Ananya Podder

Classics Inspirational

4  

Ananya Podder

Classics Inspirational

সেই ভদ্রলোক

সেই ভদ্রলোক

6 mins
304


সূর্য্যানী দুদিন হোলো অফিসের কাজে দীঘা এসেছে | রাজ্য সরকারের ইঞ্জিনিয়ার সে | দীঘার সৌন্দর্যায়নে সেও একজন আর্কিটেক্ট | সারাদিন কাজের পরে সূর্য্যানী দীঘার হোটেলে হোটেলে ঘুরে বেড়ায় শুধু সেই ভদ্রলোকের খোঁজে | যদি তাঁর দেখা পায় সে | কিন্তু তিনি কোথায়?? এই নিয়ে বার পাঁচেক দীঘায় এলো সে | প্রতিবারই খুঁজে পাবার চেষ্টা করলো সেই ভদ্রলোককে, কিন্তু তাঁর দেখা পাওয়া গেল না |সূর্য্যানীর মনে পড়ে যায় দশ বছর আগের কথা | সদ্য আঠেরো ছোঁয়া এক যুবতী বাবা মায়ের চোখে ধুলো দিয়ে কিছু বন্ধুর সাথে এক দিনের জন্য এসেছে দীঘায় বেড়াতে | এক রাত কাটিয়ে আবার কলকাতায় ফিরে যাবে | বাবা মাকে বলেছে, "অনিন্দিতার জন্মদিনের উপলক্ষে এক টা রাত ওদের বাড়িতে কাটাবে | " মা ভীষণ রকমের শাসন করে সূর্য্যানীকে | সত্যি কথা বললে কোনোদিনই হয়তো ছাড়বে না সূর্য্যানীকে | তাই চারটি ছেলে আর তিনটি মেয়ের একটি দল আসে দীঘায় বাবা মায়েদের অগোচরে |দীঘার হোটেলে ঢোকার সময়ে চেক ইন করার কালে রাহুলের হাতটা সূর্য্যানীর কাঁধে ছিল | সদ্য সদ্য প্রেম | কলেজের বন্ধুত্বের সীমা ছাড়িয়ে নতুন প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছে সবে | এই সময় রাহুলের এই রকম হালকা স্পর্শ খারাপ লাগে না সূর্য্যানীর | তাই রাহুলকে বিশেষ বাধাও দেয় না |কিন্তু মাঝ বয়স্ক হোটেল ম্যানেজারটি কেমন যেন রেগে উঠলেন | হোটেলের ট্যারিফ বলবেন কী, ধমক দিয়ে উঠলেন রাহুলকে | "বলি, মেয়েটি কী তোমার বিয়ে করা স্ত্রী?? .... তাহলে একটু সৌজন্যবোধ তো দেখাতে হয়?? .... লোকে নিজের স্ত্রীয়ের সাথেও তো এরকম অপমান মূলক আচরণ করে না !!!!"অতি আধুনিক রাহুল ভদ্রলোকের কথা শুনে বলে ওঠে, "আপনি আপনার কাজ করুন তো মশাই | জানেন, ও আমার কে হয়?? .... উই আর লাভ বার্ডস | ""লাভ বার্ডস তো মনের ভালোবাসা দাও না, এরকম ভাবে মেয়েটির সাথে দৃষ্টি কটু আচরণ করছো কেন?? "এই রকম দু এক প্রকার কথা কাটাকাটি তে হোটেলের রিসেপশন বেশ গরম হয়ে ওঠে | সূর্য্যানীদের দলের বাকি সদস্যরা ব্যাপারটাকে মিটমাট করে |তিনটে রুম নেওয়া হয়েছে, যার একটি বরাদ্দ হয়েছে তিনটি মেয়ের জন্য, আর দুটি বরাদ্দ হয়েছে চারটি ছেলের জন্য | সূর্য্যানী সারাদিনে যতবার রিসেপশনের পাশ দিয়ে যাতায়াত করেছে, ততবার ভদ্রলোক কেমন একটা অদ্ভূত দৃষ্টি দিয়ে সূর্য্যানীকে লক্ষ্য করে গেছেন | সূর্য্যানীর কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিলো | কিন্তু কাউকে কিছুই বলেনি পাছে রাহুলের কানে কথাটা ওঠে আর রাহুল ঝামেলা শুরু করে | ভদ্রলোক তিন তলার করিডোরেও ঘুরে গেছেন বেশ কয়েকবার | একজন বাবার বয়সী লোক কিভাবে যে একটি সদ্য কৈশোর পেরোনো মেয়ের প্রতি এত দৃষ্টি নিবন্ধ রাখতে পারে, সেটা ভেবেই বিরক্ত হয়ে উঠছে সূর্য্যানী |সেদিন