বাবার শিক্ষা: এক জীবন্ত নীরব পাঠশালা
বাবার শিক্ষা: এক জীবন্ত নীরব পাঠশালা
ভূমিকা
এই লেখাটি আমার জীবনের প্রথম শিক্ষক—আমার বাবাকে নিয়ে।
তিনি ছিলেন না শুধু একজন মানুষ—তিনি ছিলেন এক জীবন্ত নীরব পাঠশালা। তাঁর শিক্ষা আজও আমার প্রতিটি সিদ্ধান্তের পেছনের আলো হয়ে জ্বলজ্বলে।
---
প্রথম পাঠ
বাবা আমাকে কখনও পরীক্ষায় প্রথম হতে বলেননি।
তিনি শুধু জানতে চাইতেন—"আজ স্কুলে নতুন কিছু শিখেছি কিনা?"
---
শৈশবের সূচনা
শৈশবের সূচনা হয়েছিল জামজুরি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের টিনের ছাউনির নিচে।
সেখানে জীবনকে প্রথম দেখেছিলাম অক্ষরজ্ঞানের আলোয়—"ক" থেকে "ক্ষ" পর্যন্ত হাত ধরে চলা সেই পথচলায় বাবা-মা ছিলেন নিঃশব্দ সঙ্গী।
বাবা ছিলেন মাতাবাড়ি আর.ডি. ব্লকের একজন সরকারি কর্মচারী, আর মা—একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা।
---
নতুন শহর, নতুন পথ
জামজুরি থেকে ছনবনে স্থানান্তর—নতুন শহর, অচেনা রাস্তা, রমেশ স্কুলের অপরিচিত মুখগুলো।
দাদা ভর্তি হলেন কিরিট বিক্রম ইনস্টিটিউশনে।
বাবা তখনও বলতেন—
"ভেতরটাকে শক্ত রাখো, বাইরে থেকে নমনীয় হও।"
---
তৃতীয় স্থান এবং জীবনের শিক্ষা
ক্লাস টু-এর বার্ষিক পরীক্ষায় তৃতীয় হওয়ার দিনটি আজও চোখে ভাসে।
মা ঢোলকলমি গাছের ডাল দিয়ে শাসন করেছিলেন (সেই কঠোর ডালের স্পর্শ এখনও পিঠে জ্বলে)।
সন্ধ্যায় বাবা বাড়ি ফিরে আমাকে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে দেখে কোলে টেনে নিয়েছিলেন।
তাঁর গলার স্বর এখনও কানে বাজে—
“তুমি কাঁদছ কেন? আমি কি কখনও বলেছি তোমাকে ফার্স্ট হতে হবে?”
“ফার্স্ট হওয়া সফলতার মানদণ্ড নয়, কিন্তু মনে রেখো—শেখা থেমে গেলেই তুমি হেরে যাবে। মানুষের সফলতা নির্ভর করে দৃষ্টিভঙ্গির ওপর, শুধু মেধার ওপর নয়।”
সেই একটিমাত্র বাক্য আমাকে গড়ে তুলেছিল।
---
অপেক্ষার শিক্ষা
আমাদের পরিবার বিলাসী ছিল না, তবু বাবা প্রতিটি চাওয়ার মর্ম বুঝতেন।
কোনো কিছু চাইলে তিনি বলতেন—
"চাওয়া আর পাওয়ার মাঝে যে অপেক্ষা, সে-ই তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষক।"
আর সেই অপেক্ষাই জন্ম দিয়েছিল তীব্র ইচ্ছা, অনুশাসন আর কৃতজ্ঞতার।
---
মৌলিক শিক্ষা
আমার বাবার শিক্ষা ছিল মৌলিক—তিনি আমাদের শেখাতে চেয়েছিলেন কীভাবে মানুষ হতে হয়।
তিনি কখনও কঠোরভাবে নিষেধ করেননি খারাপ সঙ্গ ত্যাগ করতে, বরং বলতেন—
"ভালো-মন্দ দুইটাই দেখো, অনুভব করো, কিন্তু নিজে কি করবে, সেটা তুমিই ঠিক করো।"
---
জীবনের প্রকৃত অর্থ
এই শিক্ষাই আমাকে গড়ে তুলেছে।
কলেজ জীবনে যখন সহপাঠীরা বাইকের শব্দে মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণের খেলায় ব্যস্ত, আমি তখন বাবার কথাগুলো মনে করে নির্লিপ্ত থেকেছি।
আমার ঈর্ষা জন্মায়নি, কারণ আমি জানতাম—জীবন মানে কেবল বাহ্যিক আরাম-আয়েশ নয়।
আমার জীবন কখনও বাইরের জাঁকজমকে আটকায়নি।
জীবন মানে—
শীতের রাতে গাছের পাতাহীন ডালে একা বসে থাকা পাখির নীরবতা,
পৌষের সকালে শিশিরভেজা ঘাসে খালি পায়ে হেঁটে যাওয়া,
বনের বুক চিরে বয়ে যাওয়া নদীর মতো নিজস্ব গতিতে চলা,
রাতের আকাশে হারিয়ে যাওয়া একলা তারার আলো,
সরষে ক্ষেতের হলুদে ডুবে থাকা একাকী সন্ধ্যা,
নিঃসঙ্গ সকালে চায়ের কাপে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখা,
নদীর কুয়াশায় মিলিয়ে যাওয়া কোনো অদৃশ্য গল্প।
---
জীবনের কঠিন পরীক্ষা
কিন্তু সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল নবম শ্রেণিতে।
মা ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হলেন। তাঁকে ভেলোর সিএমসি হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়ে ফিরিয়ে আনলেন বাবা।
আর ঠিক তার পরেই—১৯৯৯ সালের সেই মে মাস...
