিঁধু আনমোনা হয়ে বলে উঠল,সত্যি কী আমি ওরকম হয়ে পড়েছিলাম?...কই আমার তো কিছু মনে পড়ছে না।
---ঠাকুর চাপলে মনে থাকে না।
বিঁধু উঠে পড়ল।তালগাছে কয়েকটা বাবুই পাখির বাসা ঝুলছে।হাওয়াই সেগুলো দোলনার মত দোল খাচ্ছে।সেদিকে একমনে তাঁকিয়ে বলে উঠল,জিজ্ঞেস করতে পারোনি, আমার কোলে কখন একটা সন্তান আসবে?
ওর স্বামী কোন উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না।
একটু বাদে বলে উঠল,ভেতরের ঘরে কুলুপ দিয়ে রেখে দিই।
আজ থেকে আমারা মোটেও গরীব না।
তাই কালথেকে আর কাজে বেরুব না। তুই আমার জন্য চুল্লু আর মাংস রাঁধবী।আমি খাটিয়ায় বসে খাব।আর তোকেও খাওয়াব।একদম বড়লোকদের মত করে।
...মাঝরাতে হরিহরপুর সাঁওতালপাড়ায় ডাকাত পড়ল।
ডাকাতের দল প্রথমেই দুটো বোম ফাটিয়ে সবাইকে সাবধান করে দিয়েছে।
সবাই যেন ঘরের ভেতরেই থাকে।কোনরকম রংবাজি করলে মাথার খুলি উড়িয়ে দেওয়া হবে।
তাই সকলে জড়োসড়ো হয়ে নিজেদের ঘরে হুড়কো তুলে নিশব্দে বসে আছে।
...বিঁধু এবং তার স্বামী দুজনেই জানে হাঁড়িদুটো কোথায় রাখা আছে।
কিন্তু কিছুতেই বলতে চায়ছে না।
...চোখের সামনে বড়লোক হওয়ার এতবড় স্বপ্নকে তার স্বামী সহজে ভেঙে ফেলতে চায় না।তাই বিঁধুকেও মানা করে রেখেছে।যাতে না বলে।
তাই বিঁধুর স্বামী বুকটায় হাওয়া ভরে,ডাকাতের সর্দারকে বলে উঠল,বলব না। ওগুলো আমরা চুরি করিনি।সবাই দান করেছে।ওগুলো আমাদের সম্পদ।তোদের সেসব কিছুতেই দেব না।
গুতো,গাতা দেওয়ার পরও কোন কাজ হচ্ছে না দেখে,সর্দার বলে উঠল,ছেড়ে দে ওকে।ওর ডাসা মাগীটাকে গিয়ে ধর।
হাঁড়ির ঠিকানা না বললে মাগীটাকেই সবাই মিলে ভোগ করব।
যেই বলা,সেই কাজ।
বিঁধু হাত দুটো জড়ো করে কাঁদতে,কাঁদতে বলে উঠল,দয়া কর।আমাকে তোরা ছেড়ে দে।...ও স্বামী গো তুমি ওদের সবকিছু দিয়ে দাও।।আমরা আগের মত গতর খাঁটিয়ে খাব।
ওর স্বামী জিদ ধরেই রইল।কিছুতেই বলবে না।
অষ্টমীর জোৎস্না হেসে উঠেছে।তাতে বিঁধুদের উঠোনটা ধবধব করছে।আগে পেঁপে আর কলা গাছের ছায়ায় ঢেকে থাকত।এখন ফাঁকা।ঠিক যেন মরা নদীর তীরে হাঁ মত শ্মশানটা!
রাতপাখিগুলো এডাল,সেডাল করে চেঁচিয়ে উঠল।তারাও এসময় একটা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছে।
একে,একে ডাকাতের লোক বিঁধুর শরীর থেকে সবকটা কাপড় খুলে ফেলল।
বিঁধু আকাশ,বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠল,বাঁচাও..বাঁচাও।
গ্রামসুদ্ধ লোক সিটিয়ে বসে আছে। বাচ্চাদের মুখ চেপে নিজেদের নিশ্বাস বায়ুকে পর্যন্ত বুকের প্রকোষ্টে বন্দি করে রাখল।
সকলের কানে বিঁধুর আর্ত চিৎকার ধাক্কা খেলেও কেউ এক পা নড়ল না।
....আজ দশদিন ধরে গাঁয়ের এমন কী দূর,দূরান্ত থেকে আগত শত,শত মানুষ তার কাছে সাহায্যের আশায় বসে ছিল।বিঁধু তাদের কাউকে খালি হাতে ফেরায় নি।তাকে সবাই দেবী জ্ঞানে করজোড়ে মাথা ঝুঁকিয়ে শ্রদ্ধায় প্রণাম পর্যন্ত করে গেছে।
....অথচ আজ যখন সে বিপদে।গলার শিরা ফাটিয়ে সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে।কেউ আসছে না।
কারণ আজ তার কাছে দৈবশক্তি ভর করে নেয়।
মানুষের তৈরি একোন অনাচার সৃষ্টি!!
বিধাতা তার নন্দন কাননে,এমন করুণ দৃশ্য দেখে হয়তো চোখ বন্ধ করে ফেলেছেন।
সর্বপ্রথম দলের সর্দার বিঁধুর উলঙ্গ দেহে বর্বর পৌরুষের লাঙল চালাল।
যন্ত্রণাই বিধুর আত্মা পর্যন্ত ককিয়ে উঠল।
দূর থেকে কুকুরগুলো প্রতিবাদ করে উঠল।তবু কোন মানুষ সাড়া দিল না।
...পর পর তিনজনের অবাধ্য শরীরের অনাচারে বিঁধুর প্রতিজ্ঞার বাঁধ হুড় হুড় করে ভেঙে গেল।
পারল না। স্বামীকে দেওয়া কথা রাখতে।
বলে ফেলল,হাঁড়িদুটোর গোপন ঠিকানা।
ভেতর ঘরের মাটি খুঁড়ে বের করা হল।
সর্দার হাত নেড়ে পরীক্ষা করে বলে উঠল,আগে বলে দিলে তো কেমন তোর পাছায় রক্ত ঝরত না।
বোম ফাটিয়ে পাড়া মাত করে ঘোড়ার পিঠে চেপে ডাকাতের দল নিমেষে উধাও হয়ে গেল।
এদিকে নিস্তব্ধ আঙ্গনে যন্ত্রণায় ছটপট করতে লাগল বিঁধুর উলঙ্গ শরীরটা ।
... তার স্বামী আশাহত বুকে দুচোখে আক্রোশ ঢেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল।
বিঁধুর নারী মন চায়ছিল, তার স্বামীর শক্ত হাতখানা ধরে উঠতে।
সে আশাও তার ভেঙে খান খান হয়ে গেল।ওই মাটির হাঁড়িদুটোর মত।
তাদের বঙা দেবতার থানটা একটু দূরেই।এখান থেকে চাইলেই দেখতে পাওয়া যায়।একটা ঘন ঝোপের পাশে।
এখন সেখানে এক চাপ গাঢ় অন্ধকার আষাঢ়ী গোবরের মত চুপটি হয়ে বসে আছে।
তিনিও বোধ হয় অনেকগুলো জাগা রাতের সুখনিদ্রায় মগ্ন হয়ে পড়েছেন।না হলে এরকম অনাচার সহ্য করেন কিভাবে?
একটা পেঁচা শেষ প্রহরের ডাক দিয়ে ঘন বাঁশঝাড়ের ভিতর গোপন আস্তানায় ঢুকে পড়ল।