সন্ধ্যের সময় সমুদ্রের তীরে সময় কাটিয়ে হোটেলে ফেরার সময় রাহুলরা কিছু হুইস্কি আর ভদকার বোতল কিনে নিয়ে আসে | রাত আটটার সময় হোটেলের রেস্তোরাঁতেই রাতের খাবার অর্ডার করে শুরু হয় জলসা | তবে এই জলসায় সূর্য্যানী উপস্থিত থাকলেও মদ মুখে তোলেনি, বলা যায় যে, ওকে কেউ মদ খাওয়াতে পারেনি |রাতে একই ঘরে খাবার খাওয়ার পরে মদের নেশায় বন্ধুরা যখন ঘোরের মধ্যে, তখন সূর্য্যানী সবাইকে শুভ রাত্রি জানিয়ে নিজের ঘরে ফিরে আসে | অনিন্দিতা আর রিচা আরও কিছু সময় পরে আসবে বলে জানায় |ঘরে ফিরে সূর্য্যানী গল্পের বই পড়ছিলো | এমন সময় দরজায় আঘাত পড়ে | সূর্য্যানী একটু ভয় পেয়ে যায়, ভাবে, যে, সেই ভদ্রলোক নয় তো !! ... আরও দুবার ডোর বেল বাজার পরে আই হোলের দিকে চোখ রেখে সূর্য্যানী দেখে, দরজার ওপারে রাহুল দাঁড়িয়ে | রাহুলকে দেখে একটু স্বস্তি বোধ হয় তার | দরজা খুলে জিজ্ঞেস করে, "তুই এখানে কেন?? "রাহুল উত্তর দেয়, "বাকি সবাই ছাদে গেল, ছাদ থেকে সমুদ্রের ঢেউ দেখবে বলে |.... আর আমি চলে এলাম আমার সমুদ্রের কাছে | ভিতরে আসতে দিবি তো, নাকি দরজার বাইরে দাঁড় করিয়েই গল্প করে যাবি | ""না, না, তা কেন?? ভিতরে আয় | "রাহুল ঘরে ঢোকে | বিছানায় দুজনে পাশাপাশি বসে গল্প করতে থাকে | কিছু মিষ্টি মধুর কথাবার্তার পরে অকস্মাৎ রাহুল সূর্য্যানীকে আদর করতে চায় | সূর্য্যানী বাধা দিয়ে বলে, " রাহুল, তুই তোর ঘরে যা | ""কেন সূর্য্যানী, তুই কী আমায় ভালো বাসিস না?? .... ভালোবাসায় এসব তো স্বাভাবিক ব্যাপার | ""ভালো বাসি, খুব ভালো বাসি তোকে | কিন্তু এসবের সময় নয় এখন |... তোর প্রচুর নেশা হয়েছে | ঘরে গিয়ে ঘুম লাগা একটা | "" দীঘায় এসেছি কী ঘুমোব বলে?? ... এরকম সুযোগ পাওয়ার জন্যই তো তোর সাথে দীঘায় আসা !! ... আয়, আজ আমরা প্রেমের জোয়ারে ভেসে যাই | ""না, এটা ভুল | এটা অন্যায় | এসব ঠিক নয় | তুই ঘরে যা রাহুল | আমার ভালো লাগছে না | ""তুই কী আমায় হুকুম করছিস সূর্য্যানী?? ""ধরে নে তাই | তুই এখান থেকে যা | "... কথাটা বলে সূর্য্যানী দরজা খোলার জন্য বিছানা থেকে উঠতে যায় |এমন সময় হিংস্র হায়নার মতো রাহুল ঝাঁপিয়ে পড়ে সূর্য্যানীর উপরে | সূর্য্যানী বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে, পারে না | রাহুল আক্রমণের সাথে সূর্য্যানীর জামা ছিঁড়ে দেয় | সূর্য্যানী চিৎকার করতে থাকে | কিন্তু রাহুলের দয়া হয় না | এমন সময় দরজায় জোরে জোরে ঘা পড়ে | কিন্তু রাহুল তখনও হিংস্র পশুর মতো সূর্য্যানীকে চেপে ধরে রেখেছে | আরও কয়েকটা ঘা পড়ার পরে দরজাটা হঠাৎ করে খুলে যায় | সূর্য্যানী দেখে, সেই ভদ্রলোক | ঘরে ঢুকে সোজা রাহুলের গালে এক চড় বসান | রাহুলের যেন নেশার ঘোর কাটে !!.... সূর্য্যানী উঠে গিয়ে ছেঁড়া জামার উপরে একটা জ্যাকেট পরে |ভদ্রলোক হুঙ্কার দিয়ে বলে ওঠেন, "বেরিয়ে যাও এক্ষুনি এই ঘর থেকে | "রাহুল কিছু একটা বলার চেষ্টা করতে