সেই অস্থিরতা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই, অফিসের এক সন্ধ্যায় বাবা আর ফিরে এলেন না।
রাত গড়ায়, দরজার সামনে কেউ নেই। ফোনে কেউ কিছু জানে না।
মা বিছানায় অসুস্থ, আর বাবা—কোথায়? কার মুখের দিকে তাকাব? কাকে বলব এই ভয়?
বাইরে ঝোড়ো হাওয়া, চারদিক নিস্তব্ধ। সেই রাতে আকাশে ছিল না একটাও তারা।
যেন রাতও জানত—এই ঘর আজ নিঃসঙ্গ।
অফিসের ষড়যন্ত্রের কথা শুনলাম, অপহরণের কথা কানে এলো।
প্রতিটি মুহূর্ত যেন রাতের অন্ধকারে সময় থমকে দাঁড়াল।
প্রতিবেশীরা ফিসফিস করে কথা বলে, কেউ সাহস করে কিছু জিজ্ঞেস করতে চায় না।
মা চোখ বুজে শুয়ে থাকেন, আর আমার হাত ধরে থাকেন—আমরা দুজনেই অপেক্ষা করছি,
কখন ফিরবেন বাবা? কখন আবার শুনব দরজায় তাঁর পায়ের শব্দ?
দুটি বিপর্যয় একে একে আমাদের পরিবারকে তছনছ করে দিল।
বাড়ির ভিতরটা নীরব, শুধু শোনা যায় ঘড়ির টিকটিক শব্দ আর মায়ের অর্ধেক কণ্ঠে বাবার নাম।
প্রতিদিনের রুটিন যেন থমকে গেছে—কেউ স্কুলে যাচ্ছে না, কেউ অফিসে যাচ্ছে না।
শুধু অপেক্ষা... অনিশ্চয়তা... আর একরাশ ভয়।
আজও মনে পড়ে ছোটবেলার সেই গান—
"বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই..."
শুধু একটাই আকুতি:
"চাঁদের আলো হয়ে পাশে থেকো, বাবা।"
---
অমর শিক্ষা
তবু আমি বিশ্বাস করি—আজ আমি এবং আমার দাদা, মা ও পরিবারকে নিয়ে যেভাবে বেঁচে আছি,
যেভাবে একে অপরের পাশে দাঁড়াই, সত্য এবং মানবতাকে ধারণ করি—
সেই সমস্ত কিছু দেখে বাবার আত্মা নিশ্চয়ই শান্তি পায়।
তিনি তো শুধু বই বাঁধিয়ে দিতেন না—
'তিনি আমাদের জীবন বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন—ভালোবাসা, সহানুভূতি আর দৃষ্টিভঙ্গির সুতোয়।'
---
উপসংহার
আজ আমি জানি—জীবন মানে ফার্স্ট হওয়া নয়।
জীবন মানে বাবার সেই কথাগুলোকে প্রতিদিন নতুন করে শেখা—
“শেখা কখনও থামিও না—থামলেই হার।”
“জীবন মানে পদে পদে জয় নয়, জীবন মানে—মানুষ হওয়ার নিরব সাধনা।”
“শিক্ষা শুধু বইয়ে থাকে না, বাবার চোখের চাহনিতে ছিল তার অক্ষর—
এক জীবনের পাঠ,
বাবার নীরবতায় আমি তা পড়ে গেছি দিনরাত।”
---
বাবা, তোমার শিক্ষা আজও আমার পথচলার আলো।
তোমার অনুপস্থিতিতে তোমার কথাগুলোই আমার সঙ্গী।
প্রতিটি সিদ্ধান্তে, প্রতিটি মুহূর্তে তোমার স্মৃতি আমাকে শক্তি দেয়।
জীবন মানে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার সাধনা।
“আর সেই সাধনায় তুমি আজও আমার পাশে আছো—নীরব, নিভৃতে, অমলিন...
… এবং ঠিক সেইজন্যই—
‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম।’"
