শেষ ফুলস্টপ!
শেষ ফুলস্টপ!
যতবার ফ্লাইটে উঠেছি, বুকের এক কোণে কেমন একটা টান লেগে থেকেছে। একটা অজানা আশঙ্কা—যেন আকাশের ওই অপার নীলচে শান্তির আড়ালে লুকিয়ে আছে মৃত্যু।
এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
আজ সকালের খবরটা প্রথমে বিশ্বাসই হচ্ছিল না।
আকাশরাজ ফ্লাইট ৭১৭, যা রাজবন্দরের সারদা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল, সেটি টেক-অফের কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ভেঙে পড়ে।
হ্যাঁ, একেবারে শহরের পাশের মেঘনানগর—আবাসিক এলাকা।
মানুষের ঘুম ভাঙার আগেই, ২৪২ জন মানুষ চিরঘুমে চলে গেলেন।
শেষ সংকেতটা এসেছিল ৬২৫ ফুট উচ্চতা থেকে।
তারপর—ধপ করে নিঃশব্দতা।
না কোনো সাড়া, না কোনো ফিরে আসা।
ফ্লাইটে ছিল যাত্রী, ক্রু—আর তাদের স্বপ্ন।
ফোনে তোলা হাসিমাখা সেলফি, অসমাপ্ত চিঠি...
আর এখন?
শুধুই লেলিহান আগুন, কালো ধোঁয়া, অসংখ্য জ্বলন্ত প্রশ্ন।
---
[ছনবনের চায়ের দোকানে]
বিকেলে গেলাম ছনবনের প্রবীর দার দোকানে।
অরিজিৎ এসে বসলো পাশের চেয়ারে।
— “শুনেছিস? বলছে ফুয়েল লিক ছিল।”
আমি কিছু বললাম না।
প্রবীর দা চাপা গলায় বললেন—
— “তবে কি জানিস? শুনেছি ওই ফ্লাইটে নাকি এক মন্ত্রীমশাইয়ের দূরসম্পর্কের ভাই ছিলেন... সাবোটাজও হতে পারে...”
সবাই চুপ।
কেউ কেউ চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে।
আকাশে হঠাৎ একটা ঘুড়ি চোখে পড়লো—
ছেঁড়া সুতোয় জড়িয়ে পাক খেতে খেতে নামছে।
আড্ডার গন্ধ বদলে যায়।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বিকাশ বলল—
— “দেখ, এরা আবার তদন্ত করবে। মিডিয়া গরম করবে কয়েকদিন।
তারপর?
তারপর আবার আমরা সিনেমার পোস্টার দেখবো, ভোটের প্রচার শুনবো,
আর কেউ ওই ঘুড়িটার কথা মনে রাখবে না...”
আমি চুপ করে থাকি।
কারণ আমি জানি—
জল্পনা সত্য-মিথ্যার বেড়াজাল পেরিয়ে আসল সত্যিকে ফিরিয়ে আনতে পারে না।
---
[ব্যক্তিগত শোক ও দর্শন]
ফিরে আসবে না সেই মেয়েটা,
মায়ের হাতে বানানো পুরি খেয়ে ব্যাগ গোছাচ্ছিল যে।
ফিরে আসবে না সেই ডাক্তার ছেলেটা,
যে মেডিকেল হোস্টেলে দাঁত ব্রাশ করছিল, আর যার মাথার উপরেই আকাশ ফেটে পড়ল।
আমি শুধু ভাবি—
আমার মা যদি থাকতেন ওই ফ্লাইটে?
আমার ভালোবাসার মানুষটি যদি ওড়ার কথা ভাবতেন কোনো কাজের প্রয়োজনে?
আমি কেঁপে উঠি।
---
[ঘুড়ির গল্প ও রূপক]
কিছুদিন আগে এক শর্ট ফিল্ম দেখেছিলাম—
একটা ছোট্ট কাগজের ঘুড়ি, শিশুর হাতে তৈরি।
রঙিন কাগজে লেখা—
“ফিরে আসবো”।
ঘুড়িটা উড়ছিল হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে, উড়ছিল অনেক ওপরে।
কিন্তু হঠাৎ এক ধাক্কায়, এক বিদ্যুৎ রেখায় ছিঁড়ে গেল সুতো।
ঘুড়িটা পড়তে লাগলো—
ধীরে ধীরে, পাক খেতে খেতে।
সে জানতো, মাটিতে পড়া অবধারিত।
তবুও পড়ে যেতে যেতে, শেষবারের মতো দেখে নিল সূর্যটাকে,
মেঘের ফাঁক দিয়ে জেগে থাকা নীলটাকে,
নিচের ছোট ছোট বাড়িগুলোকে।
আমরাও যেন সেই ঘুড়ি—
কখন ছিঁড়ে যাবে নিয়তির দড়ি, কেউ জানে না।
শুধু জানি—
পড়ে যাওয়া নিশ্চিত।
আর পড়ে যাওয়ার আগে, একবার শেষবারের মতো বাঁচতে চাই।
---
[শেষ কথাটি]
এই খবরটা শুধুই খবর নয়।
এটা একটা শেষ ফুলস্টপ।
জীবনের, সম্পর্কের, স্বপ্নের।
জানি না কে দায়ী, কী সত্যি।
শুধু জানি—
আমাদের কারও শেষ ফুলস্টপ কোথায়, তা কেউ জানে না।