যাচ্ছিলো | ভদ্রলোক বলে উঠলেন, " আর একটা কথা বললে সোজা থানায় ফোন করবো | "বেগতিক দেখে রাহুল চলে যায় | এরই মধ্যে সূর্য্যানীর বাকি বন্ধুরা ছাদ থেকে নেমে আসে | অনিন্দিতারা ব্যাপারটা কিছুটা আন্দাজ করে | ক্রোধিত ভদ্রলোক ওদের সবার দিকে তাকিয়ে বলেন, " আঠেরো পেরিয়ে গিয়েছো বলে কী সবাই খুব বড়ো হয়ে গেছো !! ... আজ যদি এই মেয়েটার সর্বনাশ হয়ে যেত, তাহলে কে দায়িত্ব নিত এই ঘটনার?? ... আমার প্রথম থেকেই ছেলেটি কে সুবিধার মনে হয়নি | তাই আজ সারাদিন সি সি টিভি ক্যামেরায় নজর রেখেছিলাম | ভাগ্যিস, আমার ডাবল ডিউটি আজ | এভাবে সর্বনাশ ডেকে আনতে একবারও ভয় করে না তোমাদের?? "সবাই চুপ, কারোর মুখে কোনো কথা নেই | সূর্য্যানীদের প্রত্যেকের গালে কথার চড় মেরে উনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন |পরের দিন সকালে হোটেল ছাড়ার সময় ভদ্রলোকের খোঁজ করেছিল সূর্য্যানী | কিন্তু ভদ্রলোক তখন ছিলেন না হোটেলে | হোটেলের অন্য একজন এমপ্লয়ীর কাছে জানতে পেরেছিলো সূর্য্যানী যে, ভদ্রলোকের একটি মেয়ে ছিল, যে হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যায় | থানায় ডায়েরি করার পরে পুলিশের তল্লাশি চলে | দিন পাঁচেক পরে কোলাঘাটের কাছাকাছি একটি জায়গায় একটি স্যুটকেসের মধ্যে পাওয়া যায় উনার মেয়ের মৃতদেহ | কিন্তু খুনীর খোঁজ মেলেনি|সেদিন সূর্য্যানী বন্ধুদের সাথে আর কলকাতায় ফিরে আসেনি | ফিরে এসেছিল একা ট্রেনে চেপে | বাড়ি ফিরে এসে বাবা মাকে জানিয়েছিল তার অপরাধের সব কথা | সব শুনে সেদিন মা শাসন করার বদলে বুকে টেনে নিয়েছিল মেয়েকে |তারপর থেকে শুরু হয় নতুন অধ্যায় | কলেজ যাওয়া বন্ধ করে জয়েন্ট এন্ট্রান্সের জন্য, আই আই টির জন্য তৈরী হতে শুরু করে | রাত দিন এক করে পড়া শুনা চালিয়ে যেতে থাকে সে | পরিণামে সে খড়গপুর আই আই টি তে বি. টেক এ ভর্তি হয় | তারপর আর জীবন থেমে থাকেনি | একের পর এক মাইলস্টোন পেরিয়ে আজ সে একজন প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ার |জীবনের এই অধ্যায়টা যার জন্য দেখতে পাওয়া, তাকে একবার সামনে থেকে ধন্যবাদ জানানোর খুব ইচ্ছে আছে সূর্য্যানীর | ভগবানের বেশে তিঁনি সেদিন না এসে দাঁড়ালে আজ সূর্য্যানীর নামের আগে একটি বিশেষণ বসতো যার নাম 'ধর্ষিতা ' | তাই তাকে এভাবে খুঁজে বেড়ানোর চেষ্টা | কিন্তু তাঁর দেখা যে আজও পাওয়া গেল না | ভগবান স্বরূপ ছিলেন বলেই কী তিঁনি আজও ধরা দিলেন না সূর্য্যানীকে |তবুও সূর্য্যানী খুঁজে বেড়ায় সেই ভদ্রলোককে যিনি সূর্য্যানীকে অস্তমিত হতে দেননি সময়ের আগে | সমুদ্রের বালু তটে দাঁড়িয়ে সূর্য্যানী আজও মনের মধ্যে সেই ভদ্রলোককে একটা প্রণাম জানায় | এ প্রণাম মনের গভীরের সমর্পন, যে, বার বার নতি স্বীকার করে বলে, " আমার সর্ব ভুলের পরিত্রাতা, আমায় একটি বার সুযোগ দাও তোমার সামনে নতজানু হতে | "



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics